বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই, ২০১৪

গাজার ধ্বংসযজ্ঞ থেকে কী পাচ্ছে ইসরাইল


ইসরাইল গাজায় এমন এক সময় কয়েক সপ্তাহব্যাপী ধ্বংসযজ্ঞ চালাল যখন মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি বেশ উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো। ইরাক সিরিয়ায় ভ্রাতৃঘাতী সঙ্ঘাত নজিরবিহীন দ্বিধাবিভক্তি এনেছে এই অঞ্চলের মুসলিম জনগণের মধ্যে। মিসরের রাষ্ট্রীয় নীতিই যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে ইসরাইলি স্বার্থের পৃষ্ঠপোষকতা করা। শক্তিশালী আরব দেশগুলোর অখণ্ডতাকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে। আরব বসন্তের মাধ্যমে যেসব দেশে গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের আাওয়াজ উঠেছিল সেগুলোকে শক্তি দিয়ে দমন করে আবার নতুন স্বৈরাচার চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে।
এ ধরনের এক পরিস্থিতিতে গাজায় এবারের ইসরাইলি হামলার তাৎপর্যটাই কী এ প্রশ্ন অনেকের মধ্যে। আজকের লেখায় ফিলিস্তিন সঙ্কটটাকে গভীর থেকে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে। এই দেখা শুধু আরব বা মুসলিম দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নয়, ইহুদি জনগোষ্ঠীর মধ্যে যারা আগ্রাসনবাদিতার ভুল ও অসঙ্গতি তুলে এনেছেন তাদের ব্যাখ্যাকেও পরিস্থিতি উপলব্ধির জন্য উদ্ধৃত করা হয়েছে।
আমেরিকা তাদের উদ্যোগে শুরু হওয়া শান্তি আলোচনা ব্যর্থ করে দেয়ার পরও তেল আবিবকে এবারের গাজা আগ্রাসনে সমর্থন করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাদের সর্বজনীন চুক্তির কাছাকাছি একটি ব্যবস্থা যেন করা আছে যাতে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলছেন, অন্যান্য দেশের মতো ইসরাইলের তার নাগরিকদের সীমানার ওপার থেকে পরিচালিত হুমকি থেকে রার অধিকার এবং বাধ্যবাধকতা রয়েছে; কিন্তু বারাক ওবামার বেদনাদায়ক বিবৃতিতে ইসরাইলের বোমাবর্ষণ এবং গাজায় দখলদারিত্বের কারণে সৃষ্ট রাজনৈতিক ও নৈতিক বিষয় নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা হয়নি। দেশটি যে নভেম্বর ২০১২ সাল থেকে বিদ্যমান যুদ্ধ বিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করেছে এবং গাজার বেসামরিক জনগণকে ঝুঁকির মধ্যে না নিয়ে অহিংস উপায়ে ইসরাইলের বেসামরিক জনগণকে রক্ষা করা যেত কি না, সেই প্রশ্ন বিবেচনায় আনা হয়নি। এই আগ্রাসনে ইসরাইলের প্রতিরা বাহিনীর (আইডিএফ) হাতে নিহতের সংখ্যা ১৩শ পার হয়েছে, যার বেশির ভাগই হলো বেসামরিক ব্যক্তি।
গাজার ওপর ইসরাইলের হামলার পর নিউ ইয়র্ক টাইমসে জেরুসালেমভিত্তিক বিশ্লেষক নাথান ট্র্যাল উল্লেখ করেছেন যে, ‘হামাস ইসরাইলকে লক্ষ্য করে প্রথম রকেট নিক্ষেপ করেনি বরং জুন মাসের প্রথম দিকে গঠিত ফিলিস্তিনি ঐক্যের সরকারকে বিদায় করতে চেষ্টা করেছে ইসরাইল, যদিও এ সরকার তার বৈধতা স্বীকৃতির জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দ্বারা আরোপিত সব শর্ত মেনে নিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল।
ইসরাইলও গাজার মধ্যে যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি ছিল তা লঙ্ঘন করেছে ইসরাইল, হামাস নয়। এ কাজটি ইসরাইল এই প্রথমবার করেছে এমন নয় বরং তাদের অপরাধ আরো অনেক গভীর। কোন বামপন্থীসমালোচক নন ইসরাইলি সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এবং আইডিএফ-এর গাজা বিভাগের সাবেক কমান্ডার সামুয়েল জাকাই ২০০৯ সালের ইসরাইলের গাজায় যুদ্ধ সম্পর্কে বলেছেন, ‘ছয় মাসের সময়কালের জন্য একটি সাময়িক যুদ্ধবিরতি বলবৎ ছিল এমন সময় ইসরাইল শান্ত অবস্থার উন্নয়নের পরিবর্তে তা নষ্ট করার মতো কাজ করে, যাতে (গাজা) উপত্যকার ফিলিস্তিনিদের অর্থনৈতিক দুর্দশার আরো অবনতি ঘটে... ... ... আপনি কল্পনা করতে পারবেন না তাদের অর্থনৈতিক মর্মপীড়া কোথায় গিয়ে উপনীত হয়। তারা শুধু হামাসকে পাশে পাবার প্রত্যাশা করেছে আর কিছু তারা করেনি।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক সিনিয়র বিশ্লেষক নাথান ট্র্যাল নিউ ইয়র্ক টাইমসে লিখেছেন, ‘২০০৬ সালে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ নির্বাচনে জয়ী হওয়া সত্ত্বেও, হামাস রামাল্লায় ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের কাছে গাজার আনুষ্ঠানিক কর্তৃত্ব হস্তান্তর করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ফিলিস্তিনে ঐকমত্যের সরকার গঠনের পথ প্রশস্ত হয়। এই পুনর্মিলন চুক্তির শর্তগুলো অনেকটা একতরফাভাবে পিএলও চেয়ারম্যান ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপরে প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস নির্ধারণ করেন। চুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুই সুবিধা পাওয়া থেকে হামাস নেতা এবং গাজার অধিবাসীদের বঞ্চিত করে ইসরাইল পুনর্মিলন চুক্তির বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নেয়। এ দুটি সুবিধার একটি হলো হামাস সরকারে দায়িত্বপালনকারী ৪৩ হাজার সরকারি কর্মচারীর বেতন পরিশোধ করা এবং নতুন সরকারের অধীনে তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা। দ্বিতীয়টি হলো গাজাকে অবরোধ করে রাখা ইসরাইল ও মিসরের বন্ধ সীমান্ত খুলে দিয়ে বাইরে বিশ্বের সাথে গাজাবাসীদের যোগাযোগের সুযোগ দেয়া।
নাথান ট্র্যাল লিখেছেন, ‘পুনর্মিলন সরকার অনেক উপায়ে ইসরাইলের স্বার্থের পক্ষে। হামাস রাজনৈতিক প্রতিপকে গাজায় প্রবেশ অবারিত করে দেয়। যে ঐকমত্যের সরকার গঠিত হয় সেখানে হামাসের একজন সদস্যও নেই। এ সরকারে রামাল্লাভিত্তিক প্রধানমন্ত্রী, উপপ্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাখা হয়েছে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এটা পশ্চিমা সাহায্যপ্রাপ্তির জন্য যে তিনটি শর্ত দীর্ঘ দিন ধরে আমেরিকা ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের ছিল সে দাবি মেনে চলার অঙ্গীকার করে। এ তিনটি শর্ত হলো; অহিংস নীতি, বিগত চুক্তি মেনে চলা এবং ইসরাইলের স্বীকৃতি।
এত কিছুর পরও ইসরাইল দৃঢ়ভাবে নতুন সরকারকে আমেরিকান স্বীকৃতি দানের বিরোধিতা করে। আর এ সরকারকে আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা চালায়। তারা ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার একটি ছোট পদপেকে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে। ইসরাইলের নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান পশ্চিম তীর গাজা বন্ধন সুদৃঢ় হওয়া এবং পশ্চিম তীরে হামাসের কার্যক্রমের ব্যাপারে আপত্তি জানায়।
এটি ঠিক যে সর্বশেষ যুদ্ধবিরতি ভালো চলছিল। ট্র্যালের বক্তব্য অনুযায়ী, ‘হামাসের শান্তিপূর্ণ দায়িত্ব হস্তান্তরের মাধ্যমে যা পাওয়া উচিত ছিল তা না পেয়ে এখন তারা সহিংসতার মাধ্যমে পেতে চাইছে। তারা এমন স্থিতাবস্থায় ফিরতে চাইছে না যেখানে সারা দিনে আট ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে, পানি হয় পানের অযোগ্য, পয়ঃনিষ্কাশন করতে হয় সমুদ্রে ডাম্পিং করে, জ্বালানি সঙ্কটে স্যানিটেশন প্লান্ট বন্ধ থাকে আর কখনো কখনো রাস্তায় ভেসে যায়।শুধু হামাস সমর্থক নয় অনেক গাজাবাসীই এ বিপর্যয়মূলক স্থিতাবস্থা পরিবর্তন করতে একটি বড় অঙ্কের মূল্য পরিশোধে বিশ্বাসী হয়ে পড়েছে বলে নাথান উল্লেখ করেন।
গাজায় আগ্রাসনের জন্য ইসরাইলের বেসামরিক নাগরিকদের হামাসের রকেট থেকে রক্ষাকে যুক্তি হিসেবে দেখানো হয়। প্রশ্নটি হলো ইসরাইলের বেসামরিক জনগণকে রার জন্য কম প্রাণঘাতী কোনো উপায় কি ছিল না? সীমানার ওপার থেকে আসা হুমকি থেকে বেসামরিক জনগোষ্ঠীকে রক্ষার জন্য সব সরকারের মতোই অধিকার ও দায়িত্ব তাদের রয়েছে বলে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ইসরাইলের কাজকে যে সমর্থন করেছেন তার তাৎপর্য কী? আসলেই ইসরাইলের সীমানাটি ঠিক কোথায়?
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু স্পষ্ট করে কোনো সময় সীমানা চিহ্নিত করেন না। তিনি বলেন না জনসংখ্যার কারা ঐ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। ফিলিস্তিনিদের সাথে দুই রাষ্ট্র সমাধান চুক্তিতে পৌঁছানোর জন্য ২০০৯ সালে করা অঙ্গীকারের প্রতি সম্মান দেখানোর কোনো অভিপ্রায় যে তার ছিল না তা বিশ্বকে নেতানিয়াহু জানাতে চাননি। কারণ ইসরাইল, পিএলও এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বারিত মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির যে রোড ম্যাপ তাতে ১৯৬৭ যুদ্ধবিরতি লাইনই উভয়ের সীমান্ত হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে যার কোনো একতরফা পরিবর্তনকে বারণ করা হয়েছে। এই বিধানটি ধারাবাহিকভাবে ইসরাইলি সরকারগুলো লঙ্ঘন করে তাদের অবৈধ বসতি সম্প্রসারণ চালিয়ে গেছেন। নেতানিয়াহু মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির প্রস্তাবিত ভূখণ্ড আলোচনার জন্য প্রারম্ভিক বিন্দু হিসেবে এই সীমান্তকে মেনে নিতে অস্বীকার করেছেন; কিন্তু তার ভেতরের আকাক্সাটি শেষ পর্যন্ত গোপন থাকেনি।
গত ১২ জুলাই ইসরাইল টাইমস-এর সম্পাদক ডেভিড হরোভিট বলেছেন, ‘নেতানিয়াহু স্পষ্ট করেছেন যে প্রকৃত দুই রাষ্ট্র সমাধানে তার কোনো আগ্রহ নেই।হরোভিট বলেছেন, “অনিশ্চয়তা নেতানিয়াহু মোটামুটি সরিয়ে দিয়েছেন ... এবং এখন কেউ কখনো সামনে দাবি করতে পারবেন না যে তিনি (নেতানিয়াহু) সত্যিকার অর্থে কী মনে করেন তা আমাদের বলেননি। নেতানিয়াহু এটি স্পষ্ট করেছেন যে তিনি কখনো পশ্চিম তীরে একটি সম্পূর্ণরূপে সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র মেনে নেবেন না।
নেতানিয়াহু জন কেরির উদ্যোগে শান্তি আলোচনা চলাকালেই বলেছিলেন, ইসরাইলি নিরাপত্তা বাহিনী আইডিএফ পশ্চিম তীরে স্থায়ীভাবে থাকবে। এ সময় তিনি ইসরাইল-ফিলিস্তিন সীমান্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক বাহিনী মোতায়েনের যে প্রস্তাব জন কেরি করেছিলেন তা নাকচ করে সেখানে স্থায়ীভাবে ইসরাইলি নিরাপত্তা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে বলে উল্লেখ করেন। আমেরিকান ইহুদি কংগ্রেসের সাবেক ন্যাশনাল ডিরেক্টর ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওরিয়েন্টাল ও আফ্রিকান স্টাডিজ স্কুলের অনাবাসী গবেষণা অধ্যাপক হেনরি সেইগম্যান নেতানিয়াহুর এই বক্তব্যকে বিশ্লেষণ করে বলেছেন, ‘বিভিন্ন ছিটমহল, যে গুলোকে ফিলিস্তিনীরা রাষ্ট্র বলতে পারেন, কিন্তু সার্বভৌমত্বের সংজ্ঞায়নের জন্য যে আত্বনিযন্ত্রণাধিকার ও রাষ্ট্রত্বের যে উপাদান তা কোনো দিন ইসরাইল অনুমোদন করবে না।
নেতানিয়াহু কেন তা অনুমোদন করতে চান না? কেন তিনি কেরির শান্তি আলোচনার প্রতি কোনো সম্মান দেখালেন না? কেন তিনি ফিলিস্তিনি ঐক্য সরকারের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিলেন? কেন তিনি পশ্চিম তীরের অবৈধ স্থাপনা অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন এবং কেন তিনি ইসরাইলের তিন কিশোর অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডের বিয়োগান্তক ঘটনাকে হামাসের যে প্রাতিষ্ঠানিক (সামরিক থেকে ভিন্ন) রাজনৈতিক উপস্থিতি পশ্চিম তীরে রয়েছে তা ধ্বংস করতে একটি অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করেছেন?
ইসরাইলের হারেতজ পত্রিকায় কলামিস্ট ইজহাক লাওর উল্লেখ করেছেন, নেতানিয়াহু এসব করছেন, ‘তিনি এবং তার সরকার একটি রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে ফিলিস্তিনিদের নির্মূল করতে চান। ইসরাইল সরকারের মধ্যে উত্তরাধিকারক্রমে এ মনোভাব এসেছে যে তারা ফিলিস্তিনিদের বিপর্যস্ত প্রান্তিক জনগোষ্ঠী করে রাখতে চান।২০০৬ সালে পলিটিসাইড নামে একটি বইয়ে ইসরাইলি বিশেষজ্ঞ বারুচ কিমারলিং ইহুদিবাদীদের এই অভিপ্রায়ের কথাই উল্লেখ করেছিলেন। সুতরাং এ প্রশ্ন এখন খুব গুরুত্বপূর্ণ যে ঠিক কে ইসরাইলের মানুষকে ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছেন? আর ওবামা এ সম্পর্কে কী করতে প্রস্তুত? অধ্যাপক হেনরি সেইগম্যান উল্লেখ করেছেন, ‘আমি নিশ্চিত প্রেসিডেন্ট ওবামার রাজনৈতিক উপদেষ্টারা তাকে বলছেন, কংগ্রেসের নির্বাচনী বছরে ইসরাইল লবিকে ুব্ধ করার সময় নয়। তারা নিশ্চিতভাবেই ভুল করছেন। এটি এ কারণে নয় যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সব সময় নির্বাচনের সময়ের মধ্যে থাকে বরং এই কারণে এটি ভুল যে মার্কিন নির্বাচনে এই সত্য প্রতিষ্ঠিত আমেরিকান ইহুদিরা অব্যাহত এবং ব্যাপকভাবে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কারণে ডেমোক্র্যাটদের পক্ষে ভোট দেয় কিন্তু নেতানিয়াহুর নীতির পক্ষে সমর্থন দেয়া এর কোন কারণ নয়।
হেনরির প্রশ্ন হলো, প্রেসিডেন্ট ওবামা যদি ইসরাইলি-ফিলিস্তিনিদের প্রভাবিত করার ইচ্ছা রাখেন তাহলে তিনি কেন অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রে কিছু ঝুঁকি নিতে রাজি হবেন না?
গাজায় বর্তমান যে পরিস্থিতির উদ্ভব সেটি ইসরাইল ও পশ্চিমাদের এপ্রিল ২০১৪ এর ফিলিস্তিনি পুনর্মিলন চুক্তি বাস্তবায়ন রোধ করার পথ গ্রহণের প্রত্যক্ষ ফল। নাথান ট্র্যাল-এর এই বক্তব্য অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। ইসরাইল ২০ বছর আগে অসলো চুক্তি স্বাক্ষরের পর দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান মেনে নেয়ার কথা মুখে বললেও বাস্তবে তা চায়নি। এই আলোচনার মাধ্যমে সময়ক্ষেপণ করে ইসরাইল এক দিকে পশ্চিমতীর ও পূর্ব জেরুসালেমে ইহুদি বসতি সম্প্রসারণ করেছে অন্য দিকে ফিলিস্তিনিদের যে প্রতিরোধ চেতনা, সেটাকে ভোঁতা করে দিতে চেয়েছে। ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ সংগ্রামের মূল ধারা ফাতাহ আন্দোলন সে চেতনা অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছে। তারা ইসরাইলের ছাড়ের মাধ্যমে একটি রাষ্ট্রসত্তা পাওয়ার আশায় আশায় ২০ বছর কাটিয়ে দিয়েছে। সর্বশেষ শান্তি আলোচনা ভেঙে পড়ার পর সে আশায় আর আস্থা থাকেনি। ফাতাহ নেতা মাহমুদ আব্বাসের সামনে এই ব্যর্থতার পর প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকেনি। আর হামাসও চেয়েছে ফিলিস্তিনে ঐক্যের সরকার গঠন করে গাজাকে অবরোধমুক্ত করা গেলে দুঃসহ অবস্থা থেকে সাময়িকভাবে হলেও নিষ্কৃতি মিলতে পারে; কিন্তু নেতানিয়াহুর যে লক্ষ্যের কথা ইজহাক লাওর উল্লেখ করেছেন সেটি অর্জন করতে তিনিই ফিলিস্তিনিদের ঐক্যের সরকার ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য গাজায় বেপরোয়া আগ্রাসন চালিয়েছেন। হামাসের মূল নেতা খালেদ মিশালের বক্তব্যেও এটি স্পষ্ট হয়েছে।
ইসরাইলের জন্য এই সময়টা নানা দিক থেকে ছিল অনুকূল। আরবের অন্যতম পরাশক্তি সৌদি আরব ও ইসরাইল যৌথভাবে মিসরে মুরসির সরকারকে পতন ঘটিয়ে সিসির সেনা সমর্থিত সরকারকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। গাজায় আগ্রাসনে এ দুটি দেশের কেউই ইসরাইলের সত্যিকার বিরোধিতা করার কথা নয়। ফিলিস্তিনি সাংবাদিক আবদেল বারি আতওয়ানের লেখায় সেরকম ইঙ্গিতই পাওয়া যায়। বলা হয়েছে হামাসকে দমন করার জন্য তারা এক সপ্তাহ আগ্রাসনের সময় দিয়েছিল ইসরাইলকে। সেই সময়ে কিছু করতে না পারলে সময় দেয়া হয় আরো এক সপ্তাহ; কিন্তু তাতেও সফল না হওয়ায় যুদ্ধবিরতির জন্য চেষ্টা জোরালো করা হয়েছে।
ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ সংগ্রামকে গুঁড়িয়ে দেয়ার যে চেষ্টার অংশ হিসেবে গাজায় হাজার হাজার নিরীহ নারী-পুরুষ-শিশুকে হত্যা করেছে সেটি কার্যত সফল হবে না। ইসরাইল সর্বশেষ শান্তি আলোচনা ভেঙে দিয়ে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় উদারপন্থীদের স্বপ্নকে কার্যত নিঃশেষ করে দিয়েছে। এখন তাদের সামনে আলোচনার মাধ্যমে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কোনো সম্ভাবনা আর নেই। ফলে তাদের সামনে পথ রয়েছে একটি, সেটি হলো প্রতিরোধের পথ। ইরানি নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি সেই প্রতিরোধের পথে পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিদেরও আসতে আহ্বান জানিয়েছেন। ফিলিস্তিনিদের ঐক্যবদ্ধ সরকার হলে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ রুদ্ধ হওয়ার পর সেই প্রতিরোধের পথেই আবার ফিলিস্তিনিরা এগোতে শুরু করবে সেই আতঙ্ক ইসরাইলকে বেপরোয়া করেছে; কিন্তু এই সংগ্রামে ইসরাইলের পক্ষে জেতা সহজ নয়। যদিও তারা সিসির মতো মুসলিম শাসকদের পাশে পেয়ে যেতে পারে।
এবারের গাজা আগ্রাসনে ফিলিস্তিনে অনেক রক্তক্ষয় হয়েছে কিন্তু ইরানের সাথে হামাসের যে দূরত্ব সিরিয়াকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছিল তা অনেকখানি সহজ হয়েছে। হিজবুল্লাহ আবারো হামাসের পাশে দাঁড়ানোর কথা বলেছে। সৌদি আরব ও মিসর ইসরাইলি স্বার্থের পক্ষে ভূমিকা রাখলেও ইসলামি আদর্শবাদীদের নির্মূল তারা করতে পারবে না। ইসরাইল আশা করেনি গাজার যুদ্ধে তাদের সেনা হারানোর সংখ্যা এভাবে বাড়বে। হামাসের দাবি অনুসারে এ সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়েছে। ইসরাইল ৫৩ জনের কথা স্বীকারই করে নিয়েছে। এ ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ার পর ইসরাইল ২০০৬ সালে লেবানন থেকে আগ্রাসন গুটিয়ে নিয়েছিল। গাজাকে নিরস্ত্রীকরণের যে লক্ষ্যের কথা বলে ইসরাইল সেখানে হামলে পড়েছিল সে লক্ষ্য বাদ রেখেই তাদের যুদ্ধ বিরতিতে যেতে হবে শেষ পর্যন্ত।
আর আমেরিকা বা ইসরাইলের পশ্চিমা মিত্ররা চাইলে গাজা বা পশ্চিম তীরকে পদানত করে রাখতে পারবেন না। তারা নারী ও শিশু হত্যা করতে পারেন; কিন্তু এ হত্যার মধ্য দিয়ে যে প্রতিরোধ তৈরি হচ্ছে সেই শক্তি হয়ে উঠছে অজেয়। আর অতীতে মিসর সিরিয়া জর্দান বাহিনীকে পরাজিত করা যতটা সহজ হয়েছিল ততটা সহজভাবে ইসরাইল পারছে না হামাস বা হিজবুল্লাহর মতো শক্তিকে পদানত করতে। এ বাস্তবতার কারণে নেতানিয়াহু যে বৃহত্তর ইসরাইল প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে স্বপ্ন দেখছেন সেটি বাস্তবায়ন তার পক্ষে সম্ভব হবে না। আরবের ওপর এক সময় এই অঞ্চলের শাসকদের যে নিয়ন্ত্রণ ছিল তা ক্রমেই শিথিল হয়ে পড়ছে। এ কারণে মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতিকে যারা গভীর থেকে দেখছেন তারা ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্বিচার হত্যাযজ্ঞের মধ্যেও বিজয় দেখতে পাচ্ছেন। প্রখ্যাত ফিলিস্তিনি সাংবাদিক আবদেল বারি আতওয়ানের বক্তব্য এ ক্ষেত্রে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। তার কথাটা এরকম, ‘হ্যাঁ, আমরা গাজা উপত্যকায় আমাদের ছেলেমেয়ে, ভাইবোন হারিয়েছি, হাজার হাজার লোক আহত হয়েছে, আরো হাজার হাজার লোক তাদের বাড়িঘর খুইয়েছে, লাখো লোক বাস্তুচ্যুত হয়েছে; কিন্তু তারপরও সম্মান ও মর্যাদা রার লড়াইয়ে অবতীর্ণ যোদ্ধাদের হাতে ইসরাইলি সৈন্যদের হতাহত হওয়া তথা ইসরাইলি সৈন্যদের পর্যুদস্ত হওয়ার ফলে ইসরাইলিদের মনে যে ভয় ঢুকেছে তা ফিলিস্তিনিদের তি সহনীয় করে তুলেছে। গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনে সাতটি সন্তান ও স্বামী হারানো ফিলিস্তিনি নারীটির কথা যে শুনেছেন; তার ফুসফুসের ঠিক ওপরের আর্তনাদ যারা শুনেছেন তারাই গাজার হৃদয়ের কথা শুনেছেন। তিনি তাকে মুক্ত করার জন্য আরব দেশগুলো বা তাদের সেনাবাহিনীর দরকার নেই বলে জানিয়েছেন। আরব চ্যানেলে আমি তার সাাৎকারটি সরাসরি শুনেছি। শুজাইয়াহ এলাকার ধ্বংসস্তূপ থেকে এই নতুন আদর্শই জেগে উঠেছে। পূর্ব গাজা সিটির নতুন বীর তারাই।

মাসুম খলিলী


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads