বুধবার, ১৬ জুলাই, ২০১৪

সংসদীয় গণতন্ত্রের বস্ত্রহরণ ও আন্দোলন-বিলাস


কোনো কোনো ঘটনা কিংবা ব্যক্তির কর্ম আছে যার শুরু অথবা জন্মটাই আজন্ম পাপ। অর্থাৎ পুরো বিষয় কিংবা কাজটি পাপের ফসল। এ ধরনের পাপ করে অল্প কিছু মানুষ, এর প্রায়শ্চিত্ত করতে হয় অসংখ্য সাধারণ মানুষকে। সাধারণ মানুষের দায় একটা, তারা ইচ্ছে করলে এ পাপ ঠেকাতে পারত, কিন্তু ঠেকানোর দায় শোধ করেনি। এ ধরনের পাপের জন্য মোটা অঙ্কের খেসারত গুনতে হয়, কর্তৃত্বপরায়ণ সেসব মানুষেরও যাদের কর্তব্য ছিল পাপের ভ্রƒণটি সমূলে উপড়ে ফেলা। তা না করতে পারা কিংবা তা করার জন্য সব শক্তি নিয়োগের ব্যর্থতাই তাদের খেসারতের মুখোমুখি করে। সব পাপকর্মই বিষবৃক্ষের জন্ম দেয়।

উপমা হিসেবে বলা চলে, ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচন। এই অগ্রহণযোগ্য জোরজবরদস্তির নির্বাচন সঙ্কট ঘনীভূত করেছে। জনসমর্থনহীন ও বৈধতার দৃষ্টিতে প্রশ্নবিদ্ধ একটি সরকারের জন্ম দিয়েছে। সাংবিধানিক ব্যাখ্যার মারপ্যাঁচের মধ্য দিয়ে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন, বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া, সরকার গঠন ও বিরোধী দলের নামে একটি অনুগত কিংবা গৃহপালিত বিরোধী দল সৃষ্টির মতো বিষয়গুলোকে বৈধ বানিয়ে দেয়া সম্ভব নয়।

জাতীয় পার্টির জন্ম নিয়ে ভিন্নমত থাকতে পারে। তবে এরশাদের ডিগবাজি, প্রধানমন্ত্রীর অনৈতিক ভূমিকা, রওশনকে বিরোধীদলীয় নেত্রী সাজানো, এরশাদকে উপদেষ্টা বানানো, কথিত বিরোধী দলের কাউকে কাউকে মন্ত্রিত্ব খয়রাত দেয়া, আবার দু-একজনকে বিরোধীদলীয় ঢংয়ে বক্তব্য দিতে দেয়া, সব কিছুর সাথে নৈতিক স্খলন ও গণপাপের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। এসব অপকর্মের কোনো কোনোটি আজন্ম পাপের মতো।

পৃথিবীর ইতিহাসে সংসদীয় গণতন্ত্রের নামে এমন তামাশার কোনো নজির নেই। সরকারে বিরোধী দলের মন্ত্রী-উপদেষ্টা থাকে এমন উপমাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। সংসদীয় গণতন্ত্রের এমন বস্ত্রহরণ যে অনৈতিক ও পাপ তা খোদ প্রধানমন্ত্রীও জানেন। এরশাদকে অসুস্থ বানানো, সিএমএইচে রাখা, নির্বাচনে না গিয়েও বিজয় হওয়া, প্রত্যাহার করতে চেয়েও না পারা, শপথ পড়তে জিম্মি করা প্রভৃতি কিভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে! এসব নিয়ে নির্বাচনী রঙ-তামাশা এ জাতি কখনো ভুলবে না। এরশাদ না হয় বিশ্ববেহায়ার খেতাবধারী কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব বেহায়ার মা-বাবা হতে গেলেন কেন। এর জবাব আওয়ামী লীগকে ও এর নীতিনির্ধারকদের কোনো এক দিন নাকে কানে খত দিয়েই দিতে হবে। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন ও কর্মবণ্টনে বেশ পারঙ্গমতার স্বাক্ষর রেখেছে বলে নিজেরা মনে করে। যেমন কোনো কোনো মন্ত্রী ও নেতার কাজ হলো দিনমান সকাল-সন্ধ্যা খালেদা জিয়া, তারেক জিয়া ও মরহুম জিয়ার গোষ্ঠী উদ্ধার করা। কারো দায়িত্ব খালেদাকে কথার তোড়ে নাই বা ভ্যানিস করে দেয়া। আবার কাউকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে সত্য-মিথ্যার বেসাতি করে খিস্তিখেউর করার। দু-একজনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সাফল্যগাথা প্রচারে অন্তহীন মিথ্যার ফুলঝুরিকে বিশ্বাসযোগ্য করতে প্রচেষ্টা চালাতে। মা প্রধানমন্ত্রী বেটা উপদেষ্টা, এটা হতেই পারে। অন্তত রাজতন্ত্রে এর অন্যটা হওয়ার জো নেই। উপদেষ্টা হওয়ার পর তিনি কার ছেলে কার নাতি তার চেয়েও বড় হয়ে যায় পদ-পদবির প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা রক্ষার বিষয়টি। অথচ সেই উপদেষ্টার এখন প্রধান কাজ দলকে ও সরকারকে অলিক স্বপ্ন দেখানো। উদ্ভট ভবিষ্যদ্বাণী করা। নেতাকর্মীদের অযৌক্তিক আশ্বাসনির্ভর সাহস জোগানো। মাঝে মধ্যে আঁতেল সাজার ভড়ং করা। সুবিধামতো আইনস্টাইন-নিউটন কিংবা স্টিফেন হকিংয়ের মতো বৈজ্ঞানিক সেজে যাওয়া। মাঝে মধ্যে তাকে ফতোয়া দিতেও দেখা যায়। যেমন জিন্দাবাদ দাতাদের পাকিস্তানি বানিয়ে দেয়া। জানি না এখন তার মা-বাবার নাম, দলের নাম, নানা-নানির নামের কী হবে। উর্দু ইংরেজি মিশ্রিত আওয়ামী লীগকে কার দালালি বানানো হবে। বয়স অভিজ্ঞতা যাই হোক, একজন উপদেষ্টা কেন ভুলে থাকবেন যে দায়িত্বশীল বক্তব্য না দিলে তার বক্তব্য বুমেরাং হয়ে যাবে।

আওয়ামী লীগের দু-চারজন নেতার দায়িত্ব হলো নিজের কাজ বাদ দিয়ে তাদের বানানো কিংবা জন্ম দেয়া প্রতিবন্ধী বা পঙ্গু সন্তানতুল্য বিরোধী দলকে উপেক্ষা করে কার্যত বিরোধী দলকে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে মুখ ভেংচি দিয়ে শাসানোর কাজটি এগিয়ে নেয়া। পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো নজির নেই, একটি সংসদের বিরোধী দলকে আঁচলের তলে রেখে রাজপথের কিংবা সংসদের বাইরের একটি দল ও জোটকে তুলো ধুনো করতে সরকারকে গলদঘর্ম হয়ে যেতে। প্রধানমন্ত্রীর পুতুল খেলার বিরোধী দল ও কার্যত বিরোধী দল যে আলাদা সেই সত্যটি তিনি নিজেও বার কয়েক জানান দিয়েছেন। আপসোস করেছেন খালেদা জিয়ার জন্য। কষ্ট পেয়েছেন তাকে বিরোধীদলীয় নেত্রী রাখতে বা বানাতে পারেননি বলে।

এভাবে তাসের রাজা রানি দিয়ে জুয়া খেলা যায়। শেষ রক্ষা হয় না। রাজনীতি বিশ্লেষকদের কাছে একটি বিষয় স্পষ্ট, আওয়ামী লীগ এককালের কিছু প্রতিপক্ষকে ক্ষমতায় অংশীদারিত্ব দিয়েছে। তারা আওয়ামী লীগ, শেখ হাসিনা ও বঙ্গবন্ধুকে ডিফেন্ড করে না। তাদের অতীত সুখকরও নয়। তারা শয়নে স্বপনে বিএনপি-জামায়াতকে নানা ভঙ্গিতে আক্রমণ করে। এটাই তাদের এজেন্ডা। দিলীপ বড়ুয়া ছিটকে পড়েছেন। মেনন সাইড লাইনে। বাকিরা এখনো আক্রমণভাগে খেলছেন। তাদের শেষটা দেখার জন্য অনেকেই অপেক্ষা করছেন। এসব লোকহাসানো কথাবার্তা দিয়ে দীর্ঘ দিন রাজনীতি করা যায় না। সরকার পরিচালনা করাও যায় না। কার্যত বিরোধী দল কতটা পারবে, কতটা পারবে না, তা আলাদা মূল্যায়নের বিষয়। তা ছাড়া আন্দোলন শব্দটি কারো কারো জন্য বিলাসও হতে পারে। তবে নীতি-নৈতিকতা ও দেশের জন্য পরিচ্ছন্ন সংসদীয় গণতন্ত্রের স্বার্থে এই সরকার বেশি দিন টিকে থাকা উচিত নয়। কারণ এর সাথে পাপ ও পাপের প্রায়শ্চিত্ত যোগ হয়ে জাতিকে বিপর্যয়ের মুখোমুখি এনে দাড় করিয়েছে। এ সরকার আর কোনো দিন সুশাসন উপহার দিতে পারবে না। আইনের শাসন সুদূর পরাহত। গণতন্ত্র এ সরকারের আমলে আর কোনোভাবেই কফিন থেকে বেরুতে পারবে না। লুটপাটসহ লোপাটতন্ত্রের লাগাম টেনে ধরা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না।

ব্যক্তিগতভাবে আওয়ামী লীগকে একটি পুরনো রাজনৈতিক দল মনে করি। তবে এই দলটিকে কখনো স্বচ্ছতার আশ্রয় নিয়ে রাজনীতি করতে দেখিনি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ একটি জাতীয় অর্জন। আওয়ামী লীগ কখনো জাতিকে একটি স্বচ্ছ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস উপহার দেয়নি। আগরতলা মামলা থেকে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা, পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণ থেকে শহীদদের তালিকা, জাতীয় সরকারের প্রশ্ন ও বাকশাল বিতর্ক কোথাও একটি স্বচ্ছ ইতিহাস উপস্থাপনের দায় আওয়ামী লীগ শোধ করেনি। আগরতলা মামলা ষড়যন্ত্র নয়, পরিকল্পিত সেটা বুঝতে জাতির চার দশক পার হয়ে গেছে। এ কারণে আমরা প্রতিনিয়ত অতীত হাতিয়ে মরছি। অতীত এসে বারবার সামনে চলার গতিকে রোধ করে দিচ্ছে। নতুন প্রজন্ম বিভ্রান্ত হচ্ছে। রাজনীতিবিদেরাও অতীত বিতর্কে জড়িয়ে যাচ্ছেন। এখন ইতিহাসের নামে সত্য-মিথ্যার জঞ্জাল ঠেলে ইতিহাস অন্বেষার কসরত করতে হচ্ছে। ভারতীয় তথ্য মেনে নিলে আমাদের জাতীয় অর্জন ও অস্তিত্ব চাপা পড়ে যায়। পাক-ভারত দ্বন্দ্ব সামনে এসে দাঁড়ায়। পাকিস্তানি সূত্র আমলে নিলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট হয়। বামদের তথ্য একপেশে। ডানদের বক্তব্য খণ্ডিত। আওয়ামী লীগ এই জাতিটিকে নিয়ে কী খেলা খেলতে চায় তা স্পষ্ট নয়। বিএনপি নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় মনে করেন এই দলটি এক সময় তালপট্টি দ্বীপের মতো এই দেশের মানচিত্রটিও অস্বীকার করবে। এ ধরনের রাজনৈতিক মন্তব্য সব সময় বিবেচনায় নেয়া যায় না। তবে বাস্তব সত্যটা সামনে রাখলে অস্বাভাবিকও মনে হয় না। পার্বত্য চুক্তিকে আওয়ামী লীগের অর্জন বলা হচ্ছে। কার্যত পার্বত্য সঙ্কট আওয়ামী লীগ সৃষ্টি করেছে। আবার সমাধানের নামে বানরের পিঠা ভাগের মতো কাজটাও করেছে আওয়ামী লীগ। 

২০ দলীয় জোট ঈদের পর আন্দোলনের কথা বলছে। ঈদের পরও বর্ষা থাকবে। একটি বিলম্বিত বন্যার পূর্বাভাসও রয়েছে। তারপরও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টিকে একই সাথে ক্ষমতার ও বিরোধী দলের পার্টনার বানিয়ে যে খেলা চলছে তাতো শেষ হতেই হবে। একজন মার্কিন দূতসহ অনেক উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও ফোরাম এ ধরনের সরকারের পরিণতি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। পরিণতি যে ভালো হয় না তাও বলে দিতে চেয়েছেন। আওয়ামী লীগ বৈধভাবে ক্ষমতায় এসেও অবৈধ পন্থায় জোর খাটাতে গিয়ে বিদায় নিয়ে একুশ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকেছে। এবার বৈধতা ছাড়া এসেও কিছু ভালো কাজ করে জনগণের মন জয় করতে পারেনি। জনগণ রাজনীতি থেকে আওয়ামী লীগের বিদায় চায় না, সরকার থেকে বিদায় চায়। জনগণের মনের ভাষা পড়তে ও বুঝতে পারলে আওয়ামী লীগ আবার জনগণের কাছে যেতে পারবে, নয়তো বিপর্যয় নেমে আসবে।

যেকোনো বিবেচনায় ও বিশ্লেষণে এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে একটি রাজনৈতিক মেরুকরণ অনিবার্য। তা সঙ্ঘাতের পথ ধরলে পরিণতি রাজনীতির হাত ধরে নাও আসতে পারে। সরকার ও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যেসব মুখপাত্র পাঁচ বছর ক্ষমতা চর্চার কোরাস গাইছেন সেটাই পাঁচ বছর মেয়াদ পূরণ না হওয়ার আলামত স্পষ্ট করে। আওয়ামী লীগ যা বলে তা করে এবং করতে পারে বলে যে মিথ-এর জন্ম দেয়ার চেষ্টা চলছে, সেটা চুয়াত্তর, পঁচাত্তরের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কারণ বারবার জনগণ আওয়ামী লীগকে সামনে বাড়িয়ে দেয়, আওয়ামী লীগ জনগণের ভোটের আমানত রক্ষা করতে পারে না, ক্ষমতায় আসে গণতন্ত্রের পথ ধরে। ক্ষমতায় বসে প্রথমেই মই সরায় ও গণতন্ত্রের প্রাণ বধ করে। তারপরও রাজনীতির স্টিয়ারিংটি এখনো সরকারের হাতে। তাদেরই রাজনৈতিক সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। এমনকি গ্রহণযোগ্য ফরমুলাও দিতে হবে। নয়তো সামনে সঙ্কটের অনেক খানা-খন্দক, প্রচুর চড়াই-উৎরাই, নিরাপদ অগ্রযাত্রা অসম্ভব। সংলাপ-সমঝোতা চায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। বাংলাদেশে একটি স্থিতিশীল ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার চায় প্রতিবেশীরাও। জনগণ পরিবর্তনের জন্য উন্মুখ। সময়ও পরিপক্ষ। নৈতিক দায়টাও ছোট নয়। এবার সমাধান অবশ্যম্ভাবী। পথটা কেমন হবে সেটাই বড় প্রশ্ন।

মাসুদ মজুমদার


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads