বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০১৩

নবম সংসদের সমাপ্তি এবং প্রধানমন্ত্রীর পদক্ষেপ


গত বুধবার সন্ধ্যায় হঠাৎ করেই নবম জাতীয় সংসদের সমাপ্তি ঘটানো হয়েছে। বিষয়টি অনেক কারণেই সংশয় ও আশংকার সৃষ্টি করেছে। প্রধান কারণ হলো, সমাপ্তির ঘোষণাটি শুনিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বলেছেন, কোনো ইমারজেন্সি বা যুদ্ধাবস্থার সৃষ্টি না হলে এটাই নবম সংসদের শেষ অধিবেশন। সংশয় ও আশংকার ™ি^তীয় কারণ হিসেবে এসেছে নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তমূলক ঘোষণা। তিনি বলেছেন, মহামান্য রাষ্ট্রপতি নাকি তাকে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করার এবং সে সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করার ‘অনুমতি’ দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে পরামর্শ করেই তিনি নাকি মন্ত্রিসভার আকারও ছোট করেছেন। খুবই দৃঢ়তার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, আগামী সংসদ নির্বাচন তার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রধানমন্ত্রীর দুটি ঘোষণাই ক্ষমতাসীনদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার জন্য যথেষ্ট। কারণ, নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের এবং তার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করার জন্য রাষ্ট্রপতি ‘অনুমতি’ দিয়েছেন বলে যে তথ্য প্রধানমন্ত্রী শুনিয়েছেন তা কিন্তু প্রশ্নসাপেক্ষ। এর কারণ, ঠিক তার আগের দিনই বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ১৮ দলীয় জোটের এক প্রতিনিধি দল মহামান্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ ও বৈঠক করে এসেছেন।  বৈঠককালে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এডভোকেটের কাছে গুম-খুনসহ বিরোধী দলের ওপর সরকারের দমন-নির্যাতন, গ্রেফতার ও মিথ্যা মামলার মাধ্যমে রাজনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেছেন বেগম খালেদা জিয়া। সমাধানের পন্থা হিসেবে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের দাবি মেনে নেয়ার অনুরোধও জানিয়েছেন তিনি। রাষ্ট্রপতিকে ‘রাষ্ট্রের অভিভাবক’ ও ‘জাতীয় ঐক্যের প্রতীক’ হিসেবে উল্লেখ করে বিরোধী দলের নেত্রী বলেছেন, রাষ্ট্রপতির উচিত একতরফা নির্বাচনের চেষ্টা থেকে প্রধানমন্ত্রীকে নিবৃত্ত করা। রাষ্ট্রপতিও একতরফা নির্বাচনের ব্যাপারে নিজের আপত্তি ও অনাগ্রহের কথা জানিয়েছিলেন। সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও বিরোধী দলের দাবি পূরণের জন্য চেষ্টা চালাবেন এবং ১৮ দলীয় জোটের দাবি ও বক্তব্য সরকারের কাছে পৌঁছে দেবেন বলেও আশ্বাস দিয়েছিলেন তিনি। এর ফলে রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল।
অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী সে সম্ভাবনাকেই নস্যাৎ করেছেন। কারণ, ১৮ দলীয় জোটের নেতারা রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের আগে থেকেই এমন একটি প্রচারণা চালানো হয়েছে যে, বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছানোর এবং নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে সংবিধানে নতুন একটি বিধান যুক্ত করার প্রস্তুতি নেয়ার জন্যই সংসদের অধিবেশন দফায় দফায় মুলতবি করা হচ্ছিল। কথাটা মানুষ বিশ^াসও করেছে এজন্য যে, সংবিধানের যে অনুচ্ছেদের ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রী বুধবার সংসদের সমাপ্তি ঘটিয়েছেন, সে একই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী গত ২৭ অক্টোবরই নবম সংসদের শেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটা করা হয়নি। এর মধ্যে ১৮ দলীয় জোটের নেতারা মহামান্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ ও বৈঠক করায় আশা করা হচ্ছিল যে, অধিবেশনের সমাপ্তি ঘটানোর আগেই সংবিধানে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের বিষয়ে নতুন একটি বিধান যুক্ত করা হবে। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী তার ধারে কাছে না গিয়ে প্রমাণ করেছেন, তারা আসলেই বিরোধী দলকে বাইরে রেখে একতরফা নির্বাচন করতে এবং আবারও ক্ষমতায় আসতে চান। অর্থাৎ তিনি তাদের নীলনকশা অনুযায়ীই এগিয়ে চলেছেন। ঘটনাপ্রবাহে রাষ্ট্রপতির দেয়া কথিত ‘অনুমতি’ নিয়েও কথা কম হচ্ছে না। প্রশ্ন উঠেছে, এই ‘অনুমতি’ প্রধানমন্ত্রী কি বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে রাষ্ট্রপতির বৈঠকের আগে নিয়েছেন নাকি নিয়েছেন পরে? বলা দরকার, প্রশ্ন ওঠার পেছনে যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে। প্রধান কারণ হলো, সংবিধান অনুযায়ী তো বটেই, সংসদীয় গণতন্ত্রের রেওয়াজ বা প্রথা অনুসারেও প্রধানমন্ত্রীকে ‘অনুমতি’ দেয়া সংক্রান্ত ঘোষণাটা বঙ্গভবন থেকে লিখিত আকারে আসার কথা। কিন্তু তেমন কোনো ঘোষণার কথা শোনা যায়নি।
বিষয়টি অবশ্যই গুরুতর। কারণ, আবদুল হামিদ এডভোকেট এখন আর আওয়ামী লীগের সাধারণ কোনো নেতা নন, তিনি বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি। সুতরাং তাকে নিয়ে মিথ্যাচার বা প্রতারণা কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তেমন কোনো চেষ্টা ও বক্তব্য বরং দ-নীয় অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। এ ব্যাপারে বঙ্গভবন থেকে কোনো ব্যাখ্যা দেয়া হবে কি না সেটা একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বটে। তবে চলমান রাজনৈতিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে বেশি দরকার আসলে প্রধানমন্ত্রীর দিকে লক্ষ্য করা। কারণ, এমন এক সময়ে তিনি হঠাৎ করে নবম জাতীয় সংসদের সমাপ্তি ঘটিয়েছেন যখন সব দিক থেকেই সমাধানের সম্ভাবনার তৈরি হচ্ছিল। বিশেষ করে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বেগম খালেদা জিয়া এবং ১৮ দলীয় জোটের নেতারা সাক্ষাৎ ও বৈঠক করার পর সংলাপ ও সমঝোতা সময়ের বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এডভোকেট যদি উভয় পক্ষকে এক টেবিলে বসানোর উদ্যোগ নিতেন তাহলে কারো পক্ষেই না বলা সম্ভব হতো না। কিন্তু আশা ও সম্ভাবনায় গুড়ে বালি ঢেলে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ফলে বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, একতরফা নির্বাচনের নীলনকশা অনুযায়ীই এগিয়েছেন তিনি। সে চেষ্টা তিনি চালাতেই পারেন। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী একই সঙ্গে মহামান্য রাষ্ট্রপতির মান-সম্মান ধরেও টান মেরেছেন। বিষয়টির সঙ্গে রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার এবং জাতীয় নির্বাচনসহ দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ জড়িত রয়েছে বলেই আমরা মনে করি, নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণকে নিশ্চিত করা সত্যি উদ্দেশ্য হয়ে থাকলে এই পদক্ষেপ অবশ্যই ঠিক হয়নি।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads