ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস
আন্দোলন ও শোষণের ইতিহাস। যারা রাজনৈতিক ইতিহাস পড়েছেন, তারা জানেন যে, আদিকালে কিছুসংখ্যক আদিবাসী যেমন কোল, দ্রাবিড়রা সুখ-শান্তিতে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বাস করছিলেন।
এদের জীবনে একপর্যায়ে আর্যরা অশান্তি সৃষ্টি করে। কারা এই আর্য? ইতিহাস বলে এরা বহিরাগত। ভারতে আগমনকারীদের মধ্যে আর্যরাই সর্বশেষ
আগমনকারী। নানাবিধ সমস্যার কারণে এই আর্যরা পৃথিবীর তিনটি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে বলে
এদের পৃথিবীর তিনটি পৃথক জাতির পিতৃবংশ মনে করা হয়। এদের প্রথম দলটি ইতালিতে
অবস্থান নেয়। যার ফলে ইতিহাসে এরা রোমক জাতি হিসেবে পরিচিত। দ্বিতীয় দল মিসর, এশিয়া মাইনর, মেসোপটেমিয়া হয়ে গ্রিসে পৌঁছে এবং স্থায়ীভাবে
বসবাস শুরু করে। সর্বশেষ অর্থাৎ তৃতীয় দল প্রাচীন পারস্য বা ইরান হয়ে ভারতে
পৌঁছে। ভারতে পৌঁছার পর তারা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার জন্য কোল এবং
দ্রাবিড়দের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং বিজয় অর্জন করে। বিজয়ের পর দ্রাবিড় ও কোলদের
দাস এবং দস্যু হিসেবে চিহ্নিত করে নানাভাবে নির্যাতন করতে থাকে। এখান থেকেই
নির্যাতন এবং শোষণ শাসনের শুরু। এরপর মুঘল, ইংরেজ এবং পাকিস্তানের
জমানায় মানুষ শাসন, শোষণ ও নির্যাতনের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছে। জীবন
দিয়েছে বর্বর অনেক শাসকের আমলেই। বাংলাদেশের বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার সেই
ধারাবাহিকতারই অনুসরণ করে চলেছে মাত্র। শাসন, শোষণ, নির্যাতন, গুম-খুন সবই চলছে ধারাবাহিকভাবে আর এ কারণে আন্দোলনও দানা বেঁধে
উঠছে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে। যেমনটি ঘটেছে পূর্বের অন্যান্য শাসকদের জমানায়।
আওয়ামী
লীগ বর্তমান সরকারের ক্ষমতায়ন, শাসন, শোষণ ও নির্যাতনের সাথে
ভারতে আগত বহিরাগত আর্যদের ক্ষমতায়ন, শাসন, শোষণ ও নির্যাতনের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। আর্যরা অবৈধভাবে কোল এবং
দ্রাবিড়দের পরাজিত করার পর ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে যেভাবে কোল এবং দ্রাবিড়দের দাস
এবং দস্যু হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সর্বোপরি বর্ণবৈষম্য সৃষ্টির মাধ্যমে কোল ও
দ্রাবিড়দের নি¤œবর্ণ অর্থাৎ অস্পৃশ্য ঘোষণা দিয়ে যেভাবে নির্যাতন করেছে এবং
করছে, ঠিক সেভাবেই আওয়ামী লীগ সরকার তার অপছন্দের মানুষকে নানাভাবে
হেয়প্রতিপন্ন করে চলেছে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের রাজাকার আখ্যায়িত করে অস্পৃশ্য
প্রমাণের চেষ্টা করছে। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীকেও রাজাকার বলতে কুণ্ঠাবোধ করছে না।
বিরোধী দল এমনকি নিজ দলেরও অপছন্দনীয় ব্যক্তিবর্গকে নির্যাতন, গুম, খুনের মাধ্যমে রামরাজ্য কায়েমের পাঁয়তারা করছে। ফলে
স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন বিএনপি নেত্রী
বেগম খালেদা জিয়া। তিনি আহ্বান জানিয়েছেন, সর্বস্তরের জনগণকে আন্দোলনে
শামিল হতে। আর এ কারণে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-নেত্রী, সরকার সমর্থক সুবিধাবাদী, সুবিধাভোগী লুটেরাদের গাত্রদাহের কারণ হয়েছে।
তারা নানাভাবে বলার চেষ্টা করছেন কী দরকার আন্দোলনের? দেশ তো ভালোভাবেই চলছে! ভোটারবিহীন নির্বাচনে এবং বিনাভোটে বিজয়ী সদস্যদের
নিয়ে গঠিত সরকারকে তো দেশ বিদেশের মানুষ মেনেই নিয়েছেন। মধ্যরাতের টকশোগুলোতে কোনো
কোনো আলোচক বলছেন বিএনপিকে বলব, ভারতের বিজেপির দিকে নজর দিতে। কিভাবে জনগণের
সমর্থন পেতে হয় তা বিজেপির কাছে শিখে নিতে।
বিএনপি
জন্মলগ্ন থেকে দলমত নির্বিশেষে সব স্তরের সব দলের জনগণকে নিয়েই রাজনীতি করে আসছে।
বাকশাল সৃষ্টির পর আওয়ামী লীগ যেসব পত্রপত্রিকা বন্ধ করে দিয়েছিল, যেসব রাজনৈতিক দলকে রাজনীতি করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিল বিএনপি প্রধান
জিয়াউর রহমান সেসব পত্রপত্রিকা এবং রাজনৈতিক দলকে মুক্ত করে দিয়ে গণতন্ত্র
পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উদারতার পরিচয় দিয়েছিলেন। মাঠে-ঘাটে, গ্রাম-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে সব শ্রেণীর মানুষের সাথে যোগাযোগ
করে বিএনপির প্রতি ব্যাপক জনসমর্থন গড়ে তুলেছে। তার পরও বলা হচ্ছেÑ বিজেপির কাছে রাজনীতি শিখতে হবে বিএনপিকে! নাকি প্রকারান্তরে বলতে চাইছেন
অন্য ধর্মের ধর্মীয় উপাসনালয় ধ্বংস করে নিজ জনগোষ্ঠীকে কিভাবে খুশি করতে হয় সে
বিষয়ে শিক্ষা নিয়ে বিজেপির পথ অনুসরণ করতে?
যারা
বিএনপিকে নানা উপদেশ দিচ্ছেন বিজেপির মতো জনমত গড়ে তুলতে. তারা কি মনে করছেন
বিএনপির প্রতি জনসমর্থন নেই? যদি তাই হয়, তাহলে নির্বাচনে বিএনপিকে
অংশ নিতে দেয়া হলো না কেন? নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করলেই
উপদেশদাতারা বুঝতে পারতেন বিএনপির জনসমর্থন কতটা। নির্বাচনের আগে আমি কয়েক দিনের
জন্য গ্রামে গিয়েছিলাম (নাটোর), সেখানকার সাধারণ মানুষের সাথে আমার কথা হয়েছে।
তারা বলেছিলেন, এবার বিএনপির পক্ষে কলাগাছও যদি দাঁড়ায় তাহলে জনগণ কলাগাছকেই
ভোট দেবে। আওয়ামী লীগকে দেবে না। এ বিষয়ে নির্বাচনের আগে একটি পত্রিকায় লিখেছিলাম; কিন্তু নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণের সমসুযোগ না থাকায় বিএনপির পক্ষে
অংশগ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। হলে অবশ্যই বিজেপিপন্থীরা বুঝতে পারতেন এবং বলতেন বিজেপি
নেতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের বিএনপির কাছ থেকেই জনমত গঠনের প্রক্রিয়া
আত্মস্থ করেছে। টকশোর বিজেপিপ্রিয় আলোচকেরা কি বলতে পারবেন, কবে কোন আন্দোলন হয়েছে কোনো সমস্যা ছাড়া। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, বাংলা ভাষা রক্ষার আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের আন্দোলন, কোন আন্দোলন সমস্যা-সঙ্ঘাত ছাড়া সফল হয়েছে? পৃথিবীর সব মানুষ জানে যে, আন্দোলন মানে যাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন তাদের বিপদে ফেলা। আন্দোলন মানেই
আন্দোলনের সময়কালে দেশে কিংবা প্রতিষ্ঠানে অস্বস্তি বিরাজ করা। সম্প্রতি গার্মেন্ট
কর্মীদের যে বেতন বৃদ্ধি করা হয়েছে, সে বেতন কি কর্মীদের
ভালোবেসে বৃদ্ধি করেছেন কর্তৃপক্ষ? মোটেও তা নয়। কঠোর আন্দোলন ও
ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই তা আদায় করতে হয়েছে। সুতরাং আন্দোলনের সাথে
সন্ত্রাস বা সমস্যা সৃষ্টির সম্পর্ক রয়েছে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। আর
বাংলাদেশে সন্ত্রাস কিংবা অশান্তি যে সরকারের মাস্তান বা ক্যাডার বাহিনীই প্রথম
শুরু করে, এ কথা সবার জানা। কারণ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের পথে পথে বাধা
দেয়া, সভা সমিতিতে যোগ দিতে না দেয়া, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর
আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও হওয়া এ দেশে স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। আর এ কারণে
আন্দোলন অহিংস থাকে না। তবু বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেছেনÑ ‘আন্দোলন শান্তিপূর্ণ হবে।’ তবে আমাদের ধারণা, আন্দোলন শান্তিপূর্ণ হবে কি হবে না তা নির্ভর করছে সরকারের মনোভাব এবং
সরকারদলীয় সন্ত্রাসী ক্যাডার বাহিনীর কর্মকাণ্ডের ওপর।
বিএনপি
দীর্ঘ দিন সরকারের কাছে আবেদন-নিবেদন করছে আলোচনার টেবিলে বসে সমস্যার সমাধান করতে; কিন্তু সরকার কর্ণপাত করছে না। সরকারের পক্ষ থেকে বরং বলা হচ্ছেÑ কোনো আলোচনা নয়। এ সরকার পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকবে। অথচ সমগ্র বিশ্বের জনমত
আলোচনার মাধ্যমে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য সুষ্ঠু নির্বাচন দেয়ার পক্ষে। ইউরোপীয়
ইউনিয়ন আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচন চেয়েছে। বাংলাদেশে নবনির্বাচিত মার্কিন রাষ্ট্রদূত
মার্শিয়া স্টিফেন্স ব্লুম বর্নিকাট বলেছেনÑ ‘বাংলাদেশে ৫ জানুয়ারির
সংসদীয় নির্বাচন নিঃসন্দেহে ত্রুটিপূর্ণ ছিল। এখন প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার গঠনের
দিকে এগিয়ে যেতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর জরুরি ভিত্তিতে গঠনমূলক সংলাপে
অংশগ্রহণ করা দরকার। এসব বক্তব্য ১৬ এবং ১৯ জুলাইয়ের (২০১৪); কিন্তু এসব বক্তব্যকে উড়িয়ে দিয়ে দাম্ভিক সরকারের তথ্যমন্ত্রী বলেছেন ‘নির্বাচনে কেউ না আসলে সেই নির্বাচন ত্রুটিপূর্ণ হয় এ কথা আমরা মানি না’ (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২০ জুলাই ’১৪)। দাম্ভিক সরকারের স্তাবক
বুদ্ধিজীবী এবং আলোচকদের কাছে এখন প্রশ্নÑ সরকারের এ ধরনের মানসিকতা
এবং বক্তব্যের পর আন্দোলন ছাড়া সমস্যা সমাধানের আর কোনো পথ খোলা আছে কি?
বিগত
সরকারের সময় থেকেই তো আন্দোলন চলছিল; কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে
বলা হয়েছিল নিয়ম রক্ষার প্রয়োজনেই নির্বাচন করতে হচ্ছে। সরকারের এ ধরনের
বক্তব্যের পর নির্বাচন শেষে বিএনপি জোট আন্দোলন বন্ধ করে দিয়েছিল এই ভেবে যে, হয়তো নির্বাচন শেষে সর্বজনগ্রাহ্য, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য
নির্বাচন দেবে আওয়ামী লীগ সরকার; কিন্তু এখন সরকার বলছেÑ তারা পাঁচ বছরই ক্ষমতায় থাকবে। পাঁচ বছর শেষে নির্বাচন হবে। সুতরাং
আন্দোলন এখন অনিবার্য হয়ে পড়েছে। আর এ আন্দোলন কেন সরকার তা ভালো করেই জানে। জানে
বলেই সরকারের কিছু দায়িত্ব রয়েছে। সরকার যদি মনে করে আন্দোলনের মাধ্যমে
আন্দোলনকারীরা অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারবে না, তাহলে সরকারকে বলতে হবে কোন
পথে অগ্রসর হলে আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্য সফল হবে। এ মন্তব্য ব্রিটিশ বাংলার
তৎকালীন গভর্নরের (প্রবাসী, ৩৪শ ভাগ, ৩য় সংখ্যা, আষাঢ়, ১৩৪১)। সরকার এ ধরনের ভূমিকা পালন করলে ভালো। আর তা না হলে
আন্দোলনই হবে দাবি আদায়ের একমাত্র উপায়। কারণ আন্দোলন গণতন্ত্রেরই অংশ।
গণতান্ত্রিক এই আন্দোলন হতেই হবে। সরকার এবং সরকারের স্তাবক বুদ্ধিজীবী এবং টকশোর
আলোচকেরা পছন্দ করুন আর নাই করুন। সব শ্রেণীর সমালোচককে স্মরণে রাখা উচিত যে, ভারতে নির্বাচনের স্থায়ী ব্যবস্থা আছে। সেখানে কেউ কাউকে ক্ষতিগ্রস্ত করার
জন্য ক্ষণে ক্ষণে নির্বাচনের নিয়ম পরিবর্তন করে না। সেজন্য কোনো নিয়ম বা আইন
পাল্টানোর জন্য কোনো দলের আন্দোলন করতে হয় না। এ জন্য বিজেপিকেও আন্দোলন করতে হয়নি; কিন্তু ভারত আর বাংলাদেশ এক নয়। এখানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য নেই।
দলগুলোর নেতা-নেত্রীদের মধ্যে নেই কোনো মধুর সম্পর্ক। আর এ কারণে বিরোধীদলীয়
নেত্রী সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে বালুর ট্রাক দিয়ে রাস্তা বন্ধ করে
আওয়ামী জোট সরকার উৎসব করতে সক্ষম হয়! সবার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক না থাকার
কারণে, একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ না থাকার কারণে, একে অপরের ক্ষতি করার মানসিকতার কারণে এবং কাউকে কেউ না মানার কারণে
আন্দোলন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। একই কারণে বিএনপির আন্দোলনে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায়
নেই।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন