শুক্রবার, ৪ জুলাই, ২০১৪

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে খালেদা জিয়ার সাক্ষাৎকার এবং ক্ষমতাসীনদের প্রতিক্রিয়া


ভারতের প্রভাবশালী দৈনিক ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেয়া বেগম খালেদা জিয়ার এক সাক্ষাৎকারকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। সব মিলিয়ে অবস্থা এমন হযেছে দেশবাসীকে যখন বুঝতে হচ্ছে যেন ভারতের কোনো পত্রিকা বা টিভিকে সাক্ষাৎকার কেবল ওনারাই দেবেন। খালেদা জিয়া বা অন্য কেউ কোনো সাক্ষাৎকার দিতে পারবেন না। এ যেন মামার বাড়ির আব্দারের মতো ব্যাপার-স্যাপার! ক্ষমতাসীন নেতারা তেড়ে-মেরে উঠলেও বেগম জিয়া কিন্তু ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে নতুন তেমন কিছু বলেননি। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, রাগের কারণ আসলে তিনটি। প্রথমত বেগম জিয়া বলেছেন, এ সরকারকে বৈধ বলে স্বীকৃতি দিলেই ক্ষমতাসীনরা তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি আছেন।  বেগম জিয়ার মতে এতেই প্রমাণিত হয়, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা শেখ হাসিনার সরকার বৈধ নয়। ক্ষমতাসীনদের রাগের দ্বিতীয় কারণ হিসেবে এসেছে বেগম জিয়ার অন্য একটি বক্তব্য যেখানে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার অমীমাংসিত বিভিন্ন ইস্যু এবং ভারতের কাছ থেকে জাতীয় স্বার্থ আদায় করতে না পারার জন্য তিনি আওয়ামী লীগকে দায়ী করেছেন। ভারতের সদ্য বিদায় নেয়া কংগ্রেস সরকারই যে শেখ হাসিনার বর্তমান সরকারকে স্বীকৃতিদানকারী বিশ্বের একমাত্র সরকার ছিল সে কথাটাও বেগম জিয়া বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গেই ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেছেন। তিনি সেই সঙ্গে জানিয়ে দিয়েছেন, আওয়ামী লীগের মতো কোনো দল বা সে দলের সরকারের সঙ্গে নয়, সত্যি বন্ধুত্ব ও সুসম্পর্ক চাইলে ভারতকে বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে হবে। কথাটা তিনি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজকেও জানিয়ে দিয়েছেন।
বেগম খালেদা জিয়ার এ সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হওয়ার পর মুহূর্ত থেকেই ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন ক্ষমতাসীনরা। তাদের বক্তব্য শুনে ও তৎপরতা দেখে যে কারো মনে হতে পারে, খালেদা জিয়া সম্ভবত ক্ষমতাসীনদের ‘নাড়ি’ ধরে টান মেরেছেন। না হলে এভাবে ঝাঁপিয়ে পড়বেন কেন তারা? ঘটনাপ্রবাহে বেশি কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছে জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে এ নিয়ে তুমুল নিন্দা-সমালোচনার কারণে। গত ২ জুলাই উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এবং ইনু জাসদের মঈনুদ্দিন খান বাদল বেগম জিয়াকে রীতিমতো তুলোধুনো করে ছেড়েছেন। পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে মন্ত্রী আমু বলেছেন, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেয়া সাক্ষাৎকারের বক্তব্য নাকি কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত! প্রসঙ্গক্রমে ইতিহাসও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন আমু। বলেছেন, ছিটমহল, সীমান্ত সমস্যা এবং গঙ্গা ও তিস্তার পানি বণ্টনের মতো বিষয়গুলো নিয়ে জিয়া, এরশাদ ও খালেদা জিয়ার ২১ বছরে কিছুই হয়নি। যা কিছু করার সবই নাকি করে গেছেন শেখ মুজিবুর রহমান আর সাম্প্রতিক সময়ে করছে শেখ হাসিনার সরকার! ছিটমহল নিয়ে ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি বাংলাদেশের সংসদ পাস করলেও ভারতের লোকসভা পাস না করার কারণেই যে চুক্তিটি এখনো কার্যকর হতে পারেনি সে কথাটাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন মিস্টার আমু। এজন্য নাকি মরহুম শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লীগকে দায়ী করলে চলবে না! তিস্তা চুক্তি না হওয়ার কারণ জানাতে গিয়েও নিরেট সত্য উচ্চারণ করেছেন তিনি। বলেছেন, এ ব্যাপারে মনমোহন সিং-এর কংগ্রেস সরকার নীতিগত অনুমোদন দিলেও পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির কারণে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হতে পারেনি। এতেও নাকি আওয়ামী লীগের কোনো ব্যর্থতা নেই! কারণ, বিষয়টি ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ওদিকে বিচিত্র কিছু তথ্য-পরিসংখ্যান তুলে ধরেছেন এককালের ‘কমরেড’ মতিয়া চৌধুরী। তিনি জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব যেখানে গঙ্গার ৪৪ হাজার কিউসেক পানি ‘দাবি’ করেছিলেন সেখানে ভারত সফরে গিয়ে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নাকি ‘মাত্র’ ৩৪ হাজার কিউসেকেই রাজি হয়েছিলেন! বিএনপি ও বেগম খালেদা জিয়ার ‘কূটনৈতিক বেয়াদবি’ যে আন্তর্জাতিকভাবে ‘স্বীকৃত’ এ কথাটার প্রমাণ দেয়ার জন্য মতিয়া চৌধুরী বলেছেন, ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়কে ‘দাওয়াত’ দিয়ে এনেও জামায়াতের হরতালের কারণে খালেদা জিয়া নাকি তার সঙ্গে দেখা করতে যাননি! দুই মন্ত্রীর পাশাপাশি জাসদের মঈনুদ্দিন খান বাদলও মন্দ শোনাননি। খালেদা জিয়ার উদ্দেশে তিনি বলেছেন, ‘শকুনের দোয়ায় গরু মরে না।’ অর্থাৎ খালেদা জিয়া বা তার দল ও জোট চাইলেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবং আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটবে না!
বলা দরকার, আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ও নেতাদের কেউই অল্প কথায় শেষ করার মানুষ নন। কথাও তারা যথেষ্টই শুনিয়েছেন। অন্যদিকে তাদের কথার পিঠে কথাও উঠেছে সঙ্গত কারণে। যেমন মন্ত্রী আমুর বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান একটি প্রসঙ্গ হিসেবে প্রাধান্যে এসেছে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি। ১৯৭৪ সালের ১৬ মে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে স্বাক্ষরিত এক চুক্তির মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ বেরুবাড়িকে ভারতের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। অন্যদিকে ভারত কিন্তু চুক্তি লংঘন করেছিল। কারণ, চুক্তি অনুযায়ী কথা ছিল বেরুবাড়ির বিনিময়ে ভারত তিনবিঘা বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করবে। কিন্তু নিজে বেরুবাড়ির দখল বুঝে নিলেও ভারত আজও পর্যন্ত বাংলাদেশকে তিনবিঘা দেয়নি। প্রতারণার কৌশল হিসেবে দেশটি আইনের মারপ্যাঁচ কষেছে। বিষয়টিকে উচ্চ আদালতে নিয়ে ঝুলিয়ে দিয়েছে। মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিটিকে ভারতের লোকসভাও (পার্লামেন্ট) এখনো অনুমোদন করেনি। এর ফলে বেরুবাড়ি বাংলাদেশের হাতছাড়া হয়ে গেছে। এ কথাটাই মন্ত্রী আমির হোসেন আমু এমনভাবে বলেছেন যেন চুক্তি করে আসলেও কোনো ভুল করেননি শেখ মুজিব ও তার সরকার। পর্যালোচনায় কিন্তু দেখা যাবে, ভুল তো করেছিলই, একই সঙ্গে নিজেদের অযোগ্যতা ও কূটনৈতিক মূর্খতারও প্রমাণ দিয়েছিল মুজিব সরকার। কারণ, চুক্তি যে দেশটির সঙ্গে করা হচ্ছে সে দেশের সংবিধান ও আইন সম্পর্কে আগে জেনে নেয়া সরকারের কর্তব্য ছিল। সেটা জানার চেষ্টা করলেই তারা জানতেন, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইন্দিরা গান্ধী স্বাক্ষর করাটাই যথেষ্ট ছিল না। ভারতের পার্লামেন্ট তথা লোকসভা ও রাজ্যসভার অনুমোদন তো লাগবেই, তারও আগে-পরে ছিল ভারতীয়দের সাংবিধানিক অধিকার। এই অধিকার বলে যে কোনো ভারতীয় নাগরিকই চুক্তির এবং চুক্তি অনুযায়ী তিনবিঘা হস্তান্তরের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিতে পারেন। সেটাই ঘটেছে। মামলাটি সুকৌশলে ইন্দিরা সরকারই করিয়েছিল কি না সেটা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বটে, তবে সত্য হলো, ওই মামলার অজুহাতেই আজও পর্যন্ত ভারতের পার্লামেন্ট মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিটিকে পাস করেনি। এমন বিশ্লেষণের পরও মন্ত্রী আমির হোসেন আমুরা যদি বলেন, মুজিব সরকার এবং আওয়ামী লীগ কোনো ‘ভুল’ করেনি, তাহলে নিশ্চয়ই কথা বাড়ানোর দরকার পড়ে না। কারণ, সবকিছু যারা গায়ের জোরে চালাতে চান তাদের সঙ্গে আর যা-ই হোক, যুক্তি-তর্কে যাওয়ার কোনো অর্থ হয় না।
গঙ্গার পানি এবং ফারাক্কার ব্যাপারেও তারা কি সত্যেও কাছাকাছি গেছেন? এক কথায় এর উত্তর হলো, না। তারা বরং সত্য এড়িয়ে গেছেন। কারণ, এ চুক্তিটি করার সময়ও প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের প্রতারণামূলক উদ্দেশ্যের ব্যাপারে অজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছিল। সে অজ্ঞতার সুযোগেই ফারাক্কা বাঁধ চালু করার প্রশ্নে ভারত চাতুরির আশ্রয় নিয়েছিল। মুজিব-ইন্দিরা যুক্ত ইশতেহারে বলা হয়েছিল, ফারাক্কা বাঁধ সম্পূর্ণরূপে চালু করার আগে শুষ্ক মওসুমে প্রাপ্ত পানির পরিমাণ নিয়ে উভয় পক্ষ যাতে সমঝোতায় আসতে পারে সেজন্য ভারত প্রথমে পরীক্ষামূলকভাবে ফিডার ক্যানেল চালু করবে। সে অনুযায়ী ভারত ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ৪১ দিনের জন্য ফারাক্কা বাঁধ চালু করেছিল। কথা ছিল, ৪১ দিনের নির্ধারিত সময়ে ভারত ১১ হাজার থেকে ১৬ হাজার কিউসেক পানি ফিডার ক্যানেল দিয়ে হুগলী নদীতে নিয়ে যাবে। কিন্তু ৪১ দিনের সময় সীমা পেরিয়ে যাওয়ার পরও ভারত ফিডার ক্যানেল দিয়ে পানি প্রত্যাহার অব্যাহত রেখেছে এবং বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো সমঝোতা বা চুক্তি না করেই শুষ্ক মওসুমে পূর্ণ ক্ষমতায় গঙ্গার পানি নিয়ে গেছে। সেই থেকে পানি আগ্রাসন শুরু করেছিল ভারত। সে আগ্রাসন এখনো দিন দিন আরো ভয়ংকর হয়ে উঠছে। এর ফলে শুষ্ক মওসুমে বাংলাদেশ পানি পাচ্ছে না। আবার বর্ষা মওসুমে তলিয়ে যাচ্ছে সারা দেশ। অন্যদিকে কোনো ‘ভুল’ করেনি বলা হলেও আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে কিন্তু কোনো প্রতিবাদই জানানো হয়নি। ফারাক্কার ব্যাপারে আরো কিছু অসত্য বলেছেন মতিয়া চৌধুরী। ৩৪ হাজার কিউসেক পানির হিসাব কোথায় পেয়েছেন সেটা তিনিই বলতে পারবেন তবে ইতিহাস কিন্তু তার এ তথ্যটিকে সঠিক প্রমাণ করে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের সাফল্য ও অর্জন সম্পর্কে মন্ত্রী মতিয়া যা বলেছেন সেটাও বাস্তবে হাস্যকর। কারণ, মতিয়া চৌধুরী কিন্তু বলেননি যে জিয়া যেখানে ৩৪ হাজার কিউসেকে রাজি হয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব সেখানে ৪৪ হাজার কিউসেক আদায় করেছিলেন। তিনি বরং বলেছেন, শেখ মুজিব ৪৪ হাজার কিউসেক পানির জন্য ভারতের কাছে ‘দাবি’ জানিয়েছিলেন! অন্যদিকে জিয়ার সাফল্য সম্পর্কে একই মন্ত্রীকে কিন্তু সত্য স্বীকার করতে হয়েছে।
এখানে ইতিহাস স্মরণ করা দরকার। সে ইতিহাস হলো, জিয়া নন, ফারাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধে এবং বাংলাদেশের পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন প্রধান জাতীয় নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। এ জন্য তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে অন্তত দুটি চিঠি লিখেছেন কিন্তু তার জবাবে ইন্দিরা গান্ধীর লেখা চিঠিতে সমাধানের ইচ্ছা ব্যক্ত করার পরিবর্তে ছিল প্রচ্ছন্ন হুমকি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৬ সালের ১৬ মে মওলানা ভাসানী ঐতিহাসিক ফারাক্কা মিছিলের ডাক দিয়েছিলেন। তারিখটি বেছে নেয়ার কারণ ছিল, ১৯৭৪ সালের ওই দিনটিতেই স্বাক্ষরিত হয়েছিল মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি। কৃষক-শ্রমিক ও বিভিন্ন শ্রেণীর মেহনতী মানুষ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিক্ষক-অধ্যাপক ও বুদ্ধিজীবী পর্যন্ত লাখ লাখ নারী-পুরুষ মওলানা ভাসানীর ফারাক্কা মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন। রাজশাহীর মাদরাসা ময়দানে মওলানা ভাসানীর দেয়া মাত্র ১০ মিনিটের এক ভাষণের মধ্য দিয়ে মিছিলের শুরু হয়েছিল। পায়ে হেঁটে দু’দিনে প্রায় ১০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করেছিলেন মিছিলকারীরা। কানসাট হাই স্কুল ময়দানে ফারাক্কা মিছিলের সমাপ্তি ঘোষণার সময় মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, ‘ভারত সরকারের জানা উচিত, বাংলাদেশীরা আল্ল¬াহ ছাড়া কাউকে ভয় পায় না, কারো হুমকিকে পরোয়া করে না। ...’
মূলত মওলানা ভাসানীর ফারাক্কা মিছিলের জনপ্রিয়তা এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এর ব্যাপক প্রচারণার ফলেই ভারতকে বহুদিন পর বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসতে হয়েছিল। তখনও পর্যন্ত সামরিক শাসক হলেও জনগণের ঐক্য জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সাহস যুগিয়েছিল। ১৯৭৬ সালেই তিনি জাতিসংঘে ফারাক্কা বাঁধের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছিলেন। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের রাজনৈতিক কমিটির ২৪ নবেম্বরের সর্বসম্মত বিবৃতির ভিত্তিতে ভারত ও বাংলাদেশের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক শুরু হয়েছিল এবং ১৯৭৭ সালের ৫ নবেম্বর ঢাকায় স্বাক্ষরিত হয়েছিল ‘ফারাক্কা চুক্তি’। এ সময়ের মধ্যে জিয়াউর রহমান দিল্লী¬ গিয়েছিলেন এবং গিয়ে ‘মাত্র’ ৩৪ হাজার কিউসেকে ‘রাজি’ হয়েছিলেন এরকম কোনো তথ্য কিন্তু জানা যায় না সেটা সম্ভবত মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী একাই জানেন! বাংলাদেশের অনুকূলে ‘গ্যারান্টি ক্লজ’ ছিল ‘ফারাক্কা চুক্তি’র সবচেয়ে উল্লে¬খযোগ্য বিষয়। ‘গ্যারান্টি ক্লজ’ থাকায় ভারত কখনো যথেচ্ছভাবে পানি প্রত্যাহার করতে কিংবা বাংলাদেশকে কম হিস্যা দিতে পারেনি। অবস্থায় পরিবর্তন ঘটেছিল ১৯৯৬ সালে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতায় আগত আরেক আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর সরকার ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদী গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। স্বাক্ষরিত হওয়ার পর পর, ১৯৯৭ সালের মার্চেই ভারত চুক্তি লংঘন করেছিল। সর্বনিম্ন পরিমাণ পানি পাওয়ার রেকর্ডও স্থাপিত হয়েছিল ১৯৯৭ সালের মার্চেই ২৭ মার্চ বাংলাদেশ পেয়েছিল মাত্র ছয় হাজার ৪৫৭ কিউসেক (মতিয়া চৌধুরী নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, জিয়া যদি ৩৪ হাজার কিউসেকে রাজিও হয়ে থাকেন তাহলেও বড় কোনো অপরাধ করেননি। কারণ, ৩৪ হাজার কিউসেক অবশ্যই ছয় হাজার ৪৫৭ কিউসেকের চাইতে অনেক বেশি!) সে সময় যুক্তি দেখিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘প্রকৃতির ওপর তো কারো হাত নেই!’ অন্যদিকে অনুসন্ধানে জানা গিয়েছিল, ভারত ৬৫ শতাংশেরও বেশি পানি আগেই উজানে উঠিয়ে নিয়েছিল। ১৯৭৭ সালের চুক্তির মতো ৩০ বছর মেয়াদী চুক্তিতে ‘গ্যারান্টি ক্লজ’ না থাকাই ছিল এর প্রধান কারণ। অন্যদিকে মওলানা ভাসানীর ফারাক্কা মিছিলের সূত্র ধরে জিয়াউর রহমান কিন্তু ফারাক্কা চুক্তির মাধ্যমে গঙ্গার পানির ওপর বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত দাবি ও অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। অনেকাংশে আদায় করেছিলেন।
সহজবোধ্য কারণে আওয়ামী লীগ ও তার দোসর নেতারা ক্ষুব্ধ হলেও ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বেগম খালেদা জিয়া কিন্তু এমন একটি কথাও বলেননি যার কারণে তার বিরুদ্ধে ‘কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত’ বক্তব্য রাখার অভিযোগ তোলা সম্ভব। উদাহরণ দেয়ার জন্য বাণিজ্য ঘাটতির কথাই বলা যাক। এ প্রসঙ্গে প্রমাণিত সত্য হলো, সৎ প্রতিবেশীসুলভ মনোভাব দেখানোর পরিবর্তে ভারত সব সময় বাংলাদেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করার ধ্বংসাত্মক নীতিরই বাস্তবায়ন করে এসেছে। যে অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি তথা বাণিজ্যকে ট্রানজিট-করিডোরের আড়াল বানানো হচ্ছে তার কোনো ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ এ পর্যন্ত লাভবান হতে পারেনি। ভারতের নীতি-মনোভাবের পরিণতিতে একদিকে বাংলাদেশের রফতানি আয়ে ধস নামছে, অন্যদিকে আমদানি ব্যয় বেড়ে চলেছে লাফিয়ে লাফিয়ে। স্বাধীনতার পর প্রাথমিক দিনগুলো থেকেই ভারত বাংলাদেশকে ঘাটতির মধ্যে রেখে এসেছে। ভারতের এই নীতির পরিণতিতে বাংলাদেশ ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে তো পারছেই না, কোনো কোনো অর্থ বছরে পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় বাংলাদেশের রফতানির পরিমাণ এমনকি অনেক কমেও যাচ্ছে। ভারতীয়দের নীতি ও অসহযোগিতাই এ অবস্থার কারণ। তারা বাংলাদেশের ভেতরে নিজেদের পণ্য ঠেলে দেয়ার ব্যাপারেই বেশি ব্যস্ত থাকে তা শুধু আইনসম্মত পন্থায় নয়, অনেক বেশি পরিমাণ ও ধরনের পণ্য পাঠায় তারা চোরাচালানের অবৈধ পথে। বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনার ব্যাপারেও ভারতীয়রা সব সময় প্রতারণামূলক কৌশল নিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে প্রথম বিজিপি সরকারের প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর কথা স্মরণ করা যেতে পারে। ১৯৯৯ সালে ঢাকা-কলকাতা সরাসরি বাস সার্ভিস উদ্বোধন উপলক্ষে ঢাকা সফরে এসে তিনি ২৫ ক্যাটাগরির বাংলাদেশী পণ্যের জন্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেয়ার যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তার বাস্তবায়ন আজও হয়নি। এজন্য বাজপেয়ীকে বা ভারতীয় কোনো নেতাকেই কখনো লজ্জিত হতে দেখা যায়নি। সর্বশেষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-ও যথেষ্টই দেখিয়ে গেছেন। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে তিনিও ৪৬টি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাওয়ার কথা শুনিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তারও বাস্তবায়ন এখনো হয়নি।
এভাবে সকল তথ্য-পরিসংখ্যানেই দেখা যাবে, নয়া দিল্লীর ক্ষমতায় যে সরকারই থাকুক না কেন, বাংলাদেশের প্রতি ভারতীয়দের নীতি ও মনোভাবে পরিবর্তন ঘটাবার কোনো সম্ভাবনা নেই। বাংলাদেশেরও লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ভেতরে ভেতরে তো বটেই, ভারতীয় নেতারা প্রকাশ্যেও বাংলাদেশের প্রতি প্রতারণাপূর্ণ নীতি-কৌশল অবলম্বন করে থাকেন। একই কারণে নিকটতম প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ দূরে থাকুক, এখনো মোটেই স্বাভাবিকও হতে পারেনি। সাম্প্রতিক বিভিন্ন গবেষণায় ও সেমিনারে উপস্থাপিত বক্তব্যে বরং দেখা গেছে, ভারতের প্রতি এদেশের ১৬ কোটি মানুষের মনোভাব শত্রুতাপূর্ণ। অর্থাৎ বাংলাদেশের জনগণ ভারতকে বন্ধু নয় বরং শত্রু মনে করে। বিষয়টি নিঃসন্দেহে গুরুতর। এই শত্রু মনে করার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন দেশের বিশিষ্টজনেরা। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের ঢাকা সফরের প্রক্কালে রাজধানীতে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে তারা বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের নতজানু পররাষ্ট্রনীতিই এর কারণ। বিশিষ্টজনেরা আরো বলেছেন, ভারতকে শত্রু মনে করার জন্য জনগণকে দোষ দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। সরকারের দুর্বল ও নতজানু পররাষ্ট্রনীতিই জনগণের মধ্যে ভারত সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করেছে। এর পাশাপাশি রয়েছে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বিভিন্ন ইস্যুতে ভারতের প্রতারণা, ঘোষিত অঙ্গীকার থেকে সরে যাওয়া, চুক্তি লংঘন এবং বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থবিরোধী ধ্বংসাত্মক কর্মকা-। তারা আরো বলেছেন, ভারতের নির্বাচনকে বাংলাদেশ কোনোভাবেই প্রভাবিত করতে পারে না এবং কখনো পারবেও না। কিন্তু বাংলাদেশের নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভারত শুধু প্রভাবই বিস্তার করে না, নিজের ইচ্ছাও পূরণ করে থাকে। প্রাসঙ্গিক উদাহরণ হিসেবে ৫ জানুয়ারির সর্বশেষ নির্বাচনের উল্লে¬খ করে বিশিষ্টজনেরা বলেছেন, ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে না গেলেও এবং সারাবিশ্বে ভোটারবিহীন, একদলীয় ও একতরফা নির্বাচন হিসেবে নিন্দিত ও প্রত্যাখ্যাত হলেও ভারত সে নির্বাচনকে বৈধতা তো দিয়েছেই, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশকে অস্থিতিশীলও করতে চেয়েছে। একমাত্র ভারতই সরকারকে বৈধতা দিয়েছে। ভারত প্রমাণ করেছে, বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে নয়, দেশটি কেবল আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চায়।
পাঠকরা লক্ষ্য করবেন, বেগম খালেদা জিয়াও কিন্তু ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে এ কথাগুলোই বলেছেন। অন্যদিকে প্রথম আলোকে দেয়া সাক্ষাৎকারে সুষমা স্বরাজ কিন্তু কিছুটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে হলেও কথাটার সত্যতা স্বীকার করেছেন (২৯ জুন, ২০১৪)। কারণ, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন এবং ওই নির্বাচনকে কংগ্রেসের পক্ষ থেকে বৈধতা দেয়া সম্পর্কিত প্রশ্নের জবাবে সুষমা স্বরাজ বলেছেন, ‘দেখুন, বাংলাদেশের নির্বাচনের ব্যাপারে আমাদের রায় দেয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশে রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কি হবে, তা এই দেশের জনগণই নির্ধারণ করবেন।’ আমরা মনে করি, কূটনীতি কাকে বলে তারই উদাহরণ রেখে গেছেন বিজেপি সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। আমু সাহেবদের তাই খালেদা জিয়াকে কূটনৈতিক শিষ্টাচার শেখানোর চেষ্টা ছেড়ে সুষমা স্বরাজের কাছ থেকে কূটনীতি শেখা উচিত কথাটার মধ্যে তিনি যে বাংলাদেশের ব্যাপারে কংগ্রেস সরকারের নীতি অনুসরণ করে চলারই ঘোষণা দিয়েছেন সেটাও নিশ্চয়ই সানন্দে স্বীকার করবেন আমু সাহেবরা! 
আহমদ আশিকুল হামিদ 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads