শনিবার, ৫ জুলাই, ২০১৪

জাতির ভরসার শেষ প্রদীপ যেন নিভে না যায়


এক অস্থির সময়ের মধ্য দিয়ে জাতি সময় অতিবাহিত করছে। আওয়ামী লীগের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকার মরিয়া চেষ্টায় দেশে অমাবস্যার অন্ধকার নেমে এসেছে। খুন, গুম, অপহরণ আর নৈরাজ্যে সারা দেশে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। পুনর্বার ক্ষমতা দখলের মানসিকতা থেকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে বাইরে রেখে ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ তাদের স্বার্থে সংশোধিত সংবিধানকে আঁকড়ে ধরে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের পক্ষে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছিল। এভাবে একতরফা ও ভোটারবিহীন নির্বাচনে কথিত জয় লাভের মাধ্যমে পুনর্বার সরকার গঠন করেছে। জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় লাভের অদ্ভুত রেকর্ড গড়ে বরং দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছে। এ জন্য সরকার গঠনের পর শক্তিশালী অনেক রাষ্ট্র থেকে অভিনন্দনবার্তা পেতে বিলম্ব ঘটে।
আওয়ামী লীগ নেতাদের বক্তব্যে সংবিধান এবং গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা কথা বলা হলেও প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সাথে অবিলম্বে আলোচনার ভিত্তিতে শিগগিরই একাদশ সংসদ নির্বাচন আয়োজনের কথাও বলা হয়েছিলেন। বিএনপিও দশম সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে হরতাল, অবরোধসহ আন্দোলন স্থগিত করে। তাই দেশবাসী আশা করছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে আবার কার্যকর সংলাপ শুরু হবে। এই দুদলের মধ্যে পরস্পর অসহিষ্ণু ও বৈরী সম্পর্ক ঘুচিয়ে আনতে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ উদ্যোগ নেবেন বলেই জনগণ আশা করছেন। সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতির তেমন কোনো ক্ষমতা নেই। তিনি প্রজাতন্ত্রের অনেকটা অলঙ্কার ও অভিভাবক হিসেবে পরিচিত। রাষ্ট্রপতিকে এই অভিভাবক ভাবার মানসিকতা থেকেই জাতির যেকোনো সঙ্কট ও দুর্যোগে তাকে ভরসার স্থল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আবদুল হামিদ একজন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ এবং অভিজ্ঞ ব্যক্তিত্ব। কিন্তু রাষ্ট্রপতি ইতোমধ্যেই জনগণকে প্রশ্ন তৈরির সুযোগ করে দিয়েছেন।
সম্প্রতি ল্যাটিন আমেরিকা সফরকালে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব বান কি মুনের সাথে সাক্ষাৎ করেন। বান কি মুন বাংলাদেশে প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের স্বার্থে সব দলের অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে আবার সংলাপ শুরু করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির বক্তব্য সবাইকে হতাশ করেছে। তিনি বর্তমান সরকারের পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষে এ বিষয়ে আলোচনা হতে পারে বলে নিদারুণ বিস্ময় সৃষ্টি করেছেন। এ অভিমত আমরা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মুখ থেকেই শুনে আসছি। আওয়ামী নেতারা ক্ষমতার স্বাদ ছাড়তে নারাজ। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে জনসাধারণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়ে তাদের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা। এ জন্য আওয়ামী লীগ দলীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন আয়োজনের পক্ষপাতী। আমরা জানি, আবদুল হামিদ খাঁটি আওয়ামী লীগ নেতাদের একজন হিসেবেই ছিলেন পরিচিত। জাতীয় সংসদের স্পিকার থাকা পর্যন্ত এই মানসিকতা দোষনীয় ছিল না। কিন্তু রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি দেশের সব মানুষের রাষ্ট্রপতি। তার প্রত্যাশিত ভূমিকা দ্বারা সর্বজন গ্রহণযোগ্য একজন রাষ্ট্রপতি হিসেবে সাদৃত হবেন বলে ধারণা করা হয়েছিল। বান কি মুনের সাথে নির্বাচন প্রশ্নে রাষ্ট্রপতি খাঁটি আওয়ামী লীগারের মতো কথা বলে সবাইকে এ ধারণা দিয়েছেন, তিনি দলীয় মনোভাবের ঊর্ধে উঠতে পারেননি। মনে রাখা দরকার, তিনি আওয়ামী লীগে বিলীন হয়ে গেলে জাতির শেষ আশা ভরসার প্রদীপটুকুও নিভে যাবে।
নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের সংলাপ শুরুর তাগিদ নতুন নয়। বান কি মুন বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও শান্তি-শৃঙ্খলার স্বার্থে সব দলের অংশগ্রহণে দশম সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ ও প্রধান বিরোধী দল বিএনপির মধ্যে অর্থবহ সংলাপের জোর প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। এ লক্ষ্যে দুবার তার দূত হিসেবে সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোকে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন। ফার্নান্দেজ দুই মেরুতে অবস্থান করা আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে অনেকটা কাছাকাছি অবস্থানে আনতে পারলেও তিনি বিমানে ওঠার পরপরই দুই দলই আগের অবস্থানে ফিরে গেছে। সুতরাং আমরা লক্ষ করেছি, একটি সফল প্রচেষ্টা সরকারি দলের অনড় অবস্থানের কারণে সফলতার মুখ দেখেনি। শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ ব্যতিরেকেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়ে যায়। এটাকে নির্বাচন না বলে এক প্রকার প্রহসন বলাই যুক্তিযুক্ত। বিএনপি শুরু থেকেই ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে অবৈধ বলে অভিহিত করে আসছে। এ ক্ষেত্রে তারা সরকারকে বরং কিছুটা সময় দিয়ে নতুন করে সংলাপে বসার দাবি জানিয়েছে। বিএনপির এই নীতি দেশের জনগণ এবং বিদেশী কূটনীতিকেরা গ্রহণ করেছেন। বিদেশী কূটনীতিক এবং দেশের সুশীলসমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা আওয়ামী লীগকে ফের সংলাপ শুরুর তাগিদ দিচ্ছেন। জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব সংলাপের তাগাদায় ভিন্নমাত্রা যুক্ত করেছেন।
আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা বান কি মুনের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় দেশে কোনো সঙ্কট ও সমস্যা নেইবলে জানাচ্ছেন। তারা আরো জানাচ্ছেন, বর্তমান সরকারের পাঁচ বছর মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে নির্বাচন হবে না এবং এখনই সংলাপের প্রয়োজন নেই। এমন বক্তব্য কোনো নীতিবান সচেতন নাগরিক বিশ্বাস করবে না, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপি বড় একটি দল। এ যাবৎ বিএনপি সবচেয়ে বেশি সময় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। দেশের তৃণমূল পর্যন্ত এর রাজনৈতিক ভিত্তি বিস্তৃত। এমন একটি রাজনৈতিক দলকে একেবারে অস্বীকার বা উপেক্ষা করা পরিস্থিতি বুঝতে অক্ষমতারই শামিল। বিরোধী দল নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের যে দাবি জানাচ্ছে, তা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতের প্রতিধ্বনি। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধারণা, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে ভরাডুবির আশঙ্কায় এটা বুঝতে চাইছে না। এটা বুঝেই সরকার এ বিষয়ে গণভোট দিতে রাজি হয়নি।
দেশবাসী এখন সংলাপের দিকে তাকিয়ে আছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কে কতটুকু ছাড়দিলে সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে, তা নিয়ে চলছে আলোচনা, বিচার-বিশ্লেষণ। রাজনীতিতে সীমার মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকবে, মতায় যাওয়ার প্রতিযোগিতা থাকবে, এমনকি পরস্পরকে আক্রমণ করার তির্যক ভাষাও থাকতে পারে। কিন্তু সব কিছুতেই থাকতে হবে শালীন সংস্কৃতির ছাপ। আমরা প্রায়ই তা থেকে বঞ্চিত। এমনকি প্রধানমন্ত্রী এবং বিএনপির নেত্রীর মধ্যে সৌজন্যমূলক সম্পর্ক, কুশলাদি জিজ্ঞেস করতেও দেখি না। বিএনপি মনোভাব পরিবর্তন করে পূর্বশর্ত থেকে সরে এসে সংলাপে বসার ওপর জোর দিচ্ছে। জানমালের নিরাপত্তা এবং দেশের স্থিতিশীলতার স্বার্থে সংলাপ অপরিহার্য। অবশ্য অতীতের অভিজ্ঞতা বলে, এ দেশের রাজনীতিতে সংলাপের মাধ্যমে সঙ্কট উত্তরণের নজির খুব একটা নেই। অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া এবং আওয়ামী লীগের সে সময়ের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলের মধ্যে সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই সংলাপে কোনো সুফল আসেনি। এখনকার সঙ্কট তখনকার মতোই। আমরা চাইব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বেগম জিয়া মানুষের ইচ্ছের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাবেন এবং বিএনপি নেত্রীর আহ্বানে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা সাড়া দেবেন। অশিষ্ট শব্দ চয়নে সবাই বিরত থাকবেন।
বিগত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে যে জনগণের আশা-আকাক্সার প্রতিফলন ঘটেনি, তা অনুধাবন করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনের পরদিনই সংবাদ সম্মেলনে আলোচনার মাধ্যমে একাদশ সংসদ নির্বাচনের বিষয়টি সমাধানের ওপর জোর দিয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে তিনি বিএনপিকে ধৈর্য ধারণ করে সহনশীল ও সংযত আচরণ করতে বলেছিলেন। দাবি জানিয়েছিলেন সব ধরনের সহিংসতা বন্ধ করার। জামায়াতকে ত্যাগ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। আমরা পরে লক্ষ করেছি, জামায়াতের সাথে সম্পর্কের ব্যাপারে বিএনপি একটা বক্তব্যও দিয়েছেন, যাতে কৌশলগত ঐক্যের কথা তুলে ধরা হয়েছে। আরো বলা হয়েছে এটা স্থায়ী নয়, সাময়িক।
আওয়ামী লীগ পুনর্বার সরকার গঠন করেছে ছয় মাস আগে। এই সময়ে বিএনপি বড় ধরনের কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি দেয়নি। বিএনপি সংলাপ শুরু এবং সব দলের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করে সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করছে। আওয়ামী লীগের উচিত ক্ষমতার মোহে বিভোর না থেকে দ্রুত সংলাপে বসা। জনসাধারণ আশা করে, রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এ সম্পর্কিত ইস্যুতে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অভিভাবক হিসেবে দ্রুত সংলাপের উদ্যোগ নেবেন। আমরা আশা করছি, সরকারের নীতিনির্ধারকদেরও এ ক্ষেত্রে শুভ বুদ্ধির উদয় হবে। সবাই সেই অপেক্ষায় আছি।

ড. মো: শামছুল আলম


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads