বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই, ২০১৪

সুষমার সফর ও আওয়ামী লীগের গন্তব্য


॥ এক ॥ বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার কবর রচনা করে ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাফন ঘটিয়ে আওয়ামী লীগ তার পেশী শক্তির বলে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে ৫ জানুয়ারি তামাশার নির্বাচনের মাধ্যমে জোরপূর্বক ক্ষমতা দখল করেছে। এ নির্বাচনে বিরোধী দলকে অংশগ্রহণ করতে দেয়া হয়নি। জাতিসংঘসহ বিশ্বসম্প্রদায়ের মতামত অগ্রাহ্য করে আওয়ামী লীগ নির্বাচনের নামে প্রহসনের আয়োজন করে। ১৫৩ টি আসনে নির্বাচন ছাড়াই প্রার্থী নির্বাচিত ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ বিশ্ব ইতিহাসে কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছে। নির্বাচনের নামে এত বড় প্রতারণা ও জনগণের ন্যায্য ভোটাধিকার কেড়ে নেয়ার ঘটনা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। শতকরা ৫ ভাগ ভোটারও ভোট কেন্দ্রে ভোট দিতে যায়নি। জনগণের অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে আওয়ামী লীগ কেন এই ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করার অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলো তা জনগণের নিকট এক বিরাট জিজ্ঞাসা।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের ক্ষমতাসীন দল কংগ্রেসের সক্রিয় হস্তক্ষেপ ও কূটনৈতিক সীমা লংঘন করে হাসিনাকে পুনরায় ক্ষমতায় আনার নীতি দেশে-বিদেশে সবাই অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছে। কংগ্রেসের নিকট বাংলাদেশের জনগণ নয়, আওয়ামী লীগই ছিল গুরুত্বপূর্ণ এবং পছন্দনীয়। বাংলাদেশের জনগণ যাকেই ভোট দিতে চাক, নিজেদের প্রতিনিধি মনে করতে চাক সেগুলোর ব্যাপারে কংগ্রেসের কোন গুরুত্ব ছিল না। কংগ্রেসের পরিকল্পনা ছিল হাসিনাকে পুনরায় ক্ষমতায় আনা। নির্বাচনের ঠিক আগে ডিসেম্বর মাসে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং বাংলাদেশে এসে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় আনার প্রকাশ্য তৎপরতা চালিয়েছিলেন। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ.এম এরশাদকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য ভারত প্রকাশ্য চাপ সৃষ্টি করেছিল। বিএনপিকেও নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছিল। বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ভারতের পররাষ্ট্র সচিব আমাদেরও প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু পারেন নি। কেন নির্বাচনে যেতে পারবো না তা আমরা তাকে বলেছিলাম।’ ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের এ ভূমিকায় স্পষ্ট বোঝা যায় তাদের আঁকা ছকেই আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতা দখল করেছে। একটি দলের সাথে ভারতের শাসক দল কংগ্রেসের এ সখ্যতা বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষকে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে।
এর মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই ভারতের নির্বাচনে কংগ্রেস দশ ভাগেরও কম আসন পেয়ে নিদারুণ ভরাডুবি বরণ করেছে। পক্ষান্তরে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে মোদি ভারতের মত বিশাল দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। ভারতের ৬৭ বছরের ইতিহাসে ৫৫ বছর দেশ শাসন করেছে কংগ্রেস। অথচ সেই কংগ্রেস মাত্র ৪৪ টি আসন পেয়ে ভারতের আঞ্চলিক দলে পরিণত হয়েছে। ভারতের নির্বাচনের এ ফলাফল ও মোদির সরকার গঠন পাক-ভারত উপমহাদেশসহ বিশ্ব রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
নতুন সরকার গঠিত হওয়ার পরেই নবনির্বাচিত সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের বাংলাদেশ সফরটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্যপূর্ণ। এই সফরে সুষমা যথেষ্ট হোমওয়ার্ক করে এসেছিলেন। তার ছাপ তিনি সব জায়গায় রেখে গিয়েছেন। সুষমার সফরকালে আয়োজিত এক সেমিনারে অংশ নিয়ে তিনি যে লিখিত বক্তব্য দিয়েছেন, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে তা গুরুত্বের সাথে প্রকাশ করা হয়। তিনি তার বক্তব্যে বলেছেন, ‘আমরা বুঝতে পেরেছি ভারতের (অর্থনৈতিক) বিকাশ টিকে থাকার মত স্থায়ী ও সম্পূর্ণ হতে পারে না, যদি সংলগ্ন পড়শিদের সাথে কার্যকর সক্রিয় পার্টনারের সম্পর্ক আমরা তৈরি করতে না পারি। তাই আমরা আমাদের বিকাশের লক্ষ্যাভিমুখে পড়শিদের সাথে আরো ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে আমাদের শক্তি ব্যয় করবো। এই অঞ্চলে এমন সুযোগ সুবিধা আর দায়িত্ববান সমৃদ্ধির চক্র তৈরি করতে নিজেরাই আগ বাড়িয়ে বাড়তি পথে হাটব। বাণিজ্য, বিনিয়োগ, যাতায়াত, অবকাঠামোগত সক্ষমতা ও এক পরিবেশ সহায়ক চর্চা তৈরির মাধ্যমে ও উপায়ে আমাদের অর্থনীতিগুলোকে পারস্পারিক পরিপূরক ও আত্মনির্ভরশীল করার লক্ষ্যে আমরা জোর দেব। যা এই অঞ্চলে সবার সমান বিকাশ এগিয়ে নেবে।’
সুষমা স্বরাজের এই বক্তব্যটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই বক্তব্যের এক অন্তর্নিহিত তাৎপর্য রয়েছে। এ তাৎপর্য বুঝতে হলে আমাদের মনে রাখতে হবে-
১। গ্লোবাল অর্থনীতি এখন এশিয়ামুখী।
২। চীন ও ভারতকে কেন্দ্র করেই এশিয়ায় গ্লোবাল অর্থনীতি আবর্তিত হবে।
৩। চীন ও ভারতের মধ্যে অর্থনৈতিক সক্ষমতার পার্থক্য আছে। আর এ দেশ দুটোর ঠিক মাঝখানেই বাংলাদেশের অবস্থান। সুতরাং সাম্য এবং ভারসাম্য তৈরিতে বাংলাদেশের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হবে।
৪। বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমার মিলিয়ে যে অর্থনৈতিক জোট BCIM-এর লক্ষ্য প্রত্যেকের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সুষম বিকাশ। BCIM-অঞ্চল মূলত চীন ও ভারত উভয়েরই ল্যান্ডলকড্ পূর্বাঞ্চল। যার অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে সরাসরি সড়ক রাস্তাঘাটের মাধ্যমে গভীর সমুদ্রবন্দর পর্যন্ত যোগাযোগের দুয়ার খোলার উপায় BCIM জোট। ফলে তা এ অবরুদ্ধ অঞ্চলগুলোতেও সমান বিকাশের উপায়। আর এর মুক্তি ঘটবে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের ভূমির উপর দিয়ে এবং বাংলাদেশে নির্মিতব্য গভীর সমুদ্র বন্দরের মাধ্যমে। সুতরাং ‘ভারতের বিকাশ পড়শিদের উপর নির্ভরশীল আর স্থায়ী ও সম্পূর্ণ হওয়ার উপায়’-কথাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সুষমা বা মোদি এ অঞ্চলের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে গভীরতা উপলব্ধি করেই তাদের পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণ ও বাস্তবায়নে সচেষ্ট হবে বলেই সুষমা সরাজের সফরে প্রতীয়মান হয়েছে।
কংগ্রেস তাদের আজ্ঞাবহ সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ হাতিয়ে নেয়ার যে কৌশলী ভূমিকা পালন করেছে তা প্রতিবেশী দেশ সমূহের উপর, বিশেষ করে বাংলাদেশের উপর এক নগ্ন হস্তক্ষেপ ছাড়া আর কিছু নয়। ভারত আওয়ামী সরকারের নিকট থেকে ট্রানজিট সুবিধা আদায়ের জন্য অস্থির ছিল। কিন্তু সে ট্রানজিট রুট তৈরি করার জন্য যে বিশাল অংকের অর্থ প্রয়োজন তা কিভাবে যোগান হবে সেটা কখনো ভেবে দেখেনি। ৫০০ কিলোমিটার ভারী রাস্তা নির্মাণে যে বিপুল অর্থ প্রয়োজন তা ভারতের একার পক্ষে যোগান দেয়া সম্ভব নয়। BCIM অঞ্চলের অর্থনেতিক বিকাশের লক্ষ্যে সকলের অংশগ্রহণ জরুরি। মোদি সরকার এটা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে।
সুষমা তার বক্তব্যে বলেছেন, ‘এক সুস্থির, সুরক্ষিত ও সমৃদ্ধ দক্ষিণ এশিয়া দেখার আমাদের স্বপ্নের বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ এক সামগ্রিক ও সমমর্যাদার পার্টনার। এ সম্পর্ক তৈরি করা মৌলিকভাবে জরুরি। আমাদের ইতিহাস ও ভূগোল আমাদের একত্রে বসবাসের ভাগ্য ঠিক করে দিয়েছে। এটা কি করে করবো তা আমাদেরই হাতে, একান্তই আমাদের হাতে।’ এখানে ‘সামগ্রিক’ ও ‘সমমর্যাদার পার্টনার’ শব্দ দুটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
কংগ্রেস মনে করেছিল, উত্তর পূর্ব ভারতের ৭ রাজ্যের বিদ্রোহ সমস্যা শুধুই ভারতের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। ওদের দমন করে বাংলাদেশের শিখন্ডি হাসিনার ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত করার ভেতরেই ৭ রাজ্য সমস্যার সমাধান। কংগ্রেসের এই দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে মোদি সরকারের। মোদির চোখে ভারতের পিছিয়ে পড়া রাজ্যগুলোর সমস্যার সমাধান বল প্রয়োগ বা নিরাপত্তা নয়। রিসোর্স অ্যালোকেশন অর্থাৎ সম্পদের বরাদ্দ ও বিনিয়োগ বাড়াতে পারলেই এর একমাত্র সমাধান।
ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে কোন পরিবর্তন আসবে কিনা তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। যে কোন দেশের পররাষ্ট্রনীতি তৈরি হয় জাতীয় স্বার্থের উপর ভিত্তি করে। জাতীয় স্বার্থ হঠাৎ করেই বদলে যায় না। তাই কোন দেশের মন্ত্রিসভার পরিবর্তন হলেও পররাষ্ট্র নীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে দেখা যায় না। ভারত অনুসরণ করছে ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি পদ্ধতি। এতে সরকার বদলায় কিন্তু প্রশাসন বদলায় না।
ভারত সবসময়ই চায় বাংলাদেশে একটি ভারত নির্ভর সরকার প্রতিষ্ঠিত থাকুক। আর বাংলাদেশ হয়ে থাকুক ভারতের একটি উপগ্রহ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভারতের এ মূল পররাষ্ট্রনীতির ধারা পূর্বেও ছিল এখনো আছে। ভারতের সব সরকারই চাইবে একই ধারা অনুসরণ করতে। না হলে ভারতের জাতীয় স্বার্থে আঘাত আসতে পারে।
ভারতের বাংলাদেশ নীতি কি হবে সেটা স্পষ্ট করে কোথাও ব্যক্ত করা হয়নি। তবে বিভিন্ন বক্তব্য সামনে আনলে আঁচ করা যায় ভবিষ্যৎ নিয়ে। ভারতের হাই কমিশনার পঙ্কজ শরন ভারতের নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের আগে অন্তত দু’বার প্রকাশ্যে উচ্চারণ করেছিলেন ভারতের বাংলাদেশ নীতি অপরিবর্তিত থাকবে বলে। কিন্তু মোদির বিপুল বিজয়ের পর পঙ্কজ ঠিক সময় মতো তার বক্তব্য পরিবর্তন করেন। ১৩ জুন বিডি নিউজ টোয়েন্টিফোরে তার বক্তব্য ছাপা হয়েছিল। তিনি বলেছেন, ‘কিন্তু আমি আগে যে বক্তব্য দিয়েছিলাম তার সাথে আজকের সময়ের অনেক পার্থক্য আছে। সবচেয়ে বড় তফাৎ হলো আমাদের এখন নতুন একটি সরকার আছে।’ পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা বলেছিলেন, ‘সাংবিধানিক প্রয়োজনেই নির্বাচন হয়েছে।’
সুষমা বাংলাদেশ সফরে আসার আগে বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের নীতির কিঞ্চিৎ সাব্যস্ত করে সেই বক্তব্যই দিয়েছেন, ‘সরকার সরকারের সাথে কাজ করে। আর সেই সাথে তারা বাংলাদেশের জনগণের সাথে কাজ করতে চান।’ অর্থাৎ সুনির্দিষ্ট হাসিনা তাদের আগ্রহের বিষয় নয়, এ কথাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রকাশ করলেন।
সুষমা তার লিখিত বক্তব্যে বলেছেন- “আমি জানি এ বছরের এপ্রিল-মে মাসে ভারতীয় নির্বাচনের গতিপ্রকৃতি বাংলাদেশে খুব মনোযোগের সাথে অসুসরণ করা হয়েছে। অনেকে আমাদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন এজন্য আমি ধন্যবাদ জানাই। এই নির্বাচন কেবল দুনিয়ার এক বৃহত্তম গণতান্ত্রিক চর্চা ছিল না। এটা একই সাথে ভারতের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিমাপে এক মোড় ঘুরানোর মত ঘটনা ছিল। এটা ছিল আশা-ভরসার নির্বাচন। আমি আপনাদের সামনে সরকারের এক প্রতিনিধি হিসেবে দাঁড়িয়ে আছি, যারা একটা নির্বাচন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে, যেটা বিরাট এক ত্রিশ বছরের গ্যাপ, এবারই ভারতের জনগণ কোন একক রাজনৈতিক দলের পাশে পরিষ্কার রায় দিয়েছে। আমার সরকারের বিদেশ নীতি হবে সব দেশের সাথে শান্তিপূর্ণ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে উন্নীত করার নীতিতে অসংকীর্ণ করে দেখা (এনলাইটেড) জাতীয় নিজ স্বার্থ অনুসরণ করবে। অভিজ্ঞতা দিয়ে আমরা বুঝি গণতন্ত্রের জন্য শক্তিশালী (রাষ্ট্রীয়) প্রতিষ্ঠান তৈরি আর মত ভিন্নতাকে সহ্য করা, সাথে নেয়ার ও সম্মান করার সংস্কৃতি দরকার হয়। মত ভিন্নতাকে সামলানোর এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে তা মীমাংসার সক্ষমতার ভেতর দিয়ে গণতন্ত্রের শক্তি প্রমাণ করা যায়। আমরা কিছু সার্বজনীন মূল্যবোধ ধারণ করি, যেখানে সহিংসতার কোন জায়গা নেই। এ ব্যাপারে যদি চাওয়া হয়, আমরা আমাদের চর্চার ভালো মাপের উপায় ও আমাদের অভিজ্ঞতাগুলো অন্যদের সাথে আনন্দে শেয়ার করতে পারি।”
সুষমার বক্তব্যে বুঝা যায় স্পষ্টতই পরোক্ষে হাসিনাকে নিজেদের মনোভাব বুঝিয়ে দেয়া যে, তারা গণতন্ত্র বা জনগণের প্রতিনিধিত্বের মত কোন বিষয়কে কিভাবে দেখে এবং হাসিনা তেমন প্রতিনিধি নয়। সেটাই মনে করিয়ে দেয়া। সুষমার দলের মত ত্রিশ বছর অপেক্ষা করে হলেও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নির্বাচন কমিশন ধরনের প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করে দেয়া উচিত নয়। জবরদস্তি করে নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করা উচিত নয়।
সুষমার বক্তব্যের শেষ অংশ ‘মতভিন্নতাকে জায়গা করে দেয়া, এক পাত্রে ধরা, সহ্য করা’- কেন গুরুত্বপূর্ণ সে প্রসঙ্গে এটা সুষমার সবক। এখানে বড় বিষয় হলো হাসিনার আওয়ামী লীগ নিজেদের স্যেকুলার রাজনৈতিক শক্তি বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করে, বিপরীতে বিজেপি সম্পর্কে তাদের রিডিং হলো সাম্প্রদায়িক দল; কিন্তু সেই বিজেপি সরকারের নিকট থেকেই হাসিনাকে জনগণের প্রতিনিধিত্বের অর্থ কি, গণতন্ত্রের কোর ভ্যালু মতভিন্নতাকে কিভাবে দেখতে হয় এর সবক শুনতে হলো।
সামগ্রিকভাবে দেখলে, কংগ্রেসের বাংলাদেশ নীতির বিপদ ও আত্মঘাতী দিক মোদির বিজেপি উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। ভারতের নিকট স্পষ্ট যে, ১৬ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশ। এ বিপুল জনগোষ্ঠীকে বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে শুধুমাত্র একটি দলকে বন্ধু বানিয়ে তাদের স্বার্থ হাসিল করা সম্ভব নয়। জনগণ সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুললে যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হবে তা সামাল দেয়া কারও পক্ষে সম্ভব নয়। যে জাতি পাকিস্তান থেকে পৃথক হয়েছে যুদ্ধ করে, তারা ভারতের অনুগত হয়ে থাকার কথা নয়। তাই ভারতের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য এদেশের জনগণের সাথে বন্ধুত্ব প্রয়োজন। সুষমা জনগণের সাথে বন্ধুত্ব তৈরির কথা বলে ইংগিত দিয়েছেন যে, তারা সব দলের সাথেই সম্পর্ক রাখতে চান। দলের মাধ্যমেই জনগণ সংঘবদ্ধ হয়। সকলের সাথে বন্ধুত্বের মাধ্যমে জনগণের সাথে বন্ধুত্ব তৈরি হতে পারে। ভারতের এ নীতির মূলেও তাদের স্বার্থ প্রাধান্য পাবে। সে ক্ষেত্রে তাদের পছন্দের দল হিসেবে আওয়ামী লীগ যে প্রাধান্য পাবে তাও স্পষ্ট। তাদের সে উপলব্ধি সুষমার ওই সেমিনারের লিখিত বক্তব্যে পরিষ্কার হয়েছে। সুষমার সফরে হাসিনা ভারতের ‘নিরাপত্তা স্বার্থ’ রক্ষার্থে তিনি কি করেছেন তার বর্ণনা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু হসিনা, মোদির চিন্তা-ভাবনার গতিপ্রকৃতি স্টাডি করেন নি।
ভারতের কংগ্রেস শেখ হাসিনাকে তাদের বিশ্বস্ত এবং ভারতের জন্য সম্পদ হিসেবে মনে করতো। কিন্তু নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের শুরুতেই উপলব্ধি করতে পেরেছে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষকে বাইরে রেখে শেখ হাসিনাকে সম্পদ ভাবার কোন সুযোগ নেই। বরং শেখ হাসিনা ভারতের জন্য দায় হতে পারে।
হাসিনা দেশের জনগণের ইচ্ছা, পছন্দকে বিবেচনায় না নিয়ে ভারতের কংগ্রেসের ইচ্ছা, পছন্দ অনুযায়ী চলতে গিয়ে নিজেই নিজের দলকে করেছে বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত করেছে নিজ সরকারকে এবং বিপন্ন করেছে মানবতা।
॥ দুই ॥
আওয়ামী লীগ কার্যত বিরোধীদল বিহীন সংসদ গঠন করে একদলীয় সরকার পরিচালনার ব্যবস্থা করেছে। আওয়ামী লীগের ৬৫ বছরের রাজনীতিতে গণতন্ত্র, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের বাগাড়ম্বর ছিল, বিগত নির্বাচনের মাধ্যমে তার পরিসমাপ্তি ঘটেছে। আওয়ামী লীগের অপরিণামদর্শী কার্যক্রম ও সন্ত্রাসী তা-বতা তাদের গণতান্ত্রিক চরিত্রের মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছে। রাষ্ট্রশক্তিকে ব্যবহার করে জনগণের উপর জুলুম, নির্যাতন পরিচালনা করে আওয়ামী লীগ ক্রমেই গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগ আজ বিপর্যস্ত।
বিগত ৫ বছর মেয়াদ এবং প্রহসনের নির্বাচনের পর ৭ মাস অতিবাহিত হচ্ছে, এর মধ্যে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র পরিচালনার কোন সফলতা দেখাতে পারেনি। তেল-গ্যাস-পানি-বিদ্যুৎ সমস্যা, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, সীমাহীন দুর্নীতি, মন্ত্রী-এমপিদের অর্থ কেলেঙ্কারি, তীব্র বেকারত্ব, আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতি দেশে এক ভয়াবহ নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী পেশাদরিত্বের পরিবর্তে দলীয় আজ্ঞাবাহী বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। সরকারের মন্ত্রী-এমপিগণ দেশটাকে তাদের দলের সম্পত্তি হিসেবে ভাবতে শুরু করেছে। জনগণের অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে প্রহসনের নির্বাচনকে তারা কোন আমলে নিচ্ছেন না। মন্ত্রী, এমপিগণ জোর করে ৫ বছর ক্ষমতায় থাকার আস্ফালন করছেন। প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রী পরিষদের সভায় পূর্ণ ৫ বছর মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। স্বয়ং রাষ্ট্রপতি দলীয় নেতার মত কথা বলছেন। রাষ্ট্রপতি দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকটের সমাধানে উদ্যোগ নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি জাতিসংঘ মহাসচিবের সাথে সাক্ষাৎকালে যে বক্তব্য রেখেছেন তা জাতিকে হতাশ করেছে। বিশ্ববাসীর নিকট প্রতীয়মান হয়েছে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক সংকটের সমাধান চায় না। তারা গণতন্ত্রের ধার ধারে না। সর্বত্রই দলীয়করণের মাধ্যমে তারা তাদের আধিপত্য বজায় রাখতে চায়। তাদের দলীয়করণ রাষ্ট্রের প্রতিটি কাঠামোকে ধ্বংস করে দিয়েছে। মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল বিচার বিভাগ জনগণের আস্থা হারিয়েছে।
রাষ্ট্র পরিচালনার মূলমন্ত্র সংবিধানকে তারা ক্ষতবিক্ষত করেছে। সংবিধানে বর্ণিত জনগণের চলাফেরা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও বাকস্বাধীনতাকে হরণ করা হয়েছে। নির্বিচারে গুলী করে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। মানুষের জান-মাল, ইজ্জত-আবরুর কোন নিরাপত্তা নেই। অহরহ সংঘটিত হচ্ছে মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা। আওয়ামী লীগের হিং¯্র ছোবলে মানবতা আজ বিপন্ন।
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিচার বহির্ভূত হত্যা বন্ধের কথা বলেছিল। কিন্তু তারা কথা রাখেনি। বরং বিচার বহির্ভূত হত্যা ভয়াবহ রূপ লাভ করেছে। সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, লক্ষ্মীপুর ও নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিচার বহির্ভূত নির্মম হত্যাকা- কত মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে, কত পরিবারকে অসহায় করেছে তা দেশবাসীর অজানা নয়। প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ছোবলে জীবন দিতে হচ্ছে। বিচার বহির্ভূত প্রকৃত হত্যা সংখ্যা কয়েক হাজার।
আওয়ামী লীগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধে নামার ঘোষণা দিয়েছিল। দুর্নীতি এখন ভয়াবহ রূপ লাভ করেছে। আওয়াম লীগ হত্যা, গুম, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। আওয়ামী লীগ বলেছিল মন্ত্রী সাংসদদের সম্পদের হিসাব দেবে। কেউ দেননি। পাঁচ বছরে কারও কারও সম্পদ বেড়েছে শত গুণ। আওয়ামী লীগ বলেছিল সুশাসন দেবে। এখন আওয়ামী লীগের সুশাসন এমন পর্যায়ে পৌছেছে যে, দলীয় কর্মীরা দলীয় কর্মীদের খুন করছে। আওয়ামী লীগ নেতার বাড়ি যুবলীগ নেতা দখল করে নিচ্ছে। দেশের প্রায় প্রতিটি স্থানে সংসদ সদস্য বনাম মন্ত্রী, সংসদ সদস্য বনাম উপজেলা চেয়ারম্যানের ঝগড়া চলছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটছে। আওয়ামী লীগ এসব সন্ত্রাসী কর্মকা-ে উৎসাহিত করছে। প্রবল জনমতের চাপে বিশ্বজিৎ হত্যার বিচার হলেও বেশিরভাগ আসামী পালাতক।
আওয়ামী লীগের ৬৫ তম প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে ২৪ জুন কয়েকটি পত্রিকায় প্রধানমন্ত্রী ও দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনার ‘আওয়ামী লীগই পারে, আওয়ামী লীগই পারবে’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। এ লেখায় তিনি আওয়ামী লীগের গৌরবোজ্জ্বল অতীতের বিবরণ দিয়েছেন। কিন্ত অতীত গৌরব নিয়ে কোন দল সামনে এগোতে পারে না। পারলে নির্বাচনে পাকিস্তানে পিপলস পার্টি ও ভারতে কংগ্রেসের এমন শোচনীয় পরাজয় ঘটতো না। ভারতের ৬৭ বছরের ইতিহাসে ৫৫ বছর দেশ শাসন করেছে কংগ্রেস। কিন্তু সাম্প্রতিক নির্বাচনে তাদের চরম ভরাডুবি হয়েছে।
আওয়ামী লীগ মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্বদানকারী দল হিসেবে যে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল আজ তাদের বর্বরোচিত স্বৈরশাসনে অতীতের সে ইতিহাস কলঙ্কিত। গণতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা হীন একটি দল হিসেবে আওয়ামী লীগের পরিণতি মুসলিম লীগের পথ ধরে এগিয়ে চলছে। মুসলিম লীগও পাকিস্তানের স্বাধীনতার নেতৃত্ব দাবি করতো। কিন্তু তাদের দখলদারি মানসিকতার কারণে জনগণ তাদের ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার দাপটে পাকিস্তানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা শহীদ সোহরাওয়ার্দিকে ভারতের কুকুর বলতেও তাদের বাধেনি। সেই সোহরাওয়ার্দিই আওয়ামী লীগকে শিখিয়ে গিয়েছিলেন যে, রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে জনগণের কথাই শেষ কথা। ৫ জানুয়ারির প্রহসনের নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচনে জোর-জবরদস্তি, কেন্দ্র দখল, জালভোট প্রদানের মহোৎসব করে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রকে হত্যা করেছে। আওয়ামী লীগ গণতন্ত্র হত্যাকারী দল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তারা জনগণের সামনে যে সব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তার একটিও পূরণ করতে পারেনি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রতিহিংসার যে রাজনীতি দেশে চালু করেছেন তাতে দেশের প্রতিটি নাগরিক আজ দগ্ধীভূত। আওয়ামী শাসনকাল ইতহাসের পাতায় ব্যর্থতার অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ও সরকারের মন্ত্রী-এমপিগণ যত জোর গলায়ই কথা বলুক না কেন, বাস্তবে জনগণের মাঝে তাদের কোন অবস্থান নেই। জনগণ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আজ বিক্ষুব্ধ। জনগণের পর দল থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে আওয়ামী লীগ নেতারা। ফলে সাংগঠনিক শক্তি নয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের ভরসা এখন সরকারী প্রশাসন। আওয়ামী লীগ জনমুখী কর্মসূচি দিয়ে মানুষকে দলের সাথে সম্পৃক্ত করতে পারেনি। বিভিন্ন কাজে দেশের অন্যতম প্রধান দলটিকে প্রশাসনের সহায়তা নিতে হচ্ছে। আওয়ামী লীগ জনমতের তোয়াক্কা না করে রাষ্ট্রযন্ত্রের জোরে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়। জনগনের ভোটের মোকাবেলার সাহস না দেখিয়ে আওয়ামী লীগ অত্যন্ত কৌশলে বিরোধী দলকে নির্বাচনের বাইরে রেখে ৫ জানুয়ারির প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে প্রমাণ করেছে তাদের অনুসৃত কোন নীতিই তাদের জনপ্রিয়তা অর্জনে সহায়ক হয়নি। জনভীতির কারনে জনবিচ্ছিন্ন একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্রে জড়িত হয়ে পড়েছে আওয়ামী লীগ। তাদের এই অসৎ মনোবৃত্তি থেকেই রাজনীতিতে প্রতিহিংসা, খুন, অপহরণ, গুম ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে। কিন্তু জনগণের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে কোন দলই টিকে থাকতে পারে নি, আওয়ামী লীগও পারবে না। আওয়ামী লীগের অগণতান্ত্রিক কর্মকা-, প্রতিহিংসার রাজনীতি ও ক্ষমতা কুক্ষিগত করার মনোবৃত্তি এবং জনগণের ওপর জুলুম, নির্যাতন পরিচালনা করে ক্রমেই গণবিচ্ছিন্ন দলে পরিণত হয়ে এক অজানা গন্তব্যে যাত্রা শুরু করেছে।
মতিউর রহমান আকন্দ 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads