আওয়ামী লীগ সরকার যখন বিদ্যুৎ উৎপাদনে রেকর্ড সৃষ্টির গালগল্প শোনাচ্ছে, সারা দেশে তখন চলছে সীমা ছাড়ানো লোডশেডিং। বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় গতকাল প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানানো হয়েছে, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় প্রতিদিন গড়ে তিন-চার ঘণ্টা লোডশেডিং করা হচ্ছে। গত ১৩ জুলাই বহু এলাকার মানুষ এমনকি বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনাল পর্যন্ত পুরোটা দেখতে পারেননি। ওদিকে দেশের অন্যসব অঞ্চলে চলছে লোডশেডিংয়ের অঘোষিত উৎসব। কোনো কোনো জেলা শহরে এমনকি ছয় থেকে আট ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং করা হচ্ছে। উপজেলা ও পল্লী এলাকার কথা নিশ্চয়ই আলাদা করে বলার অপেক্ষা রখে না। কিন্তু আপত্তির কারণ হলো এমন বাস্তব অবস্থার মধ্যেও ক্ষমতাসীনরা লজ্জিত হচ্ছেন না, দুঃখও প্রকাশ করছেন না। তারা বরং লোডশেডিং নিয়ে জনগণের সঙ্গে ঠাট্টা-মস্করা করে চলেছেন। শোনাচ্ছেন চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের সেই পুরনো গালগল্প। সবচেয়ে নিষ্ঠুর রসিকতা করেছেন প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা। তিনি বলেছেন, লোডশেডিং নাকি ‘আল্লাহর রহমত’! কারণ অতীত স্মরণে রাখার জন্য মাঝেমধ্যে লোডশেডিং হওয়া নাকি ভালো! বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীও মন্দ শোনাননি। জ্বালানি উপদেষ্টাকে বিপাকে ফেলে তিনি আবার বলে বসেছেন, দেশের কোথাও নাকি এখন ‘এক সেকেন্ডও’ লোডশেডিং হয় না! পিডিবিও কর্তার ইচ্ছায় কর্ম করে চলেছে যদিও সম্প্রতি পিডিবি একটু ঘুরিয়ে লোডশেডিংয়ের সত্যতা স্বীকার করে জানিয়েছে, ৪৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন মেঘনাঘাট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তিনটি ইউনিট অগ্নিকা-ে ভস্মীভূত হওয়ার কারণে উৎপাদন ঘাটতি নাকি ৬৫০ মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেছে। প্রশ্ন উঠেছে, মেঘনাঘাট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতাই যেখানে ৪৫০ মেগাওয়াট, সেখানে তিনটি ইউনিট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ৬৫০ মেগাওয়াটের বেশি ঘাটতি হলো কিভাবে? কর্তা ব্যক্তিরা একই সঙ্গে বেশি গরমে ট্রান্সফরমার পুড়ে যেতে পারে বলে ‘বাধ্য হয়ে’ লোডশেডিং করার যুক্তিও হাজির করেছেন। অর্থাৎ সরকার স্বীকার না করে পারছে না যে, লোডশেডিং আসলেও হচ্ছে।
তথ্যাভিজ্ঞরা কিন্তু সরকারের হিসাবের মধ্যে শুভঙ্করের ফাঁকি লক্ষ্য করেছেন। তথ্য-পরিসংখ্যানসহ তারা দেখিয়েছেন, ক্ষমতাসীনদের দাবি অনুযায়ী সাড়ে ৮ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কখনো উৎপাদিত হয়নি। পাশাপাশি রয়েছে সিস্টেম লসের নামে পুকুর চুরি এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ‘রফা’ করে নেয়া অবৈধ সংযোগ। এসবের ফলে বাস্তবে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ থেকে আড়াই হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত। ওদিকে ২০১২ ও ২০১৩ সালে যে আটটি নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু করার কথা ছিল সেগুলোর নির্মাণ কাজ এখনও শেষ হয়নি। কিন্তু সে সত্য এড়িয়ে এ আটটি কেন্দ্রের ক্ষমতার ভিত্তিতে হিসাব কষে সরকার সাড়ে ৮ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের গালগল্প শুনিয়ে চলেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে রেকর্ড করার দাবিও করা হচ্ছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এমনকি ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড করার কথা শুনিয়েছেন। সরকার একই সঙ্গে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুতের প্রশংসায়ও পঞ্চমুখ রয়েছে। অন্যদিকে দৈনিক সংগ্রামের আলোচ্য রিপোর্টে জানানো হয়েছে, রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে একদিকে দফায় দফায় অযৌক্তিক হারে বিদ্যুতের বিল বাড়ানো হয়েছে, অন্যদিকে ভর্তুকি দেয়ার নামে রেন্টাল কোম্পানিগুলোর ভা-ারে তুলে দেয়া হয়েছে অন্তত ৪১ হাজার কোটি টাকা। বলা দরকার রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের ব্যাপারে অভিযোগের কারণ হলো, এ খাতে বছরে ২২ থেকে ২৪ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত ভর্তুকি দেয়ার দোহাই দিয়ে পর্যায়ক্রমে দাম বাড়ানোর ফলে গ্রাহকদের আটশ’-এক হাজার টাকার স্থলে আড়াই-তিন হাজার টাকা পর্যন্ত বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে। কিন্তু এত কিছুর পরও বিদ্যুৎ সঙ্কট থেকে রেহাই মেলেনি। তেমন সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না।
বিদ্যুতের সঙ্গে শিল্পের উৎপাদন থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়া পর্যন্ত প্রতিটি বিষয় জড়িত বলেই এমন অবস্থা চলতে পারে না। তারওপর এখন চলছে পবিত্র মাস রমযান। একই সঙ্গে সারা দেশে চলছে প্রচ- গরম। সঙ্গত কারণেই সরকারের কৃতিত্বের দাবি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে রেকর্ডের দাবি সত্য হলে এত বিদ্যুৎ যাচ্ছে কোথায়? পর্যালোচনায় দেখা যাবে, বাস্তবে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুতের নামে দলীয় লোকজনকে ব্যবসা পাইয়ে দেয়ার এবং পকেট ভারি করার ব্যবস্থাই শুধু করা হয়েছে। কারণ গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে যেখানে ব্যয় হয় দেড় থেকে দুই টাকার মতো, সেখানে তেলভিত্তিক রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রের ব্যয় ১৪ থেকে ১৬ টাকা। এজন্যই একদিকে সরকার দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে চলেছে, অন্যদিকে দলীয় লোকজনকে বছরে ভর্তুকি দিচ্ছে ২৪ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত। কিন্তু এত বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দেয়ার পরও সঙ্কটের সমাধান হচ্ছে না। তাছাড়া রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রের জন্য সরকার ফার্নেস অয়েলসহ জ্বালানি তেলের দামও বাড়িয়েছে। এর ফলেও ব্যাহত হচ্ছে শিল্পের উৎপাদন। জ্বালানি তেলের দামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পরিবহনের ব্যয় তো বেড়েছেই, চাষাবাদের খরচও অনেক বেড়ে গেছে। একই কারণে বেড়ে চলেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের মূল্য। আমরা মনে করি, দলীয় লোকজনের পকেট ভারি করার জন্য বিপুল অর্থের অপব্যয় করার পরিবর্তে সরকারের উচিত জনগণের কষ্ট ও ভোগান্তিকে প্রাধান্য দেয়া এবং রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে সম্পাদিত অসম চুক্তি বাতিল করা। সরকারকে একই সঙ্গে গ্যাসভিত্তিক প্রচলিত কেন্দ্রগুলোকে সংস্কার করে সেগুলোর মাধ্যমে বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। না হলে মানুষের কষ্ট ও ভোগান্তি তো বাড়বেই, শিল্পায়নের সঙ্গে সামগ্রিক সমৃদ্ধিও বাধাগ্রস্ত হবে। সৃষ্টি হবে না নতুন চাকরির সুযোগ। সুতরাং বিদ্যুতের সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার পদক্ষেপ নিতে হবে অনতিবিলম্বে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন