কার্যত একটি অনির্বাচিত সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, স্বাধীনতার ৪৩ বছরেও আমাদেরকে ভোটের অধিকারের জন্য আন্দোলন করতে হচ্ছে। যে জাতি তার ভোটের অধিকার রক্ষা করতে পারে না তাকে পদে পদে গ্লানি বহন করতে হয়। বিশ্বের দরবারে তাদের মর্যাদা হয় ভূলুণ্ঠিত। অনেকেই বলেন, আইনের দৃষ্টিতে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বৈধ, তবে নৈতিকতার দৃষ্টিতে তা সঠিক নয়। আমি বলি People’s will is the supreme law জনগণের ইচ্ছাই সর্বোচ্চ আইন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করে জনগণ এ সরকারকে প্রত্যাখ্যান করেছে। শতকরা ৫ ভাগ ভোটারও ভোটকেন্দ্রে যায়নি। ১৫৩টি আসনে বিনা ভোটে প্রার্থী বিজয়ী হয়েছে। যে সরকারের প্রতি ৫ ভাগ ভোটারেরও কোন সমর্থন নেই, যে সরকারকে কেউ মানে না, সে সরকার জনগণের সরকার নয়। জোরপূর্বক শক্তি প্রয়োগ করে তারা ক্ষমতা দখল করেছে।
৫ জানুয়ারির প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা দখল করার পর দেশে-বিদেশে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্নের সৃষ্টি হলেও আওয়ামী লীগ তা আমলে নিচ্ছে না। জনগণের ভোটাধিকার হরণ করে ক্ষমতা দখলের যে ঘৃণ্য ধারা আওয়ামী লীগ সৃষ্টি করেছে তা গণতন্ত্রের জন্য অশনি সংকেত। সরকারের বিরুদ্ধে আপাতত তেমন কোন আন্দোলন না থাকলেও সর্বত্রই এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। রাজনীতিতে চরম অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা বিদ্যমান। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশের অর্থনীতিতে। বৃদ্ধি পাচ্ছে জনদুর্ভোগ।
অনির্বাচিত, অবৈধ সরকারের অধীনে দেশের অর্থনীতির কোন উন্নয়ন হতে পারে না। গণবিচ্ছিন্ন সরকার জনগণের কল্যাণে কার্যকর কোন ভূমিকা পালন করতে পারে না। আওয়ামী লীগের অপশাসনে দেশের অর্থনৈতিক অঙ্গনে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে এসেছে।
বিনিয়োগ, রাজস্ব আদায়, রফতানি ও রেমিটেন্সের মতো প্রধান প্রধান অর্থনৈতিক সূচকের দুরবস্থার মধ্য দিয়ে অর্থনীতির অনাগত বিপর্যয়ের লক্ষণ ক্রমেই স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। এসব দুর্দশার প্রধান কারণ হলো রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে বড় ধরনের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়তে হবে।
ব্যক্তি জীবনের আয়, বিনিয়োগ, শিল্পায়ন, ব্যাবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি, রেমিটেন্স প্রবাহ, উৎপাদন সর্বত্রই বিপর্যয়, স্থবিরতা। প্রকৃত পক্ষে মানুষের আয় বাড়ছে না। বিনিয়োগ না হওয়ায় কর্মসংস্থানের পথ সংকুচিত হয়ে পড়ছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দাবস্থা বিরাজ করছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছে অব্যাহত গতিতে। সমাজের নি¤œবিত্ত মানুষ ক্রমেই অসহায় হয়ে পড়ছে। সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় মানুষের আয় ও জীবন যাত্রার মান বেড়েছে। কিন্তু সমাজের স্বল্প আয়ের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে এমনটি বলার অবকাশ নেই। বরং সম্পদের অসম বণ্টন বেড়েছে। সমাজে একটি উঠতি ধনিক শ্রেণীর সৃষ্টি হয়েছে, যারা নানা ধরনের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদ গড়ে তুলেছেন। কিন্তু সমাজের খেটে খাওয়া মানুষ, নি¤œ আয়ের কর্মজীবীদের অবস্থা আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে। কর্মসংস্থানের অভাবে প্রতিটি পরিবারে বেকার সমস্যা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে।
সরকার এক ধরনের কসমেটিক উন্নয়নের পরিকল্পনা নিয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকার বড় বড় প্রকল্পের দিকে সরকারের আগ্রহ বেশি। বড় প্রকল্প মানে বড় দুর্নীতি। কিছু লোকের অর্থ বানানোর উপায়। কিন্তু সমাজের নি¤œবিত্ত বা নি¤œ-মধ্যবিত্তদের জীবনমান উন্নয়ন বা রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর ব্যাপারে কোন উদ্যোগ চোখে পড়ে না। দরিদ্র কিংবা নি¤œবিত্ত মানুষের জন্য রাষ্ট্রীয় সুবিধা দিন দিন কমে আসছে।
দেশের কর্মসংস্থান বলতে গেলে পুরোটাই এখন ব্যক্তি মালিকানাধীন খাতে চলে গেছে। সরকারিভাবে কর্মসংস্থানের যে সুযোগ তা এখন ক্ষমতাসীনদের দলবাজি আর ভাগ বাটোয়ারার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অপরদিকে অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও ব্যবসায় বাণিজ্যে মন্দাবস্থার কারণে ব্যক্তি মালিকানাধীন খাতে এখন কর্মসংস্থান দূরে থাক অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।
বিনিয়োগ না হওয়ায় শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। বিনিয়োগ না থাকায় কর্মসংস্থান বাড়ছে না। ব্যক্তি খাতে কর্মসংস্থান আশংকাজনক হারে কমে যাচ্ছে। বিনিয়োগ বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী ২০১০-১১ অর্থ বছরে ব্যক্তিখাতে নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে ৫ লাখ ৩ হাজার। পরবর্তীতে কমতে কমতে চলতি অর্থ বছরের ৭ মাসে ১ লাখ ২৭ হাজারে এসে দাঁড়িয়েছে। বিনিয়োগ বাড়লে নতুন শিল্প কারখানা গড়ে উঠলে, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটলে কর্মসংস্থান এভাবে হ্রাস পাবার কথা নয়। শিল্পের প্রধান খাত গার্মেন্টস নানা সমস্যার সম্মুখীন। ইতোমধ্যে বহু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বহু কারখানায় উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। শুধু তাই নয়, রফতানিও আাশানুরূপ হয়নি। রফতানির দিক থেকে বাংলাদেশ তার দ্বিতীয় অবস্থান হারিয়েছে। ভারত দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে। অর্থনীতি ও উন্নয়নের অন্যান্য দিক নেতিবাচক। বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কোন বছরই শতভাগ হচ্ছে না। বিনিয়োগ, শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান এবং ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ছাড়া কোন দেশের কাক্সিক্ষত উন্নয়ন অগ্রগতি ত্বরান্বিত হওয়া সম্ভব নয়। বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবসান ব্যতীত এর পরিবর্তন সম্ভব নয়।
একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের লক্ষ্য হলো বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পের পাশাপাশি গরীব ও নি¤œবিত্ত মানুষের জন্য রাষ্ট্রীয় সুবিধা বাড়ানো। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সরকার সে লক্ষ্য থেকে অনেক দূরে চলে এসেছে। জনগণের কল্যাণ সাধন সরকারের মূল লক্ষ্য নয়। সরকার ব্যস্ত প্রতিপক্ষকে দমন করে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে। ২০০৮ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় ডিজিটাল কারচুপির মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সরকার পরিকল্পিতভাবে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করেছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকারের উচিত ছিল ১৬ কোটি মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা। কিন্তু তা না করে সরকার জাতিকে বিভক্ত করার নানা ইস্যু সামনে টেনে এনেছে। সরকার ভেবেছিল তারা ছাড়া আর কেউ থাকতে পারবে না। এই মানসিকতা থেকেই অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীদের খুন, গুম, অপহরণ করা হয়। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে গণহারে গ্রেফতার করা হয়। সরকারের জুলুম, নিপীড়নে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। ফলে অর্থনীতির গতি মুখ থুবড়ে পড়ে। দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে দেশে বিনিয়োগে চরম স্থবিরতা বিরাজ করছে। শিল্পে, গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটের কারণে অবকাঠামোগত দুর্বলতা ও বিনিয়োগহীনতাকে বাড়িয়ে তুলেছে।
রেমিটেন্স প্রবাহে ভাটা
গত ২১ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মত কমে গেছে রেমিটেন্স প্রবাহ। গত বছরের চেয়ে রেমিট্যান্স কমে গেছে সাড়ে ২৩ কোটি ডলার, যা স্থানীয় মুদ্রায় প্রায় ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা কম। এর আগে কখনো রেমিটেন্স প্রবাহ কমেনি, বরং প্রতি বছরই আগের বছরের চেয়ে বেশি এসেছে। দেশের অর্থনীতিতে রেমিটেন্সের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রেমিটেন্স আয় কমে গেলে জাতীয় অর্থনীতির জন্য তা ভাবনার বিষয়। কাজেই এর কারণগুলো দ্রুত চিহ্নিত করে প্রতিকারের ব্যবস্থা নেয়া উচিত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ বেশ কয়েকটি শ্রম বাজার হারিয়েছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য, যা বাংলাদেশের বৃহত্তম শ্রমবাজার। বেশ কয়েকটি দেশে নতুন জনশক্তি রপ্তানি কমে গেছে। এটি রেমিটেন্স কমার অন্যতম কারণ সন্দেহ নেই। তবে দেশে রাজনৈতিক সহিংসতা ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এর একটি বড় কারণ। প্রবাসীদের অনেকেই অর্থ পাঠান বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে। অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তারা দেশে বিনিয়োগে উৎসাহিত হবেন না এটাই স্বাভাবিক।
মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা দেশের জনশক্তি রপ্তানি খাতে এক দফা আঘাত এসেছে। লিবিয়া, সিরিয়া ও বাহরাইন থেকে অনেক শ্রমিক দেশে ফেরত এসেছে। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত এই দুই বড় শ্রম বাজারও হারাতে হয়েছে বাংলাদেশকে। আইনগত জটিলতা, কিছু বাংলাদেশের শ্রমিকের অপরাধমূলক কর্মকা-, কূটনৈতিক তৎপরতায় পশ্চাদপদতা সবকিছু মিলিয়েই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। কূটনৈতিকভাবে সরকার হারানো শ্রমবাজার পুনরুদ্ধার এবং নতুন শ্রমবাজার সন্ধানে তৎপর ছিল না। রেমিটেন্স প্রবাহ কমে যাওয়ায় সরকার এখন বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করবে এটাই প্রত্যাশা। আমাদের বৈদেশিক আয়ের অন্যতম উৎস রেমিটেন্স সম্ভাব্য সংকট মোকাবিলায় এর ওপর গুরুত্ব বাড়ানোর বিকল্প নেই।
ব্যাংকিং খাতে বিপর্যয়
দেশের পুঁজিবাজারের সবচেয়ে বড় খাত ব্যাংক। বাংলাদেশের অগ্রগতির ক্ষেত্রে যে খাত গুলো বড় ভূমিকা রাখছে তার মধ্যে ব্যাংকিং খাত অন্যতম। একক খাত হিসেবে এটিই পুঁজিবাজারের সবচেয়ে বড় খাত। যার মোট শেয়ার সংখ্যা ২ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকিং খাতে কোন সমস্যা থাকলে এর প্রভাব শুধু সে খাতেই সীমাবদ্ধ থাকে না, তা অর্থনীতির অন্যান্য খাতে ছড়িয়ে পড়ে। এটা সংক্রামক ব্যাধির মত অন্যান্য খাতকেও আক্রমণ করে। এটা হচ্ছে ‘ফিন্যানসিয়াল কন্টাজিয়ন’ যা সংক্রামক ব্যাধির মত উৎপাদন খাত ও মানুষের জীবনযাত্রার ওপর প্রভাব ফেলে।
২০০৭ সালের বৈশ্বিক আর্থিক খাতের সংকটের সূত্রপাত হয় যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকিং খাত থেকে। তার পর সেটা দেশটির অন্যান্য খাত এবং পরে অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ে। সাইপ্রাস, স্পেন, গ্রিস, ইতালি প্রভৃতি দেশ এখনো এ সংকট কাটিয়ে উঠতে পারেনি। বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের কোন নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশের ওপর পড়েনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, আমানতের তুলনায় ঋণ প্রবৃদ্ধি অর্ধেকে নেমে এসেছে। আগের তুলনায় সরকারি বেসরকারি এবং বিদেশি খাতের ১৯ টি ব্যাংকের ঋণ প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক পর্যায়ে রয়েছে। এক্সপোর্টার এসোসিয়েশন, এফবিসিআই বিনিয়োগ স্থবিরতায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে রাজনৈতিক অস্থিরতা কাটিয়ে না উঠা পর্যন্ত বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। দেশের রপ্তানি আয়ের মূল খাত তৈরি পোশাকের চাহিদা আন্তর্জাতিক বাজারেও কমে এসেছে। ভারতের হাতে পোশাকের বাজার হারাচ্ছে বাংলাদেশ। ফলে এ খাতে বিনিয়োগে আগ্রহ নেই।
সাম্প্রতিককালে বেশ কিছু অনভিপ্রেত ঘটনার কারণে খাতটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিচালকদের নিয়োগ দেয়ার কারণে আর্থিক অনিয়ম ও কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটছে অহরহ। হলমার্ক ও বিস্মিল্লাহ গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারি, সম্প্রতি বেসিক ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকার অনিয়ম এর বড় প্রমাণ। যোগ্যতা, দক্ষতার পরিবর্তে রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংকগুলোতে পদোন্নতি দেয়ায় বিভিন্ন কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে থাকার কারণে স্বচ্ছতার দিক থেকে পুঁজিবাজারের অন্য খাত গুলোর চেয়ে এ খাতে বিনিয়োগ কম ঝুঁকিপূর্ণ হবে এমনই বিশ্বাস ছিল বিনিয়োগকারীদের। ব্যাংকিং খাতের উদ্ভূত সমস্যা দ্রুত নিরসন করতে না পারলে দেশে অর্থনৈতিক বিপর্যয় অনিবার্য। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর তারল্য ব্যবস্থাপনায় চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। বেসরকারি বিনিয়োগ কম হওয়ায় ব্যাংক ঋণের চাহিদা বাড়ছে না। ব্যাংকে প্রচুর অর্থ অলস পড়ে আছে। তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। বর্তমানে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে মোট তারল্যের পরিমাণ ৬ লাখ কোটি টাকা। এর বিপরীতে কোন আয় হচ্ছে না। অথচ পড়ে থাকা অলস টাকার বিপরীতে গ্রহকদের লাভ দিতে হচ্ছে। এতে ব্যাংকের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। বিনিয়োগের পরিমাণ কমে যাওয়া এবং বিনিয়োগযোগ্য অর্থ থেকে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো সংকটে পড়েছে। ঋণ প্রদানে অচলাবস্থার কারণে ব্যাংকের আয় বাড়ছে না। অর্থাৎ অর্থের রোল, লেনদেন বা সঞ্চালনের গতি অতি ধীর হয়ে পড়েছে। অর্থ সঞ্চালনে গতি না এলে ব্যবসা-বাণিজ্যেও গতি আসে না। বিনিয়োগ না হওয়ার কারনে ব্যবসা বাণিজ্যে চরম মন্দাভাবের পাশাপাশি কর্মসংস্থানও আশঙ্কাজনকহারে হ্রাস পেয়েছে।
অর্থ পাচার
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মহান জাতীয় সংসদে হাস্যরস কথাবার্তার মাধ্যমে সুইস ব্যাংক থেকে বাংলাদেশীদের পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার জন্য বক্তব্য দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর শত শত ফাঁকা ঘোষণার মত সুইস ব্যাংকে টাকা পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের ঘোষণাও একটি ফাঁকা বুলি বলে বিভিন্ন মহল থেকে মন্তব্য করা হয়েছে।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) এর এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী স্বাধীনতার পর গত ৪ দশকে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। যা মোট দেশজ উৎপাদনের ৩০.৪ শতাংশ। এ পরিমাণ অর্থ সাম্প্রতিক সময়ের দু’টি জাতীয় বাজেটের আকারের সমান। এ অর্থ পাচার না হলে দেশের প্রবৃদ্ধি আরো বেড়ে যেতো। দেশের কৃষি, শিল্প, ব্যবসা, বাণিজ্যের উন্নয়নে ব্যাপক প্রসার হতো।
বাংলাদেশের মত সীমিত সম্পদের দেশে যেখানে বিপুল সংখ্যক মানুষ বসবাস করে দারিদ্র্য সীমার নীচে, সে দেশ থেকে এভাবে অর্থ পাচার হয়ে যাওয়া অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়।
প্রতিবছর গড়ে বাংলাদেশে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে ৮০ কোটি ডলার। যা বাংলাদেশী মুদ্রায় ৬ হাজার ২ শত ৪০ কোটি টাকার ঊর্ধ্বে। মাথাপিছু পাচার হয়েছে ২০৫ ডলার। ২০১১ সালে বাংলাদেশ থেকে ২ শত ৮০ কোটি ৫০ লাখ ডলার বা ২২ হাজার ৪ শত ৪০ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। ২০১০ সালে পাচার হয়েছিল ২ শত ১৯ কোটি ১০ লাখ ডলার বা ১৭ হাজার ৫ শত ২৮ কোটি টাকা। ঐ এক বছরে দেশ থেকে টাকার পাচার বেড়েছে ২৮ শতাংশ। ২০১৩ সালে অনেক দেশের আমানত যেখানে কমেছে সেখানে বাংলাদেশীদের আমানত সুইস ব্যাংকে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। এক বছরে বৃদ্ধির হার ৬৫ শতাংশের বেশি। সুইস ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী গত ১০ বছরে ব্যাংকটিতে বাংলাদেশীদের আমানত ক্রমাগতভাবে কিছু কিছু বেড়েছে। কিন্তু আমানত অস্বাভাবিক অঙ্কে গিয়ে ঠেকেছে ২০১৩ সালে। এসব টাকা সবই আওয়ামী দুর্নীতিবাজদের। শেখ হাসিনা সুইস ব্যাংক থেকে টাকা ফেরত আনার হাস্যকর ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু তিনি কি পেরেছেন হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যাংকের অর্থ লুট রোধ করতে? কিংবা তাদের কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। সুইস ব্যাংকে যত টাকা জমা হেেছ তার চেয়ে শতগুণ টাকা ব্যাংকিং খাত থেকে লুট হয়েছে।
২০০৬ সালে বিএনপির বিদায়ী বছরে ব্যাংকটিতে ১২ কোটি ৪০ লাখ ফ্রাঁ জমা হয়েছিল বাংলাদেশীদের। ২০১৩ সালে এই অংক ৩ গুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৩৭ কোটি ২০ ফ্রাঁতে। সুইস ব্যাংক বাংলাদেশীদের জমানো টাকা বৈধ বা অবৈধ যাই হোক না কেন তা দেশের অর্থনীতির জন্য হুমকি স্বরূপ। দেশের বিনিয়োগ পরিবেশ বা আমানতের নিরাপত্তা না থাকার কারণে যদি এটি হয়ে থাকে তাহলে দেশের সঞ্চিত অর্থ বাইরে পাচার হওয়ায় এ বিনিয়োগহীনতা নিঃসন্দেহে কর্মসংস্থার ও অর্থনীতির বিকাশকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে আয় করা অবৈধ অর্থ যদি সেখানে জমা করা হয় সেটা হবে আরো মারাত্মক।
দেশে যে রাজনৈতিক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তা অর্থনৈতিক অঙ্গনে ক্যানসারের মত ছড়িয়ে পড়বে। সেই ক্যানসার থেকে অর্থনীতিকে মুক্ত রাখতে না পারলে দেশের প্রতিটি নাগরিককে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হবে।
টাকা পাচার রোধ করা না গেলে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়, বরং সমাজে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হবে। যা দেশকে বড় ধরনের সংকটের দিকে নিয়ে যাবে। অর্থ পাচারের ফলে দারিদ্র্য বিমোচন বা জনকল্যাণমুখী কার্যক্রমে সরকারের অবদান কমে যায়। জনগণ দরিদ্রতায় ভোগে। দেশী বিনিয়োগ কমে যায়। কর্মসংস্থানেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। একই সঙ্গে বিদেশী বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা যায়। যা দেশের সুশাসন ব্যবস্থাকে বড় ধরনের হুমকির মুখে ফেলে দেয়। ভেঙ্গে পড়ে শাসনতান্ত্রিক কাঠামো। এর প্রভাবে একদিকে সমাজে যেমন আইনের প্রতি জনগণের শ্রদ্ধা কমে যায়, তেমনি অর্থনীতি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। যারা অর্থ পাচার করেন বা সম্পদ গোপন করে কালো টাকার সৃষ্টি করেন তাদেরকে কর কম দিতে হয়। ফলে সমাজে সুষম কর কাঠামো গড়ে ওঠে না।
এসব টাকা পাচার হচ্ছে দুর্নীতির মাধ্যমে। সেই টাকা অর্জনও হচ্ছে দুর্নীতির মাধ্যমে। তাই দুর্নীতি বন্ধ না হলে টাকা পাচার বন্ধ হবে না। দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে রাজনৈতিকভাবে জনগণের কাছে জবাবদিহিতামূলক সরকার লাগবে। যেটা বর্তমানে বাংলাদেশে নেই। দুর্নীতিবাজ ও ক্ষমতাবান রাজনৈতিক বিত্তবানরা তাদের ক্ষমতাকে আরো পাকাপোক্ত করতে অর্থ পাচারের ব্যাপারে রাজনৈতিক সুবিধা ভোগ করে থাকেন। আর ভোগান্তি পোহাতে হয় সাধারণ জনগণকে। পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনতে হলে সবার আগে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। রাজনৈতিকভাবে প্রতিপক্ষকে হয়রানি করা বন্ধ করতে হবে। আইনের শাসন জোরদার এবং সরকার পরিবর্তন হলেও এ ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। তাহলেই কেবল বিদেশীদের মনে বাংলাদেশীদের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করা সম্ভব।
মতিউর রহমান আকন্দ
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন