শনিবার, ২৬ জুলাই, ২০১৪

র‌্যাব বিলুপ্তি প্রসঙ্গে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের চিঠি


যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বাংলাদেশে দায়মুক্তির অধিকার নিয়ে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিদের বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যার সংস্কৃতি বন্ধের উদ্দেশ্যে র‌্যাপিড একশান ব্যাটালিয়ন তথা র‌্যাবের বিলুপ্তি দাবি করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি পত্র দিয়েছেন।
গত ২২ জুলাই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত উক্ত পত্রে অভিযোগ করা হয় যে র‌্যাব গঠনের পর থেকে অদ্যাবধি আইনশৃঙ্খলা রক্ষার উদ্দেশে গঠিত এই বাহিনীটি প্রায় ৮০০ ব্যক্তিকে ধরে এনে বিনাবিচারে হত্যা করেছে। পত্রে প্রধানমন্ত্রীকে সংস্থাটির এশীয় দফতরের প্রধান ব্র্যাড এডামস মানবাধিকার লংঘনের এই জঘন্য অপরাধের দায়ে র‌্যাব বিলুপ্ত না করা পর্যন্ত সংস্থাটি থেকে সামরিক অফিসার ও সেনাবাহিনী সদস্যদের প্রত্যাহার করা সম্পূর্ণ বেসামরিক ব্যক্তিদের দিয়ে তা পরিচালনার অনুরোধ করেছেন। পত্রে অভিযোগ করা হয় যে জবাবদিহিবিহীন দায়মুক্তি থাকায় র‌্যাব বেপরোয়াভাবে পরিচালিত হবার সুযোগ পেয়েছে এবং সংস্থাটি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে এর সংস্কারের আর কোনও অবকাশ নেই। এতে সরকারি দাবির উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয় বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার কারণে সরকার ২০০০ র‌্যাব সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হলেও বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্যাতন, বেআইনী গ্রেফতার ও গুমের জন্য একজনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনও ব্যবস্থা গ্রহণের নজির পাওয়া যায়নি, পত্র-পত্রিকায় অনেক লেখালেখির পর নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় তিনজন র‌্যাব কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের পত্রে আশংকা প্রকাশ করে বলা হয়েছে যে এক্ষেত্রে যে ঢিলেঢালা অবস্থা দেখা যাচ্ছে তাতে তারা আদৌ শাস্তি পান কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এই পত্রকে একটি গণতান্ত্রিক দেশের জন্য আমরা অত্যন্ত অমর্যাদাকর বলে মনে করি।
সামগ্রিক নিরাপত্তা তথা জান, মাল, সম্মান, সম্পদ ও স্বাধীনভাবে চলাফেরার নিরাপত্তা ও মৌলিক মানবাধিকারের নিশ্চয়তা হচ্ছে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশের মানুষের কাছে আওয়ামী সরকারের অধীনে এই বৈশিষ্ট্যগুলো ম্লান হয়ে পড়েছে। জাতীয় জীবনে এখন কারোরই নিরাপত্তা নেই। নিরাপত্তার রক্ষক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীই স্বয়ং এর ভক্ষকে পরিণত হয়েছে। র‌্যাব গঠিত হয়েছিল একটি এলিট বাহিনী হিসাবে এবং জাতি আশা করেছিল যে এই বাহিনী মানবাধিকার রক্ষার অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। কিন্তু দেখা গেছে যে, সরকারি অনুপ্রেরণায় এই বাহিনীর সদস্যরা বিরোধী দল দমনের হাতিয়ারেই শুধু পরিণত হয়নি, কোন কোন ক্ষেত্রে এর বেশ কিছু সিনিয়র সদস্য দাগী আসামীর ভূমিকায়ও অবতীর্ণ হয়েছে। ফলে সংস্থাটির ইমেজ দেশে বিদেশে শূন্যের কোঠায় এসে দাঁড়িয়েছে। এতে সেনা বাহিনীরও বদনাম হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় র‌্যাবের সিনিয়র কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততা প্রমাণিত হবার পর সকল সুযোগ-সুবিধা দিয়ে সরকার তাদের সেনাবাহিনী থেকে অবসর প্রদান করেন। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে মানুষ খুনের জন্য কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এই অবস্থায় উচ্চ আদালতের তরফ থেকে তাদের অবিলম্বে গ্রেফতারের নির্দেশ প্রদান করা হয়। কিন্তু সে নির্দেশ পালন করতে গিয়েও সরকার বিভিন্ন নাটকীয়তার সৃষ্টি করেন এবং অবশেষে তারা গ্রেফতার হন। এখানে সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন উঠেছে যারা সরকারি দলের একজন নেতার নির্দেশে টাকা পয়সার কন্ট্রাক্ট নিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী নৌকার মাঝিসহ ৮ জন মানুষকে খুন করলো তারা কি বিশেষ বিবেচনায় কোনও সুযোগ সুবিধা পাবার অধিকারী? এই সরকারের আমলে সেনাবাহিনীর একজন সিনিয়র কর্মকর্তা, যিনি মেধা, দক্ষতা, প্রতিভা ও সদাচারের দিক থেকে একাধিকবার শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় দিয়েছেন, বিনা দোষে চাকরিচ্যুত হয়েছেন। তিনি ন্যায্য পাওনা সার্ভিস বেনিফিটও পাননি। একমাত্র কারণ তার পিতা সরকারি দলের প্রতিদ্বন্দ্বী একটি ইসলামপন্থী দলের নেতা। অথচ চুক্তিতে পয়সা নিয়ে যারা মানুষ খুন করলেন তাদের সসম্মানে সার্ভিস বেনিফিট দিয়ে অবসর প্রদান করা হলো। এই অপরাধীদের ছাড়া পাওয়ার ব্যাপারে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের আশংকাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে এলিট বাহিনী হিসেবে সরকার র‌্যাবকে ব্যাপক ক্ষমতা প্রদান করেছিলেন। তারা ব্যাপকভাবে এই ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে। এই অপব্যবহারে সরকার ও সরকারি দলই তাদের অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ দশটি ঘটনার তদন্ত করে অপরাধপ্রবণতায় র‌্যাবের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়েছে এসব ক্ষেত্রে সরকার নির্লিপ্ত ভূমিকা পালন করেছে। এই অবস্থায় জাতীয় স্বার্থে র‌্যাবকে বিলুপ্ত ঘোষণা এবং তা না করা পর্যন্ত এ বাহিনীর দায়মুক্তির অবসান ও র‌্যাবে কর্মরত সেনাবাহিনী সদস্যদের প্রত্যাহার করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আমরা আহ্বান জানাচ্ছি।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads