সোমবার, ৪ নভেম্বর, ২০১৩

নির্বাচনে কারচুপি, ভোট ডাকাতি ও মিডিয়া ক্যু


বর্তমানে বাংলাদেশে সবচেয়ে আলোড়িত শব্দটি হলো নির্বাচন। চায়ের দোকান থেকে শুরু করে অফিস আদালতে সবখানেই একটি প্রশ্ন ২৪ অক্টোবরের পর দেশে কী ঘটতে চলছে? আসলে দেশে কি সঠিক সময়ে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে? নির্বাচন হলে তাতে সব দল অংশ নেবে কি না? নানা প্রশ্ন সাধারণ জনগণের মধ্যে জাগছে। এ দেশে যারা আওয়ামী লীগ করেন, তারা বিএনপিকে সহ্য করতে পারেন না। শত্রু মনে করেন। ঠিক তেমনি যারা বিএনপি করেন তারাও আওয়ামী লীগকে শত্রু মনে করেন। অর্থাৎ এক দল অন্য দলকে কখনো বিশ্বাস করে না। আর যখন কেউ কাউকে বিশ্বাস না করে তখন কি কোনো দলীয় সরকারের অধীনে ক্ষমতা বদলের নির্বাচন সম্ভব? যদি আমরা ইতিহাসের পেছন ফিরে দেখি, তা হলে দেখব স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ। সরকার অবশ্য এর কিছু দিন আগেই সাংবিধানিক পরিষদ ভেঙে দিয়েছিল। সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার সময় দেশের অবস্থা খুব একটা শান্ত ছিল না। বিভিন্ন বিরোধী দলের চাপে আওয়ামী লীগ সরকার অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে পড়েছিল। বর্ষীয়ান নেতা মওলানা ভাসানীসহ অন্য বিরোধী দলগুলো সরকারকে সাধারণ নির্বাচনের জন্য চাপ দিচ্ছিল। তাদের মতে, বাংলাদেশ দ্রুত অবনতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং আওয়ামী লীগ সরকার তা প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়েছে, সেই সাথে আওয়ামী লীগ তার যোগ্যতাও হারাচ্ছে। এ দিক থেকে বিশেষ করে বাংলাদেশে সৃষ্ট নব্য রাজনৈতিক দল সমাজতান্ত্রিক দল সরকারের তীব্র বিরোধিতা করতে থাকে এবং মওলানা ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাথে মিলে নতুন নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছিল। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বিপ্লবী তরুণদের দিয়ে গঠিত হয়েছিল এবং আওয়ামী লীগের সীমাহীন ব্যর্থতা জনগণের সামনে তুলে ধরে জনপ্রিয়তা অর্জনের আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছিল। বলা বাহুল্য, তাদের সে চেষ্টা বিফলে যায়নি। এ কথা সত্য যে, আওয়ামী লীগ সরকার ইতোমধ্যে স্বেচ্ছাচারিতা ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার জন্য তাদের জনপ্রিয়তা বহুলাংশে খুইয়ে ফেলেছিল। 
এমতাবস্থায় দেশে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করায় দেশের সব বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য প্রস্তুতি চালায়। আওয়ামী লীগকে ঠেকানোর জন্য তাদের বিরুদ্ধে প্রচারণা শুরু করে। এ সময় অর্থাৎ ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি একটি দুঃখজনক ঘটনার সূত্রপাত ঘটে। উত্তর ভিয়েতনামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন করে বিমান হামলার প্রতিবাদে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ঢাকার মার্কিন তথ্যকেন্দ্রের সামনে এক বিক্ষোভ মিছিল বের করে। এই বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ নির্দ্বিধায় গুলি চালায়। ফলে দুজন ছাত্র নিহত হন। এর ফলে জনসাধারণের মনে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। সে দিন দেশের আইনশৃঙ্খলার যেমন অবনতি ঘটছিল, তেমনি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যও অতি দ্রুতগতিতে বেড়ে চলছিল, যা সাধারণ মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছিল। অতএব, দেশের এই চরম অবস্থায় বিরোধী দল আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ দাবি করে এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য একটি জাতীয় সরকারগঠনের দাবি জানায়। শেখ মুজিবুর রহমান বিরোধী দলের এই দাবি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। ৭ মার্চ ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। 
এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে জয়লাভ করেÑ এ কথা যেমন সত্য, তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম এই নির্বাচনে মাত্র কয়েকটি সিট ধরে রাখার জন্য আওয়ামী লীগ যথেষ্ট কারচুপি করে। কয়েকটি আসনে বিরোধী দলের নিশ্চিত বিজয়কে সরকার কারচুপির মাধ্যমে নস্যাৎ করে দেয়। যেমনÑ টাঙ্গাইলের রাজনীতিবিদ (ভাসানী ন্যাপ) ড. আলীম আল-রাজী, আবদুর রহমান মির্জা, রাশেদ খান মেনন, জাসদের শাজাহান সিরাজ, মেজর অব: আ: জলিল প্রমুখ নেতার বিজয় শেখ মুজিবের জীবদ্দশায় সে দিন ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল। কারণ, তাদের বিরুদ্ধে যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন তারা ছিলেন আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতা। আওয়ামী লীগের ধারণা ছিল, তাদের পরাজয় মানেই আওয়ামী লীগের চরম পরাজয় আর এ পরাজয় চূড়ান্ত অপমানের। 
তা ছাড়া আওয়ামী লীগের আরো একটি প্রবণতা ছিল, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হওয়া। যার দরুণ কোনো কোনো প্রভাবশালী আওয়ামী নেতা তাদের এলাকায় তাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রার্থী দাঁড় করাতে দেননি। যেমন তোফায়েল আহমেদ, এ কে এম ওবায়দুর রহমান, এ এইচ এম কামরুজ্জামান, মনোরঞ্জন ধর, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জিল্লুর রহমান প্রমুখ তাদের ব্যক্তিগত প্রভাব খাটিয়ে তাদের বিপক্ষের প্রার্থীদের বসিয়ে দিতে সক্ষম হন। এসব ঘটনা দুঃখজনক হলেও সত্য। 
এ কথা চরমভাবে সত্য, আওয়ামী লীগ যদি এ ধরনের জোর জবরদস্তি বা কারচুপির আশ্রয় গ্রহণ না-ও করত তথাপি তারা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেত। হয়তো বা কয়েকটি আসন তাদের হারাতে হতো। এতে আওয়ামী লীগের তেমন একটা ক্ষতি হতো না। বরং সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অবাধ নির্বাচনের সুযোগ দিয়ে আওয়ামী লীগ সে দিন জনগণের আস্থা কুড়াতে সক্ষম হতো। এভাবে আওয়ামী লীগ রাজনীতির ইতিহাসে সে দিন একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারত; কিন্তু তারা তা না করে সে দিন ভোট কারচুপির আশ্রয় নিয়েছিল। সে কারণে অনেকেই বলে থাকেন নির্বাচনে কারচুপি, ভোট ডাকাতি বা মিডিয়া ক্যু এগুলোর পথপ্রদর্শক স্বয়ং আওয়ামী লীগ। এসব বস্তুনিষ্ঠ কারণে দেশের জনগণ স্পষ্ট বুঝতে পারছে এই আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন কিছুতেই সুষ্ঠু হতে পারে না। কারণ আমরা দেখেছি সে দিন যেখানে কোনো শক্তিশালী বিরোধী দল ছিল না, আর আওয়ামী লীগের পরাজয়ের কোনো সম্ভাবনাই ছিল না, তার পরও বঙ্গবন্ধু সরকারের মতো সরকার নির্বাচনে কারচুপি করে এবং প্রভাব খাটিয়ে, ভয়ভীতি দেখিয়ে বিপক্ষের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে বসিয়ে দেয়া হয়। এই কারচুপির ধারাবাহিকতা উপলব্ধি করে প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা হাসিনা সরকারের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় মন্তব্য করেছেন এবারের নির্বাচন হবে রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে।যে যত কথাই বলুক না কেন হাসিনা সরকারের অধীনে কোনো জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে না। তার বাবা শেখ মুজিবের এনালগ সরকারের সময় যেভাবে কারচুপি, ভোট ডাকাতি হয়েছে আর এখন তো হাসিনার ডিজিটাল সরকার এবং দেশে রয়েছে বৃহৎ জনপ্রিয় বিরোধী দল। সেই অর্থে যেখানে কোনো বিরোধী দল ছিল না তখন মুজিব সরকার কারচুপি করেছে আর এখন তো বারবার নির্বাচিত বিএনপি রয়েছে বিরোধী দলে। অতএব এখানে আরো শক্তভাবে কারচুপি করতে হবে। এখন জনগণের বুঝতে অসুবিধা হয় না ভোট চোরের সন্তান এবার ভোট ডাকাতি করবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে, এটাই স্বাভাবিক। কারণ ক্ষমতায় থাকার জন্য এমন কোনো কাজ নেই যা ডিজিটাল সরকার করে যাচ্ছে না। 


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads