বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১৩

পয়েন্ট অব নো রিটার্ন


নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর পরই বিরোধী শিবির থেকে তীব্র প্রতিবাদের ধ্বনি উচ্চারিত হয়েছে। প্রতিবাদ কেবল মুখেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; পথে-প্রান্তরে ছড়িয়ে গিয়েছে। আন্দোলনের অংশ হিসেবে হরতালের অনেকগুলো কর্মসূচির পর বিগত সপ্তাহে অবরোধ কর্মসূচি পালিত হলো দেশব্যাপী। আজ শুক্রবার সে কর্মসূচি আপাতত শেষ হলেও দেশের বিভিন্ন স্থানে হত্যা-নির্যাতনের প্রতিবাদে উত্তাল মানুষ। রাজধানী ঢাকা দৃশ্যত সমগ্র দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন। রেল ও সড়কসহ সকল যোগাযোগ বিপর্যস্ত। প্রতিবাদে-প্রতিরোধে প্রকম্পিত দেশ। দাবি আদায়ের মিছিলের ধ্বনিতে প্রতিধ্বনিতে মুখরিত সহস্র কণ্ঠ। গণতন্ত্র, মানুষের অধিকার, ন্যায়বিচার আর জুলুম-নির্যাতনের অবসানই জনতার দাবি। বিশেষত, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতিষ্ঠার আন্দোলনই এখন মুখ্য। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে বিরোধী দল ও জোটসমূহ। একদলীয়ভাবে নির্বাচন করা হলে, সেটাও দেশে বা বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা বা বৈধতা পাবে না বলেও বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে  প্রশ্ন উঠেছে, দেশের চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাপ্তি কোথায়? পথের শেষ কোথায়? কোথায় সমন্বয়, পরমত সহিষ্ণুতা? কোথায় গণতান্ত্রিক সমানাধিকারে সকলের সম্মিলিত প্রয়াস? মুক্তির দিশারী মানুষ আজ নানা প্রশ্নে উত্তর জানতে চাচ্ছে। এইসব জনদাবি ও প্রশ্নের প্রেক্ষাপটে সর্বশেষ খবর হলো, রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানে একদলীয় নির্বাচন স্থগিতকরণের দাবির পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগ দাবি করেছে বিএনপি ও জামায়াতের নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট। পুরো পরিস্থিতি এখন সঙ্কট আর সমাধানের মাঝখানে চূড়ান্ত অবস্থায় ঝুলে আছে। পয়েন্ট অব নো রিটার্ন বলে ইংরেজিতে যে একটি কথা আছে, বাংলাদেশে এখন তেমনই অবস্থা। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে বিরোধী দলের। তারা বলছেন, অস্তিত্ব রক্ষায় আন্দোলনকে বিজয়ী করা ছাড়া তাদের সামনে আর কোনও বিকল্প খোলা রাখা হয়নি।
ইতিহাস দৃষ্টে বলা যায়, যে কোনও আন্দোলন-সংগ্রামের একমাত্র পরিণতি ও সমাপ্তির নাম বিজয়। আজ কিংবা আগামীকাল সেই বিজয় আসবেই। ইতিহাসের এটাই শিক্ষা। বিজয়ের পথ সহজ নয়; কুসুমাস্তীর্ণও নয়। বিজয়ের পথ হলো সংগ্রামের পথ। বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রামের ইতিহাস নতুন নয়। সংগ্রামের মধ্য দিয়েই ভারতীয় উপমহাদেশে স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বজায় রেখেছে বাংলাদেশ। সংগ্রামের মহাসড়ক পেরিয়েই স্বাধীন হয়েছে। অতএব সংগ্রাম হলো ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আন্দোলনরত জনতাকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তারা গণতন্ত্র ও আইনের শাসন এবং অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের ঐতিহাসিক দাবির কথাই উচ্চারণ করেন। তারা কোনওভাবেই একদলীয় এবং সকলের অংশগ্রহণযোগ্যতাহীন নির্বাচন মেনে নিবে না। আন্দোলনরত নেতা-কর্মীদের বক্তব্য ও মনোভাবে এ কথাই প্রতীয়মান হচ্ছে।
একগুঁয়েমীর মাধ্যমে একক নির্বাচন করার বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তা ও প্রেক্ষাপট কারও কাছে অজানা নয়। বিরোধী দলের দৃষ্টিকোণ থেকে বলা হয়েছে, একদলীয় স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সুশাসন ও সর্বদলীয় গণতন্ত্রের জন্য আজকে সংগ্রাম করতে হচ্ছে। দলনিরপেক্ষ বলে পরিচিত কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিকও এ কথার প্রতিধ্বনি করেছেন। তারা বঙ্গভবনে গিয়ে একদলীয় নির্বাচন না করার জন্য বলে এসেছেন। বিশেষত, প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে ছাড়া নির্বাচন যে সমস্যার সমাধান করতে পারবে না, সে দিকটির প্রতিই তারা বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন।
গণতন্ত্রের জন্য অতীতে ও বর্তমানে বিশ্বের নানা দেশের মতো বাংলাদেশেও সংগ্রাম করতে হচ্ছে হীন চক্রান্তকারীদের বিরুদ্ধে। ধর্ম, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ লুণ্ঠনকারীদের বিরুদ্ধে। মানুষের সম্মান, নিরাপত্তা ও মর্যাদা রক্ষার ডাকেই মূলত অবরোধ-হরতালসহ নানা কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। একদলীয় বা বিদ্বেষভরা কলুষিত মনে এই গণআন্দোলনকে দেখার মাধ্যমে কেউ কেউ এই সংগ্রামের বিরোধিতাও করছে। পক্ষ-বিপক্ষ যে কোনও রাজনৈতিক ঘটনায় থাকবেই। এটাই স্বাভাবিক। এটাই গণতান্ত্রিক। কিন্তু প্রতিপক্ষকে একতরফাভাবে নিধন করার বা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দেয়ার তো কোনও কারণ নেই? এমন করা হলে জনক্ষোভ বাড়ে বৈ কমে না। বাংলাদেশে আন্দোলন-সংগ্রাম তীব্র হওয়ার পিছনে বিরোধী দলের তৎপরতার চেয়ে সরকারি জুলুম-নির্যাতন ও উস্কানি কম দায়ী নয়। সংলাপ ও আপোষ করার দিকে বিন্দুমাত্র আগ্রহী না হয়ে বরং শক্তি ও বিষোদগারের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে সরকার যে পরিস্থিতিতে উত্তপ্ত করতে করতে বর্তমান অগ্নিগর্ভ পর্যায়ে টেনে এনেছে, সে কথা এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট। গণতন্ত্রে শাসন হয় সকলের সম্মতিতে। পুলিশ বা শক্তি দিয়ে যে শাসন, সেটা গণতন্ত্রের বিপরীত। গণতন্ত্রে মতপার্থক্যও দূর করা হয় আলাপ-আলোচনায়, সমঝোতায়। এই কথাগুলো যথাসময়ে সরকার যদি উপলব্ধি করতো, তবে পরিস্থিতির এতটা অবনতি হতো না।
নাগরিক হিসেবে প্রতিটি মানুষ শাস্তি ও নিরাপত্তা চায়। রাজনৈতিক দল হিসাবে গণতন্ত্রে প্রতিটি দলই নিজ নিজ বক্তব্য দেয়ার অধিকার চায়। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে জনগণ। এটাই গণতন্ত্রের রীতি। গণতন্ত্রে একজন মানুষও যদি ভিন্নমত প্রকাশ করে, সেটার প্রতিও সম্মান জানাতে হয়। বাংলাদেশে সেটা হচ্ছে কি? সমঝোতা হচ্ছে না; ভিন্নমত শোনা হচ্ছে না। তা হলে কী হচ্ছে?
বাংলাদেশে কোনও রাজনৈতিক দলই আকাশ থেকে পড়েনি। মুসলিম লীগের পেটের ভেতর থেকেই বেরিয়েছে খোদ শাসক দল আওয়ামী লীগ। বিভিন্ন নির্বাচনে এ দেশের রাজনৈতিক দলগুলো অংশও নিয়েছে। আজকে যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে, একদা তারাও বিরোধী দলে ছিল। বিরোধী দল বিএনপি কখনও প্রধান শক্তি হয়েছে; কখনও প্রধান বিরোধী দল হয়েছে। জামায়াত, জাতীয় পার্টি সময় সময় উল্লেখযোগ্য আসন পেয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে হয়েছে মজার ব্যাপার। যারা কোনও দিন সংসদে যেতে পারেনি; এমনকি জামানত পর্যন্ত রাখতে পারেনি; এরাই বড় বড় কথা বলছে। শুধু বলছে না, সরকারকেও সেটা মানতে বাধ্য করছে। জনগণ ভোট দেয় না, নিজেদের জনশক্তি ও জনপ্রিয়তা নেই, তারা কি করে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে? কে বা কোন দল রাজনীতি করতে পারবে; কার কি শাস্তি হবে; কাকে নির্মূল করা হবে; মধ্যযুগীয় রাজার মতো তারা সেটা আগে-ভাগেই ঠিক করে দিচ্ছেন? একদল ফতুর বুদ্ধিজীবীকে নিয়ে তারা যেটা করছেন, সেটা হটকারিতা, উস্কানি ও বিশৃঙ্খলা। এদের কথা শুনলে যে দেশের বৃহত্তর অংশকে বঞ্চিত করা হয়, সে খেয়ালও নেই। সবাই জানতে চায়, এদের শক্তির উৎস কি? জনগণ ও জনইচ্ছার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এরা কার এজেন্ডা বাস্তবায়িত করতে চায়? এখন এরাই সরকারের মাথায় চেপে মন্ত্রিসভায় বসে আছে। এটা প্রতিনিধিত্বশীল, নাকি স্বৈরাচার ও ফতুর বামদের ক্ষমতায়ন, সে প্রশ্নও উঠছে।
কথায় বলে, বন্ধুবেশী স্তাবকের চেয়ে শত্রু ভালো। বাংলাদেশের ইতিহাসও এ কথা বলে। স্বাধীনতার পর কিভাবে দেবত্তারোপ করে গণতন্ত্রকে স্বৈরতন্ত্রে আর গণতান্ত্রিক সিংহ পুরুষকে একদলের নেতা বানানো হয়েছিল, সেটা জ্বলজ্বল করছে। সেসব বন্ধুরা পরে জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক শ্রমিক হিসেবে খাল কেটেছে। এরশাদের পাতানো নির্বাচনে লাল-ঝা-া নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সরকারের ক্ষমতার বৃত্তে এবং পদ-পদবীতে এরাই এখন এগিয়ে। পরীক্ষিত আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরাও এদের দৌরাত্ম্যে কোণঠাসা। এরাই আদর্শিকভাবে আওয়ামী লীগকে বিচ্যুৎ করছে। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির পুরোধা ও বাংলাদেশের প্রধান দলের ঐতিহ্য থেকে অতীতের মতো বিচ্ছিন্ন করছে। আজকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিরোধী দলের দূরত্ব ও ওয়ার্কিং রিলেশন্স খারাপ করার পেছনে এদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। এতে কার কি লাভ হয়েছে কে জানে; কিন্তু সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে আওয়ামী লীগের। প্রবল বিরোধিতার মধ্য দিয়ে দলটিকে কাজ করতে হচ্ছে। আওয়ামী লীগের শরীরে একদলীয় স্বৈরতন্ত্রের ছাপ লেগেছে এদেরই কারণে। অথচ আওয়ামী লীগ যে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে, তাতে সকলকে সঙ্গে রাখলেও কোনও ক্ষতি হতো না; সমালোচকরাও তেমন কিছুই বলতে পারতো না। আওয়ামী লীগের সুনাম ও ভাবমূর্তি তাতে উজ্জ্বল হতো। এখন হয়েছে উল্টো।
এখন অবস্থা কি সেটা তো দেখাই যাচ্ছে। বিদেশী বন্ধুরা পর্যন্ত সংলাপ ও সমঝোতার কথা বলতে বলতে ক্লান্ত ও লজ্জিত হয়ে গেছে। যেসব আওয়ামী বুদ্ধিজীবী বিবেকের কারণে কিছু সত্য কথা ও সদুপদেশ দিচ্ছেন, তারা পর্যন্ত আক্রান্ত হচ্ছে আওয়ামী লীগের নব্যশক্তিধর নেতাদের দ্বারা। যাকে-তাকে যখন-তখন স্বাধীনতাবিরোধী/মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বানিয়ে ফেলা হচ্ছে। এই যে প্রতিহিংসার দুষ্টচক্র ঘাপটিমারা মতলববাজরা তৈরি করেছে, সেটা থেকে রাবণের চিতার মতো দাউ দাউ করে জ্বলছে হিংসার আগুন। সাধারণ মানুষ, শান্তিপ্রিয় নাগরিক এই অরাজকতা থেকে বাঁচতে চায়। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের, আইনের ন্যায়ানুগ প্রয়োগের নিশ্চয়তা চায়। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়, যাতে সকলেই অংশ নিতে এবং প্রকৃত জনমতের প্রতিফলন দেখতে পারে। চলমান আন্দোলন-সংগ্রামের দাবিও তা-ই। এই দাবি দিনে দিনে জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়ে এখন চূড়ান্ত পর্যায় অতিক্রম করছে। দেশের সর্বত্র দাবানলের মতো ছড়িয়ে গেছে গণআন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ। সর্বত্র উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। গণমাধ্যমের পাতায় বা টিভির পর্দায় চোখ রাখলে যে কেউই অতি সহজে উপলব্ধি করতে পারবেন যে, পরিস্থিতি কতটুকু নাজুক ও ভয়াবহ। এমন অবস্থার আশু উত্তরণ দরকার। একটি মীমাংসা, সমাধান বা পরিণতিতে পৌঁছা দরকার। অনিশ্চিয়তা কখনও কোনও স্থায়ী বিষয় হতে পারে না।
যে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে, সে নির্বাচনকে সকলের অংশগ্রহণমূলক করা এবং দেশে-বিদেশে বিশ্বাসযোগ্য-বৈধতাসম্পন্ন করা অতি জরুরি। পাশাপাশি আন্দোলনরত বিরোধী দল ও জোটসমূহের দাবি-দাওয়াগুলোকেও সম্মানের সঙ্গে বিবেচনা করা দরকার। তা না হলে আন্দোলন যে হারে ছড়িয়ে পড়ছে এবং যে ব্যাপকতা ও বিস্তৃতি লাভ করছে, তাতে আন্দোলনের সাফল্যের পথেই সমাধান বের হয়ে আসবে। কারণ, পয়েন্ট অব নো রিটার্নে চলে যাওয়া জনতাকে ফিরিয়ে আনা সহজ নয়। দাবি আদায় না হলে এই জনতাকে থামানোও যাবে না। আলোচনা বা আন্দোলন, যে কোনও পথেই জনতা তাদের দাবি আদায় করবেই। আলোচনা রুদ্ধ করে জনতাকে সর্বাত্মক আন্দোলনের পথে ঠেলে দেয়া হয়েছে। এখন দাবি আদায় ভিন্ন এ আন্দোলনের পরিসমাপ্তির অন্য কোনও পথ খোলা আছে কি?

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads