রবিবার, ২০ জুলাই, ২০১৪

উল্লাস ও বিপর্যয়


বিশ্বকাপ ফুটবলের সদ্য-সমাপ্ত আসরে উল্লাস ও বিপর্যয় হাত ধরাধরি করে চলেছে। একদিন যে উল্লাস করেছে, পরের দিনই সে বিপর্যয়ে কেঁদেছে। অতি-উল্লাস থেকে যখন বিপর্যয়ের অতল গহ্বরে পতিত হয়, তখন ব্রাজিলের অবস্থাটা কেমন হয়েছিল? বিশ্বকাপের আয়োজক ও সম্ভাব্য শিরোপা-প্রত্যাশীর বিপর্যয়ে পুরো ব্রাজিল নামক দেশটি এবং সে দেশের পুরো  জাতিই স্তব্ধ, বিমূঢ়, বিহ্বল হয়ে গিয়েছিল। ব্রাজিলের ইতিহাসে এতো বড় বিপর্যয় আর কেউ কখনোই দেখেনি। অথচ ব্রাজিল তো চ্যাম্পিয়ন হওয়ার উল্লাসের সকল প্রস্তুতিই সম্পন্ন করে রেখেছিল। সেটা তো হলোই না। উল্লাসের বদলে উল্টো নেমে এলো মহা বিপর্যয়।  অতএব ইতিহাস এবং অতি সাম্প্রতিক বাস্তব ঘটনাবলি থেকে এটাই দেখতে পাওয়া গেছে যে, উল্লাসের অপর পাশেই রয়েছে বিপর্যয়। দুটিই হাত ধরাধরি করে পাশাপাশি চলে।
ফুটবল মাঠের উল্লাস ও বিপর্যয় সংক্রান্ত উপমা বা উদাহরণ রাজনীতির মাঠে-ময়দানেও দেখতে পাওয়া যায়। একদিন যারা উল্লাসে আকাশ-বাতাস ফাটিয়ে দিয়েছিল, আরেকদিন তারাই বিপর্যয়ে কেঁদেছে। আবার যারা বিপর্যয় ও পরাজয়ে কেঁদেছে, তারাই পরে উল্লাসে হেসেছে। ফলে উল্লাস বা বিপর্যয়, কোনটিই স্থায়ী বা চূড়ান্ত বিষয় নয়। এগুলো বড়ই আপেক্ষিক বিষয়। কখন কোনটির দেখা পাওয়া যাবে, তা আগে থেকে টের পাওয়া যায় না। উল্লাসের জন্য প্রস্তুত দলকে কখনো কখনো কাঁদতে হয়। বিপর্যয়ের ফলে কান্নার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত দলও চমক দেখিয়ে কান্না রেখে উল্লসিত হয়। এ কথা খেলার মাঠে যেমন সত্য, রাজনীতিতেও সত্য। সবচেয়ে তাজা উদাহরণ হলো ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি। ভারতের স্বাধীনতার পর থেকেই দলটি উগ্র-হিন্দুত্ববাদী, সাম্প্রদায়িক ও মুসলিমবিদ্বেষী হিসেবে পরিচিত। ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকারী উগ্র-হিন্দু-সন্ত্রাসীদের সঙ্গে বিজেপির সম্পর্কের অভিযোগও রয়েছে। সেই বিজেপি কখনোই ২/৩টির বেশি আসন পায় নি। দমে না থেকে সেই দলটি কঠোর পরিশ্রমের দ্বারা অটল বিহারি বাজপেয়ির নেতৃত্বে কিছুদিনের জন্য ভারতের ক্ষমতায়ও চলে আসে, যদিও সে ক্ষমতা স্থায়ী হয় নি। আর এখন মোদী নেতৃত্বে বিরাট ও একক বিজয় নিয়ে দিল্লির মসনদ দখল করেছে বিজেপি। এ এক অবিশ্বাস্য কাহিনি। যারা সব সময় বিপর্যয়ের জন্য হতাশ ছিল, তারাই সময়ের বিবর্তনে এখন হাসিতে-আনন্দে উল্লসিত। আর যে কংগ্রেস ভারতে সব সময় হেসেছে বিজয়ের হাসি, তারা এখন বিপর্যয়ে মুখে অন্ধকার দেখছে। এমন ঘটনা কেবল ভারতে নয়, বিশ্বের নানা দেশে নানা সময়ে দেখা গেছে। ইতিহাসেও সম্ভবত উল্লাস আর বিপর্যয় পাশাপাশি হাঁটে। অতএব উল্লাস দেখেই আনন্দে আটখানা হওয়ার কিছু নেই; আবার বিপর্যয় দেখে ভয়ে অজ্ঞান হওয়ারও কিছু নেই। উভয় পরিস্থিতিই সাময়িক এবং পরিবর্তনযোগ্য। 
বাংলাদেশের উদাহরণ ও বাস্তব পরিস্থিতিতে উল্লাস আর বিপর্যয়ের বিষয়টি আলোচনা করা যেতে পারে। প্রশ্নবিদ্ধ-একতরফা-দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী রাজনীতির তথাকথিত সাফল্য ও আনন্দ একটি অদ্ভুত পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। যারা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এবং স্বল্প ভোটে ‘বিজয়ী’ হয়েছেন, তারা গণতন্ত্রের কৃতিত্বের জন্য না হলেও নিজেদের ‘সাফল্যে’ আনন্দিত-উল্ল¬সিত। উল্লাসের চোটে এমন একতরফা ও অস্বাভাকি রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ‘স্বাভাবিক’ মনে করে তারা পূর্ণ পাঁচ বছর মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার বিষয়ে কার্পণ্য করছেন না। ভাষণে, বক্তব্যে, আচরণে তারা তেমনটিই বলছেন বা করছেন। তাদের সমুদয় প্রশাসনিক কার্যক্রমও সে পথেই এগিয়ে চলেছে। এহন সাফল্যের অপর দিকেই, দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক, স্বচ্ছ নির্বাচন না হলে ‘বিপর্যয়ের আশঙ্কা’ করা হচ্ছে। এ আশঙ্কা ক্ষমতা থেকে ছিটকেপড়া আন্দোলনরত বিএনপি বা জামায়াতেরই নয়; বরং দেশি-বিদেশি সকলেরই। দেশের মধ্যে যারা গণতন্ত্র ও সুশাসন নিয়ে কাজ করেন, তারা উদ্বিগ্ন। বিদেশে যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান গণতান্ত্রিকতার পক্ষে কথা বলেন, তারাও বলতে শুরু করেছেন বিপর্যয়ের বিষয়ে। সবচেয়ে বেশি সরব মিডিয়া, মানবাধিকার ও সুশাসন বিষয়ক ক্ষেত্রে কর্মরতগণ। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সাম্প্রতিক বক্তব্যসমূহ পড়লে যে কোনো সাধারণ নাগরিকের পক্ষেও সম্ভাব্য বিপদ ও বিপর্যয় সম্পর্কে টের পাওয়া সম্ভব। সামগ্রিকভাবে সর্বমহল থেকে গণতন্ত্রের ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বেগ ক্রমেই উচ্চকিত হচ্ছে। বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনীতিকে ঘিরে এখন এমন বিপরীতমুখী স্রোত বইছে। এমনটি হয়েছে সরকারের একচ্ছত্রতার কারণে এবং বিরোধী দলের বিরুদ্ধে অগণতান্ত্রিক ও অমানবিক নিপীড়নের জন্য। তত্ত্বগতভাবে এটা ঠিক যে, বিরোধী দলকে নিপীড়ন ও নির্মূল করে সরকার স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠতে পারে। সরকার যেন গণতন্ত্রের পথে থাকে, সেজন্য প্রধানত বিরোধী দলই চাপ প্রয়োগ করে। বাংলাদেশের বর্তমান সংসদে যে বিরোধী দল আছে, তারা চাপ দেওয়ার সামর্থ্য রাখে না। সংসদের বাইরের বিরোধী দলসমূহের শক্তি ও সামর্থ্য সরকারকে গণতন্ত্রের পথে রাখার কাজে ব্যবহার করতে পারছে না পেটুয়া বাহিনীর অত্যাচারের কারণে। এমন অবস্থায় ভারসাম্যের সঙ্কট স্বাভাবিক এবং যা থেকে বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন অনেকেই। ফলে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি উপরে-উপরে যত উল্লাসমুখর ও ভালোই দেখা যাক না কেন, ভেতরের সুপ্ত সমস্যাও এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। ভেতরে সঙ্কট রেখে সামনে এগিয়ে যাওয়া মানেই হলো বিপর্যয়ের ভয়কে সঙ্গে নিয়ে চলা। এক্ষেত্রে একমাত্র পন্থা হতে পারে আপস ও সমঝোতা এবং পারস্পরিক সৌহার্দ্য এবং সম্প্রীতি। গণতন্ত্রকে সামনে রেখে আপোস-সমঝোতা-সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি বজায় রাখা সম্ভব হলে রাজনৈতিক সঙ্কট কাটানো কঠিন নয়।
কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যেভাবে উগ্রতা, শক্তিমত্তা, দলীয় ক্ষুদ্রতা এবং বিভেদ ক্রিয়াশীল রয়েছে, সেখানে কোনও সঙ্কট মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধ হওয়াই দুরূহ। সমস্যার সমাধানতো দূর অস্ত। তাহলে ভবিষ্যতে কি হবে? একদিকে ক্ষমতার তথাকথিত বিজয়োল্ল¬াস আর আনন্দ এবং অন্যদিকে বিপর্যয়ের ভীতি কি চলতেই থাকবে? একটি জাতির গণতান্ত্রিক অর্জন ও সংগ্রামের পথে ঐক্যবদ্ধ বিজয় সূচিত না হয়ে দলীয় বিজয় নিশ্চিত হলেতো কোন কোন দলের লাভ হতে পারে; জাতির সামগ্রিক লাভের জায়গাটি ফাঁকাই থাকছে। গণতন্ত্রের পথে কোন ধরনের ফাঁক থাকাওতো গণতন্ত্রের সুস্থতার জন্য কাম্য নয়। প্রকৃত সুশাসনের জন্য আমরা যখন গণতন্ত্রের কথা বলবো, তখনতো ফাঁক ও ফাঁকি ছাড়া সকলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে বিশুদ্ধ ও প্রকৃত গণতন্ত্রেরই কথা বলবো। দলীয় বা অংশত গণতন্ত্রের কথা বলবো না। দলীয় ও বিশেষ কারও গণতন্ত্র সামষ্টিক কল্যাণের ক্ষেত্রে প্রভাব রাখতে পারবে কি না, সেটাও এক বড় প্রশ্ন। বর্তমান বিজয়ের আনন্দোল্ল¬াস আর বিপর্যয়ের ভীতির সঙ্কটাপন্ন বৈপরীত্যের মধ্যে ভবিষ্যতের শান্তি ও স্থিতিশীলতার বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। এ ভাবনাটি ক্ষমতার উল্লাসে যারা মাতাল বা বিপর্যয়ের ভয়ে যারা নিত্য আতঙ্কিত তারা পারবে না। শান্তি ও স্থিতিশীলতার মতো জনগুরুত্বপূর্ণ এবং জাতির স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ভাবনাটি ভাবতে পারবেন তারাই, যারা আর্দশের জন্য রাজনীতি করেন, ভয় ও বিপদের মধ্যেও অবিচল সংগ্রাম করেন, এবং দেশ ও মানুষের স্বার্থে তৎপর থাকেন। বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ায় এমন আদর্শবাদী-নিবেদিতপ্রাণদের বড় বেশি প্রয়োজন।
এ কথা ঠিক যে, জাতীয় রাজনীতিতে মহান চিত্ত সম্পদের অধিকারী নেতা বা প্রকৃত স্টেটসম্যানের অভাবহেতু সাধারণ মানুষ প্রায়শই বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট হয়। জনতা নানা আবেগের ফানুসে চেপে ‘লিডার উইথ স্পল মাইন্ড’-এর অনুসরণ করে সস্তা ইস্যুতে উত্তেজিত হয়। এভাবে জাতির শান্তি ও স্থিতিশীলতার জায়গাটিকে দুর্বল করে একদল ক্ষুদ্রমনা-স্বার্থবাদী তথাকথিত নেতা। যারা প্রকৃত ও সুদূরপ্রসারী বিপদকে লুকিয়ে রেখে সাজানো উল্লাস করে এবং সত্য পরিস্থিতির বয়ান মিথ্যা ও আবেগের ভাষ্যে ঢেকে রাখে। এরাই গণতন্ত্রের স্তম্ভ ও সংস্কৃতিকে মজবুত করার বদলে খাটের তলায় লুকিয়ে-থাকা ইঁদুরের মতো গোপনে কুট-কুট করে কেটে প্রতিনিয়ত দুর্বল করে। আমাদের দুর্ভাগ্য এটাই যে, এইসব তথাকথিত নেতা-পদবাচ্যরা মহৎ আর্দশের জন্য রাজনীতি করে না, ভয় ও বিপদে দেখলেই পলায়ন বা আত্মসমর্পন করে, দেশ ও মানুষের স্বার্থে তৎপর থাকা তাদের পক্ষে মোটেই সম্ভব হয় না। আরও দূঃখ ও পরিতাপের বিষয় এটাই যে, এরা কেবল ক্ষমতাসীন দলেই থাকে না, বিরোধী দলের মধ্যেও সরকারের দালাল বা এজন্ট হিসাবে ঘাপটি মেরে থাকে। এদের সাবোটাজ বা অন্তর্ঘাতের জন্য গণতান্ত্রিক রাজনীতি অনেক সময়ই সঠিক পথে অগ্রসর হতে পারে না। কিংবা গণতান্ত্রিক বিজয় অর্জন এদেরই শাঠ্য-ষড়যন্ত্রে  অনেক সময়ই নস্যাৎ হয়ে যায়। অতএব উল্লাসের আনন্দে উৎফুল্ল কিংবা বিপর্যয়ের বিপদে আক্রান্ত হওয়ার পূর্বে নিজের চারপাশে ভালো করে তাকিয়ে রাজনৈতিক শত্রু ও মিত্রকে সঠিকভাবে চিহ্ণিত করাই আজকের জরুরি কর্তব্য। বাক্যবাগিশ, ক্ষমতা ও দক্ষতাহীন অসৎ স্তাবকদের ব্যাপারে সতর্ক থাকাও এখন অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এইসব আগাছা তাড়ানোর কাজগুলো সঠিকভাবে করা হলে যে সুস্থতা অর্জন করা যাবে, তার শক্তিতে বিপর্যয়কে উল্লাসে রূপান্তরিত করা মোটেও কঠিন হবে না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads