বুধবার, ২৩ জুলাই, ২০১৪

আবারও সেই কর্তৃত্ববাদী শব্দমালা


দুর্বৃত্তায়ন গণতন্ত্রের প্রতীক হতে পারে না, রাজনীতিরও নয়। অথচ দুর্বৃত্তায়ন ক্রমেই গ্রাস করে চলেছে আমাদের রাজনীতিকে। এমন রাজনীতির সামর্থ্য থাকে না দেশ ও জনগণের কল্যাণ করার। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, অনাকাক্সিক্ষত এমন রাজনৈতিক বাতাবরণেই আমাদের বসবাস। মানুষ অনেক সময় বর্তমানের দুঃখ-যন্ত্রণা সহ্য করে সুন্দর ভবিষ্যতের আশায়। কিন্তু ভবিষ্যত যে উজ্জ্বল হবে এমন সম্ভাবনা কোথায়? আমরা শুনে এসেছি, শিক্ষাই জাতির মেরুদ-। আমরা এ কথাও শুনেছি যে, আজকের শিক্ষিত তরুণরাই জাতির ভবিষ্যৎ। কিন্তু আমরা এ কেমন ভবিষ্যৎ গড়ছি? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তো দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ। শ্রেষ্ঠ এই বিদ্যাপীঠে যা চলছে তা দেখার জন্য তো কাগজে কলমে কর্তৃপক্ষ আছে। কিন্তু সে কর্তৃপক্ষ কেন সক্ষমতা হারিয়ে বসে আছে, তা জানার কিংবা বোঝার দায়িত্ব কেউ অনুভব করছে না। ফলে আমাদের ভবিষ্যৎ যেন আমরা নিজেরাই বিনষ্ট করে চলেছি। কোন স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক দেশে বিপর্যয়ের এমন খোলামেলা চিত্র মেনে নেয়া যায় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অনুযায়ী হলসমূহে শিক্ষার্থীদের আবাসন সমস্যার সমাধানসহ সব কর্মকা- পরিচালিত হওয়ার কথা কর্তৃপক্ষের নির্দেশে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, হলগুলোর উপর প্রশাসনের কোনো নিয়ন্ত্রণই নেই। ফলে হলগুলোতে শিক্ষার্থী উঠানো, কক্ষগুলো বরাদ্দ দেয়া, হলে কে থাকবেন, কে থাকবেন নাÑ সবই নির্ভর করে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাদের মর্জির  উপর। তাদের কাছে জিম্মি হাজারও শিক্ষার্থী। ২৩ জুলাই প্রকাশিত প্রথম আলোর এক রিপোর্টে বলা হয়, হলগুলোতে প্রাধ্যক্ষরা কার্যত নিষ্ক্রিয়, আবাসিক শিক্ষকরা খোঁজ নেন না সাধারণ শিক্ষার্থীদের। হল প্রশাসন শিক্ষার্থীদের হলে তোলার কথা থাকলেও কাজটি করেন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রনেতারা। আর এ সুযোগে প্রথম বর্ষের ছাত্রদের হলে তুলে জোর করে মিছিলে নেয়া হয়। হলগুলোতে খোঁজ নিয়ে এবং ছাত্রলীগের হল শাখার নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের অন্তত এক হাজার শিক্ষার্থী হলে উঠেছেন। এদের উঠানোর পেছনে সবচেয়ে বড় পরিচয় ছিল, তারা সবাই ছাত্রলীগ করেন। উল্লেখ্য যে, সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ৯৭জন শিক্ষার্থী উঠেছিলেন। তাদের গত ১০ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে ছাত্রলীগ বের করে দেয়। তাদের নিজ নিজ এলাকার আওয়ামী লীগ নেতার সুপারিশ নিয়ে আসতে বলা হয়। পরে ওই শিক্ষার্থীদের অনেকে নিজ এলাকার আওয়ামী লীগ নেতাদের সুপারিশপত্র এনে হলে উঠেছেন বলে জানা গেছে। অভিযোগ রয়েছে, হলে থাকতে হলে ছাত্রলীগের মিছিল-সমাবেশে অংশগ্রহণ অনেকটা বাধ্যতামূলক। চলতি বছর বিভিন্ন হলে ওঠা প্রথম বর্ষের ১২জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বললে প্রতিবেদককে জানানো হয়, হলে ওঠার পর বিভিন্ন সময়ে রাতে মিছিলের নামে প্রথম বর্ষের ছাত্রদের দিয়ে মহড়া দেওয়ান ছাত্রনেতারা। এমন কি অনেক সময় তাদের দিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আকস্মিক অভিযানের নামে বেড়াতে আসা বাইরের লোজনকে অপদস্ত বা মারধোর করানো হয়। এর মাধ্যমে মফস্বল থেকে আসা শিক্ষার্থীদের ‘সাহসী’ করার নামে মূলতঃ মারামারির প্রাথমিক পাঠ দেয়া হয়। এসব অভিযোগ অবশ্য অস্বীকার করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদী হাসান। তিনি দাবি করেন, ‘আমরা সবাইকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সংগঠনে যোগ দেয়ার আহ্বান জানাই। জোর করে কাউকে রাজনীতি করানোর নজির আমাদের নেই।’ মেহেদী হাসান অস্বীকার করলেও ছাত্রনেতাদের নির্দেশ না শুনলে যখন-তখন ছাত্রদের হল থেকে পিটিয়ে বের করে দেয়ার অনেক নজির রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিস ও সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী গত এক বছরে অন্তত ৯৪জন শিক্ষার্থীকে হল থেকে বের করে দিয়েছে ছাত্রলীগ। ছাত্রদলের দপ্তর সম্পাদক নাজমুল হাসান অভিযোগ করেন, শুধু ছাত্রদল করার কারণে গত ৫ বছরে ১৪৩ জনকে হল থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। অবশ্য বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন ছাত্রদল একইভাবে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করেছিল। হল থেকে ছাত্রলীগের অনেক কর্মীকে বের করে দিয়েছিল। দুর্বৃত্তায়নের এমন পরিবেশ থাকলে ছাত্ররা জাতির কাক্সিক্ষত ভবিষ্যৎ হবে কেমন করে? অনাকাক্সিক্ষত এমন কর্মকা- থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে রক্ষা করতে হলে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদদের পক্ষ থেকে তেমন কোনো উদ্যোগ তো দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। এর ফলাফল যা হবার তাই হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতারা বিদ্যাচর্চার দায়িত্ব পালনের বদলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে অনাকাক্সিক্ষত কিছু কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছে। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও সন্ত্রাসের সাথে তাদের নাম যুক্ত হচ্ছে। এসব নিয়ে স্বার্থের লড়াইয়ে নিজেদের মধ্যেও হানাহানি হচ্ছে। হচ্ছে আহত ও নিহত হওয়ার ঘটনাও। দুর্বৃত্তায়নের সংস্কৃতি এখন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রনেতাদের শুধু বেপরোয়া করে তুলছে না, মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধকেও তারা বিসর্জন দিচ্ছে। নইলে ছাত্রলীগের নেতারা অধ্যক্ষের টেবিলে অস্ত্র রেখে প্রাণনাশের হুমকি দেয় কেমন করে? শীর্ষ নিউজের খবরে বলা হয়, কিশোরগঞ্জের সরকারি গুরুদয়াল কলেজে গত সোমবার ভর্তি কার্যক্রম পরিচালনার সময় কলেজ ছাত্রলীগ নেতা হেভেনের নেতৃত্বে কতিপয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মী তাদের কিছু দলীয় ছাত্রকে ভর্তির সুপারিশ করে। কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ নিয়মের বাইরে ছাত্রভর্তির কোনো সুযোগ নেই বলে জানালে, ছাত্রলীগ নেতারা অধ্যক্ষের কক্ষে ঢুকে তাদের তালিকা মতো ছাত্রভর্তির জন্য চাপ দেয়। অধ্যক্ষ এতে অসম্মতি জানালে ছাত্রলীগ নেতা হেবেন অস্ত্র বের করে অধ্যক্ষের টেবিলের উপর রাখে এবং তাদের ছাত্রভর্তির সুপারিশ মানা না হলে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। এ সময় তারা অধ্যক্ষের কক্ষের জিনিসপত্র তছনছ করে। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। রাজনীতি করলে শিক্ষিত তরুণদেরও যদি এমন অধঃপতন ঘটে তাহলে এই রাজনীতির কোনো প্রয়োজন আছে কি?
আমরা জানি, যে কোনো কাজের সফলতার জন্য প্রয়োজন নেতৃত্বের সঙ্গত দায়িত্ব পালন। এমন দায়িত্ব পালন করতে গেলে প্রয়োজন হয় শিক্ষা-দীক্ষা, আদর্শবোধ, নৈতিকতা ও ত্যাগ-তিতিক্ষার। এসব গুণাবলী ব্যতিরেকে কেউ নেতৃত্বের চেয়ারে বসলেও তার দ্বারা কাক্সিক্ষত দায়িত্ব পালন সম্ভব হয় না, বরং দেশ ও জনগণের ক্ষতির মাত্রাই বৃদ্ধি পায়। দেশে বর্তমান সময়ের দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি তার বড় প্রমাণ। এই রাজনীতির কারণেই দেশের ভবিষ্যৎ শিক্ষিত তরুণরা এখন বিভ্রান্তির অলিগলিতে বিনাশের পথে হাঁটছে। দুঃখের বিষয় হলো, আমাদের রাজনীতিবিদরা এখন নেতৃত্বের দায়িত্ব পালনের বদলে কর্তৃত্বের ছড়ি ঘোরাতে ব্যস্ত। কর্তৃত্ববাদী রাজনীতিবিদদের কারণেই দেশে গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটছে না। বরং কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতায় অর্থবল ও বাহুবল এখন তাদের কাছে মুখ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু এর ফলাফল কখনও দেশ, জনগণ এমনকি তাদের নিজেদের জন্যও ভাল হবে না। এ প্রসঙ্গে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রসঙ্গ টেনে কথা বলা যায়। বিশাল সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যখন ছত্রখান হয়ে গেল, তখন পলিট ব্যুরোর এক সদস্যকে প্রশ্ন করা হয়েছিলÑ কেন এমনটি হলো? তখন সোভিয়েত সা¤্রাজ্য পরিচালনাকারী পলিট ব্যুরোর সে সদস্য জবাবে বলেছিলেনÑ আমরা পলিট ব্যুরোর সদস্যরা নেতৃত্বের  দায়িত্ব পালনের বদলে কর্তৃত্বের ছড়ি ঘুরিয়েছি, তাই এমন পরিণতি হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের মত শক্তিশালী একটি রাষ্ট্রের এমন করুণ পরিণতি দেখেও আমাদের ছোট্ট দেশটির ছোট- ছোট নেতাদের কোনো বোধোদয় ঘটবে কিনা কে জানে?
তবে আপাতত আমাদের দেশের মন্ত্রী বাহাদুরদের চলনে-বলনে যে অভিব্যক্তি প্রকাশিত হচ্ছে, তাতে সহসা বোধোদয়ের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। নারায়ণগঞ্জে দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতির কারণে ৭ খুনের ঘটনায় সারাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু আমাদের এক মন্ত্রী সেই ঘটনাকে কোনো বড় বিষয় বলে মানতে রাজি নন। তিনি বরং গণমাধ্যম কর্মীদের হুমকি দিয়ে বলেন, ‘আপনাদের জন্য এমন আইন করা হচ্ছে যাতে ভবিষ্যতে আপনাদের স্বাধীনতাই থাকবে না। নারায়ণগঞ্জে ৭ খুনের ঘটনার চিত্র বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে দেখানোয় সমাজকল্যাণ মন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী এই হুমকি দেন। গত ২২ জুলাই সচিবালয়ে এক সভায় তিনি বলেন, ‘আপনারা যা ইচ্ছা তাই দেখাবেন, বারবার দেখিয়ে একটা সেন্টিমেন্ট তৈরি করবেন, মানুষকে উত্তেজিত করছেন।’ মন্ত্রীর এমন বক্তব্যে কর্তৃত্ববাদী মানসিকতারই প্রকাশ ঘটেছে।
মন্ত্রী বাহাদুরের আকাক্সক্ষা তারা যেভাবে চাইবেন মিডিয়া যেন সেভাবেই চলে। এমনটি হলে মিডিয়ার আর কোনো প্রয়োজন আছে কি? মিডিয়ার কাজ হলো ঘটনার বস্তুনিষ্ঠ প্রকাশ। ঘটনা কার পক্ষে-বিপক্ষে গেল তা বিবেচনা করা মিডিয়ার কাজ নয়। মিডিয়ার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো, স্টাবলিশমেন্টের ভুল-ত্রুটি তুলে ধরা-যাতে সরকার ও কর্তৃপক্ষ সচেতন হতে পারে এবং জনগণও বিষয়গুলো সম্পর্কে অবহিত হতে পারে। যে কোনো সভ্যদেশে মিডিয়ার এই কাজকে প্রশংসার চোখে দেখা হয়। সরকারও কালো আইনের মাধ্যমে মিডিয়ার স্বাধীনতা খর্ব করতে চায় না। কিন্তু আমাদের মন্ত্রী বাহাদুর শোনালেন ভিন্ন কথা। গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতা ও দায়িত্ববোধের বদলে তিনি উচ্চারণ করলেন কর্তৃত্ববাদী শব্দমালা।
কর্তৃত্ববাদী মানসিকতার কারণে আমাদের রাজনীতি ভুল পথে হাঁটছে, ছাত্র রাজনীতিও বিভ্রান্তÑ এর পরিণতি আমাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের বার্তা শোনায় না। যারা এখন আমাদের সুন্দর ভবিষ্যতের কথা শোনাতে চাইছেন, তারা বাস্তব-বার্তা কতটা উপলব্ধি করছেন সেটাই এখন দেখার বিষয়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads