ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়
খ্যাতিমান অধ্যাপক ড. আহমদ শরীফ স্যার সম্পর্কে একটি ঘটনা শুনেছিলাম। হতে পারে তিনি
নিজেই ঘটনাটি আমাকে বলেছিলেন। তিনি সরাসরি আমারও শিক্ষক ছিলেন। একবার টিউটোরিয়াল পরীক্ষার
সময় তিনি দেখতে পান, সেই পরীক্ষায় একজন ছাত্রী নোট দেখে নকল করছেন। শরীফ
স্যার তো একেবারে তেলে-বেগুনে জ্বলে আগুন। তুমি কেন নকল করবে? সেটা হবে না। তারপর তিনি সেই ছাত্রীকে কাসরুম থেকে বের করে দিয়েছিলেন। অপমানে
ওই ছাত্রী গিয়ে নালিশ করেছিল বিভাগীয় প্রধানের কাছে। বিভাগীয় প্রধান শরীফ স্যারকে ডেকে
জিজ্ঞেস করেছিলেন, কী ঘটেছিল। কেন তিনি ওই ছাত্রীকে বের করে দিয়েছিলেন। শরীফ স্যার
বলেছিলেন আমি জানি, মেয়েটি বিবাহিত। চঞ্চলমতি ছেলেমেয়েরা যা-ই করুক, একজন বিবাহিত মেয়েকে অবশ্যই দায়িত্বশীল হতে হবে। সে তো নকল করতে পারে না। এটা
তাকে মানায় না। ওই ছাত্রী তার দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে পারেন নি বলেই তাকে বের করে
দেয়া হয়েছে।
সমাজে
দায়িত্বশীলদের কাছ থেকে তাই আমরা দায়িত্বশীলতা আশা করি। সততা আশা করি। সে আশা এখন ধুলায়
লুণ্ঠিত হতে বসেছে। দায়িত্বশীলেরা দায়িত্বহীন আচরণ করছেন। অবিরাম মিথ্যা কথা বলছেন।
এরা পরস্পরের বিরুদ্ধে এমন সব কুৎসামূলক রটনা করছেন, যা শুনলে কানে আঙুল দিতে হয়।
ঘৃণায় মুখ কুঞ্চিত হয়ে আসে। গ্লানিতে অস্থির লাগে। ভাবতে লজ্জিত হতে হয়, এরা আবার আমাদের মতো একটি সুসভ্য দেশের মানুষের নেতৃত্বের আসন দখল করে আছেন।
সম্প্রতি সেটাই আবার প্রমাণ করল আমাদের দেশের বর্তমান বৈধতার প্রশ্নে বিতর্কিত সরকার।
মাসখানেকের মধ্যে সরকারের মিথ্যাবাদিতার দু’টি প্রমাণ পাওয়া গেল। সে মিথ্যাবাদিতার
কারণে সারা দুনিয়ায় জাতি হিসেবে আমাদের মাথা হেঁট হয়ে গেছে।
সময়ের
হেরফের সামান্য। মাত্র এক মাস। গত ১৯ জুন যুক্তরাষ্ট্র সফররত বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি
অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ জতিসঙ্ঘ মহাসচিব বান কি মুনের সাথে বৈঠক করেন। ওই বৈঠক নিয়ে
প্রচারিত খবরে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। জাতিসঙ্ঘে নিয়োজিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত
ও স্থায়ী প্রতিনিধি আবদুল মোমেন জানান, রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ওই বৈঠকে
বলেছেন, সংলাপের ব্যাপারে সরকারের কোনো কার্পণ্য নেই, তবে তা হবে বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষে। কেউ যদি নির্বাচন বর্জন করে তাহলে
সংলাপ হবে কিভাবে? জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবও রাষ্ট্রপতির সাথে এ বিষয়ে সহমত প্রকাশ করেন
বলে আবদুল মোমেন জানান। এতে বাংলাদেশজুড়ে একেবারে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। সত্যি কি বান
কি মুন এমন কথা বলেছেন? এই প্রশ্ন সর্বত্র আলোচিত হতে শুরু করে।
তবে জাতিসঙ্ঘ
মহাসচিব খুব দ্রুতই নিজ অবস্থান স্পষ্ট করেন। জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের পক্ষ থেকে দেয়া এক
বিবৃতিতে বিষয়টি খোলাসা করে দেয়া হয়। তাতে বলা হয়, জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব বাংলাদেশের
সংসদের বাইরে থাকা দলগুলোর সাথে সংলাপের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। একই সাথে ৫ জানুয়ারির
নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতে বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমঝোতা না হওয়ায় দুঃখ
প্রকাশ করেছেন। তবুও ভাগ্য ভালো, রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ নিজে থেকে এ বিষয়ে কোনো
কথা বলেননি। আবার এ কথাও তো সত্য, বান কি মুন তাকে কী বলেছিলেন, সেটাও তিনি স্পষ্ট করে বলেননি। তার এ মৌনতা থেকে স্পষ্ট হয়, জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব বান কি মুন তার সাথে সহমত প্রকাশ করেননি। অর্থাৎ এক তেলবাজ
মিথ্যুক আমলা আবদুল মোমেন রাষ্ট্রপতিকে প্রায় মিথ্যাবাদী প্রমাণ করে ফেলেছিলেন। যা
হোক, প্রমাণিত হয়েছে, বান কি মুন সত্য বলেছেন আর মিথ্যা
বলেছেন জাতিসঙ্ঘে নিয়োজিত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি আবদুল মোমেন। ওই আমলা কি মন্ত্রী
হবেন, নাকি মিথ্যাবাদিতার দায়ে তাকে কূটনৈতিক দায়িত্ব থেকে অপসারণ করা
হবে?
দ্বিতীয়
ঘটনাটি ঘটল জনপ্রতিনিধিত্বহীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে। সম্প্রতি লন্ডনে
আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই সম্মেলনের মূল লক্ষ্য ছিল, বাল্যবিয়ে রোধ করা এবং মেয়েদের খতনার কুপ্রথা বিলোপ করা। মেয়েদের খতনার এই
রীতিটি প্রধানত আফ্রিকার কোনো কোনো দেশে প্রচলিত আছে। বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো সমস্যা
নেই। সেই সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়েছিলেন পৃথিবীর একমাত্র সরকারপ্রধান বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিত্বহীন
সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর কোনো দেশের, এমনকি আফ্রিকান কোনো দেশেরও প্রধানমন্ত্রী
ওই সম্মেলনে যোগ দেননি। তা থেকে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয়, শেখ হাসিনার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড
ক্যামেরনের সাথে একটি করমর্দনের ছবি তোলা আর তার মাধ্যমে জনগণকে এই বলে ধোঁকা দেয়া
যে, প্রহসনের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসীন তার সরকারকে ব্্িরটিশ সরকার স্বীকৃতি
দিয়েছে। গত ২২ জুলাই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে শেখ
হাসিনা ডেভিড ক্যামেরনের সাথে সাক্ষাৎ করেন। যথারীতি তার সাথে করমর্দন করেন এবং শেখ
হাসিনার সেই উজ্জ্বল হাস্যময় ছবি দেশের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
আর প্রায়
সাথে সাথেই আমলা-কূটনীতিক কাম-পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী দেশে ফিরেই তিনি
শেখ হাসিনাকে খুশি করার জন্যই হোক, কিংবা নিজের মন্ত্রিত্ব রক্ষার
জন্যই হোক, এক বেহুদা মিথ্যা বলে বসলেন। ২৪ জুলাই ঢাকা ফিরেই তিনি বললেন ক্যামেরন বলেছেন, ‘ইলেকশন ইজ ওভার। ইট ইজ পাস্ট। নাও উই লুক টু দ্য
ফিউচার। (নির্বাচন হয়ে গেছে, অতীত অতীতই। এখন আমরা ভবিষ্যতের দিকে তাকাব।)’ মাহমুদ আলী আওয়ামী রাজনীতিতে যোগদানের আগে পর্যন্ত নানা ধরনের কূটনৈতিক দায়িত্ব
পালন করেছেন। আত্মস্থ না হন, দেখেশুনেও তার কিছু শেখা উচিত ছিল। তা ছাড়া তিনি
দিনাজপুরের বনেদি পরিবারের লোকও। তার পিতা হাসান আলী আইয়ুব খানের মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী
ছিলেন। এ ধরনের ফাসেক কথা তার জন্য কতটা মানানসই হলো, সেটিও বিবেচনার দাবি রাখে; কিন্তু তার এই অসত্য বক্তব্য
প্রকৃতই যে মিথ্যাচার, সেটা প্রমাণ হতে সময় লাগল না। ওই একই দিন ব্রিটিশ
প্রধানমন্ত্রীর মুখপাত্র যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা মাহমুদ আলীর বক্তব্যের সম্পূর্ণ
বিপরীত। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর মুখপাত্র অলস্টার ক্যাম্পবেল জানান, বাংলাদেশের গত ৫ জানুয়ারির সাধারণ নির্বাচনে অর্ধেকের বেশি সংসদ সদস্য বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায়
নির্বাচিত হওয়ায় ডেভিড ক্যামেরন হতাশা প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাথে
বৈঠকে ক্যামেরন এ হতাশা ব্যক্ত করেন। ক্যাম্পবেলের ওই বিবৃতিতে আরো বলা হয়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠকে ক্যামেরন বাল্যবিয়ে রোধ, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন, উন্নয়ন লক্ষ্য ও প্রবাসী বাংলাদেশীদের বিষয়ে কথা
বলেন। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রতি
শ্রদ্ধাশীল একটি উদার গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার গুরুত্বের ব্যাপারে দুই
প্রধানমন্ত্রী একমত পোষণ করেন।
আবদুল
মোমেনের মতো মাহমুদ আলীও বিষয়টা একেবারে চেপে গেলেন। যদি তিনি সৎ হতেন, যদি তার সেই ব্যক্তিত্ব থাকত, তাহলে তিনি বুক ফুলিয়ে বলতেন, ক্যাম্পবেলই মিথ্যে কথা বলেছেন। তিনিই সত্য কথা বলছেন। যা হোক, শেখ হাসিনাকে খুশি করার জন্য মাহমুদ আলী এখন পর্যন্ত ওই পর্যায়ে যাননি; কিন্তু প্রমাণ হয়েছে যে, মোমেন কিংবা মাহমুদ আলী কেউই সত্যবাদী নন। মাহমুদ
আলী ক্যামেরনের সাথে বৈঠক নিয়ে যা বলেছিলেন, তা ছিল সম্পূর্ণরূপে তার মনগড়া, উদ্দেশ্যমূলক এবং জনগণকে বিভ্রান্ত করা; কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে
এ রকম বিভ্রান্ত করার কাজ খুব সহজ নয়।
এরপর কে
কথা বলতে যাবে প্রধানমন্ত্রী বা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে? যেকোনো দেশের সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধান আতঙ্কে থাকবেন, এদের সাথে কথা বললে এরা সে কথা নিয়ে না জানি কী মিথ্যা প্রচারণার আশ্রয় নেন।
রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ কথা বলেননি; কিন্তু শেখ হাসিনা সিনাজুড়ি করতে
কসুর করেননি। তিনি বলেছেন, ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট যদি তাকে স্বীকৃতি নাই দিয়ে
থাকে, তাহলে তাকে দাওয়াত দিলো কেন? কেনই বা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী
ডেভিড ক্যামেরন তাকে প্রধানমন্ত্রী বলে সম্বোধন করলেন। অতএব কথা যাই হোক, স্বীকৃতি তিনি পেয়ে গেছেন। শুধু তিনিই নন, তার সরকারের কিছু লাফাঙ্গা শিক্ষাবঞ্চিত, শিষ্টাচার-অজ্ঞ ব্যক্তি এখন যেখানে সেখানে যেকোনো দেশ বা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানকে
কথায় কথায় দেখে নেয়ার হুমকি দিচ্ছে। মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী তো বাংলাদেশের নবনিযুক্ত
মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে এই বলে আগাম হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন যে, তিনি যেন এই সরকার সম্পর্কে কথাবার্তা হিসাব করে বলেন। ছোট মুখে কত বড় কথা!
অথচ ২০০৮ সালে কংগ্রেস নিয়ন্ত্রিত ভারত সরকার আর যুক্তরাষ্ট্র মিলেই এক আঁতাতের মাধ্যমে
আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল, তাতেও মতিয়া মন্ত্রী হয়েছিলেন। সে নির্বাচন কোনো
নির্বাচনই ছিল না। শতাংশের হারে কোথাও কোথাও ভোট পড়েছিল শতভাগেরও বেশি। আওয়ামী লীগেরই
সাধারণ সম্পাদক মরহুম আবদুল জলিল
জোরগলায়
বলেছিলেন, ওই নির্বাচন ছিল আঁতাতের নির্বাচন। তাতে আবদুল জলিলকে কম মূল্য
দিতে হয়নি।
এখন ক্ষোভ
মিডিয়ার বিরুদ্ধে। ধরা যাক, ডেভিড ক্যামেরনের মুখপাত্র বলেছেন, ইলেকশন ইজ ওভার। পাস্ট ইজ পাস্ট। তাই বলে বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলো সেসব প্রকাশ
করে দিয়ে সরকারকে হেয়প্রতিপন্ন করবে? এও কি সহ্য করা যায়? অতএব সরকার এখন নতুন কৌশল নিতে যাচ্ছে। পরোক্ষভাবে জালে আটকে ফেলতে চাইছে পুরো
গণমাধ্যমকে। সংবাদপত্র, সংবাদ সংস্থা, অনলাইন নিউজ পোর্টাল, টেলিভিশন, রেডিওসহ গণমাধ্যমের সব শাখাকে জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতার মধ্যে আনার
জন্য আটটি আইন ও নীতিমালা করা হচ্ছে। তা ছাড়া টকশো নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
যে কেউ ইচ্ছে করলেই যাতে সাংবাদিক হতে না পারেন তার জন্য বিধিবিধান করা হচ্ছে। বাধ্যতামূলক
করা হচ্ছে সরকারের প্রেসনোট বা বক্তব্য পুরোপুরি প্রকাশে। সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধানের
ভাষণ পুরোপুরি প্রচার করতে হবে। এসব বিধিবিধান মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে মারাত্মকভাবে
ুণœ করবে। এমন সব বাকশাল-মার্কা নীতি কিংবা তার চেয়েও ভয়াবহ কঠোরতার
মাধ্যমে দমন করা হবে মিডিয়া; কিন্তু সাংবাদিকতা একটি সৃষ্টিশীল পেশা। বিচিত্র
ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এই পেশায় এসে সাংবাদিকেরা সফল হয়েছেন। পৃথিবীর
কোনো দেশেই
শতভাগ সাংবাদিক সাংবাদিকতার ওপর ডিগ্রি নিয়ে এ পেশায় আসেন না। অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাই এ
পেশায় টিকে যাওয়ার মাপকাঠি। তবে যাই হোক, মনে হচ্ছে, লেবু বেশি চটকানো
হচ্ছে।
রশি বেশি টাইট দেয়া হচ্ছে। ছিঁড়ে গেলে ‘বিপদ ভারী হবে’।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন