বুধবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৪

বিচার বিভাগের ওপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ


গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী জাতীয় সংসদ রাষ্ট্রের অভিভাবক নয়। রাষ্ট্রের অবিভাবক হচ্ছে সংবিধান। আর সংবিধানের অভিভাবক হচ্ছে উচ্চ আদালত। বিচার বিভাগ জনগণের রক্ষাকবচ। বিচার বিভাগ যথাযথভাবে ভূমিকা পালন করতে না পারলে দেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র রক্ষা পাবে না। সকল প্রকার চাপের ঊর্ধ্বে থেকে বিবেকের কাছে জবাবদিহির অনুভূতি নিয়ে স্বীয় দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে বিচার বিভাগ দেশে শান্তি, স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় কার্যকর অবদান রাখে। বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল। বিচার বিভাগের উপর কোন ধরনের রাজনৈতিক প্রভাব, নিয়ন্ত্রণ কাম্য নয়। পৃথিবীর সকল গণতান্ত্রিক দেশসমূহ বিচার বিভাগকে সকল রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত রেখেছে। বিচার বিভাগ যদি স্বীয় দায়িত্ব পালন করতে না পারে, সেদেশে ধ্বংস ও নৈরাজ্য ছাড়া আর কিছুই কল্পনা করা যায় না। সরকার বিচার বিভাগের উপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার যে চক্রান্ত করছে তা দেশকে এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে গণতন্ত্র।
বাংলাদেশের সংবিধানে স্বাধীন বিচার বিভাগের কথা উল্লেখ আছে। সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- ‘রাষ্ট্রের নির্বাহী অংগসমূহ হইতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন।’ সে মতে ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক ঘোষণা করা হয়। কিন্তু ৭ বছরেও দেশে বিচার বিভাগের জন্য পৃথক কোন সচিবালায় গড়ে ওঠেনি। দেশের প্রধান বিচারপতিসহ এ অঙ্গনের সাথে সংশ্লিষ্টরা বিভিন্ন সময় বলে আসছেন, পৃথক সচিবালায় ছাড়া বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সম্ভব নয়।
আমাদের সংবিধানের চতুর্থ অংশে বিচার বিভাগের কথা বলা হয়েছে। সংবিধানে বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ স্তর হলো দেশের সুপ্রীম কোর্ট যা অ্যাপিলেট ডিভিশন ও হাইকোর্ট ডিভিশন নিয়ে গঠিত। প্রধান বিচারপতি ও সুপ্রীম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতি নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি।
সংবিধানের ৯৫(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন এবং প্রধান বিচারপতির সহিত পরামর্শ করিয়া রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারক নিয়োগ দান করিবেন।’
এখন সংবিধান সংশোধন করে বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সংশোধনীর খসড়া ইতিমধ্যেই মন্ত্রীসভায় অনুমোদন হয়েছে। আগামী সেপ্টেম্বর মাসে সংসদের অধিবেশনে এ খসড়া উপস্থাপন করা হবে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। এটি সংসদে পাস হলে বিচারপতিদের অপসারণ ক্ষমতা পাবে সংসদ।
আমাদের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কোন নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোন ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি (ক) উক্ত দল হতে পদত্যাগ করেন অথবা (খ) সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোট দান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাহার আসন শুন্য হইবে। তবে তিনি সেই কারণে পরবর্তী কোন নির্বাচনে সংসদ সদস্য হইবার অযোগ্য হইবেন না।’
সংবিধানের এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোন সদস্যই দলের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন অবস্থান নিতে পারেন না। আমাদের দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধানই দেশের প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সে জন্য বিচারকের নিয়োগ এবং অপসারণ নির্বাহী প্রধানের অভিপ্রায়ের উপর নির্ভরশীল।
 দেশের নিম্ন আদালতগুলো উচ্চ আদালতের অধীনে করে দেয়া হলেও সেখানে নিয়োগ, কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি ও ছুটি মঞ্জুরের মতো বিষয়গুলো রাষ্ট্রপতির অধীন। আবার রাষ্ট্রপতি এসব দায়িত্ব পালনকালে প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ গ্রহণ করেন।
সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘বিচার বিভাগীয় পদে বা বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনকারী ম্যাজিষ্ট্রেট পদে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক উক্ত উদ্দেশ্যে প্রণীত বিধিসমূহ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দান করিবেন।’
১১৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘বিচার কর্ম বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনে রত ম্যাজিষ্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রন (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি দান ও ছুটি মঞ্জুরসহ) ও শৃঙ্খলা বিধান রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত থাকিবে এবং সুপ্রীম কোর্টের সহিত পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তাহা প্রযুক্ত হইবে।’
রাষ্ট্রপতিকে এসব কাজ করতে হয় নির্বাহী বিভাগের পরামর্শক্রমে। আমাদের সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ব্যতিত সব দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুসারে কাজ করতে হয় রাষ্ট্রপতিকে। তাই মন্ত্রী পরিষদে অনুমোদিত সংশোধনী পাস হলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলে কিছু থাকবে না।
নিম্ন আদালত সম্পর্কে সুপ্রীম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবীগণ বহু পূর্বেই মন্তব্য করেছেন, ‘নিম্ন আদালত সরকারের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।’ এখন নতুন সংশোধনীর মাধ্যমে দেশের গোটা বিচার বিভাগের উপর সরকারের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চক্রান্ত চলছে।
॥ দুই ॥
দীর্ঘদিনের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অনেক রক্ত, অমূল্য জীবন ও সীমাহীন ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর শোষন, বঞ্চনা ও জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। ছাত্র, যুবক, কৃষক, শ্রমিক, মেহনতী মানুষ একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তাদের স্বপ্ন ছিল একটি স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশের। যেখানে জনগণ ন্যায়বিচার পাবে, মাথা উচুঁ করে দাঁড়াতে পারবে। জীবনের নিরাপত্তা পাবে। ক্ষুধা, দারিদ্র, বেকারত্ব জাতিকে গ্রাস করবে না।
বাংলাদেশের যতটুকু অর্জন তা জনগণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমেই কেবল সম্ভব হয়েছে। জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ফলেই ১৯৫২ সালে মহান ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণআন্দোলন এবং ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ সফলতা অর্জন করেছিল। আবার ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও জনতার স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণে স্বৈরাচারের পতন ঘটেছিল এবং গণতন্ত্রের পুন:যাত্রা শুরু হয়েছিল। গণতন্ত্রের সেই অগ্রযাত্রা আজ স্তব্ধ হতে চলেছে। গণতান্ত্রিক সকল প্রতিষ্ঠানসমূহকে সরকার একে একে ধ্বংস করে দিচ্ছে। দেশে গণতন্ত্রই যদি না থাকে তবে মানুষের কোন অধিকার আর থাকবে না।
ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলকারী বর্তমান সরকার একের পর এক সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠার পর আদালত ও মিডিয়ার উপর নজর দিয়েছে। ইতিমধ্যেই সম্প্রচার নীতিমালার মাধ্যমে মিডিয়ার উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। দেশের সংবাদপত্র কর্মী, কলামিষ্ট, বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল মিডিয়ার উপর সরকারের ঘোষিত নীতিমালার বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ কারো কথায় তাদের সিদ্ধান্তের পরিবর্তন ঘটিয়েছে এমন নজির খুব একটা নজরে পড়ে না। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হবে এমনটি ভাবার কোন সুযোগ নেই। মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের নীতিমালা ঘোষণার পরই সরকার গত ১৮ আগস্ট মন্ত্রীসভার বৈঠকে বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের উপর ফিরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পার্লামেন্টের অনুমোদনের পরেই তা বাংলাদেশের সংবিধানে সন্নিবেশিত হবে।
বর্তমান সরকার গণতন্ত্রকে নিশ্চিহ্ন করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে এটি তার আরেকটি পদক্ষেপ। গণতান্ত্রিক শাসনের শর্তগুলো ফিরিয়ে দেয়ার জন্য দেশের বুদ্ধিজীবী, কলামিষ্ট, সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের পাশাপাশি দেশের বাইরে থেকে সরকারকে আহ্বান জানানো হয়েছে। বন্ধুসুলভ (Friendly criticism) সমালোচনাকে সরকারে ভালো চোখে দেখছে না। বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংগঠনের মতামত উপেক্ষা করে চলছে সরকার। সরকারের সাম্প্রতিক প্রবণতা থেকে প্রকাশ হয়ে পড়েছে কোন ধরনের সমালোচনা সরকার গ্রহণ করবে না। করতে রাজী নয়। সরকার নিজেদের ভুলত্রুটি প্রকাশ হওয়ার ছিদ্র বন্ধ করে দিচ্ছে। সরকারের এ প্রবণতাকে অনেকে অসামরিক স্বৈরাচারী বলে আখ্যায়িত করেছেন। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন শাসকগোষ্ঠী সর্বদাই জনগণের মুখের ভাষা, মত প্রকাশের অধিকার কেড়ে নেয়। আওয়ামী লীগ যেহেতু ক্রমাগতভাবে গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে তাই বিভিন্ন ধরনের কালো আইন প্রণয়ন করে ক্ষমতা আকড়ে থাকার শেষ চেষ্টা তারা করে যাচ্ছে।
সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সমর্থন নিয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত গণতান্ত্রিক সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনা করতে খুব বেশী আইন-কানুন ও বিধি-বিধানের প্রয়োজন হয় না। ১৭০৭ সালে আওরঙ্গজেবের শাসনকালের শেষ থেকে ১৯৪৭ সালে মাউন্ট ব্যাটেনের সময় পর্যন্ত ২৪০ বছরে এদেশে যত আইন কানুন ও নীতিমালা রচিত হয়েছে, গত সাড়ে পাঁচ বছরেই তার চেয়ে অনেক বেশী আইন কানুন ও প্রবিধান এবং নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। শিক্ষানীতি, নারীনীতি, স্বাস্থ্যনীতিসহ অসংখ্য নীতি প্রণয়ন করেছে সরকার। কিন্তু এসব নীতি দ্বারা জনগণের কল্যাণ বলতে কিছু হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। প্রকৃতপক্ষে কোন একটি নীতিমালা দ্বারা মানুষের কল্যাণ হয়নি। শুধু যে কল্যাণ হয়নি তা নয়, নতুন নতুন সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে এমন কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে যার কুফল ভোগ করছে সমগ্র জাতি।
বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত হওয়ার মাধ্যমে দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রগতি চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। যেকোন দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সাফল্যমন্ডিত করতে হলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কোন বিকল্প নেই। কথিত আছে, ‘Judiciary is the third pillar rather backbone in any strong democratic state system and only protection to all segments of society’ অর্থাৎ বিচার বিভাগ তৃতীয় স্তম্ভ, তথা যেকোন শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর মেরুদন্ড এবং কেবল মেরুদন্ডই পারে সমাজের সব অংশকে রক্ষা করতে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধখ্যাত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন চার্চিল বলেন, ‘If our judiciary  is dispensing the justice than we lost nothing’ -যদি আমাদের বিচার বিভাগ ন্যয়বিচার দিয়ে জনগণকে সেবা দেয় তাহলে আমাদের হারানোর কিছুই নেই।
‘A state of injustice can not run’ -ন্যায়বিচারহীন কোন রাষ্ট্র চলতে পারে না। ন্যয়বিচার নিশ্চিত করতে হলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। ন্যয়বিচার নিশ্চিত করা একটি গণতান্ত্রিক সমাজের অন্যতম মূল উদ্দেশ্য। এই কারণে দেখা যায়, প্রতিটি রাজনৈতিক দলই তাদের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতে তারা ক্ষমতায় গেলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দান করে। বর্তমান শাসকদল আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোতে এর ব্যতিক্রম ছিল না।
কিন্তু আওয়ামী লীগ গণবিচ্ছিন্ন হয়ে জনগণের উপর স্বৈরশাসন চাপিয়ে দেয়ার অব্যাহত প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে একে একে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের সকল চরিত্রকে ধ্বংস করে দিয়েছে। তাদের আপাতত শেষ আক্রমণের শিকার বিচার বিভাগ।
শাসকদলের পক্ষ থেকে তাদের এসব গণতন্ত্র বিরোধী পদক্ষেপের স্বপক্ষে কুযুক্তি প্রদর্শনের ব্যাপারে কোন কমতি নেই। তাদের বক্তব্য হলো বিচার বিভাগের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার জন্য এ আইনের প্রয়োজন আছে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘বিচার বিভাগের জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার জন্যই বিচারকদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে দেয়া উচিৎ। সংসদের হাতে এই ক্ষমতা দিলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হবে না। বরং বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় জনগণের যে সুফল লাভ সেটাই এই সংশোধনের মারফত আরো পাকাপোক্ত হবে।’ সাবেক প্রধান বিচারপতি ও আইন কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি এবিএম খাইরুল হক বলেছেন, ‘আদালতের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতেই বিচারপতিদের অভিশংসন বা অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে থাকা উচিৎ। আর সংসদের হাতে এ ক্ষমতা থাকা গণতান্ত্রিক।’ তিনি বলেন, ‘উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অভিশংসন বা অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে ফিরিয়ে দেয়া নিয়ে কোন ভয়ের কারণ নেই। ১৯৫০ সাল থেকে এটা ভারতে রয়েছে। এটা একটি গণতান্ত্রিক বিষয়।’ আওয়ামী লীগের অন্যান্য মন্ত্রী, এমপি ও দলীয় নেতাগণও একই ভাষায় কথা বলছেন। আমেরিকা, কানাডা, ব্রিটেন, ইতালি, ফ্রান্স কিংবা প্রতিবেশী দেশ ভারতে সবখানেই চালু আছে অভিশংসন আইন। তবে প্রয়োগ খুবই কম। ভারতে স্বাধীনতার প্রথম দিন থেকেই অভিশংসন আইন চালু আছে, কিন্তু প্রথম প্রয়োগ হয়েছে ২০০৯ সালে, অর্থাৎ দীর্ঘ ৬২ বছর পর। আর শিকার হয়েছিলেন কলকাতার বিচারক সৌমিত্র সেন। এর আগে পাঞ্জাব ও হারিয়ানার বিচারপতি ভি রামস্বামীর বিরুদ্ধেও অভিশংসনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এসব ঘটনা বিশ্লেষন করলে দেখা যায় কোথাও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই। সবই নৈতিক।
শাসক দলের উদ্যোগে বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে ন্যস্ত করে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হরণ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের লক্ষ্যে জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা চাপিয়ে দেয়া, এ দুয়েরই একটাই লক্ষ্য দেশে গণতন্ত্র হত্যা করা। দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রগতির পথ রূদ্ধ করে দেয়া। আর দেশে যখন গণতান্ত্রিক ধারার বিকাশের পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয় তখন দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়। আর নৈরাজ্যের পথ ধরেই অসাংবিধানিক ও অবাঞ্ছিত কর্মকা- জাতিকে গ্রাস করে। ওয়ান ইলেভেনের তিক্ত অভিজ্ঞতা দেশের জনগণ নিদারুণভাবে প্রত্যক্ষ করেছে। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনকাল দেশের জন্য সুফল বয়ে আনেনি।
বিচারকদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদকে দেয়ার সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণভাবে বিচার বিভাগকে দলীয়করণ করার একটি অশুভ প্রচেষ্টা বলে মন্তব্য করেছেন সুপ্রীম কোর্ট বার এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন। তিনি আরো বলেন, এই প্রস্তাব পাস করা হলে সংবিধানের অনেক জায়গায়ই পরিবর্তন করতে হবে। অন্যান্য সাংবিধানিক পদের ক্ষেত্রেও এই আইন প্রযোজ্য হয়ে যাবে।
বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা ভারত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশের পার্লামেন্টে আছে বলে শাসক দলের পক্ষ থেকে যে যুক্তি তুলে ধরা হচ্ছে তা যুক্তি নয়, কুযুক্তি এবং অসৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত। এসব কুযুক্তি এ কারণে যে, ঐসব দেশে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত। ঐসব দেশে কোনদিন গণতন্ত্র হত্যা করে একদলীয় বাকশালী ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়নি। অথবা অর্ধেকেরও বেশী আসনে বিনা নির্বাচনে প্রার্থী বিজয়ী এবং ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে কোন সরকার নিজেদের বৈধ সরকার বলে তৃপ্তিবোধ করেনি। অন্যান্য দেশে সুশাসন ও গণতান্ত্রিক যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে তা আমাদের দেশে এখনো গড়ে উঠেনি। গণতন্ত্রকে মজবুত ভিত্তির উপর দাঁড় করানোর স্বার্থেই এ অশুভ সিদ্ধান্ত থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন। অন্যান্য দেশের শাসক দলের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, গণতান্ত্রিক চেতনা, পরমত সহিষ্ণুতা, শ্রদ্ধাবোধকে অনুসরণ না করে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের উপর ন্যস্ত করার উদাহরণ টেনে আনা কিছুতেই যুক্তিসংগত হতে পারে না। বিনা ভোটে নির্বাচিত সংসদ যাদের কোন নৈতিক ভিত্তি নেই, তারাই যদি বিচারকদের স্বাধীনতার কথা ভাবে তাহলে বুঝতে হবে তার পেছনে লুকিয়ে আছে কোন অসৎ উদ্দেশ্য।
দেশে সুদীর্ঘকাল যাবৎ বিদ্বেষপূর্ণ, পারস্পরিক ও ক্ষমতা কেন্দ্রীক রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রেক্ষিতে সংসদের উপর বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা দেয়া হলে দেশে আরেকটি বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।
মতিউর রহমান আকন্দ 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads