বুধবার, ১৬ জুলাই, ২০১৪

ইবাদতের বসন্তকাল চলে যাচ্ছে


সর্বশ্রেষ্ঠ সর্বোৎকৃষ্ট মাস মাহে রমযান, হাজার মাসের সেরা। শান্তির বারতা নিয়ে উদ্বেলিত উচ্ছ্বসিত করে তুলেছে মুমিনের হৃদয়। মুসলিম জাতির খুশির আর অন্ত নেই। রমযানের প্রথমে মাহে রমযানকে স্বাগত ও মোবারক জানাতে মুসলমানেরা বিভিন্ন রঙের ব্যানারে আনন্দ মিছিল বের করে ছিল। আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তুলেছিল ‘খোশ আমদেদ মাহে রমজান’ স্লোগানে। আর মুমিন খুশি না হয়ে কি পারে? ইবাদতের বসন্তকাল হলো মাহে রমযান। ইবাদতের এক লোভনীয় ও জমজমাট অফার নিয়ে প্রতিবছর মুমিনের দুয়ারে হাজির হয় এই পবিত্র মাস। এ মাসে ইবাদতে সওয়াব আল্লাহ অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়ে থাকে। এজন্য রমযান মাসে মসজিদগুলো কানায় কানায় ভরে ওঠে, লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে। সারা দিন রোজা পালনের পর ক্লান্ত শান্ত শরীর নিয়ে তারা  ঈশার নামাযসহ বিশ রাকায়াত তারাবীর নামায পড়ার মতো বিশাল কষ্ট স্বীকার করে থাকেন অনায়াসেই।  এ জন্য আল্লাহ্ এর প্রতিদান স্বহস্তে দান করবেন। হাদিশ শরীফে এরশাদ হয়েছে বনি আদমের প্রতিটি আমলের প্রতিদান বহুগুণে বৃদ্ধি হতে থাকে-১০গুণ থেকে ৭০০ গুণ এমনকি আল্লাহ্ চাইলে তার চেয়ে বেশী দিবেন। আর রোজার ক্ষেত্রে কুরআনে এরশাদ হয়েছে, রোজা আমার জন্য আমি তার প্রতিদান দেবো। হাদিস পাকে আছে রোজাদারদের জন্য দু’টি আনন্দঘন মুহূর্ত রয়েছেÑ এক হচ্ছে ইফতারের সময়। আর এক হচ্ছে আল্লাহ্র সাথে সাক্ষাতের সময়। (মুসলিম শরীফ) এই অর্জনের মহা সুযোগটি ক্রমান্বয়ে বিদায় নিতে চলেছে। রহমত, মাগফিরাত, নাজাতের ঘোষক পবিত্র মাহে রমজান। লোভনীয় অফার কখন স্থায়ী  হয় না। আর হলে মূল্যায়ন থাকে না। ইবাদতের বসন্তকাল চলে যাচ্ছে। আর এটি বিদায় নেওয়ার আগে সুন্দর মহোৎসবটি আমাদের অবশ্যই উপহার দিয়ে যাবে। পবিত্র মাহে রমযান একমাস সিয়াম সাধনা মানব জীবনের শুদ্ধতালাভের এক সুযোগ এনে দেয়। সাওম মানে বিরত থাকা। কুকর্ম, কুচিন্তা ও ইন্দ্রিয় পরির্চচা পরিহার করে সংযমী হওয়াই রোজার শিক্ষা। রামাযান এর শাব্দিক অর্থ দগ্ধ করা। সিয়াম সাধনার উত্তাপে, ধৈর্যের অগ্নিদহনে মুসলমান মাত্রই এ মাসে কু-প্রবৃত্তিকে দগ্ধ করে শুদ্ধ-পরিশোধিত মানুষে পরিণত হয়। তাই রমযানুল মুবারক দৈহিক, আত্মিক, নৈতিক ও সামাজিক পরিশুদ্ধির প্রশিক্ষণের মাস। দিনের বেলায় রোজা আর রাত্রে ইবাদতের মাধ্যমে দেহমনকে পরিশুদ্ধ করতে পারে এ রমযান মাসে। পবিত্রতা ও পরিশুদ্ধতা জন্য সিয়াম পালিত হয়ে থাকে। রোজা ৩০দিন হওয়ার তাৎপর্য হলো, যখন আদম (আঃ) জান্নাতের গাছের ফল খাওয়ার পর তা ৩০ দিন পেটে ছিল। যখন তিনি খাঁটি তওবা করলেন তখন আল্লাহ্ তার ত্রিশদিন রোজা রাখার হুকুম দিলেন। তার অপরাধ দেহ থেকে খাদ্যের উপকরণ দূর করার জন্য ৩০দিন রোজা ফরজ করেছেন। (দুররাতুন নাছেহীন: ২৯) অন্য রেওয়ায়েতে আছে মানুষ কোন খাদ্য খেলে তার উপকরণ ৩০দিন পর্যন্ত থাকে। তাই আদম (আঃ) গন্ধম খেলে তার উপকরণ ৩০দিন পর্যন্ত থাকবে। সে জন্য অপবিত্র খাদ্য থেকে পবিত্র করার জন্য ৩০ দিন রোজা ফরজ করেছেন।(মাজালিসুল আবরার) রসুল (সাঃ) আর ও বলেছেন, যে লোক ন্যায় সঙ্গত কারণ ছাড়া একটি রোজা ভেঙে ফেলবে, এরপর সে সারা জীবন রোজা রাখলে তার ক্ষতিপূরণ হবে না।-তিরমিজি, নাসায়ী, ইবনে মাজা, ইবনে খুজায়মা।                        
সিয়াম পালিত হয় ১. চিত্ত শুদ্ধির জন্য ২. পরিচ্ছন্নতার জন্য ৩. সত্যবোধকে জাগ্রত রাখার জন্য, ৪. পার্থিব আকাক্সক্ষাকে নিবৃত্ত রাখার জন্য ৫. বিনয় ও নম্রতা প্রতিষ্ঠার জন্য, সহমর্মিতা ও সোহার্দ্যরে চেতনায় উজ্জীবনের জন্য এবং ৬. সর্বোপরি মহান প্রভু আল্লাহ্র কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য।  আত্মিক পরিশুদ্ধি: সিয়াম সাদধনার মাধ্যমে আত্মিক পরিশুদ্ধি ও আধ্যাত্মিক পবিত্রতা অর্জন করে থাকে।  আল্লামা ইবনুল কায়্যিম আল-জাওযি (রহঃ) বলেন, মানুষের আত্মিক ও দৈহিক শক্তি সংরক্ষণে রোজা অত্যন্ত কার্যকর। একদিকে মানুষের পাশবিক চাহিদার প্রাবল্য থেকে মুক্ত করে তার দৈহিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিশ্চয়তা বিধান করে। অপরদিকে নৈতিক উৎকর্ষ সাধনের মাধ্যমে আত্মিক সুস্থতা সাধন করে। মাসব্যাপী রোজার মাধ্যমে মানুষের জৈবিক চাহিদা ও পাশব প্রবৃত্তি দুর্বল হয়ে যায়। মনুষ্যত্ব ও রুহানিয়ত সজীব জাগ্রত হয়। রিপুর তাড়নামুক্ত হয়ে মানুষ আল্লাহ্ প্রদত্ত বিবেক ও প্রজ্ঞার সদ্ব্যবহার করে সুউচ্চ মর্যাদার অধিকারী হতে পারে। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মানুষ সতকর্মের প্রতিধাবিত হওয়ার প্রণোদনা লাভ করে এবং অসদুপায়ে সম্পদ পুঞ্জীভূত করার মানুসিকতা লোপ পায়।  আমরা সিয়াম পালনের ক্ষেত্রে চিত্ত শুদ্ধির কথা বলেছি। চিত্তশুদ্ধি কাকে বলে? মানুষের চিত্ত সততই চঞ্চল।আমাদের চিত্তে নানা ধরনের ইচ্ছা জাগে এবং সে সব ইচ্ছার দু’টোই আছে। কিন্তু চিত্তকে শাসনে রেখে অপরাধের আগ্রহ থেকে মুক্ত রাখা অত্যন্ত কঠিন। এখন এ কাজটি কিভাবে সাধন করতে হবে? তার একটি প্রথাগত দিক-নির্দেশনা  আমরা সিয়াম সাধনার মধ্যে পেয়ে থাকি। রমজানে ব্যবহারিক নিয়মকানুনগুলো আমরা যদি পরিপূর্ণভাবে পালন করি, তাহলে তার মধ্যদিয়ে চিত্তশাসন সহজেই কার্যকর হয়।একজন মানুষ  যদি সারা দিন আহার্য ও পানীয় গ্রহণ না করে এবং সে সময় টুকুতে যদি সে যদি মহান প্রভু আল্লাহ্তায়ালার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার সর্ববিধ কার্যক্রম গ্রহণ করে, তাহলে তার চিত্তে পার্থিব আকাক্সক্ষা জাগবে না এবং অশুদ্ধ ও বিকল চিন্তায় চিত্ত ভারাক্রান্ত হবে না। দৈহিক পরিশুদ্ধি: অতিভোজন ¯œায়ুকোষে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে। রোজা দেহের জন্য প্রতিষেধকের কাজ করে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণায় দেখা গেছে, উপবাস ব্রতের কারণে দেহাভ্যন্তরে এন্টিবায়োটিক এক বিরাট শক্তি সৃষ্টি হয়, যার মাধ্যমে বহু ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও জীবাণু মারা পড়ে। এক মাসের সিয়াম সাধনার উদ্দেশে দিনের বেলা যখন পানাহার বন্ধ থাকে, তখন পাকস্থলী ও অন্ত্রের ঝিল্লি দেহযন্ত্র থেকে জীর্ণ পদার্থগুলো বের করে দেয়। সারা বছর জৈব রসজাত যে বিষ দেহে জমা হয়, সিয়ামের আগুনে তা পুড়ে নিঃশেষে রক্ত বিশুদ্ধ হয়, বিষমুক্ত হয়। একজন রোজাদার রমযান মাসে তার প্রতিটি অঙ্গ বিশেষত হাত-পা, চোখ, মুখ উদরকে অবৈধ ও গর্হিত কাজ থেকে বিরত রেখে সংযমী হয়। দেহের ওপর রোজার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। ইচ্ছা শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ রেখে দৈহিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে আল্লাহ্র নির্দেশিত পথে পরিচালিত করার শিক্ষা দেয় মাহে রমজান। নৈতিক পরিশুদ্ধি: ‘যখন রমযান শুরু হয়, মহান আল্লাহ্ জান্নাতের দরজা উন্মুক্ত করে দেন। জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেন এবং শয়তানকে শৃঙ্খলিত করে রাখেন।’ যার কারণে ইবাদত, জিকির, তেলাওয়াত, কৃচ্ছ্রতা সাধন ও আল্লাহ্র একনিষ্ঠ আনুগত্যের স্বর্গীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয়। কেবল পানাহার পাপাচার ত্যাগ করলে রোজা পালন হয় না। সেই সঙ্গে সব ধরনের অন্যায় পাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে এবং অন্তরকে করতে হবে পরিচ্ছন্ন। তবে রোজা মুমিনের জীবনে নিয়ে আসবে অফুরন্ত রহমত ও বরকত। এ প্রসঙ্গে নবী করিম (সাঃ) বলেন, তোমাদের মধ্যে যে ব্যাক্তি রোজা রাখে সে যেন কোনরকম অশ্লীলতা ও হৈ-হুল্লোড় না করে। কেউ যদি তাকে গালাগালি করে  তার সাথে ঝগড়া করে সে যেন বলে- আমি একজন রোজাদার’। (বুখারী ও মুসলিম)। রোজা র্ধৈয্য, সংযম  ও নৈতিক উৎকর্ষের  জন্ম দেয়। শিষ্ঠাচারের মাধ্যমে নৈতিক চরিত্র গঠন রমযানের সিয়াম সাধনার একটি মৌলিক শিক্ষা। সামাজিক পরিশুদ্ধি: শুদ্ধতার এ অমোঘ মাসটিতে সাধনায় সিদ্ধিলাভ করার সুযোগ অবারিত হয়। সিয়ামের অর্থ হল তাকওয়া অনুশীলনই অপরাধমুক্ত তৈরীর অন্যতম হাতিয়ার। রমজান মানুষের মধ্যে মানবিকতাবোধের উম্মেষ ঘটায়। মহানবী (সাঃ) ভাষায় –‘সহমর্মিতাও সোহার্দ্যরে মাস মাহে রমজান’। (বায়হাকি)।কেননা ধনী ও বিত্তশালীরা সারা দিন রোজা রেখে দরিদ্র জনগোষ্ঠির জঠর  জ্বালার দহন -বেদনা বুঝতে সক্ষম হন,ফলে তাদের মধ্যে সমাজের বঞ্চিত অবহেলিত মানুষের প্রতি সহমর্মিতার অনুভূতি জাগ্রত হয়। রমজান মাসে দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত মানুষের কল্যাণে অর্থ ব্যয় করা সওয়াবের কাজ। মহানবী (সাঃ) বলেন, হে আয়েশা!  অভাবগ্রস্ত মানুষকে ফেরত দিও না। একটি খেজুরকে টুকরো টুকরো করে হলে ও দান কর। দরিদ্র মানুষকে ভালোবাসো এবং কাছে টানো।  কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ্ তোমাকে কাছে টানবেন।’সমাজের প্রতিটি সদস্য সিয়াম সাধনার ফলে অর্জিত সহমর্মিতার শিক্ষা বছরের এগার মাস অনুশীলন করতে পারে তাহলে ক্ষুধা দারিদ্র্যমুক্ত পৃথিবী গড়া সম্ভব। রমযান মাস কিছু অসাধু ব্যবসায়ী নিত্য ব্যবহার্যদ্রব্য মজুত করে বাজারে কৃত্রিম সংকটের সৃষ্টি করে অত্যধিক মুনাফা লাভের আশায়। এটা অত্যন্ত গর্হিত অন্যায় কাজ। মহানবী (সাঃ) বলেন, মজুতদার অভিশপ্ত।’ রমজানে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মানুষ হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ লালসা, কামনা-বাসনা প্রভৃতি অন্যায় আচরণ পরিহার করে অতিমানবীয় জীবনের দীক্ষা লাভ করে থাকে। অতএব মাহে রমজানের সিয়াম সাধনা আল্লাহ্ পাকের এক অপূর্ব নিয়ামত, যা অফুরন্ত কল্যাণের পথ উন্মোচিত করে। 
এইচ এম আব্দুর রহীম 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads