বুধবার, ৯ জুলাই, ২০১৪

অর্থমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী... কেলেঙ্কারিতেই সফল


মহাজোট সরকারের সবচেয়ে সৌভাগ্যবান মন্ত্রীদের একজন শিক্ষামন্ত্রী। প্রচার-প্রচারণায় তিনি একজন সফল মন্ত্রী। সৌভাগ্যবান আরেকজন মন্ত্রী হচ্ছেন অর্থমন্ত্রী। গত সাড়ে পাঁচ বছরের আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে ব্যাংক বীমা আর্থিক প্রতিষ্ঠান আর শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির কারণে অর্থমন্ত্রী নানাভাবে সমালোচিত হয়েছেন। খোদ অর্থমন্ত্রী নিজেই সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, দেশের সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি হচ্ছেন তিনি। নিজের নির্বাচনী এলাকা সিলেটেও তিনি সমালোচিত। তার দলের যুবসংগঠন যুবলীগের নেতারা তার বিরুদ্ধে ঝাড়মিছিল করেছেন। এর পরও বলতে হবে, তার মধ্যে একধরনের সরলতা আছে। অর্থমন্ত্রী মাঝে মাঝেই কেলেঙ্কারির দায় নেন। আত্মসমালোচনাও করেন। যেমন ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর ৭১ টেলিভিশনে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আমরা এই নির্বাচনে সত্যিকারে জনগণের ম্যান্ডেট পাইনি। আরেকটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। পরে অবশ্য অন্য মন্ত্রীদের সাথে সুর মিলিয়ে বলেন নির্বাচন টির্বাচন হবে না। আমরা পাঁচ বছর থাকব। হলমার্ক, ডেসটিনি, বেসিক ব্যাংক, শেয়ারবাজার, ড. ইউনূসকে নিয়ে কঠোর মন্তব্যসহ নানা কেলেঙ্কারির সাথে তার নাম জড়িয়ে আছে। এত কিছুর পরও কিন্তু বহাল তবিয়তে তিনি তার দায়িত্বে আছেন। বিভিন্ন সময় তিনি গণমাধ্যমের তোপের মুখে পড়েছেন। যদিও রাবিশ বলে সব কিছু উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর মন্ত্রিসভায় বড় ধরনের রদবদলের পরও অর্থমন্ত্রী টিকে গেছেন। মন্ত্রিসভা থেকে বেশ কয়েকজন কচিকাঁচাকে সরিয়ে দেয়া হলেও প্রবীণদের কাউকে সরানো হয়নি; বরং আরো কিছু প্রবীণ সদস্য যোগ হয়েছেন। আওয়ামী মন্ত্রিসভার প্রবীণতম এই মন্ত্রী সব সময় আলোচনায় আছেন। আশা করা যায়, যত দিন মন্ত্রী থাকবেন আলোচনায় থাকবেন তিনি। মনে রাখতে হবে, আলোচনায় থাকাও রাজনীতির একটি কৌশল।
অর্থসংক্রান্ত বিষয়ে কেলেঙ্কারির ঘটনায় অর্থমন্ত্রী নানাভাবে সমালোচিত হলেও শিক্ষাসংক্রান্ত বিষয়ে বড় বড় সব কেলেঙ্কারির পরও শিক্ষামন্ত্রী ততটা সমালোচিত হননি। যদিও শিক্ষাক্ষেত্রে যেসব কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে তাতে পুরো শিক্ষাব্যবস্থা এখন ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আর শিক্ষামন্ত্রীর মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, অর্থমন্ত্রী কেলেঙ্কারির বিষয়গুলো অস্বীকার করেননি। আবার যারা এর সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেননি। কারণ যারা এসব আর্থিক কেলেঙ্কারির সাথে জড়িত তারা এতটাই প্রভাবশালী যে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা হয়তো তার ছিল না। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রী কেলেঙ্কারির নায়কদের শুধু আড়াল করছেন না, তিনি পুরো ঘটনাই বেমালুম চেপে যাচ্ছেন। বলছেন, এমন কোনো ঘটনাই ঘটেনি। যারা এসব অভিযোগ করছেন তাদের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ আনছেন। সাবেক বামপন্থী এ নেতা স্টালিনীয় কায়দায় যারা কেলেঙ্কারি তুলে ধরছেন তাদেরকে প্রতিপক্ষ হিসেবে হাজির করছেন। তারা নাকি মন্ত্রীর ভালো কাজে ঈর্ষাবশত এমন করছেন।
দেশের বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় একের পর এক প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটছে। মন্ত্রীর কাছে তা তুলে ধরা হলে তিনি প্রথমে বলছেন, এগুলো প্রশ্ন ফাঁস নয়, শিক্ষকদের সাজেশন। অতীতে এ ধারাবাহিক প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা না ঘটলেও নিয়ম হচ্ছে, প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ উঠলে সাথে সাথে পরীক্ষা বাতিল করে দেয়া হতো। কিন্তু মন্ত্রী যখন স্বীকার করছেন না, তখন পরীক্ষা বাতিলের প্রশ্নও আসে না। বেশ ভালো। এরপর ফেসবুক আর ইন্টারনেটে হুবহু পাওয়া গেল প্রশ্ন। একটি-দুটি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস নয়, ধারাবাহিকভাবে সব পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হতে থাকল। সোনামণিদের প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিকপর্যায়ের পরীক্ষার সব প্রশ্ন ফাঁস হতে থাকল। সেগুলো সংবাদপত্রে প্রকাশ হওয়ার পর মন্ত্রী বললেন, এগুলো তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। ক্ষমতাসীন দলের সাথে ভিন্ন মত আছে এমন শিক্ষক বুদ্ধিজীবীরা এ সময় ছিলেন নিশ্চুপ। কারণ এসব বিষয় নিয়ে কথা বললে আবার প্রশ্ন ফাঁসের প্রচারণার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে মামলা বা চাকরি চলে যাওয়ার ভয়। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের প্রবল সমর্থক এবং শিক্ষামন্ত্রীর ভক্ত-অনুরক্ত দুয়েকজন শিক্ষক শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ তুললেন। শেষ পর্যন্ত মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের দিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হলো। সেই কমিটি রিপোর্ট দেয়ার আগে সংসদে দাঁড়িয়ে মন্ত্রী বললেন, কোনো পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়নি। তার এই দাবির এক সপ্তাহ না যেতেই তার গঠিত কমিটি রিপোর্ট দিয়েছে হ্যাঁ প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। কিন্তু কারা কিভাবে প্রশ্ন ফাঁস করেছে, তাদের চিহ্নিত করতে পারেননি। কিন্তু প্রশ্ন যে ফাঁস হয়েছে, তা সত্যি। তাহলে প্রশ্ন ফাঁসের দায়িত্ব কে নেবে? জ্ঞানী-গুণী সফল মন্ত্রী তো নিতে পারেন না। এর দায়দায়িত্ব এখন নিতে হবে শিক্ষার্থীদের। কারণ, শিক্ষার্থী না থাকলে পরীক্ষা হতো না।  আর পরীক্ষা না হলে তো প্রশ্ন ফাঁস হতো না। তাই শাস্তি যদি দিতে হয় শিক্ষার্থীদের দিতে হবে। নিয়ম করা হলো, একটি পরীক্ষার পর আর কোনো বিরতি দেয়া হবে না। অর্থাৎ প্রতিদিন ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষা দিতে হবে, যাতে কেউ প্রশ্ন ফাঁস করতে না পারে। প্রশ্ন ফাঁস কেলেঙ্কারি রোধে মন্ত্রীর এই মডেল বিশ্বজুড়ে গৃহীত হতে পারে। এমনকি ইউনেস্ক এই মডেল পরীক্ষামূলক চালু করতে পারে। প্রথমে ব্রিটেন আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রশ্ন ফাঁস করে তারপর প্রতিদিন পরীক্ষা নেয়ার ব্যবস্থা করতে পারে। এতে ছাত্রছাত্রীরা সময় কম থাকায় ঘুম থেকে জেগে লেখাপড়ায় মনোযোগী হবে, আর তাতে মেধার বিকাশ ঘটবে।
কেলেঙ্কারি শুধু প্রশ্ন ফাঁসের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। কেউ যাতে পরীক্ষায় ফেল না করে সে জন্য শিক্ষকদেরও নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। কারণ এত কিছুর পরও যদি ছাত্ররা ফেল করে তাহলে মন্ত্রীর তো মানমর্যাদা থাকে না। এভাবে শিক্ষকদের প্রতি কঠোর নির্দেশ হয়েছে, দিল নরম করে খাতা দেখতে হবে। ফেল করলেও পাস করাতে হবে। ফলাফলে দেখা যাচ্ছে মেধার বিস্ফোরণ ঘটছে। জিপিএ ৫ আর গোল্ডেন জিপিএর ছড়াছড়ি। ভালো ফলাফল করা এই শিক্ষার্থীরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় পাস মার্ক পর্যন্ত পাচ্ছে না, তখন বোঝা যাচ্ছে এরা কী শিখছে।
প্রশ্ন ফাঁস কেলেঙ্কারির আগে ভর্তিবাণিজ্য নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এক অস্থির পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। বিশেষ করে রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন ও আইডিয়াল স্কুলে ভর্তিবাণিজ্যের সাথে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা ছাড়া মন্ত্রীর আরেক বাম সতীর্থ নেতা এবং মতিঝিল এলাকার স্থানীয় সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধেও অভিযোগ ওঠে। তিনি পরে শিক্ষামন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতি থেকে প্রমোশন পেয়ে মন্ত্রী হয়েছেন। ভর্তিবাণিজ্য নিয়ে চার দিকে হইচই শুরু হলে মন্ত্রী দীর্ঘ দিন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেন। শেষ পর্যন্ত লটারির মাধ্যমে ভর্তির নিয়ম চালু করে কেলেঙ্কারি ঢাকার চেষ্টা করেন। শুধু ছাত্রভর্তি নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সব শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার কারণে শিক্ষক নিয়োগে নানা অনিয়ম এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। মন্ত্রী জানেন কিনা, আজ সব ধরনের স্কুলশিক্ষক নিবন্ধন ও নিয়োগে মোটা অঙ্কের টাকা ছাড়া চলে না। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে চলছে চরম দলবাজি। শিক্ষক নিয়োগে নৈতিক দিকটির কোনো গুরুত্বই দেয়া হচ্ছে না। ফলে আমরা দেখছি আইডিয়াল ও ভিকারুননিসার মতো দুটি স্কুলে শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রী ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে ভিকারুননিসার শিক্ষক পরিমল জয়ধর ও প্রধান শিক্ষিকা হোসনে আরার অপরাধকে আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে। বাংলাদেশে অতীতে এমন কেলেঙ্কারির ঘটনা আর কখনো ঘটেনি।
সর্বশেষ শিক্ষামন্ত্রী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্নীতি ও অনিয়ম নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ টিআইবির একটি গবেষণা প্রতিবেদন নিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন। টিআইবির এই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে টাকার বিনিময়ে সার্টিফিকেট পাওয়া যায়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদনের জন্য তিন কোটি টাকা পর্যন্ত বিনিময় হয়। মন্ত্রী টিআইবির রিপোর্ট শুধু অসত্য নয়, দুরভিসন্ধিমূলক বলেও উল্লেখ করেছেন। তিনি টিআইবির এই রিপোর্টের সত্যতা প্রমাণ করার জন্য চালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেছেন, না হলে এই রিপোর্ট প্রত্যাহার করতে হবে। কিন্তু টিআইবি তার অবস্থানে অনড় থেকে বলছে, গবেষণা প্রতিবেদন প্রত্যাহারের প্রশ্নই আসে না। মন্ত্রীর চ্যালেঞ্জ নিয়ে এর বেশি কিছু তারা বলছেন না। টিআইবির সাথে যারা সংশ্লিষ্ট তারা সবাই সুশীলসমাজের লোক। এদের অনেকে একসময় বাম রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ফলে শিক্ষামন্ত্রীর প্রতি তাদের বেশ দুর্বলতা আছে। সুশীলসমাজের মুখপাত্র গণমাধ্যমে তারা সব সময় শিক্ষামন্ত্রীকে সফল মন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। ফলে শিক্ষামন্ত্রীকে নিয়ে এখন বেশ বেকায়দায় আছেন। বাম নেতা আওয়ামী লীগার হলে তার রূপ যে এমন হবে তা তারা আগে অনুমান করতে পারেননি। ফলে না পারছেন কইতে, না পারছেন সইতে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে টিআইবির এই অভিযোগ বা গবেষণা প্রতিবেদন যে মন্ত্রী আমলে নেবেন না, তা এখন স্পষ্ট। বরং সুশীলসমাজের জন্য সামনের দিনগুলো যে আরো কঠিন হয়ে পড়বে তার আলামত দেখে তারা নিশ্চয়ই শঙ্কা বোধ করছেন। তাদের জন্য দুর্ভাগ্য হচ্ছে, সুশীলসমাজকে হেস্তনেস্ত করার কাজে আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভার বামপন্থীরা এগিয়ে আছেন। সামনে সুশীল বনাম সাবেক বাম মন্ত্রীদের লড়াই আরো নানা রূপে দেখা যাবে।
এত কিছুর পরও মন্ত্রীর কি কোনো সাফল্য নেই? অবশ্যই আছে। চার দিকে দিবস আর উৎসব পালনের মধ্যে মন্ত্রী চালু করেছেন বই উৎসব। প্রাথমিক পর্যায়ে বিনামূল্যে বই বিতরণকে তার এক বিশাল সাফল্য হিসেবে দেখানো হচ্ছে। অথচ আশির দশক থেকে ইউনেস্কর সহায়তায় বিনামূল্যে বই বিতরণ শুরু হয়েছিল। পরবর্তী সরকারগুলোর আমলে তা অব্যাহত ছিল। অতীতের ধারাবাহিক কার্যক্রম এখনো চলছে। কিন্তু এই বই বিতরণের প্রচারণা এমনভাবে চালানো হচ্ছে যেন এই শিক্ষামন্ত্রীর আমলে প্রথম বিনামূল্যে বই বিতরণ করা হচ্ছে। অন্যের সাফল্য নিজের বলে চালিয়ে দেয়ার অপরিসীম দক্ষতা রয়েছে এই সরকারের। কেলেঙ্কারির ক্ষেত্রে তারা যে সাফল্য দেখিয়েছেন অতীতে আর কেউ তা দেখাতে পারেনি। ফলে জোর করে সফল মন্ত্রী হওয়ার চেষ্টা শেষ পর্যন্ত সফল হচ্ছে না; বরং যারা সফল হিসেবে প্রচারণা চালিয়েছিলেন তারাও এখন মনোযাতনায় ভুগছেন। 

আলফাজ আনাম


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads