ঈদুল ফিতর নেক বান্দাদের জন্য
খুশির দিন । যারা রোজা পালন করেছেন তাদের জন্য ইদুল ফিতর আনন্দ ও উৎসবের দিন । আর পাপি-তাপিদের জন্য এটা শাস্তি ও
আজাবের দিন । সাহাবী
হযরত ওয়াহাব ইবনে মুনাব্বিহ (রাঃ) ঈদের দিন কাঁদছিলেন। কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলে ছিলেন, আজ খুশির দিন ওই ব্যক্তির জন্য, যার রোজা কবুল হয়েছে। ঈদুর ফিতরের দিন হল পুরুস্কার লাভের দিন। এদিন
একদল ফেরেশতা দাঁড়িয়ে যান এবং বলতে থাকেন, ‘হে মুসলিম সম্প্রদায়! তোমারা তোমরা দয়াময় প্রভুর দিকে ছুটে চলো। তিনি তোমাদের কল্যাণ দান করবেন। তিনি
তোমাদের পুরস্কার দেবেন’। রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা তোমাদের ঈদকে তাকবীর দ্বারা
সৌন্দর্যম-িত কর’। রাসূল
(সাঃ) ইরশাদ করেছেন, পাঁচটি
রাত জেগে যে ব্যাক্তি ইবাদত করবে, তার জন্য
জান্নাত ওয়াজিব হবে। রাতগুলোহল জিল হজ্জের রাত ২. আরাফার রাত, ৩. ঈদুল আজহার রাত ৪. ঈদুল ফিতরের রাত ৫.
মধ্য শাবানের রাত। সুতারাং ঈদুল ফিতরে ইবাদত করা পুণ্যময় কাজ। ঈদের অনাবিল
সুখ-আনন্দ শুধু রোজাদারদের জন্য। যারা ইচ্ছাকৃত রোজা ছেড়ে দিয়েছে তাদের জন্য এ
আনন্দ নয়। ঈদের
পুর্ণাঙ্গ আনন্দ-খুশি ও কল্যাণ অর্জন করতে হলে আরো ঘনিষ্ঠ করতে হবে আত্মীয়
স্বজনদের সাথে সুসর্ম্পক, ঘনিষ্ঠ ও অন্তরঙ্গ করতে হবে পরিবার-পরিজনের সাথে।
আমাদের ভাষায় ঈদ মানে আনন্দ হলে ও শাব্দিক বা সার্বিক বিবেচনায় ঈদ অর্থ শুধু আনন্দ
বা আনন্দ-উচ্ছ্বাস নয়, খুশির
বন্যা, ভোগাসক্তি বা
অনিয়ন্ত্রিত উচ্ছলতা নয় বরং ঈদ ও একটি ইবাদত । ঈদুল আজহা যেমন হজ ও কোরবানীর ঈদ,তেমনি ঈদুল ফিতর রোজা রাখা বা ফিতরাদানের
ঈদ। উভয়টাই পৃথক এক একটা ইবাদত। তবে এ ইবাদতের সাথে জড়িয়ে থাকে আনন্দ। মাসব্যাপী
সিয়াম সাধনায় পুরস্কারের আশা অন্তরে পোষণ করা রোজা রাখার আনন্দ। আল্লাহ্র রহমত, গুনাহের ক্ষমা, দোজখ থেকে মুক্তি, শবেকদরে হাজার বছরের পুণ্য তাকওয়া অর্জনের
মাধ্যমে আল্লাহ্র নৈকট্য লাভ-এ সবই রোজাদারের পুরুস্কার। রোজাদার রোজা শেষে
প্রত্যক্ষভাবে পুরস্কার না পেলে ও তিনি বুঝতে পারেন এগুলো। তবে রোজা কবুল হওয়া না
হওয়া নিয়ে এ একটা সংশয় থাকে। গরিব-দুঃখীর মুখে হাসি ফোটাতে, তাদের ভাল খাওয়াতে পরাতে, তাদের সন্তানদের মুখে মিষ্টান্ন, আর ঈদের দিনে দু’মুঠো
খাবার আর গায়ে নতুনজামা তুলে দিতে ধনীদের ফিতরাদান হলো রোজাদারদের আর একটি আনন্দ।
আর ঈদের সূচনা হয় এভাবে। বায়হাকি শরীফের হাদিসে বর্ণিত আছে। ‘রাসূলুল্লাহ্
(সাঃ) যখন মদিনায় উপস্থিত হলেন তখন তাদের দু’টি উৎসব পালন করতে
দেখেন। আর এ উপলক্ষে তারা বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও উৎসব পালন করে আসছে। তিনি তাদের কাছে
প্রশ্ন রাখলেন,এর মৌলিকত্ব ও
বিশেষত্ব কি ? তারা বললো আমরা
অন্ধকার যুগে এটা পালন করতাম আজ ও এটা পালন করছি। এ কথা শুনে রাসূল (সাঃ)বললেন, আল্লাহ্পাক তোমাদের এ দু’টি উৎসবের
পরিবর্তে এর চেয়ে অধিক উত্তম দু’টি দিন দান করেছেন এক ঈদুল আজহা আর ঈদুল
ফিতর। সুতারাং আগে উৎসব বন্ধ করে এ দু’টি দিনের নির্দিষ্ট অনুষ্ঠান পালন শুরু কর।’ নিছক আনন্দ উৎসব ও খেল-তামাশা এবং বাহারী
দামি পোশাক-পরিচ্ছদের নাম ঈদ নয়। এতে ইসলামী তাহজীব তামাদ্দুনের পরিবর্তে
অনৈসলামিক কার্যকলাপের প্রসার ঘটে, যা পবিত্র ইসলামের কল্পনা ও করা যায় না। ইসলামের আনন্দ উৎসব হবে
আল্লাহ্র নির্দেশ নীতি ও আর্দশ অনুযায়ী। এর বাইরে কোন কিছুকে ইসলামের আওতাভুক্ত
করা যায় না। এজন্য রাসূল (সাঃ) জাহেলী যুগের খেল-তামাশার আনন্দ-উৎসবকে বাতিল ঘোষণা
করেছেন। আল্লাহ্র দেয়া বিধানকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অনুপ্রাণিত করেছেন।
আমরা ঈদ উৎসবকে মনে করেছি বিলাসের উৎসবে। এ দিনে কে কত দামি পোশাক পরতে পারে, কে কত পোলাও, কোর্মা, রোস্ট, রেজালা, বিরিয়ানি, জর্দা ও
ফিরনি ইত্যাদি অধিক পরিমাণে রান্না করতে পারে এসবের প্রতিযোগিতা চলে । কিন্ত
ইসলামের আদর্শ কি এটা? মুসলমানদের
ঈদের আনন্দ হলো, স্বার্থত্যাগের
মাধ্যমে অভাবী, নিরন্নকে সাহায্য
করার প্রাপ্ত আনন্দ। পরিতাপের বিষয়, আমাদের ঈদ উৎসব এখন বিকৃতি রূপ ধারণ করেছে । ত্যাগের উৎস পরিণত হয়েছে
ভোগের উৎসবে। ঈদের দিনগুলিতে আমরা সাহাবায়ে ক্বেরামের জীবন থেকে সাহায্য নিতে
পারি। তারা নিজের ভালো, পরিচ্ছন্ন
জামা-কাপড় পরিধান করতেন । অনেক বেশী দান করতেন। এমনকি সাধ্যের সবটুকু বিলিয়ে
দিতেন। দীর্ঘ সময় মসজিদে কাটাতেন। অন্যান্য ইবাদত ও বেশী করতেন। তাতেই অনেক বেশী
আনন্দিত হতেন । পক্ষান্তরে আমাদের ঈদ-উৎসবে ত্যাগটা গৌণ, আর ভোগ ও ভোজনটাই মুখ্য। আমরা নাচ, গান, আড্ডাও টেলিভিশন দেখে সময় নষ্ট করে দেই। মসজিদে ও বেশীক্ষণ থাকতে চাই
না। দামি ও বাহারী পোশাকের প্রতিযোগিতা অবতীর্ণ হই এই দিনে। আবার কেউ কেউ ফিতরা
দিতে ও ইতস্তন বোধ করি। অথচ হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ
(সাঃ) ইরশাদ করেছেন, ‘ফিতরা, জাকাত, রোজাদারকে বেহুদা, অবাঞ্ছনীয়
ও নির্লজ্জতামূলক কথাবার্তা বা কাজ কর্মের মলিনতা থেকে পবিত্র করার এবং
গরীব-মিসকিনদের ব্যবস্থা করার উদ্দেশ্যে অবশ্যই আদায় যোগ্য। যে ব্যক্তি ঈদের নামাযের আগে আদায় করবে তা ওয়াজিব
ফিতরা হিসাবে আল্লাহ্র কাছে গৃহীত হবে। আর যে ব্যক্তি ঈদের নামাযের পরে তা সাধারণ
দানরূপে গণ্য হবে। (আবু দাউদ ও ইব্নে মাজাহ) প্রিয় নবী (সাঃ) ঈদের দিন সকালে
পরিবার- পরিজন ও
পাড়া-পড়শিদের সচেতন করে তুলতেন তাদের করণীয় কর্তব্য সম্পর্কে। হযরত আব্দুল্লাহ্
ইব্নে আব্বাস (রাঃ) বলেন, মহানবী
(সাঃ) প্রত্যেক ঈদেই তার মেয়ে ও স্ত্রীদেরকে ফিতরা,দান সাদকা আদায়ের নির্দেশ দিতেন ।(মুসনাদে আহমদ) । সদকায়ে ফিতর আদায়ের ফলে একজন দীন দরিদ্র লোক ও ঈদের আনন্দে সামান্য
হলে ও শরিক হতে পারে। কিন্তু আমাদের সমাজে আজ যেভাবে ঈদ উৎসব পালন করা হয় তা কি
প্রকৃত ঈদের আনন্দের আবেদনের সঙ্গে সঙ্গতিপুর্ণ। এর উত্তর খুঁজলে নেতিবাচক জবাব
বেরিয়ে আসবে। রোজার সংযম, আত্ম
শুদ্ধি, ত্যাগ এবং ঈদের
উদ্দেশ্য ও স্বরূপ থেকে আজ আমরা বহুদূরে অবস্থান নিয়েছি। প্রকৃত ঈদের আনন্দ উৎসব
হচ্ছে, ইসলামী জীবন
যাত্রা ও সাংস্কৃতির পরিপূর্ণ অভিব্যক্তি এবং সার্বজনীন আবেদনময়, যা উৎকট পঙ্কিলতার সংস্পর্শ থেকে সম্পূর্ণ
মুক্ত ও পবিত্র । রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেন, নিশ্চয়ই আল্লাহপাক খুশি হন তখন, যখন তার দেয়া নেয়ামতের শোকর আদায়ের গুণ বান্দার মাঝে প্রকাশ পায়।
ঈদের পুণ্যময় আনন্দের মাঝে নবী করিম (সাঃ) এর নির্দেশনার বাস্তবায়ন যত বেশী হবে
ততই ঈদ-উৎসব সফল ও সার্থক হবে । প্রতিছর মুসলমানদের ঘরে এ বার্তা নিয়ে আসে। রোজার
শেষে ঈদুল ফিতর। একজন রোজাদার রমজানের একমাস সিয়াম সাধনার মধ্য দিয়ে কৃচ্ছ্রতা, সংযম, ধৈর্য ও মানবিক মুল্যবোধের প্রশিক্ষণ লাভ করে; তারই মূল্যায়নের দিন ঈদুল ফিতর। রোজা
মানুষের মনে উদারতা, সহমর্মিতা
ও মানব প্রীতি কতটা জাগিয়ে তুলতে পেরেছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় ঈদের দিনে । ঈদের
নামাযে ধনী নির্ধন, ইতর ভদ্র, ছোট-বড় সবাই মিলে এক কাতারে কাঁধে কাঁধ
মিলিয়ে দাড়ায় ও ভক্তিভরে মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে কল্যাণ শান্তির জন্য
প্রার্থনা করে; তখন এক অপূর্ব দৃশ্যের
অবতারণা করে। ঈদগাহ হয়ে উঠে সামাজিক মিলনমেলা । বছরে অন্ততঃ ঈদের দিন মানুষ
ক্ষুদ্রতা সঙ্কীর্ণতা, তুচ্ছতা,হিংসা বিদ্বেষ ভুলে পরস্পরকে ভালবাসে ।
পারস্পরিক কুশলবিনিময়ের মাধ্যমে সর্ব স্তরের মানুষের মধ্যে সামাজিক ঐক্য ও সংহতি সৃষ্টি হয় ।
মুসলমানদের জীবন ধারায় এর মূল্য বিশাল ।
রমযানের রোজা সাহ্রী, তারাবী, ইফতার
যারা যথাযথভাবে পালন করেছেন, পাপাচার
ত্যাগ করার প্রশিক্ষণনিয়েছেন, ঈদের
আনন্দ তাদের জন্য। অপরদিকে যারা ইচ্ছাকৃতভাবে রোজা ছেড়ে দিয়েছে, দিনের বেলা পানাহার ও যৌন পরিচর্চায় লিপ্ত
হয়েছে, তাদের জন্য ঈদ হলো
দুঃখ হতাশার। ঝলমলে ও সুবাসিত নতুন জামা গায়ে দিয়ে ও তাদের প্রাপ্তি ভা-ার শূন্য ।
প্রবৃত্তির প্ররোচনাকে দমন করে যারা বিবেকের শক্তিকে জাগ্রত করতে পেরেছেন রমজান
মাসে । ঈদের দিন আল্লাহ্ তায়ালা ক্ষমা করে দেন।
ঈদের জন্য রোজাদারদের জন্য এটা বিরাট প্রাপ্তি । ঈদের দিন বড় ছোট সমাজের সব সদস্য নতুন জামা
পরে বন্ধু বান্ধব, আত্মীয়স্বজন
ও পাড়া পড়শিদের বাড়ী বাড়ী গিয়ে ছালাম, কোলাকুলি ও শুভেচ্ছ বিনিময় করে থাকে। ঈদের দিন ঘরে ঘরে সেমাই পোলাও, বিরিয়ানি, পায়েসসহ নানা সুস্বাদু খাবার তৈরী হয়ে থাকে। ঈদের দিন ভাল খেলে ভাল
পরলে ঈদের আনন্দ সম্পূর্ণ হয় না, অন্যদের
খাওয়া-পরার সুযোগ করে দিত হবে। সুস্বাদু খাবার কেউ একা খায় না- সবাইকে খাইয়ে আনন্দ
তৃপ্তি লাভ করে। যার খাওয়ানো সর্মথনেই , তার মিষ্টি কথা বলে , ¯েœহ-মমতা,ও
সহানুভূতি দেখিয়ে সবাইকে খুশি করা উচিত । এটাই ঈদের দিনের কর্তব্য। এর ফলে পরস্পর
শত্রুতাভাব বিদূরিত হয়ে সমাজের সদস্যদের মাঝে ভ্রাতৃত্বভাব জেগে উঠবে । ত্যাগের
মাধ্যমে মানুষ মানুষের ভালবাসা পায় এবং জীবনের অমরত্ব লাভ করে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন