সরকার সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়ার এবং যে কোনো সময় যে কোনো পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিল করার আইন করতে যাচ্ছে। প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, পত্রিকার ডিক্লারেশন দিয়ে থাকেন জেলা প্রশাসকরা। কিন্তু পত্রিকা নিষিদ্ধ করার বা কোনো পত্রিকার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা নেই জেলা প্রশাসকদের হাতে। ১৯৭৩ সালের প্রিন্টিং প্রেসেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স আইনে কালাকানুন নামে বর্ণিত এ ধরনের অনেক বিধান ছিল। সেগুলোর আড়াল নিয়ে যখন-তখন পত্রিকা নিষিদ্ধ করা হতো, সম্পাদক ও সাংবাদিকদের মামলায় ফেলে জেলেও ঢোকানো হতো। একই কারণে ওই আইনের বিরুদ্ধে সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীরা বছরের পর বছর ধরে আন্দোলন করেছেন। ধারাবাহিক সে আন্দোলনের চাপেই বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ১৯৯১ সালে আইনটি বাতিল করেছিল। সম্প্রতি ১৯৭৩ সালের সে আইনের একটি ধারা পুনরুজ্জীবিত করাসহ সাহাবুদ্দিন সরকারের সংশোধনীটি বাতিল করার লক্ষ্যে কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। যুক্তি দেখাতে গিয়ে বলা হচ্ছে, সরকার বা জেলা প্রশাসকদের হাতে কোনো ক্ষমতা না থাকায় রাষ্ট্রবিরোধী এবং ধর্মীয় সম্প্রীতি নস্যাৎ করার মতো মারাত্মক কিছু বিষয়ে লিখলেও কোনো পত্রিকার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যায় না। মূলত এ উদ্দেশ্যেই সরকার ১৯৯১ সালের সংশোধনী বাতিল করে ১৯৭৩ সালের আইনের একটি ধারা পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু সবই করা হচ্ছে যথেষ্ট গোপনীয়তার সঙ্গে। তা সত্ত্বেও বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে এ সংক্রান্ত খবর প্রকাশিত হয়েছে, বিষয়টি নিয়ে জাতীয় সংসদে পর্যন্ত আপত্তি জানিয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের দোসর এক এমপি। অন্যদিকে খুবই কৌতুহলোদ্দীপক উক্তি শোনা গেছে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর মুখে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তো বটেই, মঙ্গলবার জাতীয় সংসদেও তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, তিনি নাকি এ বিষয়ে কিছুই জানেন না! আমরা মনে করি, এতো বড় একটি বিষয়ে কিছুই না জানাটা মাননীয় তথ্যমন্ত্রীর যোগ্যতার প্রমাণ দেয় না। তিনি নিশ্চয়ই জানেন তবে রাজনৈতিক কৌশলের কারণে না জানার ভান করেছেন। ইনু সাহেবদের মতো রাজনীতিকদের জন্য এ ধরনের কৌশল অবলম্বনের মধ্যে বিস্ময়ের কিছু থাকতে পারে না। অন্যদিকে সত্যিই যদি জাঁদরেল তথ্যমন্ত্রীকে না জানিয়ে বা সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে এতো বড় একটি পদক্ষেপ নেয়া হয়ে থাকে তাহলে নিশ্চয়ই ভীত ও শংকিত না হয়ে পারা যায় না। কারণ, এমন অবস্থা কোনো স্বৈরশাসকের অধীনেই সম্ভব। বর্তমান ক্ষমতাসীনরাই যে পত্রিকা বন্ধের নতুন কৌশল অবলম্বন করতে যাচ্ছেন না সেকথারই বা নিশ্চয়তা কোথায়? কারণ, গণতন্ত্রের আড়াল নিয়ে গুম-হত্যা থেকে শুরু করে ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে অবৈধ সরকার গঠনসহ এতো বেশি অপকর্ম তারা করেছেন যেগুলো এক সময় তাদের নিজেদের জন্যই বিষফোঁড়া হয়ে উঠতে পারে। সেজন্যই সম্ভবত আগেভাগে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে তৎপর হয়েছেন ক্ষমতাসীনরা।
তাছাড়া ইতিহাস ও ঐতিহ্য রাখারও তো ব্যাপার রয়েছে! কারণ, সংবাদপত্রসহ গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করার ক্ষেত্রে ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন আওয়ামী লীগের প্রাণপুরুষ এবং স্বাধীনতা-উত্তর প্রথম সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ক্ষমতায় বসার পর থেকেই সরকারের সমালোচনা এবং বিরোধী রাজনীতিকে সহিংস পন্থায় দমনের ভয়ংকর পদক্ষেপ নিয়েছিলেন শেখ মুজিব। মুজিব সরকার শুধু ১৯৬০ সালে স্বৈরশাসক আইয়ুব সরকারের প্রবর্তিত প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্সকেই ১৯৭৩ সালে সে কালাকানুনটিকে ‘মুদ্রণযন্ত্র ও প্রকাশনা অর্ডিন্যান্স’ নামে প্রবর্তন করেছিল। এই অধ্যাদেশের আড়াল নিয়ে সরকার একদিকে সরকারবিরোধী সংবাদ প্রকাশনার ওপর নিয়ন্ত্রণ চাপিয়েছে, অন্যদিকে একের পর এক সংবাদপত্রের প্রকাশনা নিষিদ্ধ করেছে। ১৯৭২ সালে মওলানা ভাসানীর ‘হক-কথা’ ছাড়াও নিষিদ্ধ হয়েছিল পাঁচটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুদের মূল দল জাসদের মুখপত্র দৈনিক ‘গণকণ্ঠ’ও নিষিদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু এতকিছু করেও বিরোধী রাজনীতিকে নির্মূল বা দমন করা সম্ভব হয়নি। এর পরপর ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে মারা গিয়েছিল হাজার হাজার মানুষ। দরকার যখন ছিল সকল দলকে সঙ্গে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য চেষ্টা চালানো প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব তখন তথাকথিত ‘দ্বিতীয় বিপ্লবের’ আড়ালে নিজের একচ্ছত্র নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার এবং সরকারের বিরোধিতাকে সমূলে উৎখাত করার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের ইচ্ছা ও নির্দেশে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাস করা হয়েছিল। চতুর্থ সংশোধনীর ফলে প্রচলিত সংসদীয় পদ্ধতির স্থলে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পদ্ধতি প্রবর্তিত হয় এবং সকল রাজনৈতিক দল বাতিল ও বিলুপ্ত করে দেশে একটি মাত্র দল রাখার বিধান করা হয়। এই সংশোধনীর ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিব একমাত্র দল বাকশাল গঠন করেন। তার নির্দেশে সরকারনিয়ন্ত্রিত চারটি ‘দৈনিক ইত্তেফাক’, ‘দৈনিক বাংলা’, ‘বাংলাদেশ অবজারভার’ ও ‘বাংলাদেশ টাইমস’ ছাড়া দেশের সকল সংবাদপত্র নিষিদ্ধ হয়েছিল ১৬ জুন। এর ফলে শত শত সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মী বেকার হয়ে পড়েছিলেন। অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছিল ১৯৭৫ নালের ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিব নিহত হওয়ার পর।
আমরা মনে করি, ক্ষমতাসীনদের উচিত ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়ার কারণ সম্পর্কে ভেবে দেখা। গণতন্ত্রের এবং স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের দোহাই দিয়ে দৈনিক আমার দেশ ও দৈনিক সংগ্রাম থেকে শুরু করে দিগন্ত ও ইসলামিক টিভি পর্যন্ত অসংখ্য গণমাধ্যমকে সরকার ফ্যাসিস্ট আক্রমণের শিকার বানিয়েছে। রিমান্ডে নিয়ে নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়েছে সম্পাদক ও সাংবাদিকদের ওপর। সমগ্র এ প্রেক্ষাপটেই জেলা প্রশাসকদের হাতে পত্রিকা নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা দিয়ে আইন সংশোধন বা নতুন আইন প্রবর্তনের খবরে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে সকল মহলে। কারণ, জেলা প্রশাসকদের সাধারণত রাজনৈতিক বিবেচনায় নিযুক্তি দেয়া হয়। ডিসিদের অনেকেও আগ বাড়িয়ে সরকারের লেজুড়বৃত্তি করে থাকেন। সুতরাং ধরে নেয়া যায়, সত্যি নতুন আইন প্রবর্তন করা হলে তার প্রয়োগ ও ব্যবহারও হবে যথেচ্ছভাবে। জেলা প্রশাসকদের দিয়ে সরকার অবশ্যই নিজের ইচ্ছা পূরণ করিয়ে নেবে। অমন পরিস্থিতিতে সরকারবিরোধী পত্রিকাগুলোই শুধু নিষিদ্ধ হতে থাকবে না, গণতান্ত্রিক রাজনীতিও বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়বে। সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীরাতো চাকরি হারাবেনই। সব মিলিয়েই আমরা সরকারের নতুন আইন প্রবর্তন চেষ্টার বিরোধিতা করি।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন