এখন রাজনীতি আর রাজনীতি নেই। অর্থনীতি নেই অর্থনীতিতে। সুশাসনের কোনো অবকাশ নেই। সংসদে বসে যাত্রাপালার আড্ডা। ঘর হতে বের হলে জীবন নিয়ে ঘরে ফেরা যাবে কিনা সংশয়, মেয়ে স্কুল-কলেজে গেলে সম্ভ্রম নিয়ে ফিরতে পারবে কিনা, ছোট বাচ্চারও হাত ছেড়ে দেওয়ার উপায় নেই-কোন ফাঁকে কে টান দিয়ে নিয়ে যায়, যেখানে সেখানে অপহরণ-হত্যা বাণিজ্যে র্যাব-পুলিশের জড়িয়ে পড়া-এমনি সব ঘটনা নিত্যদিন ঘটছে। খুনি, চোরের পক্ষ নিয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে খুনসহ বিভিন্ন অপকর্মের হোতাদের পাশে দাঁড়াবেন বলে বুক ফুলিয়ে ঘোষণা দিয়েছেন। স্বর্ণ চোরদের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। কোথায়ওবা এসব চোরের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। প্রশ্নপত্র ফাঁস বিষয় কোনো পত্রিকায় প্রকাশিত হলে তা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন। শতভাগ পাসের বিষয়ে যারা সমালোচনা করেছেন, তিনি তাদের এক ধরনের মূর্খ বলেই যেনো অভিহিত করেছেন।
প্রথম দিকে আমরা কিছু ফুটানির কথা শুনেছিলাম কালো টাকার মালিকদের আর ছাড় নেই। তখনই ওয়াকিফহাল মহল ধারণা করেছিলো যে, এবার বুঝি ঘুষখোর, বাটপার, চোরেরা ধরা খেয়ে যাবে। অর্থমন্ত্রী প্রতিবছরই বলেন, কালো টাকার মালিকদের ছাড় নেই। কিন্তু বাজেট পাসের আগে আগে ঠিকঠিকই কোনো না কোনোভাবে ছাড়ের রাস্তা বের করেন। এবারও তাই হলো। ছাড় না দিয়ে উপায় কি? কেননা বছরভর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, মন্ত্রী-এমপিরা টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ঘুষ-দুর্নীতি, খুন-অপহরণের মাধ্যমে যে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করে সেটা নিয়ে তো তাদের বিপদে ফেলা যাবে না। বিপদে ফেললে বিরোধী দল দমনে এদের সহায়তা পাওয়ার আশা কমে যাবে। সেটা সরকারের জন্য সুবিধাজনক নয়। কারণ জনগণ নয়, মাস্তানি শক্তি এই সরকারের ভরসা। দলীয় মাস্তানদের হাতে টাকা গুঁজে দিতে না পারলে তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কোনো সরকারকে রক্ষায় রাস্তায় নামবে। ফলে অর্থ-বিত্তের মালিক তাদের করতেই হবে। সুতরাং কালো টাকাও সাদা করতে হবে।
কেউ কেউ বলছেন, টাকা আবার সাদা-কালো কি? অর্থাৎ ঘুষ-দুর্নীতি, চুরি, ব্যাংক লুট যে পথেই উপার্জন করা হোক না কেনো সে টাকা টাকাই। তা নিয়ে এত কথা কিসের। আর মন্ত্রীদের কে কখন যে কী বলছেন তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে দেখি রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াতে। আর প্রতিনিয়ত পত্র-পত্রিকায় সড়কের অবস্থা দেখি খানাখন্দে ভরা। কোথায়ও কোথায়ও ছ্যাপ দিয়ে লেপ দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা আছে। আজকে রাস্তা ঠিক হচ্ছে, ১০/১৫ দিনের মধ্যেই আবার খানাখন্দ। অর্থাৎ লুট আর দলীয় লোকদের বিত্তবান করে তোলার চেষ্টা। তেমনি এক আজব কথা শুনলাম স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের মুখে। তিনি জাতীয় সংসদে বললেন, পৃথিবীর কোথায়ও নাকি রোগী মরে গেলেও ছুটির দিনে ডাক্তাররা চিকিৎসা করেন না। শুধুমাত্র তার সরকারের আমলেই বাংলাদেশে ছুটির দিনে চিকিৎসা হচ্ছে। এমন গাঁজাখুরি কথা আমরা কোনোদিন শুনিনি। হাসপাতালের পরিবেশ যে খারাপ সে কথা স্বীকার করেছেন। কিন্তু আবার এও বলেছেন, ডাক্তাররা গ্রামে থাকলো কি থাকলো না সেটা দেখার দায়িত্ব তার নয়। তাহলে সে দায়িত্ব যে কার সেটিও বোঝা দুষ্কর।
রেলের কালো বিড়ালখ্যাত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বাসার দিকে রওনা হয়েছিলো ৭০ লক্ষ টাকার বস্তা। সে গাড়িতে ছিলেন সুরঞ্জিতের এপিএস, রেলের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা আর উত্তরাঞ্চলের মহাপরিচালক ইউসূফ আলী মৃধা। বলা হয়েছিলো এগুলো চাকরি দেবার নামে ঘুষ বাণিজ্যের টাকা। সে ঘুষের দায়ে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পদত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু তার অপার ভাগ্য, পরদিনই গণেশ উল্টে গেলো। রেলমন্ত্রিত্ব গেলো বটেই কিন্তু দপ্তরবিহীন মন্ত্রী হিসেবে সুরঞ্জিতকে জনগণের পয়সায় আরও অনেকদিন পুষে যাওয়া হলো। আর ঐ যে বস্তার টাকা খুব স্বাভাবিকভাবেই সে টাকা জমা হবার কথা ছিলো রাষ্ট্রীয় কোষাগারে। কিন্তু তা হয়নি।
নিয়ম অনুযায়ী উৎস জানা ছাড়া কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে অত টাকা জমা নেয় না ব্যাংক। কিন্তু সুরঞ্জিতের এপিএস সেই ৭০ লাখ টাকা নিয়ে তারই অ্যাকাউন্টে জমা দিতে হাজির হয়েছিলো ব্যাংকে। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী সে টাকা জমা নিতে অস্বীকার করে ব্যাংক। তখন ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের চাপে সে টাকা জমা হয়ে গেছে। তারপর ঐ টাকার যে কি হলো তার কোনো হদিস মেলেনি। ৭০ লাখ টাকার একটি বস্তা না হয় ধরা পড়েছিলো কিন্তু এভাবে কত বস্তা যে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে গেছে সেকথাও আমরা কেউ জানি না। দেশবাসীও জানে না। এদিকে আবার ‘দুর্নীতি ধোয়ার মেশিন দুদক’ ঐ অভিযোগ থেকে বহু আগেই সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে অব্যাহতি দিয়েছে। ছিলো উত্তারঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক ইউসূফ আলী মৃধা। তার বিরুদ্ধেও ‘অভিযোগের কোনো সত্যতা’ পাওয়া যায়নি বলে দুর্নীত দমন কমিশন রায় দিয়ে দিয়েছে। এই কমিশন আর কতজনকে যে ‘দুর্নীতি অভিযোগে ডেকে এনেছে, জেরা করেছে তার মধ্যে মন্ত্রী-এমপি’রাও বাদ যায়নি। কিন্তু শেষমেষ ফলাফল শূন্য। সকলকেই এই কমিশন সততার সার্টিফিকেট দিয়ে বিদায় দিয়েছে। অবশ্য দুদক যখন ডাকাডাকি করছিলো, তখন কেউই বিশ্বাস করেনি যে, প্রকৃতপক্ষেই এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মানুষ বিশ্বস করেছে এর সবই লোক দেখানো। আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপি-নেতারা বিগত পাঁচ বছরে দশ, বিশ, পঁঞ্চাশ, শত, হাজারগুণ সম্পদের মালিক হয়েছেন। দুই বিঘা জমি দুইশ’ বিঘা হয়েছে। দেড়তলা বাড়ি ডিম পেড়েছে অনেকগুলো পাঁচ-ছয় তলা ভবনের। এরা দুদকে এসে দু’একবার বেড়িয়ে গিয়েছে। তারপর সবকিছু শুনশান। অনেকে দুদকের নোটিশের জবাবও দেয়নি। কিন্তু দুদক নিজেই সাফাই গেয়েছে উনি অসুস্থ, পরে আসবেন। এর সবই সীমাহীন বেহায়াপনা।
সুইজারল্যান্ডের বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গতবছর যারা ওদেশের ব্যাংকে গোপন অ্যাকাউণ্ট করে টাকা রেখেছেন তাদের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় ৩২৩৬ হাজার কোটি টাকা। এই বিশাল অঙ্কের টাকা সুইস ব্যাংকে কারা জমা রাখলো, বলে না দিলেও সেটি বুঝতে কারও অসুবিধা হয়নি। গত ২৭ জুন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা সুইস ব্যাংক থেকে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনা সম্পর্কে বলেছেন, এটা নিশ্চিত যে, তারা যে পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন তাতে খালেদা জিয়াসহ তার দুই ছেলে এই অর্থ পাচারকারী হিসেবে ধরা পড়বেন (ডেইলি স্টার, ২৮/০৬/১৪)।
সুইস ব্যাংকে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ জমা পড়েছে গত এক বছরে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য যদি সত্য হয়, তাহলে গত একবছর ধরে বেগম খালেদা জিয়া ও তার দুই ছেলে সারা দেশে বিপুল মাত্রায় লুটপাট করেছেন। আর সে অর্থ নিয়ে জমিয়েছেন সুইস ব্যাংকে। শেখ হাসিনার এই কথা কোনো শিশু বা উন্মাদও বিশ্বাস করবে না। তিনি বলেছেন, সুইস ব্যাংকে যারা টাকা জমিয়েছেন, তাদের তালিকা শেখ হাসিনার কাছে এসে পৌঁছেছে। এটি এক অসম্ভব, অকল্পনীয় ব্যপার। সুইস ব্যাংকে যারা টাকা রাখে তাদের সঙ্গে ব্যাংকের শর্তই থাকে যে, কস্মিনকালেও তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের হিসাব কেউ জানতে পারবে না। আজ পর্যন্ত তা পারেওনি। এ নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সুইজারল্যান্ডের অনেক টানাপড়েন চলেছে। কিন্তু সুইস সরকার কিছুতেই তাদের অবস্থান থেকে সরে আসেনি। পৃথিবীর বহু দেশের একনায়কেরা তাদের লুণ্ঠিত টাকা সুইস ব্যাংকে জমা রেখেছিলেন। কিন্তু সে টাকা তুলে ভোগ করতে পারেননি। কার্যত ব্যাংকগুলোই তার মালিক হয়ে গেছে। শেখ হাসিনা যদি তালিকা হাতেই পেয়ে থাকেন, তাহলে সুইস ব্যাংকে অর্থ জমাকারীদের নাম, ঠিকানা প্রকাশ করছেন না কেনো। আসলে বিগত সাড়ে পাঁচ বছরে এই সরকারের মন্ত্রী, এমপি, নেতারা যে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করেছেন, হাজারগুণ সম্পত্তির মালিক হয়েছেন, তাদের টাকাই যে সুইস ব্যাংকে জমা হয়েছে এটি নিশ্চিত করে বলা যায়। শেখ হাসিনার দুর্নীতিবাজ তোষণ নীতিও তার প্রমাণ।
এবার দেখা যাক পরীক্ষায় পাস করিয়ে দেওয়ার বাহাদুরি। এই সরকারের আমলে গত পরীক্ষায় প্রায় শতভাগ ছেলে-মেয়ে পাস করেছে। এ এক অসম্ভব ও অকল্পনীয় ব্যপার। দেখা গেছে, নিজ স্কুলে যারা টেস্ট পরীক্ষায় সব বিষয়ে ফেল করেছে, অন্য স্কুল থেকে পরীক্ষা দিয়ে তারা ভালোভাবেই পাস করেছে। প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সাফল্যের বিশাল হাসি দিয়েছেন। কিন্তু পত্রিকায় রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, ২৮ নম্বর পেলেই তাকে ৩৩ দিয়ে যেনো পাস করিয়ে দেওয়া হয়। জিপিএ৫ এর কাছাকাছি গেলে যেনো নম্বর বাড়িয়ে তাকে জিপিএ৫ করে দেওয়া হয়। অন্যক্ষেত্রেও তাই। এর উপর প্রায় প্রতিটি প্রশ্নপত্র ফাঁস করে দেওয়া হয়েছে যেনো লেখাপড়ার প্রয়োজন ফুরায়। আমরা এসএসসি পরীক্ষায় গোটা বই পড়ে পরীক্ষার হলে গেছি। প্রশ্ন যেখান থেকেই আসুক যেনো জবাব দিতে পারি। কেউ ৬০% নম্বর পেয়ে ফার্স্ট ডিভিশন পেলে স্কুল থেকে তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে। কীভাবে তারা পড়েছেন, কীভাবে প্রস্তুতি নিয়েছেন, কত ঘণ্টা পড়েছেন এটা জানিয়ে আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছেন। অংক পরীক্ষায় বইয়ের ‘এ টু জেড’ সমস্ত পাটীগণিত, বীজগণিত ও জ্যামিতির সম্পাদ্য, উপপাদ্য সমাধান করে রেখেছি। তারপর পরীক্ষার হলে গেছি। এখন সে পাঠ চুকেছে। কিনতে কিংবা ফেসবুকে প্রশ্নপত্র ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে, ৫টি প্রশ্নের জবাব তৈরী করতে হচ্ছে। ব্যাস, তারপর জিপিএ-৫ অথবা গোল্ডেন।
ফলে শিক্ষার মান আজ তলানিতে। শেখ হাসিনা আকর্ণ হাসি দিয়ে বললেন, যারা অধিক পাসের হারের সমালোচনা করছেন, তারা না বুঝে করছেন। আর প্রধানমন্ত্রীও যা বুঝে করছেন তা আরও বিপজ্জনক। সেটি হলো শতভাগ পাস করলে কোনো স্কুল বা শিক্ষককে জবাব দিতে হবে না। কিন্তু একজন ফেল করলে ঐ পরীক্ষককে জবাবদিহি করতে হবে। এটি হীরক রাজার দেশেও বোধকরি কল্পনার বাইরে।
ফলে আমাদের সামনে এক ঘন অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়। পরবর্তী প্রজন্মকে আমরা শিখিয়ে যাচ্ছি ঘুষ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি আর বিনে লেখাপড়ায় পাস। এভাবে আমরা আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে রেখে চলে যাবো?
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন