শনিবার, ২৩ আগস্ট, ২০১৪

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা বিচারের আগে রায় হয় না


এই উপমহাদেশে সম্প্রতি ২টি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। একটি গ্রেনেড হত্যা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উক্তি। আরেকটি হল পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে তাহরিক নেতা ইমরান খানের লংমার্চ এবং মওলানা কাদিরের বিপ্লবী মার্চ। গুলিস্তানের আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে আজ থেকে ১০ বছর আগে ২১ আগস্ট একটি গ্রেনেড হামলা হয়। ঐ হামলায় সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভী রহমানসহ ২৪ ব্যক্তি নিহত হন। তখন ক্ষমতায় ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া এবং বিরোধী দলের নেত্রী ছিলেন শেখ হাসিনা। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঐ নৃশংস হত্যাকা-ের পর ১০ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এই ১০ বছরের মধ্যে বিগত ৫ বছর ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ। তারা আগে ২ বছর ক্ষমতায় ছিল আওয়ামীপন্থী সামরিক জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ নিয়ন্ত্রিত তখাকথিক জরুরি সরকার। বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতায় ছিলেন ২ বছর। দেখা যাচ্ছে যে আওয়ামীপন্থীরা ৭ বছর ক্ষমতায় ছিলেন এবং বিএনপি পন্থিরা ২ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। এই সাত বছরেও আওয়ামী সরকার এবং তাদের অনুসারী মঈন ইউ আহমেদের সরকার গ্রেনেড হত্যা মামলার কোনো কুল কিনারা করে নাই। সময়ের আবর্তনে এই দিনটি প্রতি বছর ফিরে আসে আর আওয়ামী লীগ তখন করুণ স্বরে এই কাহিনী বর্ণনা করে জনতার সহানুভূতি আকর্ষণের চেষ্টা করে। কিন্তু বিচার তারা সম্পূর্ণ করেনি। এমন একটি স্পর্শকাতর ইস্যুকে তারা বছরের পর বছর ঝুলিয়ে রেখেছে। ঐ ঘটনার পর বিএনপি তো ক্ষমতায় ছিল মাত্র ২ বছর। ঘটনা ঘটার পর পরই তারা বিভিন্ন তদন্ত কমিশনের মাধ্যমে বিষয়টির তদন্ত কাজ শুরু করেন। ২ বছরে তদন্ত শেষ হয়নি। প্রশ্ন হল, পরের সাত বছর এই সংবেদনশীল ইস্যুটির বিচারিক ফয়সালা হলো না কেন?
প্রতি বছর যখন এই দিনটি ফিরে আসে তখন আওয়ামী লীগ এই দিনটিকে  তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এটিকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করে। এবারও তারা সেই যথেচ্ছ ব্যবহার থেকে বিরত হয়নি। এবার বরং প্রধানমন্ত্রী অন্যান্য বারের চেয়ে এক ডিগ্রী এগিয়ে গেছেন। এবার তিনি সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পরিবারকে ‘খুনি পরিবার’ আখ্যায়িত করে বলেছেন, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডে যেমন জিয়াউর রহমান জড়িত ছিলেন, ঠিক তেমটি ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার হত্যাকাণ্ডে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, তার ছেলে তারেক রহমান ও এই সময়ের মন্ত্রিপরিষদ সদস্যরা সরাসরি জড়িত। এরা একটি খুনি পরিবার। এই খুনি পরিবারের হাত থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করতে হবে। বিএনপি জামায়াত জোটের নাশকতা ও নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে দেশবাসীকে সচেতন থাকার আহ্বান জানিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি  বলেছেন, সামান্য ক্ষমতার লোভে যারা মানুষ হত্যা করে, দেশের ক্ষতি করে; তারা মানুষ নয়- মানুষ নামের পশু। এই খুনি ও দেশ বিরোধীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। তাদের সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। তিনি আরও বলেন, একটি খুনি পরিবার ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা নস্যাৎ করতে চায়; শহীদদের আত্মত্যাগ বিসর্জন  দিতে চায়। হত্যা-ধর্ষণ- লুটতরাজ চালিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মানুষের আকাক্সক্ষা পদদলিত  করতে চায়। এদের কাজই হচ্ছে হত্যা আর দুর্নীতি করা। এরা দুর্নীতিবাজ পরিবার। ২১ আগস্টের ঘটনার সঙ্গে খালেদা-তারেক রহমানসহ সেই সময়ের বিএনপি জামায়াত জোট সরকারের জড়িত থাকার বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণ তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশ হওয়ার কথা ছিল মুক্তাঙ্গনে। কিন্তু আগের দিন রাত ১১টায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের দলীয় অফিসের সামনে সমাবেশের অনুমতি দেয়া হয়। অর্থাৎ এই ষড়যন্ত্রে  বিএনপি সরকার ও তাদের মন্ত্রীরা জড়িত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বৃহস্পতিবার ২১ আগস্ট একটি নতুন তথ্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ঘটনার দীর্ঘদিন আগে থেকে তারেক রহমান ধানম-ির ৫ নম্বরে তার শ্বশুরবাড়ি অবস্থান করছিলেন। মায়ের সেনানিবাসের বাড়ি ছেড়ে তিনি কেন শ্বশুরবাড়িতে ছিলেন- সেটিই প্রশ্ন। গ্রেনেড হামলা ও হত্যাকা-ের পরিকল্পনা বাস্তবায়নেই তিনি সেখানে অবস্থান করছিলেন। এ রকম বহু তথ্য-প্রমাণ আমাদের হাতে রয়েছে। সরকারি মদদ না থাকলে এত বড় ঘটনা হয় না।
দুই
শেখ হাসিনা দেশের সম্মানিত প্রধানমন্ত্রী। তিনি শুধু প্রধানমন্ত্রীই নন, তিনি বাস্তবে সমস্ত ক্ষমতার মালিক ক্ষমতা তার নিকট থেকেই উৎসারিত হচ্ছে। তেমন একটি রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক পরিম-লে শেখ হাসিনা যখন বলেন যে, ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের জন্য জিয়াউর রহমান দায়ী এবং ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার জন্য খালেদা জিয়া এবং তার পুত্র দায়ী, তখন কিন্তু সব কথা শেষ হয়ে যায়। তখন আর কারো কিছুই বলার ব্যাপার থাকে না। শেখ হাসিনা যখন জানেন যে, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার জন্য বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া এবং তার ছেলে তারেক রহমান দায়ী তখন তো আর তদন্ত করার কোনো প্রয়োজন থাকে না। যারা তদন্ত কাজ চালাচ্ছেন অথবা যারা বিচারিক কার্যক্রমে নিয়োজিত আছেন তিনি তো তাদের তদন্ত কর্ম এবং বিচারিক কাজের ওপর মোহর মেরে দিয়েছেন। তিনি তো বলেই দিয়েছেন যে, বেগম জিয়া এবং তার পুত্র তারেক জিয়া এই গ্রেনেড হামলার জন্য দায়ী। তাহলে তো আর তদন্ত আর বিচার কাজের কোনোই প্রয়োজন পড়ে না। তার এই উক্তিটিকে যদি তদন্ত অফিসার এবং বিচারিক প্রক্রিয়ায় নিয়োজিতরা গাইড লাইন হিসেবে গ্রহণ করেন তাহলে তো কিচ্ছা খতম। এভাবে কি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জেনেশুনে তদন্ত কাজকে প্রভাবিত করছেন? এটি ক্ষমতার গুরুতর অপব্যবহার এবং বিচার কার্যের ওপর সরকারের নগ্ন হস্তক্ষেপ। অবশ্য ফ্যাসিস্ট ডিকটেটরেরা এভাবেই কাজ করে। তারা ঘোড়ার আগেই গাড়ি জুড়ে দেয় অর্থাৎ রায় লেখার আগেই বলে দেয়া হয় যে কি রায় লিখতে হবে।
এখন আওয়ামী লীগের দারুণ সময়। জাতীয় পার্টির মতো এই রকম দো আঁসলে বিরোধী দল বাংলাদেশে ৪২ বছরে আসেনি। ভারত এবং পাকিস্তানে ৬৭ বছরেও আসেনি। এখন একদিক দিয়ে বলতে গেলে ৩০০টি আসনের মধ্যে ৩০০টি আসনই তাদের দখলে। সংসদে ভোটাভুটি হলে সবগুলো ভোট সরকারের পক্ষে পড়বে। এভাবে বিচার এবং তদন্তকে আওয়ামী লীগ সরকার হাস্যস্পদ করে তুলছে।
তিন
সর্বশেষ খবরে মনে হচ্ছে যে, পাকিস্তানের ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের সাথে রাজনৈতিক লড়াইয়ে হেরে যাচ্ছেন। ইমরান খান অবশ্য বলেছেন যে তিনি সরকারি দলের সাথে আলোচনায় বসলেও যে গণবিপ্লব তিনি শুরু করেছেন সেটি থামবে না। ইমরান খানের হয়তো রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং আন্দোলন করার দৃঢ় মনোবল রয়েছে। কিন্তু এই কলাম লেখার সময় পর্যন্ত যেসব খবর পাওয়া যাচ্ছে সেসব খবর থেকে দেখা যাচ্ছে যে, পার্লামেন্টে যে ১২টি রাজনৈতিক দল রয়েছে তার ১১টি নওয়াজ শরিফের সাথে রয়েছে। এমনকি পাকিস্তান পিপলস পার্টি বিরোধী দল হলেও তারা নওয়াজ শরিফকে সমর্থন করছে। পিপলস পার্টির নেতা মরহুমা বেনজির ভুট্রোর স্বামী আসিফ আলী জারদারি ঘোষণা করেছেন যে, পাকিস্তানের বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটে তিনি নওয়াজ শরিফকে সমর্থন করবেন।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে পাকিস্তানের ৩৪২ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় পরিষদ বা পার্লামেন্টে নওয়াজ শরিফের রয়েছে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা। তার রয়েছে ১৯০ জন সদস্য। অর্থাৎ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। ২য় বৃহত্তম দল হল পাকিস্তান পিপলস পার্টি। সদস্য সংখ্যা ৪২। ৩য় বৃহত্তম দল ইমরান খানের তাহরিকে ইনসাফ (পিটিআই)। সদস্য সংখ্যা ৩২। ইমরান খানের সাথে যুক্ত হয়েছেন একজন বিপ্লবী ধর্মীয় নেতা। নাম তাহিরুল কাদরি। তিনি পাকিস্তানী কানাডিয়ান। তার দলের নাম পাকিস্তান আওয়ামী তাহরিক। পাকিস্তানের বিগত ৬৫ বছরের রাজনৈতিক গতি ধারা যারা পর্যবেক্ষণ করেছেন তারা দেখেছেন যে পাকিস্তানে ক্ষমতার যে কয়টি কেন্দ্র রয়েছে তার মধ্যে ২টি কেন্দ্র অতি গুরুত্বপূর্ণ। একটি হল পাকিস্তানের শক্তিশালী সামরিক বাহিনী। আরেকটি হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
আমেরিকা বলেছে যে, গত বছর একটি শান্তিপূর্ণ, নিয়মতান্ত্রিক এবং গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে পাকিস্তান মুসলিম লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করেছে এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নওয়াজ শরিফ প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। অতএব আমেরিকা এই সাংবিধানিক এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সমর্থন করবে। তারা সংবিধান বহির্ভূত কোনো সমাধান সমর্থন করে না। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীও বলেছে যে, তারা দেশে শান্তি এবং স্থিতিশীলতা চায়। দেশে স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হোক এমন কোনো কিছু তারা সমর্থন করে না। পাকিস্তানের নতুন সেনা প্রধান জেনারেল রাসেল শরিফ স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে ইসলামাবাদে যারা বিক্ষোভ করছে তাদের সাথে পাকিস্তান সরকারের আলোচনায় বসা উচিত। তিনি চান যে এই বিক্ষোভ নিয়ে দেশে যেন কোনো সহিংসতা না ঘটে এবং দেশে যেন স্থিতিশীলতা বিনষ্ট না হয়। এই অসন্তোষ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ছোট ভাই পাঞ্জাবের মুখ্য মন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সাথে এক বৈঠকের পর জেনারেল রাসেল শরিফ একথা বলেন।
পাকিস্তানের বিক্ষোভের সর্বশেষ পরিস্থিতি ওয়াশিংটন টাইমসের ভাষায় নিম্নরূপ: The protests remained peaceful Wednesday as lawmakers met inside a parliament guarded by soldiers for the first time under a civilian government in Pakistan’s history. Men and women danced to drum beats and music as vendors sold carnival-style food. Other demonstrators slept outside at times and took showers at a public park. অর্থাৎ সংসদ সদস্যরা যখন পার্লামেন্টের ভেতরে অধিবেশনে মিলিত হয়েছিলেন তখন বিক্ষোভকারীরা বাইরে শান্ত ছিলেন। তবে সংসদ ভবনের নিরাপত্তার জন্য সেনাবাহিনী ভবনটিকে ঘিরে রেখেছিল। বিক্ষোভকারীরা সঙ্গীত এবং ড্রামের বাদ্যের তালে তালে নৃত্য করছিল এবং ভেন্ডররা খাবার বিক্রি করছিল। অন্যান্য বিক্ষোভকারীরা অনেকে ঘুমাচ্ছিল এবং অনেকে পাবলিক পার্কে গোসল করছিল।
ইমরান খানের বিক্ষোভ সবশেষে কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় সেটা দেখার জন্য আরো দুচার দিন অপেক্ষা করতে হবে।
আসিফ আরসালান

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads