সোমবার, ২৫ আগস্ট, ২০১৪

অর্থনৈতিক সঙ্কটের কবলে দেশ


দেশ ক্রমান্বয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সঙ্কটের কবলে নিপতিত হতে যাচ্ছে। বিদেশী বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে। বিদেশীরা মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে। বিদেশী সাহায্য কমে যাওয়ায় দেশের অর্থনীতি ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে দিন দিন। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক সহিংসতায় বিনিয়োগ পরিস্থিতিরত  নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এরপর থেকে বড় ধরনের বিদেশি বিনিয়োগ দেশে আসেনি, অন্যদিকে দেশী বিনিয়োগের ও খুব বেশি দেখা মিলছে না। দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক সূচক থাকলে ও ব্যাংকের ঋণ বিতরণ কমেছে। ব্যাংকে অলস টাকা পড়ে থাকলে ও বিনিয়োগ নেই। উদ্যোক্তাদের অভিমত, রাজনৈতিক অস্তিরতার কালো মেঘ এখনও কাটেনি। সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হওয়ায় যে কোন মুহূর্তে রাজনৈরতিক অবস্থা উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে। তাই নতুন বিনিয়োগ করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় সম্ভাবনার দ্বার ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে অর্থনীতিতে। বাইরের উদ্যোক্তরা এ দেশে আসতে চাচ্ছে না। বিদেশী বিনিয়োগে নানা সুবিধা থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক অস্থিরতায় ঝুঁকি বর্তমানে বড় বাধা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এতে কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে না বাংলাদেশ। সম্ভাবনার লক্ষ্য পথ থেকে বাংলাদেশ দিন দিনই পিছিয়ে পড়ছে প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায়। নানা প্রতিকূলতার সত্ত্বেও সামাজিক অর্থনৈতিক উন্নতিতে বাংলাদেশ ছিল উন্নয়নশীল দেশগুলোর মডেল। কিন্তু রাজনৈতিক সহিংসতায় বাংলাদেশ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ জোট ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয়  জোটের বিরোধ সাত শতাংশ জিডিপি অর্জনকে বাধাগ্রস্ত করবে। রাজনৈতিক সম্ভাবনা থাকার সত্ত্বেও এমনকি প্রতিবেশী মিয়ানমারের তুলনায় ও বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশী বিনিয়োগ কম হয়েছে। চলতি ২০১৪ সালে জানুয়ারী থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে নিবন্ধিত মোট যৌথ বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণ ২১ কোটি ৫০ লাখ ১২ হাজার মার্কিন ডলার। অথচ গত বছরের এই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ৪৫ কোটি ৩৩ লাখ ৫৫ হাজার ডলার। এ হিসেবে নিবন্ধিত বিনিয়োগের পরিমাণ কমেছে ৫২ দশমিক ৫৭ শতাংশ। চলতি বছরের শুরু থেকে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বিনিয়োগ কমতে শুরু করে। কয়েক বছর ধরে বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশকে নিয়ে নেতিবাচক বার্তা যাচ্ছে। উদ্বেগজনক এ অবস্থায় বিনিয়োগ চলে যাচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকাসহ এশিয়ার অন্য দেশগুলোতে। এটা আমাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথকে রুদ্ধ করে দিচ্ছে। বিশ্ববিনিয়োগ প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৩ সালে মিয়ানমারে বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার। এর আগের বছর বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার।  অথচ এই সময়ে বাংলাদেশে বিনিয়োগ এসেছে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে কঙ্গোয় বিনিয়োগ হয়েছে ২ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া ঘানা, নাইজেরিয়া, মোজান্বিক, তানজানিয়া ও উগান্ডায় বিদেশী বিনিয়োগ হয়েছে যথাক্রমে ৩ দশমিক ৩, ১ দশমিক ৪, ৫ দশমিক ২, ১ দশমিক ৭ ও ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ বা দক্ষিণ এশিয়ার দুই একটি দেশে বিনিয়োগ কমলে ওই সকল দেশে বিস্ময়করভাবে গত কয়েক বছর বিনিয়োগ বাড়ছে। আন্তর্জাতিকদাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক ধারণা করছে, চলতি বছর মন্দা কাটিয়ে বিশ্বঅর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারবে না বাংলাদেশ। সংস্থাটি আশা করে এ বছর প্রবৃদ্ধি কমে ৫.৭ শতাংশের বেশি হবে না। সংস্থাটি জানায়, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও নির্বাচনকে ঘিরে অস্থিতিশীলতার কারণে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি কমে ৫.৭ শতাংশ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে বাংলাদেশে অস্থিতিশীলতারও বিশৃঙ্খলতার কারণে বেসরকারীখাতে বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি কমেছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবাসী আয় ১২.৬ শতাংশ বাড়লেও চলতি অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে তা কমে ৮.৪ শতাংশ হয়েছে।  জনশক্তি রপ্তানি কম হয়েছে বিধায় এ অবস্থার সৃ্িষ্ট হয়েছে বলে বিশ্বব্যাংক।  এমন সংবাদ মোটেই সুখকর নয়।  সামনে আন্দোলনের ভয় তাদের পেয়ে বসেছে। তারা এক অনিশ্চয়তার মধ্যে সামনে অগ্রসার হতে পারছে না। জিএসপি সুবিধা নাকচে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ হ্রাস অব্যাহত রয়েছে। এক মাসে দেশী বিনিয়োগ কমলে পরের মাসে বিদেশী বিনিয়োগ কমছে। সব মাসে লক্ষ্য করা যাচ্ছে কমার চিত্র। এ অবস্থায় সব অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও সরকারী কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছে। বিনিয়োগ না থাকায় ব্যাংকগুলোতে অলস টাকার পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বিরাজমান পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেশি। এ অবস্থা চলতে থাকলে আমানতকারীদের সঙ্গে ব্যাংক সম্পর্কে অবিশ্বাস জন্ম নিতে পারে। যা প্রকান্তরে ব্যাংকিংখাতকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে পারে। ৫ই জানুয়ারীর নির্বাচনের পর নতুন বাণিজ্যমন্ত্রী জিএসপি সুবিধা পাওয়ার ব্যাপারে অমর বাণী শুনিয়ে ছিল। তাতে বিনিয়োগ কিছুটা ইতিবাচক হয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বার যখন জিএসপি সুবিধা বাতিল করা হল তখনই বিনিয়োগ তলানিতে নামতে শুরু করে। বিনিয়োগ বোর্ডের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী জুন মাসে ২১ হাজার ৬৮৭ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে। যা আগের মাসে ছিল ২৫ হাজার ৫০৬ জন। সে হিসাবে দেশী বিদেশী বিনিয়োগে কর্মসংস্থান কমেছে তিন হাজার ৮১৯ জনের। একই সঙ্গে শিল্প নিবন্ধের সংখ্যাও কমেছে। এ সময় শিল্প নিবন্ধন হয়েছে ১৩৩টি। যা আগের মাসে ছিল ১৫৪টি। কমেছে ২১টি। বিওআই প্রতিবেদন অনুযায়ী জুন মাসে দেশী শিল্পে ২০ হাজার ২৮৬ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে। যা আগের মাসে ছিল ২৪ হাজার ৬৯৩ জন। সে হিসাবে দেশী শিল্পে কর্মসংস্থান কমেছে চার হাজার ৪০৭ জন। একই সঙ্গে শিল্প নিবন্ধের সংখ্যা কমেছে। এ সময় শিল্প নিবন্ধন হয়েছে ১২৪টি। যা আগের মাসে ছিল ১৪৭। কমেছে ২৩টি। এদিকে দেশের পোশাক শিল্প ধ্বংসের মুখে। তৈরি পোশাক থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আসে মোট রফতানি আয়ের ৮১ শতাংশ। পোশাক শিল্প এখন চ্যালেঞ্জর মুখে। দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিখাত জনশক্তি। এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর রপ্তানিখাত ঝিমিয়ে পড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের জনশক্তি রপ্তানি একেবারে শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। সরকারী নীতির কুপ্রভাবে রফতানিমুখী জনশক্তি শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানিকারক হিসেবে যে তৈরি পোশাক সম্ভাবনাময় দেশের তালিকায় নাম লেখিয়েছে বাংলাদেশ, সেই শিল্প বিশ্ববাজারে এখন চরম ভাবমর্যাদা সঙ্কটে ভুগছে দেশ। প্রতিনিয়ত শ্রমিক অসন্তোষ, কারখানা ভাংচুর, পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়ে বহু শ্রমিকের মৃত্যু। বেতন-বোনাস না পেয়ে তোবা গ্রুপের শ্রমিকদের অনশন, হা-মীম, গরিব এন্ড গরিব ও তাজরীনের মতো ভয়াবহ অগ্নিকা--রানা প্লাজার মতো বিশ্বকাঁদানো ভবন ধস, আসওয়াদ দুর্ঘটনা ও স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপের দশ তলা ভবন শ্রমিকদের আগুন পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া। এ সবের ধারাবাহিকতায় দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজার বাংলাদেশী পণ্যের জিএসপি সুবিধা বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে শত শত কারখানা ভিয়েতনাম-কম্বোডিয়ায় স্থানান্তর হয়েছে। দুই যুগ ধরে কাজ করা আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের ও অর্ডার প্রত্যাহার করার ঘটনা ঘটছে। গ্যাস বিদ্যুতও পুঁজি সঙ্কটে হাজার হাজার কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে জনমনে প্রশ্নের সৃষ্টি হচ্ছে এ দেশের তৈরি পোশাকশিল্প কি পাটের ভাগ্যবরণ করতে যাচ্ছে।  বাংলাদেশকে এক সময় বলা হতো কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পাটের ছিল স্বর্ণযুগ; চা শিল্পেও ছিল বিরাট অবদান; কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আজ এ দুই খাতই মৃতপ্রায়। সেই জায়গা দখল করেছে আমাদের গার্মেন্টশিল্প। এই শিল্প প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এক কোটিরও বেশি লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা ছাড়াও প্রতিবছর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছে গড়ে দুই হাজার কোটি মার্কিন ডলার। গার্মেন্টশিল্প গত ৩০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছে। বিশ্বে তৈরি পোশাক রফতানিতে বর্তমানে চীনের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। ১৯৭৮ সালে প্রথম দেশীয় গার্মেন্টে উৎপাদিত তৈরী পোশাক বিদেশে রফতানির মধ্য দিয়ে এই শিল্পের বিদেশী বাণিজ্যে যাত্রা শুরু হলেও অল্প কিছু দিনের মধ্যেই আমাদের দেশের তৈরি পোশাকশিল্প বিশ্ববাজারে নিজেদের অবস্থান তৈরিতে সম হয়। শ্রমিকের সহজলভ্যতা, অপেক্ষাকৃত কম মজুরি, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও পোশাকের উন্নতমান বাংলাদেশের পোশাক শিল্পকে বিশ্ববাজারের প্রতিযোগিতায় অন্যতম প্রতিযোগী হিসেবে অবস্থান এনে দেয়। বর্তমানে বাংলাদেশ পোশাক রফতানিতে প্রতিযোগিতা করছে চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশগুলোর সাথে। বর্তমানে দেশে নিবন্ধিত প্রায় সাড়ে সাত হাজার গার্মেন্ট রয়েছে; কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, আমাদের এই শিল্প কিছু দিন পরপরই বিভিন্ন প্রতিকূলতার সম্মুখীন হচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, মাল খালাসের অনিয়ম, ব্যাংক ঋণের সঙ্কট, অবকাঠামোগত দুর্বলতাসহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে গার্মেন্ট মালিকদের বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে এবং বিদেশী ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে অনেক সময়ই ব্যাপক বেগ পেতে হয়। তার মধ্যে মাঝে মাঝে সংঘটিত শ্রমিক অসন্তোষ এই শিল্পে নিয়ে আসে স্থবিরতা। বিগত কয়েক বছর বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে শ্রমিক আন্দোলন ও অসন্তোষ পোশাকশিল্পে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করেছে, যার প্রমাণ পাওয়া যায় সাম্প্রতিক রফতানিখাতে পোশাকশিল্পের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার মাঝে। অন্যদিকে আমেরিকা ও ইউরোপে রফতানি কমেছে প্রায় ২৮ ও ১৫ শতাংশ। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছে চীন, ভারত ও ভিয়েতনাম। বাংলাদেশের পোশাক শিল্প বাধাগ্রস্ত হলে এই দেশগুলোই তার সুবিধা পাবে। দীর্ঘ দিন ধরে অস্থিরতার কারণে পোশাক রফতানি বাণিজ্যে ধস নামার মতো পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। ইতোমধ্যে শ্রমিক অসন্তোষের কারণে অনেক পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। অস্থিরতার কারণে সময়মতো অর্ডার সরবরাহ করতে না পারায় ক্রেতারা অন্য দেশে চলে যেতে পারেন। আর এখাতে বিপর্যয় নেমে এলে দেশের অর্থনীতি মারাত্মক বাধাগ্রস্ত হবে। শ্রমিকেরা বেকার হলে তাদের ক্রয়মতা কমে যাবে। দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়বে। ক্রেতারাও এ সুযোগে পণ্যমূল্য কমিয়ে দেবে। গত এক দশকে তৈরী পোশাকে মূল্য প্রায় ৩২ শতাংশ কমেছে। এ সময়ে এক ডজন পোশাকের মূল্য ৩৯ ডলার থেকে ২৬ ডলারে নেমে এসেছে। গার্মেন্ট শিল্প সম্পূর্ণভাবেই ক্রেতানির্ভর শিল্প। বিদেশী ক্রেতাদের কারণেই এ শিল্প গড়ে উঠেছে। এই ক্রেতাদের কাছে অর্থের চেয়ে সময়ের দাম বেশি। কোনো কারণে পোশাক সরবরাহে বিলম্ব হলে তারা অন্য দেশে চলে যাবে, এটা স্বাভাবিক। উদ্যোক্তারাও প্রতিকূল অবস্থায় এ দেশে কর্মসংস্থানের চেয়ে ব্যবসায় নিয়ে বেশি চিন্তা করবে। তারা তাদের ব্যবসায়িক সুবিধার জন্য অন্য দেশে চলে যাবে। ইতোমধ্যে চীনে মজুরি নিয়ে অসন্তোষের কারণে বিদেশী কোম্পানি চীন ছাড়তে শুরু করেছে। এটা বাংলাদেশের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করেছে। ক্রমাগত অস্থিতিশীলতা এই সুযোগকে নষ্ট করে দেবে। বাংলাদেশে একজন শ্রমিক প্রতি মাসে সর্বনিম্ন বেতন পান ৫৫ মার্কিন ডলার, চীনে ২০৬ ডলার, শ্রীলঙ্কায় ১০৭ ডলার, পাকিস্তানে ৮৫ ডলার, ভারতে ৬৫ ডলার। কম মজুরি সত্যিই কাম্য নয় যদিও এই দেশের শ্রমিকদের মজুরি অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম হওয়ায় আমাদের পোশাক শিল্প বিশ্ববাজারের প্রতিযোগিতায় টিকে আছে। সম্প্রতি শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিজিএমইএ অধিভুক্ত গার্মেন্টগুলোর মধ্যে নিম্নতম মজুরি দিচ্ছে ৯২.৪২%, সময়মতো মজুরি দিচ্ছে ৮১.৮১%, অতিরিক্ত কাজের ভাতা দিচ্ছে ৯৫.৫৫% এবং বিকেএমইএর অধিভুক্ত গার্মেন্টগুলো নিম্নতম মজুরি দিচ্ছে ৮৫.৭%, সময়মতো মজুরি দিচ্ছে ৮৫.৭১%, অতিরিক্ত কাজের ভাতা দিচ্ছে ৮৫.৭১%। এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী কিছু কিছু গার্মেন্ট শ্রম আইন ও সরকারি নীতিমালা অনুসরণে ব্যর্থতার পরিচয় দিলেও বেশির ভাগ গার্মেন্ট মালিকই কিন্তু নিয়ম মেনে শ্রমিকদের বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছেন। একটি বিষয় এখানে স্পষ্ট, শুধু মজুরি বাড়ানোর জন্য বা বেতন-বোনাসের জন্য বারবার এত বড় বিক্ষোভ ও ভাঙচুর হওয়ার কথা নয়। বিদেশী ষড়যন্ত্র, ঝুট সন্ত্রাসী, স্থানীয় ক্ষমতাশালীদের স্বার্থকেন্দ্রিক ধ্যান-ধারণা, কিছু মালিকপক্ষের অসাধুতা এবং কিছু শ্রমিক নেতার ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের জন্য বারবার শ্রমিকদের গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, যার ফলে এই শিল্পে দেখা যাচ্ছে অস্থিরতা। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান খাত দেশের তৈরী পোশাক শিল্পকে নিয়ে চলছে নানামুখী ষড়যন্ত্র। সাম্প্রতিক সময়ে সাভারের রানা প্লাজা ধসের পরে এখানেও এক নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। এর আগে তাজরীন ফ্যাশনসে ভয়াবহ আগুন এবং কয়েক বছর আগে সাভারের বাইপাইলের স্পেক্ট্রা গার্মেন্ট ধসে পড়ার ঘটনারও কোনো সুষ্ঠু তদন্ত হয়নি। এ সব ঘটনার প্রত্যেকটির নেপথ্যেই রয়েছে গার্মেন্ট শিল্প ধ্বংসের একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। যে কারণে কোনো একটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হচ্ছে না বা হলেও এক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা লক্ষণীয়। এই সুযোগে দেশে আতঙ্ক সৃষ্টি করে আমাদের পোশাক শিল্পকে ধ্বংস করার চক্রান্ত করা হচ্ছে। বিভিন্ন মহল দেশের গার্মেন্ট শিল্পের বেহাল দশা যতটা না, তার চেয়েও ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানোর চেষ্টা করে চলেছে। এ শিল্পকে নিয়ে বিদেশী ষড়যন্ত্র হওয়াটা অস্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়। একটি অর্থকরী সম্ভাবনাময় খাতকে বাংলাদেশ থেকে সরিয়ে অন্য দেশে নিয়ে যেতে বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীরা উঠেপড়ে লাগতেই পারে। সেক্ষেত্রে এই মহলকে চিহ্নিত করতে হবে। এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে এবং এটা করতে হবে সরকারকেই। ‘বিদেশী ষড়যন্ত্র’ বলে দোষ চাপিয়ে বসে থাকলে চলবে না। আর যদি দেশের ভেতরের কোনো কুচক্রী মহল সত্যিই এর পেছনে থেকে থাকে, তবে তাদেরও চিহ্নিত করা হোক। শাস্তি দেয়া হোক। রক্ষা করা হোক তৈরী পোশাক শিল্প খাতকে। যা হোক, বর্তমানে তৈরী পোশাক শিল্পের খাতটি যেহেতু আমাদের অর্থনীতিতে একটি বড় শক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে, তাই সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে যাতে মালিক ও শ্রমিক উভয়েই এই শিল্পের বিকাশধারায় উৎসাহিত হয়। এ জন্য সরকারকে বেশ কিছু কার্যকর পদপে নিতে হবে। নতুন মজুরি কাঠামো প্রণয়ন, শ্রম আইন বাস্তবায়ন, শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ, তদন্ত কমিটি কর্তৃক প্রদানকৃত সুপারিশমালা বাস্তবায়ন, স্থানীয় রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী মহলের এই শিল্পের ওপর প্রভাব কমানো, ঝুট ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ, মালিকদের কাঁচামাল আমদানি ও পোশাক রফতানিতে শুল্ক কমানোসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।  
এইচ এম আব্দুর রহিম 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads