পবিত্র মাহে রমযান শেষে পশ্চিম আকাশে ঈদের হেলালী চাঁদের হাসি ফুটে ওঠে। হাজারো দুঃখ কষ্ট সত্ত্বেও সর্বত্র খুশির জোয়ার বইতে দেখা যায়। প্রতিটি রোজাদার নতুন চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বাভাবিক জীবন ধারায় আত্মনিয়োগ করে। দীর্ঘ এক মাসের সাধনালব্ধ নতুন অনুভূতি ও নতুন চেতনা দ্বারা জীবন হয় মার্জিত। এক দিকে মহাস্রষ্টা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের মধ্য দিয়ে দুনিয়ার হাসানা (কল্যাণ) ও আখেরাতের হাসানাকে এভাবে নিশ্চিত করার মধ্য দিয়েই ইসলাম মানবতার সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত প্রয়াসী, কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, আমরা সবাই রোজা শেষের উৎসব আনন্দ কী সেভাবে পালন করছি? কেবল ঐ দিনই উত্তম খাদ্য খাবার, নতুন পোশাক পরিচ্ছদ পরিধান, দারিদ্র্য অসহায়দের মধ্যে ফিতরা, অন্নদান, সাদকা বণ্টন ও কোলাকুলির মধ্যেই আমরা একে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি। অথচ পৃথিবীর অপরাপর জাতিগোষ্ঠীর জাতীয় উৎসব আনন্দ দিবসের লক্ষ্য উদ্দেশ্যের ব্যতিক্রম মুসলমানদের ঈদের দিন পালনের লক্ষ্য উদ্দেশ্যটি আরও ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী। কারণ আত্মশুদ্ধির মাসব্যাপী প্রশিক্ষণের মূল উদ্দেশই হলো মানবজীবনের বিভিন্ন স্তরে আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ম বিধি লঙ্ঘনে সৃষ্ট অশান্তির আগুনে যে মানবসমাজ জ্বলছে এই প্রশিক্ষণ দ্বারা সেই আগুনকে নির্বাপিত করতে উদ্যোগী হতে হবে। মানুষ রমযানের প্রশিক্ষণ শেষ ব্যবহারিক জীবনের প্রতিটি কাজে আল্লাহর বিধানের অনুশীলন দ্বারা যাবতীয় অন্যায়-অবিচার অশান্তির মূলোৎপাটন করবে, যা গোটা সমাজকে অশান্তিময় করে তুলছে। কিন্তু মাত্র একটি দিনের আনুষ্ঠানিক খুশি উৎসব দ্বারাই আমরা আল্লাহ প্রদত্ত দিবসটি সমাপ্ত করে ফেলি। ঈদের প্রকৃত লক্ষ্যকে ধরে রাখলে বছরের প্রতিটি দিবসকেই আমরা ঈদের দিন হিসেবে পেতে পারি। কিন্তু তা না করতে পারাতে দিনটি আনুষ্ঠানিকতায় রূপান্তরিত হতে যাচ্ছে। কথাতো ছিল যেই জুলুম-অন্যায় দ্বারা অপরের অধিকার ক্ষুণœ হচ্ছে, যেই দুর্নীতির দ্বারা সমাজের রুই-কাতলের সুবিধা বৃদ্ধি পেলেও সিংহভাগ নাগরিক নিজের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে জীবনটি তাদের হররোজ রোজাতে পরিণত হচ্ছে। ঈদ উৎসব থেকে তাদের জীবনে আনন্দ উৎসব আনার সেই শিক্ষা নেয়। কিন্তু তা আমাদের হচ্ছে না। ফলে এটি আরও দশটি সম্প্রদায়ের জাতীয় উৎসবের মতোই হয়ে যাচ্ছে। ঈদুল ফিতরের সুদূরপ্রসারী শিক্ষা অনুযায়ী রমযান শেষের একটি দিনই কেবল সামজের গরিব দুঃখীদের সুখ-দুঃখের শরীক হলে চলবে না। সারা বছরই তাদের সুখে সুখী, তাদের দুঃখে দুঃখী থাকার সহমর্মিতা থাকতে হবে। এ জন্যে ন্যায়নীতি ভিত্তিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো সৃষ্টি করতে হবে।
জীবনের সকল কাজের জন্য মহাস্রষ্টার সমীপে জবাবদিহিতার সার্বক্ষণিক অনুভূতি মানবচিত্তে জাগ্রত ও স্থায়ী রাখার জন্যেই পৌনপুনিক ইবাদত করতে হয়। বছরে একবার রোজা পালনের প্রশিক্ষণ ও পরে ঈদ উৎসব ও সকল মুসলমান বিশেষ করে মুসলিম সমাজ নেতৃত্বকে একথাটিই প্রতিবছর তাগিদ দিয়ে যায়। ঈদ উপলক্ষে রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব কৃচ্ছ্রসাধনার এই মাস থেকে জাতিকে উপদেশ গ্রহণেরও আহ্বান জানান। কিন্তু তিক্ত হলেও না বলে উপায় নেই যে, এই আহ্বান পর্যন্তই সবকিছু সীমাবদ্ধ থাকে। এ জন্যে বাস্তব কোনো পদক্ষেপ গৃহীত হতে দেখা যায় না। অথচ ঈদের চেতনা আমাদের এমন সমাজ গড়ারই তাগিদ দেয়, যেখানে ধনী-গরিব, সাদা-কালো, আশরাফ, আতরাফ নির্বিশেষে সব মানুষের সুখময় ও নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তা বিদ্যমান থাকে। এদিক থেকে সামাজ ও রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের আত্মজিজ্ঞাসা থাকা উচিত। সমাজের সাধারণ মানুষ যারা দীর্ঘ একমাস আত্মশুদ্ধির প্রশিক্ষণ নিয়ে ঈদ উদযাপন করবেন, তারাও এ ব্যাপারে নিজেদের দায়িত্ব কর্তব্যের দিকটি অস্বীকার করতে পারবেন না। এদিক থেকে ঈদের মহান দর্শনের ভিত্তিতে আমাদের ব্যক্তি ও সমাজজীবনে কাক্সিক্ষত সুখ ও সমৃদ্ধি আনতে হলে সমাজের বিবেকবানদের কর্তব্য হলো, আমাদের সমাজ ও জাতীয় নেতৃত্বকে নিজেদের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
আমরা যেই মুহূর্তে ঈদ উদযাপন করতে যাচ্ছি ঠিক এক সময় স্বদেশে-বিদেশে পৃথিবীর বিভিন্ন ভূখ-ে মুসলমানদের জীবন অশান্তির অনলে দাউ দাউ করে জ্বলছে। মুসলিম সমাজের পারস্পরিক অনৈক্য এবং আল্লাহর রজ্জু পবিত্র কুরআনকে ঐক্যবদ্ধভাবে দৃঢ়হস্তে ধারণের অভাবেই মুসলিম উম্মাহর জীবন আজ এই দুর্বিষহ অবস্থার শিকার। ইসলামের আন্তর্জাতিক বৈরী শক্তি চাচ্ছে ইসলাম ও মুসলিম চেতনা বিশ্বাসকে পৃথিবী থেকে মুছে ফেলতে। এই উদ্দেশ্যে তারা প্রতিটি মুসলিম দেশে অতীত থেকে শিক্ষা-সংস্কৃতি রাজনীতি এমনকি ধর্মীয় গৌত্র মুসলমানদের মধ্যে দলাদলি অনৈক্য সৃষ্টি করে আসছে। এ জন্য সমাজের একশ্রেণীর লোককে অর্থ দিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতায় আনার প্রলোভন দেখিয়ে অন্যভাবে হাত করে ইসলামবিরোধী পরিবেশ সৃষ্টি করে। আজকাল এ জন্যে প্রচারমাধ্যমকে বেশি কাজে লাগায়। কারণ ইসলামপন্থীরা এ ব্যাপারে বেশি উদাসীন থাকে। ফলে এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তারা সমাজের সাধারণ মানুষের কাছে ইসলামপন্থীদের হেয়প্রতিপন্ন করে তদের বক্তব্যের প্রভাব বিনষ্ট করে তোলে। কাজেই ইসলামের দেশী-বিদেশী শত্রুদের হাত থেকে ইসলাম, মুসলমান, ইসলামী মূল্যবোধ এমনকি মুসলমানদের স্বাধীনতা রক্ষা করতে হলে এ জন্যে সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ আবশ্যক। একমাত্র ইসলামী ঐক্যশক্তি দ্বারাই এটা সম্ভব। আর মুসলিম চিত্তে ঐক্যের চেতনা জাগ্রত করার ত্যাগ ও আত্মশুদ্ধির মাসে ঐ উৎসবগ্রন্থ আল-কুরআনের অধিক চর্চার তাগিদ করা হয়েছে। তাই এই ঈদ উপলক্ষে গোটা মুসলিম উম্মাহকে ইসলাম ও নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থে পবিত্র কুরআনের আহ্বানের ভিত্তিতেই সকলে ঐক্যবদ্ধ হওয়া ও নেতাদের ঐক্যবদ্ধ করার নিজ নিজ পরিম-লে সচেষ্ট হওয়া সময়ের প্রধান দাবি বলে আমরা মনে করি। মোটকথা, যেই তাকওয়া তথা খোদাভীতিপূর্ণ জবাবদিহিতাপূর্ণ সাবধানী জীবনের অধিকারী হবার জন্য মহান আল্লাহ সিয়াম সাধনার প্রশিক্ষণ ও ঈদের ন্যায় তাৎপর্যপূর্ণ আনন্দের ব্যবস্থা করেছেন, মুসলিম চিত্তে সেই চেতনার আধিক্য সৃষ্টি হোক, দুনিয়া ও আখেরাতের হাসানা উভয়ই নিশ্চিত হবার মধ্য দিয়ে এই উম্মাহর সুখ-শান্তি ও বিনয় সূচিত হোক এটাই সময়ের একমাত্র দাবি।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন