বৃহস্পতিবার, ৩ জুলাই, ২০১৪

সুষমার ঢাকা সফরের বার্তা


ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ঢাকা সফর করে গেলেন। এটাকে শুভেচ্ছা সফর বলে উল্লেখ করা হলেও এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনুধাবনের চেষ্টার কমতি নেই। সফরকালে বর্ণাঢ্য বিজেপি নেত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের সাথে কথা বলেছেন। বক্তব্য রেখেছেন নিরাপত্তা থিংকট্যাংক আয়োজিত সেমিনারে। সুশীলসমাজের নির্বাচিত প্রতিনিধির সাথেও মতবিনিময় হয়েছে তার। তবে সচেতনভাবেই হয়তো তিনি গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের মুখোমুখি হননি। একটি দৈনিকের লিখিত প্রশ্নের লিখিত সাক্ষাৎকার তার পক্ষ থেকে এসেছে। এর মধ্যে মোদি-সুষমার সম্ভাব্য পররাষ্ট্র কৌশলের উচ্চারিত অনুচ্চারিত বিভিন্ন বার্তা নিয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ চলছে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে সুষমার প্রথম সফর ছিল বাংলাদেশে। তবে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে তিনি দিল্লিতে বৈঠক করেছেন। মোদি সরকারের পররাষ্ট্র কৌশল কেমন হবে তা নিয়ে নির্বাচনের আগে আলোচনা খুব বেশি হয়নি। নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠনের পর এ নিয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ হয়েছে। তবে নরেন্দ্র মোদির বিদেশনীতি অনুচ্চারিত থাকলেও তা নিয়ে যে তার গভীর কিছু ভাবনা রয়েছে তা স্পষ্ট হয় শপথ অনুষ্ঠানে সার্ক নেতৃত্বকে আমন্ত্রণ জানানোর মাধ্যমে। এরপর তিনি প্রথম বিদেশ সফরে গেছেন ভুটানে। তারপর সেপ্টেম্বরে যাবেন যুক্তরাষ্ট্র। জাপান, চীন আর ব্রাজিলও থাকবে তার প্রথম দিককার বিদেশ সফরের তালিকায়। এর পর হয়তো ঢাকায় দ্বিতীয় ঘরপরিদর্শনে আসবেন নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি।

সুষমার ঢাকা সফরের দিন তারিখ ঠিক হওয়ার পর বাংলাদেশের ভেতরে বেশ কিছু তৎপরতা প্রত্যক্ষ করা যায়। আকস্মিকভাবে নির্ধারিত হয়ে যায় সুষমা স্বরাজের ঢাকা সফরের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইসলামি দলের প্রধান মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর মামলার রায়। ভারতীয় কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা প্রণব মুখার্জির প্রেসিডেন্ট হিসেবে আসা প্রথম বাংলাদেশ সফরের সময়ও ইসলামি দলের একজন বড় মাপের নেতার ফাঁসির রায় ঘোষিত হয়েছিল ট্রাইব্যুনালে। এর প্রতিবাদে বিরোধী পক্ষের ডাকা হরতালে প্রণবের ঢাকা সফর সময়ের বড় অংশজুড়ে বাংলাদেশে ছিল সহিংস নিস্তব্ধতা। সে সময় হরতালের কথা উল্লেখ করে বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ভারতীয় প্রেসিডেন্টের সাথে সাক্ষাতের কর্মসূচি বাতিল করেন। এর প্রভাব দেখা যায় কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকারের বাংলাদেশ নীতিতে। নয়া দিল্লি বাংলাদেশে বিরোধী পক্ষের সাথে যোগসূত্র একেবারেই কমিয়ে দেয়। শাসক দল আওয়ামী লীগ ও তার নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রতি একতরফা পৃষ্ঠপোষকতা দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে বেড়ে যায়। বিরোধী পক্ষের ওপর হত্যা নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। ৫ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে নয়া দিল্লির পক্ষ থেকে প্রকাশ্য ভূমিকা নেয়া হয়। ভারতের পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিং বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের সাথে বৈঠক করে নির্বাচনে যেতে চাপ সৃষ্টি করেন। এ ব্যাপারে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকার সাথে সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে বিরোধী জোটনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বিস্তারিত উল্লেখও করেছেন। 

একতরফা নির্বাচনের সময় বাংলাদেশের সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে বিরোধী দল দমনে এখানকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে প্রতিবেশী দেশের বিশেষ বাহিনীর অংশগ্রহণের খবর ছড়িয়ে পড়ে। ধারণা করা হয়, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারকে আবারো ক্ষমতায় নেয়ার ব্যাপারে দিল্লির এই আগ্রাসী ভূমিকায় পৃষ্ঠপোষকতা ছিল প্রণব মুখার্জির। তার সাথে মুজিব পরিবার ও আওয়ামী লীগ নেতাদের ব্যক্তিগত পর্যায়ের সম্পর্ক দীর্ঘ দিনের। একই সাথে এতে বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার প্রণবের সাথে সাক্ষাৎ না করারও একটি যোগসূত্র রয়েছে বলে মনে করা হয়। সাধারণভাবে এই সাক্ষাৎ না হওয়ার কারণ হিসেবে বিএনপির ডানপন্থী নেতা ও জোটের ডান শরিকদের প্রভাব সক্রিয় ছিল বলে মনে করা হয়। অথচ পরে জানা যায়, এই সাক্ষাৎ বাতিলে সক্রিয় ছিল সরকারের উচ্চপর্যায় ও প্রতিবেশী গোয়েন্দা সংস্থার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষাকারী একজনের প্রভাব।

প্রণব মুখার্জির সফরের সেই ফর্মুলা এবার সুষমা স্বরাজের ক্ষেত্রে প্রয়োগের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এর অংশ হিসেবে তার সফরকালে জামায়াতে ইসলামীর আমিরের মামলার রায় নির্ধারণ করা হয়। দিল্লির নতুন সরকারের নীতি প্রণেতারা বিষয়টিকে ভালোভাবে দেখেননি। তারা বাংলাদেশের সাথে রাষ্ট্রিক সম্পর্ক উন্নয়ন করাকে লক্ষ্য হিসেবে দেখছেন। এক পক্ষকে আস্থায় রেখে অন্য পক্ষকে শত্রু বানানোর আগের সরকারের কৌশলকে তারা যথার্থ মনে করেননি। ট্রাইব্যুনালের রায়ের দিন ধার্যে সুষমার সফর স্থগিত হয়ে যাওয়ার শঙ্কা সৃষ্টি হয়। এ ব্যাপারে কঠোর বার্তা আসে ঢাকায়। ট্রাইব্যুনালের রায় স্থগিত হয়। শেষ পর্যন্ত সুষমার সফরও হয় নিরুদ্বিগ্ন। দিল্লির তাৎপর্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পায় ঢাকা।

ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরে বিএনপি চেয়ারপারসন ও ১৯ দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাথে সুষমার বৈঠক নিয়ে পর্দার অন্তরালে চলে নানা ঘটনা। সরকারপক্ষ চায়নি এই বৈঠক হোক। কর্মসূচিতে বৈঠকটি না রাখতে প্রচেষ্টা নেয়া হয় বিভিন্নভাবে। দিল্লির সাউথ ব্লক বা ঢাকার মিশনে দায়িত্ব পালন করছে কংগ্রেস আমলের সেটআপ। তাদের বিশেষ সহানুভূতি রয়েছে বাংলাদেশ সরকারের রাজনৈতিক এজেন্ডার প্রতি। প্রশ্ন উঠানো হয় কোন ক্যাপাসিটিতে ১৯ দল নেত্রীর সাথে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠক হবে। তিনি তো এখন আর বিরোধী দলের নেত্রী নন। সফরের রুটিন সূচি থেকে বাদ দেয়া হয় এ কর্মসূচি; কিন্তু বিজেপি নেতৃত্ব ভালো করেই জানে বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচন হলে বেগম খালেদা জিয়াই হতে পারতেন প্রধানমন্ত্রী। স্থানীয় মিশন বা সাউথ ব্লকের কর্তারা না চাইলেও ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ইচ্ছায় শেষ পর্যন্ত সুষমার সাথে সাক্ষাৎ হয় খালেদা জিয়ার। শুধু আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎই নয়, একই সাথে সুষমার প্রস্তাবে দুজনের মধ্যে সংক্ষিপ্ত একান্ত বৈঠকও হয়। 

বিজেপি নেতৃত্ব বাংলাদেশের সাথে পররাষ্ট্র সম্পর্কে আসলেই কী চান তার নীরব বার্তা পাওয়া যায় এই ঘটনায়। সুষমা স্বরাজ নিজে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের মুখোমুখি হননি। সাংবাদিকদের সামনে আসেননি বাংলাদেশের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী বিদেশসচিব সুজাতা সিংও। ব্যতিক্রমীভাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আকবর উদ্দিন সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছেন। তবে ঢাকার একটি দৈনিকে সুষমা স্বরাজ লিখিত সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। বিস-এর সেমিনারে রাখেন বক্তব্য। উভয় ক্ষেত্রেই বিজেপি সরকারের বাংলাদেশ নীতি নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

বিস-এর সেমিনারে সুষমা স্বরাজ গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, ‘অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জেনেছি, গণতন্ত্রের জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি সহনশীলতার সংস্কৃতি, অংশগ্রহণ ও ভিন্নমতের বিকাশ প্রয়োজন।এ বক্তব্যটিকে মনে করা হয় যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হওয়ায় বাংলাদেশের সুশাসনের েেত্র যে সমস্যা চলছে, সেটি প্রতিফলিত হয়েছে এ বক্তব্যে। কংগ্রেস অতীতে যেভাবে আওয়ামী লীগ সরকারের সব প্রক্রিয়ায় সমর্থন জুগিয়েছে, বিজেপি সেভাবে সমর্থন না ও দিতে পারেÑ এ রকম আভাসও পাওয়া যায় এ বক্তৃতায়। সুষমা স্বরাজ ঢাকা সফরকালে বারবার বলেছেন, তার সরকার বাংলাদেশে যে সরকারই আসুক না কেন, তাদের সাথে কাজ করতে চায়। দুই দেশের জনগণের মধ্যে সম্পর্ক নির্মাণ করতে চায় মোদির নেতৃত্বাধীন ভারত। ঢাকা ত্যাগের আগে বিমানবন্দরে তিনি এই কথা বলেছেন। সুষমা জানিয়েছেন তিনি বিরোধী জোটনেত্রী খালেদা জিয়াকে বলেছেন, ‘দুই দেশের জনগণের সম্পর্ক নিবিড় হোক, সেটা ভারত সরকার চায়। বাংলাদেশের সরকারের সঙ্গে ভারত সরকারের সম্পর্ক থাকবে। বাংলাদেশে যে দলই মতায় আসুক, তার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে গুরুত্ব দেবে ভারত। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো বাংলাদেশের লোকজনকেই মেটাতে হবে।একই ধরনের বক্তব্য সুষমা ঢাকার একটি দৈনিকের সাথে সাক্ষাৎকারেও দিয়েছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের নির্বাচনের ওপর আমাদের রায় দেয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশে রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কী হবে, তা এই দেশের জনগণই নির্ধারণ করবেন। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ভবিষ্যৎমুখী। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক এই দুই দেশের ভবিতব্য নির্ধারণে যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, সেটাকে বিবেচনায় নিয়েই আমরা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি নির্ধারণ করি।

বিজেপি সরকার দুদেশের সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে কোনো দলের সাথে বিশেষ সম্পর্ক যেমন নির্মাণ করবে না তেমনিভাবে ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের পর গঠিত সরকারের সাথে দূরত্ব বজায় রেখে চলবে এমনটিও তার বক্তব্যে ইঙ্গিত পাওয়া যায় না। এ বিষয়ে তার বক্তব্য স্পষ্ট। সুষমা তার সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেন, ‘আমাদের সরকার বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সাথে সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করবে। দুটি দেশের মধ্যকার সম্পর্ক নির্ভর করে দুই দেশের জনগণ ও সরকারের মধ্যকার সম্পর্কের ওপর। আমরা বাংলাদেশের সাথে একটি ব্যাপকভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশীদারিত্ব তৈরি করার ইচ্ছা রাখি, আর সেটা সমাজের সবাইকে নিয়েই আমরা করতে চাই।এই বক্তব্যে স্পষ্ট বোঝা যায় কেন শেখ হাসিনা সরকারের ইচ্ছার বাইরে গিয়ে সুষমা স্বরাজ বিরোধী জোটনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাথে বৈঠক করেছেন। তিনি কংগ্রেস সরকারের চাপের মুখে আদায় করা খাল-নদী ভরাট করে ট্রানজিটের মতো সুবিধার পরিবর্তে স্বেচ্ছামূলক টেকসই সম্পর্ক নির্মাণ করতে চাইছেন ঢাকার সাথে। তার অজানা নয় বাংলাদেশে মুক্ত নির্বাচন হলে কোন পক্ষ সরকার গঠন করবে। আজ হোক কাল হোক সে সরকারই বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা পাবে। 

কংগ্রেস ও বিজেপির বাংলাদেশ নীতিতে বিশেষ কিছু পার্থক্য স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। কংগ্রেস বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে যেভাবে জড়িত হয়ে পড়েছিল বিজেপি সেভাবে এখানকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইবে না। কংগ্রেস সরকার বাংলাদেশে ৫ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানে সব ধরনের কূটনৈতিক-অকূটনৈতিক সহযোগিতা দিয়েছে। এ নির্বাচন অনুষ্ঠানে এক দিকে যেভাবে বিরোধী দলের প্রতিরোধ আন্দোলন প্রতিহত করতে সহায়তা দিয়েছে, তেমনিভাবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের নির্বাচনে সমর্থন জোগাড় করে দেয়ার প্রচেষ্টাও নিয়েছে। বিজেপি সরকার ৫ জানুয়ারি-উত্তর সরকারকে টিকিয়ে রাখতে সে ধরনের ভূমিকা নেবে না। এখানকার রাজনৈতিক পরিবর্তনে বাধা হওয়া অথবা বাধ্য করা কোনো ভূমিকাই তারা অতীতের মতো নেবে না। তারা সরকার এবং জনসমর্থনপুষ্ট বিরোধী দলের সাথে সমান্তরাল সম্পর্ক রক্ষা করবে। মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচার ট্রাইব্যুনালের মতো সংবেদনশীল ইস্যুতে বিজেপি আগের কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকারের মতো কোনো ভূমিকা নেবে না। এ দেশের রাজনীতির ইস্যুগুলোকে এখানকার রাজনৈতিক ও অন্য শক্তির ওপর ছেড়ে দেবে। 

বাংলাদেশে ভারতের কংগ্রেসের একই ঘরানার সেক্যুলার দলকে ক্ষমতায় রাখা এবং এর বিপরীত রাজনীতিকে দুর্বল করার ব্যাপারে যে ভূমিকা ইউপিএ সরকারের সময় ছিল, সেটি বর্তমান এনডিএ সরকারের সময় থাকবে না। বিজেপি রাজনীতিতে ধর্মের শক্তি ব্যবহারকে অসঙ্গত মনে করে না। সেটি হিন্দু মুসলিম খ্রিষ্টান বা বৌদ্ধ যে ধর্মই হোক না কেন। কংগ্রেস নিজ দেশে বিজেপির বিরুদ্ধে যে ভূমিকা নিয়েছে, বাংলাদেশে ইসলামিস্টদের ব্যাপারে একই ভূমিকা নিয়েছে। বিজেপি সে ভূমিকায় আবির্ভূত হতে চায় না। দলটি বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়। আবার রাজনৈতিক সহিংসতার সময় সংখ্যালঘুদের ওপর আসলেই কারা হামলা চালিয়েছিল তেমন একটি গোপন প্রতিবেদনও তাদের কাছে আছে। 

এসবের বাইরে দর্শনগত একটি বিষয় কংগ্রেস ও বিজেপি সরকারের বাংলাদেশ নীতিতে পার্থক্য এনে দিতে পারে। সেটি হলো নেহরু ডকট্রিনে বিজেপির অনাস্থা। নেহরু ডকট্রিন অনুযায়ী ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর দিল্লির এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। তাদের ভৌগোলিক স্বতন্ত্র মানচিত্র থাকলেও সব ক্ষেত্রে সার্বভৌম সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো শক্তি থাকবে না। এ কারণে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকারগুলো সব সময় বাংলাদেশের রাজনীতি অর্থনীতি এমনকি নিরাপত্তাব্যবস্থাকেও নিয়ন্ত্রণ বা প্রভাবের মধ্যে রাখার চেষ্টা করেছে। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আই কে গুজরাল এই ডকট্রিন থেকে বেরিয়ে নতুন ধারণা দেন। প্রতিবেশী দেশগুলোতে ভারতের প্রভাব বিস্তারের জন্য তিনি নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টার পরিবর্তে বড় দেশ হিসেবে কিছু একতরফা ছাড় দিয়ে নৈতিক প্রভাব বিস্তারে বিশেষ গুরুত্ব দেন। নরেন্দ্র মোদির পররাষ্ট্র সম্পর্ক এই দুই ডকট্রিনের মাঝামাঝি হতে পারে বলে আভাস পাওয়া যায়। এর মূল ভিত্তি হবে পরস্পরের মধ্যে সহযোগিতা, একে অন্যের দিকে এগোনো। তিনি ভুটান সফরের সময় উল্লেখ করেছেন, প্রতিবেশীরা ভারতের প্রতি অগ্রসর হলে তিনি তাদের দিকে এগোবেন। এর মধ্যে একতরফা দায়িত্ব পালনের বিষয় না থাকলেও গায়ের জোরে নিয়ন্ত্রণের বিষয়ও নেই। মোদি দেবেন আর নেবেন তত্ত্বকে সম্পর্কের ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করতে পারেন। বাজপেয়ির পররাষ্ট্রনীতিতেও এর কিছুটা ছাপ ছিল। 

বিজেপি ও কংগ্রেসের নীতির আরেকটি বড় পার্থক্যের এলাকা হলো আর্থ-রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। কংগ্রেস আধা সমাজতান্ত্রিক দল হিসাবে নিজের বিকাশ ঘটিয়েছে। আজীবন থেকেছে সোভিয়েত বলয়ে। সামাজিক নিরাপত্তা জাল তৈরি ও দরিদ্রদের নামমাত্র দামে খাদ্য সরবরাহের মতো নানা কর্মসূচি ছিল দলটির। বিজেপি বিশেষত নরেন্দ্র মোদি সে নীতিতে একেবারে বিশ্বাস করেন না। তিনি মনে করেন, দরিদ্রদের বিনামূল্যে খাবার নয়, তাদের খেটে খাওয়ার মতো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য তিনি গুজরাটে ব্যাপক দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছিলেন। সর্বভারতের দায়িত্ব নিয়েও তিনি একই দিকে অগ্রসর হতে চাইছেন। প্রতিবেশী নীতির ক্ষেত্রে তার এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাবও রয়েছে। কংগ্রেস যেখানে প্রতিবেশীদের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে সেসব দেশের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হওয়ার পথে নানাভাবে বাধা সৃষ্টির নীতি অন্তরালে অনুসরণ করেছে, সেখানে মোদির বক্তব্য হলো প্রতিবেশী দেশ থেকে অনুপ্রবেশ বন্ধ নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করে হবে না। সমান্তরাল অর্থনৈতিক উন্নয়নকেও উৎসাহিত করতে হবে। এ নীতি কার্যকরভাবে অনুসরণ করতে পারলে আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে একটি নতুন অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। নরেন্দ্র মোদি আঞ্চলিক বিরোধের জটে জড়িয়ে ভারতের সামনে বিশ্বশক্তি হিসেবে স্বীকৃতি লাভে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে চান না। তিনি আঞ্চলিক নেতা হতে চান প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে আস্থার সম্পর্ক বজায় রেখে। 

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, নরেন্দ্র মোদির ভিশন অনেক বড়; কিন্তু ভারতের সামরিক বেসামরিক ও গোয়েন্দা সংস্থার আমলাতন্ত্র এমন এক কাঠামো তৈরি করে রেখেছে, যার বাইরে অনেক সময় রাজনৈতিক নেতৃত্ব যেতে পারে না। এটিকে অতিক্রম করে নরেন্দ্র-সুষমা কতটা প্রতিবেশীদের মধ্যে আস্থা ও সহযোগিতার সম্পর্ক নির্মাণ করতে পারেন সেটিই লক্ষ করার বিষয়। 

মাসুম খলিলী


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads