সম্প্রতি সুইজারল্যান্ড সরকার
তাদের ব্যাংকে গচ্ছিত বিদেশীদের অর্থের এক পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা গেছে, এখনো শীর্ষদের তালিকায় বাংলাদেশের নাম উঠেছে। বর্তমান সরকার বিভিন্ন রেকর্ডে
তাদের নাম উঠানোর জন্য কী কোশেশ-কসরতই না করে যাচ্ছে। পৃথিবীর বৃহত্তম মানব পতাকা তৈরি।
লাখো কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত। এসব নিয়ে এরা ইতোমধ্যে ভালোই রেকর্ড করে ফেলেছে। সেই রেকর্ড
করায় এ দেশের জনগণের ভাগ্যের কী পরিবর্তন হয়েছে, সেটি বড় কথা নয়। বড় কথা হলো, সরকার রেকর্ড করে ফেলেছে। সুইস ব্যাংকের গোপন অ্যাকাউন্টে ২০১৩ সালে বাংলাদেশীরা
অর্থ পাচার করে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছে। সে জন্য সরকারকে হাজারো সেলাম ও অভিনন্দন।
এই খবর
প্রকাশিত হওয়ার পরপরই খুব স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী মহলে শোর তোলা হলো যে, এই টাকা তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোর। কত কল্কি-গঞ্জিকা সেবন করলে এ ধরনের
অভিযোগ তোলা যায়, সেটি ভেবে দেখার মতো। এ যদি বিএনপি নেতৃত্বাধীন আমলের জোট সরকারের
পরিসংখ্যান হতো, তাহলে বোধ করি এসব গঞ্জিকা সেবক একেবারে অ্যাকাউন্ট নম্বর দিয়ে
তাতে কত টাকা আছে তার তালিকাই প্রকাশ করে দিতো; কিন্তু দুর্ভাগ্য, ঘটনাটি সে সময়ের নয়। ফলে খুব স্পষ্ট করে ওসব কথা বলা গেল না। বিগত মন্ত্রিসভায়
ঠাঁই ছিল; কিন্তু এবারের সাইড লাইনের খেলোয়াড় আওয়ামী লীগের এক সম্পাদক হাছান
মাহমুদ শেখ হাসিনাকে সন্তুষ্ট করার জন্য বলেই ফেললেন, সুইস ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে তারেক রহমানের টাকা আছে। আওয়ামী লীগের একটা সুবিধা
আছে। আর তা হলো এই যে, এরা যেসব অভিযোগ তোলে তার কোনো তথ্যপ্রমাণের দরকার
হয় না। শত কণ্ঠে গোয়েবলসীয় কায়দায় এরা একই কথা অবিরাম বলতে থাকে। ফলে তাদের ধারণা হয়
যে, ওই সব মিথ্যে কথা জনগণ একেবারে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করছে। এরা
নিজেরাও যেমন অন্ধ তেমনি এরা মনে করে যে, জনগণও তাদের মতোই অন্ধ। ফলে এসব
মিথ্যাচার জনগণ বিশ্বাস করবে।
আর তারেক
রহমানের প্রসঙ্গ এলে তো কথাই নেই। তারেক রহমান বেয়াদব, তারেক রহমান অর্বাচীন, তারেক রহমান মূর্খÑ এমন সব অশিষ্ট কথাবার্তায় তারা পরিবেশ ভারী করে তোলেন। এর আগে তারেক রহমান
যখন বলেছিলেন, ‘জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট ও স্বাধীনতার
ঘোষক’, তখন আওয়ামী শীর্ষস্থানীয় নেতানেত্রী থেকে শুরু করে
অশিক্ষিত ও জ্ঞানপাপী সমর্থকেরা একেবারে ‘রা’ ‘রা’ করে উঠেছিলেন। আড়াই হাজার বছরের সভ্যতায় সমৃদ্ধ এই বাংলাদেশের
যা কিছু অর্জন, এর সব কিছুই আওয়ামী দৃষ্টিতে শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘিরে। সেই কারণে
আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের ইতিহাসের শুরুটাই করে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে। যদিও ওই
ভাষা আন্দোলনেও শেখ মুজিবুর রহমানের তেমন কোনো অবদান ছিল না। এর আগে এ দেশের কৃষ্টি-সংস্কৃতি
নির্মাণে বাংলাদেশী জাতি গঠনে সহস্র বছর ধরে যারা কাজ করে গেছেন, ঐতিহাসিক অবদান রেখে গেছেন, আওয়ামী লীগ সেগুলো ইতিহাসের পাতা
থেকে মুছে দিতে চাইছে।
জিয়াউর
রহমান যে স্বাধীনতার ঘোষক ও বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন, সে বিষয়ে সম্প্রতি তারেক রহমান একটি তথ্য, প্রমাণ, দলিলসহ একটি গ্রন্থ সঙ্কলন করেছেন। এতে তার নিজের কথা নেই বললেই চলে। সবটুকুই
দলিল। তথ্য ও প্রমাণ। তার এই তথ্যের সাথে অনেক তথ্যেরই মিল রয়েছে তাজউদ্দীন আহমদের
কন্যা শারমিন আহমদের বই ‘তাজউদ্দীন আহমদ : নেতা ও পিতা’ বইয়ে। সে বই সম্পর্কে আওয়ামী লীগারেরা তেমন কোনো উচ্চবাচ্য করেননি। শারমিন
আহমদ লিখেছেন যে, তাজউদ্দীন আহমদ একটি ক্যাসেট প্লেয়ার ও স্বাধীনতার ঘোষণা লিখে
নিয়ে ২৫ মার্চ শেখ মুজিবের বাড়িতে হাজির হয়েছিলেন; কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান সেই
ঘোষণা দিতে কিছুতেই রাজি হননি। কিংবা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রেও স্বাক্ষর দিতে অস্বীকৃতি
জানান। তিনি বরং তাজউদ্দীন আহমদকে বলেন, ‘বাড়ি গিয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে
থাক, পরশু দিন (২৭ মার্চ) হরতাল ডেকেছি।’ স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া কিংবা ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর দেয়া সম্পর্কে শেখ মুজিবুর
রহমান বলেছিলেন, ‘এটা আমার বিরুদ্ধে দলিল হয়ে থাকবে। এর জন্য পাকিস্তানিরা
আমাকে দেশদ্রোহের জন্য বিচার করতে পারবে।’ তাজউদ্দীন আহমদ শেখ মুজিবুর রহমানের
বাসায় গিয়ে দেখতে পেয়েছিলেন যে, তিনি গ্রেফতার বরণের জন্য বিছানাপত্র গুছিয়ে তৈরি
হয়েছিলেন। অর্থাৎ শেখ মুজিবুর রহমান কোনোভাবেই স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি।
এই কথাগুলো
যখন তারেক রহমান বলেছিলেন, তখন আওয়ামী লীগের পাঠবঞ্চিত নেতানেত্রীরা একেবারে
‘রা’ ‘রা’ শোর তুলেছিলেন। গালিগালাজের তুবড়ি
ছুটিয়েছিলেন; কিন্তু শারমিন আহমদের বই প্রকাশিত হওয়ার পর তাকে গালিগালাজ করেননি।
আওয়ামী লীগের মন্ত্রী- এমপিদের বইয়ের এবং বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়েই তারেক রহমান বলেছিলেন
যে, জিয়াউর রহমানই ছিলেন স্বাধীনতার ঘোষক এবং বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট।
এ কথা অসত্য নয় যে, ২৬ মার্চের (১৯৭১) পর ২৭ মার্চ জিয়াউর রহমান শেখ
মুজিবের নামে দ্বিতীয় দফায় স্বাধীনতার ঘোষণা দেন; কিন্তু সে ঘোষণায়ও বাংলাদেশের
প্রভিশনাল প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজেকে উপস্থাপিত করেন। এর সব কিছুই তিনি তথ্য প্রমাণ
ফটোকপি আর আর্কাইভ, ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের অবমুক্ত দলিল ওয়েবসাইট প্রভৃতি
থেকে উদ্ধৃত করে প্রমাণ করেছেন। তাহলে তিনি বেয়াদব বা অর্বাচীন হলেন? নাকি যারা তাকে বেয়াদব ও অর্বাচীন বলে অভিহিত করল, তারাই বেয়াদব ও অর্বাচীন।
আওয়ামী
নেতাদের একটা সুবিধা হলো, এরা শেখ হাসিনা যা বলেন, শতকণ্ঠে সেই ডুগডুগিই বাজাতে থাকেন। কিছু দিন আগে জাতীয় সংসদে নারায়ণগঞ্জের
গডফাদার সেখানকার সেভেন মার্ডারের সাথে সংশ্লিষ্টতাযুক্ত শামীম ওসমানের পক্ষে কথা বলার
সময় বললেন যে, শামীম ওসমানের বাবা জোহা কাকার (শামসুজ্জোহা) বাসায়ই আওয়ামী লীগ
প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এমন ডাহা অসত্য কথা এ পর্যন্ত কেউ বলেনি। আওয়ামী লীগ নেতাদের কেউ
কোনো লেখাপড়া করেন, তাদের কথাবার্তায় এমন কোনো প্রমাণ মেলে না। ভাবখানা
এমন যে, শেখ হাসিনা যা বললেন সেটাই শেষ সত্য। ইতিহাস কিংবা লিপিবদ্ধ তথ্য-প্রমাণ
অর্থহীন। তারেক রহমান বিতর্কের অবসানের জন্য, জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক
ও প্রথম প্রেসিডেন্ট কি না, সেটি বোঝার জন্য আওয়ামী নেতাদের তারেক রহমানসংবলত
বই ‘জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট ও স্বাধীনতার ঘোষক’, শারমিন আহমদের ‘তাজউদ্দীন আহমদ : নেতা ও পিতা’, আওয়ামী নেতা রফিকুল ইসলাম বীর উত্তমের বই ‘এ টেল অব মিলিয়নস’, সাবেদ আলী ভূইঞার বই ‘মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস’, অলি আহমদের বই ‘রাষ্ট্র বিপ্লব : সামরিক বাহিনীর সদস্যবৃন্দ ও বাংলাদেশের
মুক্তিযুদ্ধ’, এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারের ‘মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর’, আবুল মাল আব্দুল মুহিতের ‘বাংলাদেশ : ইমার্জেন্স অব এ নেশন’, মেজর জেনারেল শফিউল্লাহর বইসহ
মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণকারী আওয়ামী লীগারদের বইগুলো পড়ে দেখার অনুরোধ জানাব।
রাজনীতি করতে হলে কিছুটা লেখাপড়ারও দরকার আছে। কারণ রাজনীতিবিদেরা অধম হলেও জনগণ কেন
উত্তম হবে না।
এতসব প্রসঙ্গ
আসত না। এলো সুইস ব্যাংকে টাকা পাচারে ২০১৩ সালে বাংলাদেশে অসাধারণ রেকর্ডের কারণে।
এই রেকর্ডের জন্যও প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ। কারণ গত এক বছরে তার মন্ত্রী-এমপিরা এবং
নেতাকর্মীরা দুর্নীতির ক্ষেত্রে যে গিনেজ বুকে নাম উঠিয়ে ফেলার পর্যায়ে চলে গেছেন সে
কৃতিত্ব তার। সংসদে তার স্বভাবসুলভ ঢঙে বক্তৃতায় তিনি বললেন, সুইস ব্যাংক কাদের টাকা আছে, সে তালিকা তিনি হাতে পেয়ে গেছেন।
সাব্বাশ! তিনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা তো! পৃথিবীর কোনো ব্যাটার সাহস আছে তাকে তালিকা না
দিয়ে পারে। যদি সুইস ব্যাংক তালিকা না-ই দিত তাহলে তিনি হয়তো যেভাবে বিশ্বব্যাংকের
অডিট রিপোর্ট দাবি করে বসেছিলেন, সেভাবেই সুইস ব্যাংকের অডিট রিপোর্টও দাবি করতেন।
তবে তার
এই দাবি যে কতটা হাস্যকর সেটা বোধ করি তিনি অনুমানও করতে পারেননি। তিনি ভেবেছেন, কোথায় সুইজারল্যান্ড, কোথায় তার ব্যাংক, কোথায় তাতে কার কী অ্যাকাউন্ট, সেটা এ দেশের একেবারে আবাল জনগণ
কিভাবে বুঝবে? তিনি বলে দিলেন তালিকা হাতে এবং হাসি দিলেন যে, এই তালিকায় যাদের নাম আছে, তারা হলো তারেক-কোকোসহ সব বিএনপির
লোক। হা: হা:, এবার বিএনপি যায় কোথায়; কিন্তু শেখ হাসিনা নিজে না জানতে
পারেন, এ দেশের লাখ লাখ শিক্ষিত মানুষ জানেন সুইস ব্যাংকে কার টাকা জমা
আছে, এটা বের করা বঙ্গবন্ধুর কন্যা হলেই যথেষ্ট নয়। সে প্রক্রিয়া বড়
দীর্ঘ ও জটিল। এমনকি বারাক ওবামা হলেও নয়।
বিশ্বের
বহু একনায়ক সুইস ব্যাংকে গোপন অ্যাকাউন্ট করে টাকা রেখেছেন এবং কোনো দিন সে টাকা ভোগ
করতে পারেননি। এসব টাকা সুইজারল্যান্ডের অর্থনীতির নিয়ামক হয়েছে। প্রায় ৩০০ বছর আগে
থেকেই সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে গোপন অ্যাকাউন্ট খুলে টাকা জমা রাখার ব্যবস্থা চালু
ছিল। প্রধানত ফরাসি রাজাদের গোপন অর্থ এসব ব্যাংকে রাখা হতো। ১৭১৩ সালে জেনেভার সিটি
কাউন্সিলে আইন হয় যে, গ্রাহকদের অ্যাকাউন্টের হিসাব সম্পূর্ণ গোপন রাখা
হবে। কেবল গ্রাহক ছাড়া অন্য কারো কাছে অ্যাকাউন্ট সম্পর্কিত তথ্য জানানো নিষিদ্ধ ছিল।
তখন থেকেই শুরু হয় বিভিন্ন দেশ থেকে অর্থ পাচার করে সুইস ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলে টাকা
রাখা। ১৯৩৪ সালে এই গোপনীয়তা আরো জোরদার করা হয়। কেউ এই গোপনীয়তা ভঙ্গ করলে তার বিরুদ্ধে
শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়। ফলে সুইস ব্যাংকের কদর বাড়ে। তাদের বিরুদ্ধে যে অনৈতিকতার
অভিযোগ নেই, এমন নয়। তারা বহু আমানতকারীর অর্থ মেরে দিয়েছে আর তা দিয়ে জাতীয়
অর্থনীতি সমৃদ্ধ করেছে।
সুতরাং
আমাদের প্রধানমন্ত্রীর কাছে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের কার কার টাকা জমা আছে, এ রকম একটি দাবি সম্পূর্ণ হাস্যকর এবং জনবিভ্রান্তিমূলক। এদের তালিকা যদি বাংলাদেশ
পেতে চায় তাহলে বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশকে আইনি প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হতে হবে। সরকার
প্রধান তা না জানলেও এ দেশের অর্থনীতি-সচেতন হাজার হাজার মানুষ সে কথা জানেন। প্রধানমন্ত্রীর
কাছে যদি তালিকা থেকেই থাকে, কারা ২০১৩ সালে বাংলাদেশের অর্থপাচারের এমন রেকর্ড
স্থাপন করল, তাহলে তা প্রকাশ করে দিন। যদিও আমরা নিশ্চিত বলতে পারি যে, সুইস ব্যাংক তাদের গোপনীয়তার স্বার্থে সে তথ্য অস্বীকার করবে; কিন্তু শেখ হাসিনাকে এটা মানতেই হবে যে, ২০১৩ যদি বাংলাদেশের নাগরিকদের
সুইস ব্যাংকের গোপন টাকা ৩২৩৬ কোটিতে দাঁড়িয়ে থাকে তবে তার সবই আছে আওয়ামী চোট্টাদের।
শেখ হাসিনা কি ক্ষমতা রাখেন তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে? তিনি কি পেরেছেন হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংকের অর্থ লুট রোধ করতে? কিংবা তাদের কারো বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে? সুইস ব্যাংকে যত টাকা জমা হয়েছে তারচেয়ে শত গুণ টাকা ব্যাংকিং খাত থেকে লুট
হয়েছে। মাননীয় শেখ হাসিনা, আপনিও আপনার পিতার মতো এখন চোরের খনির মালিক হয়ে
পড়েছেন?
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন