দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা রোধ করতে ব্যর্থ হওয়ার জের এখন পড়েছে খোদ শাসক দলের ওপর। আওয়ামী লীগ এখন নিজের লোকদেরকেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। নিজেই এখন হয়ে ওঠেছে নিজের প্রতিপক্ষ। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরের সূত্রে এমন চিত্রই দেখা যাচ্ছে। প্রকাশ, ফেনী জলার ছাগলনাইয়া উপজেলার ঘোপালে দলীয় কোন্দলের জের ধরে পরিবার নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দিন। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মহিউদ্দিন উপজেলার ঘোপাল ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ড আ’লীগের সভাপতি, তার স্ত্রী কোহিনুর বেগম উপজেলা মহিলা আ’লীগের সাবেক সভানেত্রী ও বর্তমান ঘোপাল ইউপি সদস্য। তাদের ছেলেরাও ছাত্রলীগ ও যুবলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। কিছুদিন ধরে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে স্থানীয় প্রতিপক্ষের সাথে মহিউদ্দিন পরিবারের দলীয় কোন্দল চলে আসছে। সম্প্রতি প্রতিপক্ষরা তাদের বসতঘর ও দোকানপাট জ্বালিয়ে দেয়ার ঘটনায় পুলিশ মামলা না নেয়ায় আদালতে মামলা করেন মহিউদ্দিনের স্ত্রী কোহিনুর মেম্বার। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে প্রতিপক্ষরা চাঁদার দাবিতে বন্ধ করে দেয় মহিউদ্দিনের ৩টি স’মিল। তাছাড়া একের পর এক মিথ্যা মামলা দিয়ে পুলিশী হয়রানি ও নিজ দলীয় ওই প্রতিপক্ষের প্রকাশ্য অস্ত্রের মহড়ার কারণে দীর্ঘ ২ মাস ছেলেদের নিয়ে এলাকায় ঢুকতে পারছে না বলে অভিযোগ কোহিনুর মেম্বারের। কয়েকদিন আগে ঘোপালের দৌলতপুরে অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় র্যাবের ফেনী কার্যালয়ে ছেলেদের জড়িয়ে বিবৃতি দেয়ার প্রতিবাদে গত শুক্রবার বিকেলে ছাগলনাইয়া পৌরসভার জমাদ্দার বাজারে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি এসব অভিযোগ করেন। পুলিশী হয়রানির বিষয়ে জানতে চাইলে ছাগলনাইয়া থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, কোহিনুর মেম্বার ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে থানায় ১৫ থেকে ২০টি মামলা রয়েছে। অর্থাৎ পরিস্থিতি এখন নিজেদের ওপরই সওয়ার হয়েছে।
কথায় আছে, অন্যের জন্য খাদ কাটলে, সে খাদেই একসময় খাদ-কর্তনকারীর বিনাশ হয়। সাপুড়ে যেমন সাপ নিয়ে খেলতে খেলতে সাপের কামড়েই প্রাণ হারায়, তেমনি আগুন নিয়ে যারা খেলে তারা আগুনেই নির্বংশ হয়। দানব ফ্যাঙ্কোনস্টাইন নির্মাতাদেরই সর্বনাশ করেছিল। অতএব আওয়ামী লীগের লোকেরাই এখন আওয়ামী লীগের জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফেনীরই আরেকটি ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, সোনাগাজীতে চাঁদাবাজির অভিযোগে ফেনী-৩ (সোনাগাজী-দাগনভূঞা) আসনের এমপি হাজী রহিম উল্যার ভাতিজা ফারুককে আটক করেছে পুলিশ। এমপির বাড়ি সংলগ্ন সোনাপুর বাজারের ব্যবসায়ীরা তার বেপরোয়া চাঁদাবাজির প্রতিবাদে গত শনিবার দিনভর দোকান বন্ধ রেখে ধর্মঘট শুরু করলে সোনাগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার হস্তক্ষেপে রাত ৮টার দিকে তাকে আটক করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। সংশ্লিষ্ট সূত্র ও ব্যবসায়ীরা জানান, এমপি হাজী রহিম উল্যার ভাতিজা ফারুক বেশ কিছুদিন ধরে চাঁদার দাবিতে সোনাপুর বাজারের ব্যবসায়ীদের নানা হুমকি দিয়ে আসছিল। ভয়ে অনেকে চাঁদা দিলেও অন্যরা দিতে অস্বীকৃতি জানান। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে সদলবল নিয়ে গত শনিবার বাজারে মহড়া দেয় ফারুক। প্রতিবাদে ফারুককে গ্রেফতারের দাবিতে সব ব্যবসায়ীরা দোকান বন্ধ করে ধর্মঘটের ডাক দেয়। খবর পেয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লুৎফুন নাহার ঘটনাস্থলে এসে ওই চাঁদাবাজকে গ্রেফতারের আশ্বাস দিলে ব্যবসায়ীরা ধর্মঘট প্রত্যাহার করে। গতকাল রোববার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে সোনগাজী থানার ওসি আবু জাফর মো. ছালেহ ফারুককে আটকের সত্যতা নিশ্চিত করেন।
উদাহরণস্বরূপ ফেনীর দু’টি ঘটনার উল্লেখ করার কারণ পাঠক বুঝতে পারবেন। ফেনীতে কিছুদিন আগেই আওয়ামী লীগের আন্তঃকোন্দলে কি ভয়াবহ সহিংসতা, রক্তপাত, খুন-খারাবি হয়েছে, তা দেশে-বিদেশে সবাই জানেন। এমন ভয়াবহতার উদাহরণ বাংলাদেশে খুবই কম। সন্ত্রাসীরা নিজ দলের লোককেও রেহায় দেয়নি। প্রকাশ্যে বর্বরতম পদ্ধতিতে নিধন করে। সবাই ভেবেছিল, কোন্দল কমানোর জন্য হাইকমান্ড ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু কিছুই করা হয়নি। উপরমহল নির্বিকার থাকায় ফেনীর পরিস্থিতি আরও শোচনীয় হয়েছে। উপরের দুটি উদাহরণ সে অবক্ষয় ও অধঃপতনের পরিচয়বাহী। এতে শাসক দলের ভেতরের চিত্রটি খুবই করুণভাবে ফুটে ওঠেছে। আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ রূপে আওয়ামী লীগকেই দেখা যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বিরোধী পক্ষ আওয়ামী লীগের কঠোর সমালোচনা করলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। অনেক ব্যাপারে আওয়ামী লীগেরও উত্তর দেয়ার মতো বড় মুখ নেই। বিএনপির নেতা মির্জা ফখরুল আওয়ামী লীগকে যে ভাষায় সমালোচনা করেছেন, তাকে অযৌক্তিক বলারও কিছু নেই। ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ একটি পরিত্যক্ত রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বলেছেন, আওয়ামী লীগের মতো একটি দল রাজনৈতিকভাবে বিরোধী দলকে মোকাবিলা করতে পারছে না। তারা রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে গেছে। সে কারণে দলটির নেতারা অবান্তর কথা বলছেন। বিএনপির প্রচার সম্পাদক ও সাবেক বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকের ওপর পুলিশী হামলার তিন বছর পূর্তি উপলক্ষে স্বাধীনতা ফোরাম আয়োজিত এক প্রতিবাদী নাগরিক সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন। তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে মির্জা আলমগীর বলেন, যেই হাসানুল হক ইনু গণবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে সশস্ত্রভাবে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন। সেই ইনু এখন আওয়ামী লীগের মন্ত্রী হয়েছেন। দুদিন আগে ‘তথাকথিত সরকারের’ তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বিএনপির চেয়ারপারসনকে নিয়ে ভয়ংকর কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, খালেদা জিয়া জঙ্গিবাদ ও রাজাকারের সমর্থক। তাই তাকে সরিয়ে দিতে হবে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলেন, তারা এ কথা বলতে পারেন। কারণ তারাই গণবাহিনী তৈরি করে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন। অনেককে সরিয়েও দিয়েছিলেন। এ সময় খালেদা জিয়ার এতটুকু ক্ষতি হলে দায় সরকারকেই নিতে হবে বলে হুঁশিয়ার করেন তিনি। মির্জা আলমগীর বলেন, জয়নুল আবেদিন ফারুকের ওপর হামলা মূলত ব্যক্তি ফারুক নয়, এটা সংসদীয় গণতন্ত্রের ওপর আক্রমণ। কারণ যারা এ আক্রমণ করেছিল সরকার তাদেরকে পুরস্কৃত করেছে। এমনকি অনেক টাকা দিয়ে সেসব পুলিশ কর্মকর্তাদের বিদেশে ছুটি কাটানোর ব্যবস্থা করেছিল। দলের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরাতে শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিকল্প নেই।
দেশের ভেতরের মতোই বাইরেও সমালোচনা হচ্ছে সরকারের নানা কার্যক্রমের। এনজিও কার্যক্রমের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রস্তাবিত আইন প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছে নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। সরকারের সমালোচকদের নীরব করার উদ্দেশে প্রণীত এ আইনের ব্যাপারে বাংলাদেশকে সাহায্যকারী দাতাদেশগুলোর প্রকাশ্য উদ্বেগ প্রকাশ করা উচিত বলেও মত দিয়েছে সংস্থাটি। গতকাল রোববার হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে এ আহ্বান জানানো হয়। দ্যা ফরেন ডোনেশন রেগুলেশন এ্যাক্ট, ২০১৪ শীর্ষক খসড়া আইনটি সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে উপস্থাপনের কথা রয়েছে। প্রস্তাবিত আইন অনুযায়ী বিদেশী অর্থনৈতিক প্রকল্প অনুমোদনের এখতিয়ার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর কাছে থাকবে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের ডেপুটি ডিরেক্টর ফিল রবার্টসন বলেন, এনজিওর বৈধ কার্যক্রম সীমাবদ্ধ করার ক্ষেত্রে খসড়া আইন সহজে অপব্যবহার হতে পারে। সমালোচকদের ওপর আক্রমণের ক্ষেত্রেও এ আইন ব্যবহৃত হতে পারে।
একদিকে আওয়ামী লীগ নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ¦-সংঘাতে পরিস্থিতি উত্তপ্ত ও রক্তাক্ত করবে আর অন্যদিকে বিরোধী দলকে মুখ বন্ধ করার জন্য আইন করবে বা শক্তি প্রয়োগ করবে-এমন দ্বিমুখিতায় গণতন্ত্রের বারোটা বাজতে বাধ্য। এতে দলীয় সংঘাত-স্বেচ্ছাচার যেমন বাড়বে, তেমনি বিরোধী কণ্ঠ দমিত হবে। গণতন্ত্রে কোনটিই কাম্য নয়। অবশ্য বাংলাদেশে এখন কোন ধরনের গণতন্ত্র আছে বা আদৌ প্রকৃত গণতন্ত্র আছে কি-না, তা নিয়ে বিদেশের প-িতরা দ্বিধান্বিত। গণতন্ত্রের চিরায়ত আদর্শের সঙ্গে বাস্তবের ফারাক একটি বা সামান্য নয়, বিরাট। এই ফাঁক ও ফাঁকি ভরাট করে সবাইকে নিয়ে গণতন্ত্রকে বাঁচানোর বদলে দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ যখন আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ, তখন আশার বদলে হতাশাই প্রধান হয়ে ওঠে। এই হতাশা সমাজ ও শাসনে যারা সৃষ্টি করেছে, তাদেরকেই দূর করতে হবে। নইলে তারা নিজেরাই শুধু হতাশায় ডুববে না, অন্য সবাইকেও বিনাশ করে ছাড়বে। অতএব, সাধু সাবধান!
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন