এবারও ব্যতিক্রম হয়নি; পবিত্র ঈদুল ফিতরের ছুটিতে যথারীতি অনেক দুর্ঘটনা যেমন ঘটেছে, তেমনি মৃত্যু ঘটেছে অসংখ্য মানুষেরও। নিহতদের সঠিক সংখ্যা জানার জন্য আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে সত্য, তবে নারী ও শিশুসহ শতাধিক মানুষ যে প্রাণ হারিয়েছে সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে সারা দেশেই। চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও ফরিদপুরের ভাঙ্গার মতো কয়েকটি এলাকায় বাস গিয়ে গভীর খাদে পড়েছে। কোথাও আবার বাস ও ট্রাকের সঙ্গে প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাসের মুখোমুখী সংঘর্ষ হয়েছে। এ ধরনের সংঘর্ষ বা দুর্ঘটনায় সাধারণত চালকরা বেঁচে যায়। কিন্তু এবার একাধিক চালকেরও মৃত্যু হয়েছে। সড়ক পথের তুলনায় নৌপথ অবশ্য নিরাপদই ছিল। পাঁচ-সাতশ’ আসনের লঞ্চে চার-পাঁচ হাজারের বেশি যাত্রী ঠেসাঠেসি করে উঠলেও কোনো লঞ্চ দুর্ঘটনার শিকার হয়নি। তা সত্ত্বেও নদী প্রাণ কেড়ে নিয়েছে ঠিকই। নৌকাডুবিতে কুষ্টিয়ায় মারা গেছে অন্তত ১৫ জন শিশু-কিশোর। আরো জনাপনেরোর খোঁজ পাওয়া যায়নি। ফলে তাদেরও মৃত্যু ঘটেছে বলেই ধরে নেয়া হচ্ছে। সিরাজগঞ্জের চৌহালিতেও নৌকাডুবিতে বেশ কয়েকজন প্রাণ হারিয়েছে। আনুমানিক এই ঈদপূর্ব পরিসংখ্যানের সঙ্গে যুক্ত হতে চলেছে ঈদ-উত্তর দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর পরিসংখ্যান। কারণ ঈদের ছুটি শেষে এরই মধ্যে শুরু হয়েছে কর্মস্থলে ফিরে আসার পালা। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য তথ্যটি হলো, অন্যান্য বছরের মতো এবারও সড়ক দুর্ঘটনা এবং দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়েছিল ছুটির প্রথম দিক থেকেই। ঈদ এগিয়ে আসার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে একের পর এক সড়ক দুর্ঘটনার এবং সেসব দুর্ঘটনায় মানুষের অসহায় মৃত্যুর খবর এসেছে। সন্দেহ নেই, বেশি কথা বলার জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠা যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবার নেহায়েত মন্দ দেখাননি। মুষল ধারায় শ্রাবণের বৃষ্টি শুরু হলে খানাখন্দে ভরা এবং আওয়ামী ঠিকাদারদের নামকাওয়াস্তে মেরামত করা সড়ক-মহাসড়কগুলোর হাল-অবস্থা কেমন হতো এবং দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর সংখ্যা কোথায় গিয়ে পৌঁছাতো এ ধরনের কোনো বিষয়ে কল্পনা করার পরিবর্তে এখানে জানানো দরকার, এবারের ঈদের ছুটিতেও জীবন হারিয়েছে অসংখ্য মানুষ। এর কারণ শুধু কোনোভাবে জোড়াতালি দেয়া সড়ক-মহাসড়ক কিংবা মহাসড়কগুলোতে চলাচলকারী থ্রিহুইলার, ইজিবাইক, নছিমন, করিমন ও ভটভটি ধরনের নানা বাহারি নামের হালকা ও ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন নয়, অপ্রশস্ত ও খানাখন্দে ভরা সড়ক-মহাসড়কও। যাগাযোগমন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীনরা লম্বা কথা ও আশ^াসের মধুর বাণী শোনালেও পরিস্থিতিতে যে উল্লসিত বা নিশ্চিন্ত হওয়ার মতো উন্নতি হয়নি তার প্রমাণ মানুষকে এবারও প্রাণ দিয়েই দিতে হয়েছে। গাড়ির সংখ্যা দ্রুত বেড়ে চললেও এবং ঈদের সময় মানুষের ভিড় বাড়বে জানা থাকলেও সরকার যেমন কঠোর নজরদারি করেনি, মালিক ও চালকরাও তেমনি যথোচিত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেননি। এজন্যই একের পর এক দুর্ঘটনা ও মানুষের মৃত্যু ঘটেছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, স্ব^াভাবিক সময়ের পাশাপাশি বিশেষ করে পবিত্র ঈদের সময় প্রতি বছর এত বেশি প্রাণহানি ও যানবাহনের ধ্বংসসহ আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি মেনে নেয়ার ও সহ্য করার মতো অবস্থা এখনো বাংলাদেশের নেই। এজন্যই মহাসড়কগুলোকে নিরাপদ করা দরকার। ঘটনাক্রমে মাঝে-মধ্যে হালকা যানবাহনের চলাচল নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দেয়া হলেও আমরা মনে করি না যে, কেবল নিষিদ্ধ করা হলেই দুর্ঘটনা এক লাফে শূন্যের ঘরে নেমে আসবে। কারণ দুর্ঘটনার অন্য কিছু অনস্বীকার্য কারণও রয়েছে। চালকদের অদক্ষতা, অসাবধানতা এবং পাল্লা দেয়ার ও সামনের গাড়িকে ওভারটেক করার প্রবণতা এরকম একটি বড় কারণ। বহু চালকেরই যে প্রশিক্ষণ ও লাইসেন্স নেই, সে কথা জানার জন্য গবেষণা বা অনুসন্ধানের দরকার পড়ে না। এ ধরনের চালকরা এমনকি রাজধানীতেও বছরের পর বছর ধরে দিব্যি গাড়ি চালাচ্ছে। ধরা পড়লে উৎকোচ দিয়ে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে তারা। সুতরাং মহাসড়কে দুর্ঘটনা কমাতে হলে এমন আয়োজন নিশ্চিত করা দরকার, যাতে লাইসেন্সহীন ও অদক্ষ কোনো লোক গাড়ি চালাতে না পারে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে রয়েছে ত্রুটিযুক্ত যানবাহন। নগদ উৎকোচের বিনিময়ে ত্রুটিযুক্ত, এমনকি লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা শত শত যানবাহনও দেশের সব অঞ্চলে চলাচল করছে। একই কথা লঞ্চ ও স্টিমারের বেলায়ও সমান সত্য। এবারও ছুটি শুরু হওয়ার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রচারিত খবরে দেখা গেছে, ভাঙা ও লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা অনেক লঞ্চকে নতুন রং লাগিয়ে এবং কোনোভাবে ঝালাই বা মেরামত করেই নদীতে ভাসিয়ে দিচ্ছেন মালিকরা। তারা শুধু ভাড়ার টাকা গুনতেই বেশি ব্যস্ত থেকেছেন, মানুষের জীবন নিয়ে সামান্যও চিন্তা করেননি। সমগ্র এ প্রেক্ষাপটেই আমরা মনে করি, সত্যিই দুর্ঘটনা কমাতে এবং পর্যায়ক্রমে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে চাইলে ত্রুটিযুক্ত ও ফিটনেসবিহীন কোনো যানবাহনকে মহাসড়কে চলাচল করতে দেয়া যাবে না। একযোগে ট্রাফিক আইনেরও কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। চালকরা যাতে আইন মেনে চলে এবং পাল্লা দিতে বা ওভারটেক করতে গিয়ে দুর্ঘটনা না ঘটায়, বাস নিয়ে সোজা খাদে চলে না যায়Ñ এসব বিষয়ে নজরদারি বাড়াতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে নজরদারির জন্য দায়িত্বপ্রাপ্তদের প্রতিও। কারণ উৎকোচের সঙ্গে তাদের সরাসরি সম্পর্ক থাকার প্রতিষ্ঠিত অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, এমনকি ক্ষমতাসীন রাজনীতিকদের বিরুদ্ধেও। এজন্যই বাস তো বটেই, ফিটনেসবিহীন অনেক লঞ্চ-স্টিমারও বাধাহীনভাবেই চলাচল করতে পেরেছে। একই কারণে পদক্ষেপ নিতে হবে সামগ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপারে, পরিকল্পনাও নিতে হবে দীর্ঘমেয়াদি। এভাবে সব মিলিয়ে ব্যবস্থা নেয়া হলেই মহাসড়কের পাশাপাশি নৌপথেও দুর্ঘটনা কমে আসতে পারে বলে আমরা মনে করি। বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে তেমন পরিকল্পনা এবং পদক্ষেপ নেয়া দরকার অনবিলম্বে, যাতে আর কোনো দুর্ঘটনায় মানুষকে জীবন হারাতে না হয়। যাতে বিশেষ করে ঈদের ছুটিতে মানুষ আনন্দ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয়।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন