সোমবার, ৭ জুলাই, ২০১৪

পরোপকারীর প্রতি অবিচার


পত্রিকান্তরে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে বলা হয়, এ কেমন ভাগ্য লিটনের? হায় হায় কোম্পানি ডেসটিনির খপ্পরে পড়ে অর্থকড়ি হারিয়ে নিঃস্ব লিটন শেষ পর্যন্ত জীবনও বিসর্জন দিলেন পরের জন্য। আর জীবনদানের পর জুটলো চরম নির্মমতা। দেশের আইন অনুযায়ী যে কেউ খুন হলে তার স্বজনদের অধিকার থাকে খুনিদের বিরুদ্ধে বিচার চাওয়ার। অথচ এমন একজন বীরের স্বজনদের সেই অধিকারও কেড়ে নিয়েছে পুলিশ। লিটন হত্যায় পুলিশ গত রোববার পর্যন্ত মামলা নেয়নি। পুলিশ শুধু ব্যস্ত সেই ফাতেমাকে নিয়ে। যে ফাতেমার জন্য অসহায় এক লিটনের জীবন চলে গেছে দুর্বৃত্তদের গুলীর আঘাতে। ফাতেমার একাধিক প্রেমের বলি হতে হয়েছে পরোপকারী লিটনকে। অথচ লিটন হত্যার তদন্তের ব্যাপারে পুলিশের কোনো মাথা ব্যথাই নেই।
লিয়াকত হোসেন লিটনের (৪৫) বাড়ি রংপুরের সুতিপাড়ায়। দুই ছেলের জনক তিনি। স্ত্রী মোর্শেদা স্কুল শিক্ষিকা। লিটন নিজেও স্কুল শিক্ষক ছিলেন। মায়ের নামে গড়ে তোলা নামাপাড়া লাইলি বেগম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করতেন তিনি। তাদের প্রচেষ্টায়ই ১৯৮৯ সালে স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। লিটনের বাবা নাজমুল হুদাও স্কুল শিক্ষক ছিলেন। শুরুতে স্কুলটি চলতো লিটনের পারিবারিক অর্থ ব্যয় করেই। স্কুলটি অর্থ সংকটে পড়লে এক বন্ধুকে দায়িত্ব দিয়ে অর্থ উপার্জনের জন্য লিটন চলে যান দুবাইয়ে। সেখান থেকে অর্থ উপার্জন করে এনে সে অর্থ দিয়েই স্কুল চালাতেন তিনি। দেশে ফিরে আবারও স্কুলে শিক্ষকতা করার এক পর্যায়ে এক আত্মীয়ের প্ররোচনায় ডেসটিনির সাথে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ডেসটিনিতে নিজের উপার্জিত ২০ লাখ টাকার মতো বিনিয়োগ করেন। এছাড়া আত্মীয়-স্বজন এবং প্রতিবেশী অনেকের টাকাও তিনি বিনিয়োগ করেন ডেসটিনিতে। এই ডেসটিনি নিঃস্ব করে দেয় লিটনকে। এক পর্যায়ে ডেসটিনি বন্ধ হয়ে গেলে মানুষের লাখ লাখ টাকার দেনার বোঝা নিয়ে আত্মগোপন করতে হয় লিটনকে। লিটন তার বসতবাড়ি, স্ত্রীর অলংকার, বাড়ির সব আসবাবপত্র বিক্রি করে মানুষের কিছু কিছু টাকা পরিশোধ করেন। পাওনাদারদের অত্যাচারে একসময় তাকে এলাকা ছেড়ে চলে আসতে হয়। চাকরি নেন উত্তরায়। সেখানে গত বৃহস্পতিবার রাতে আর্তচিৎকার শুনে ফাতেমাকে বাঁচাতে গিয়ে দুর্বৃত্তদের গুলীতে নিহত হতে হয় লিটনকে।
লিটন তো মজলুমকে বাঁচাতে গিয়ে দুর্বৃত্তদের গুলীতে বীরের মতো প্রাণ দিয়েছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, গুলীতে আহত লিটনের ভাগ্যে চিকিৎসা জোটেনি। এমনকি তার হত্যার ব্যাপারে খুনের মামলা পর্যন্ত নেয়নি থানা। নিহত লিটনের আত্মীয়রা কয়েকদিন ঘুরেও রোববার বিকাল পর্যন্ত থানায় মামলা করতে পারেননি। পুলিশ বলেছে, এ সংক্রান্ত অপহরণের মামলাটি হয়েছে। নতুন করে আর কোনো মামলার প্রয়োজন নেই। উল্লেখ্য যে, নিহতের স্বজনরা লাশ নিয়ে উত্তরা থানায় গেলে ওসি বলেছিলেন, লিটনের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পাওয়া উচিত। তার পরিবার যাতে সহায়তা পায় সে বিষয়টিও তিনি দেখবেন। লিটন যে সিকিউরিটি গার্ড কোম্পানিতে চাকরি করতেন তার মালিক বড় ধরনের ক্ষতিপূরণ দেয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন মালিক বলছেন, এক-দেড় হাজার টাকার বেশি দিতে পারবেন না। যে ফাতেমাকে বাঁচাতে গিয়ে লিটন প্রাণ দিলেন তার পরিবারের সদস্যরা লিটনের লাশটি পর্যন্ত দেখতে আসেনি। পুলিশও লিটনের আত্মীয়-স্বজনদের এড়িয়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে লিটনের পরিবার এখন হতাশার অন্ধকারে নিমজ্জিত। স্বয়ং ওসি লিটনের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পাওয়া উচিত বলে মন্তব্য করার পরও লিটন এখন এতো অবহেলার শিকার কেন? আমাদের প্রশাসনের কাছে লিটনের মতো আত্মত্যাগী বীরের কি কোনো মর্যাদা নেই? তার প্রতি রাষ্ট্রের কি কোনো দায়িত্ব নেই? লিটনের স্ত্রী এখন তার শিশু সন্তানদের নিয়ে কি করবেন, কিভাবে বেঁচে থাকবেন? গুনীজনরা বলে গেছেন, যে দেশে বীরের সম্মান হয় না, সেই দেশে বীর জন্মায় না। আমাদের সরকার ও সমাজ লিটনের হত্যার বিচার করে কিনা, তার পরিবারের প্রতি কোনো দায়িত্ব পালন করে কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads