রবিবার, ৩১ আগস্ট, ২০১৪

বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী... রাজনীতি, রাজনৈতিক দল ও শূন্যতা

রাজনীতিশব্দটি বিশ্বজনসমাজে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত বলেই দেশে দেশে রাজনৈতিক দলের কার্যকলাপ দেখা যায়। এ কথা অনস্বীকার্য যে, মানবসত্তার অপরিহার্য অঙ্গ হচ্ছে রাজনীতি। প্রাচীন গ্রিসে জ্ঞানীদের শিকবলে যাকে মান্য করা হতো, সেই অ্যারিস্টটলের বহু উদ্ধৃত মন্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য ÔMan is by nature a political animal.Õ রাজনৈতিক জীব হিসেবে মানুষের আচরণ ইতর প্রাণীর চেয়ে উত্তম। কারণ মানুষ প্রাণিজগতে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে অধিষ্ঠিত। তারা নিজেদের মাঝে ভিন্ন ধরনের মতামত, পৃথক চাহিদা ও পরস্পরবিরোধী স্বার্থকে উপস্থাপন করতে পারে।
আসলে রাজনীতি কী সেই প্রশ্নটির উত্তর সবাই নিশ্চিতভাবে পেয়ে গেছেন, তা বলা যাবে না। হয়তো একটা সর্বজনগ্রাহ্য রূপরেখা পাওয়া যেতে পারে। সুতরাং রাজনীতিনামে পরিভাষাটিকে ঘিরে এখনো নানা বিতর্ক ও মতানৈক্য বিদ্যমান রয়েছে। রাজনীতির বিষয়বস্তু নিয়ে নানাজন নানা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তবে প্রাচীনকালের রাজনীতির আলোচনা শুরু হয় রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা সম্পর্কিত চর্চা থেকে। এখন সরকার, সরকারের প, বিরোধী প, ক্যাবিনেট, পার্লামেন্ট, আমলাতন্ত্র, কর্মচারী, ক্যান্টনমেন্ট, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, নির্বাচন, অর্থনীতি, জনগণের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, অন্য দেশের সাথে সম্পর্ক, শ্রমিক-কৃষক-পেশাজীবী, সুশীলসমাজ ইত্যাদির সমন্বয়ে রাজনীতির পরিসীমা নির্ণীত হয়।
রাজনীতি পরিসীমার অভ্যন্তরীণ উপাদানগুলো সময়ের ব্যবধানে নিরন্তর নানা অভিঘাতে বৈচিত্র্যময় হয়ে ওঠে। যেহেতু রাজনীতি সামাজিক কার্যকলাপ হিসেবে বিবেচিত হয়, তাই সমাজভুক্ত পরস্পরবিরোধী গোষ্ঠীর সঙ্ঘাত থেকে রাজনীতির আবির্ভাব হয় বলে অনেক পণ্ডিত সমাজবিজ্ঞানের বিচারে রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিশ্লেষণ করে থাকেন।
তবে রাজনীতিচর্চা তার ঐতিহাসিক বিকাশের প্রক্রিয়ায় আদিম বন্য বর্বর অবস্থা থেকে রাষ্ট্রের উদ্ভবকালে রাজন্যবর্গ, অভিজাততন্ত্র, জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরাচার, একনায়কতন্ত্র, একদলীয় নাৎসি ও ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা, মার্কসবাদী সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং উদার ও বহুত্ববাদী গণতন্ত্রকে ঘিরে রাষ্ট্র, সরকার ও শাসনের স্বরূপ নানা যুগে নানা দেশে পৃথিবীর মানুষ নানাভাবে অবলোকন করেছে। রাজনীতিশাস্ত্রের চর্চা, সরকার, সেনাবাহিনী ও যুদ্ধবিগ্রহের মধ্যে আটকে না থেকে আধুনিক যুগে বৃহত্তর সমাজে প্রবেশ করেছে। সেই থেকে রাষ্ট্রের সংগঠিত নাগরিকেরা রাষ্ট্র ও সমাজের নানা প্রয়োজন যেমন সার্বভৌমত্ব, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, ধর্ম, ক্রীড়া ইত্যাদি নিয়ে ভেবেছেন এবং এর ফলে নানা পরস্পরবিরোধী মতবাদের উদ্ভব ঘটিয়ে সঙ্ঘ গড়ে তুলেছেন। মানবসমাজের অগ্রগতির ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্র, সরকার, জনসমাজ ও জনজীবনের নানামুখী বিষয় নিয়ে চিন্তাশীল মানুষের যুক্তিতর্কের মধ্য দিয়ে যে মতবাদ গড়ে ওঠে, তাতে আবর্তিত হয়েই ক্রমান্বয়ে জনসমাজে রাজনৈতিক দলের উৎপত্তি ঘটে। রাষ্ট্র, সরকার, জনগণ ইত্যাদি নিয়ে মানুষের ভাবনাকে আমরা রাজনৈতিক ভাবনা বলে অভিহিত করতে পারি, যা রাজনৈতিক মতবাদে পরিণতি লাভ করে। এভাবেই রাজনৈতিক চিন্তা অগ্রগতির ক্রমধারায় নাগরিকদের সামষ্টিক চেতনায় আধুনিক স্তর লাভ করে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে রাজার মতাকে কেন্দ্র করে পার্লামেন্টে টোরি ও হুইগরা তুমুল ঝগড়ার সূত্রপাত করেন। ইংল্যান্ডে রাজার উত্তরাধিকার ও স্বর্গীয় চরম মতার অধিকার নিয়ে বিতর্ক তিক্ততায় পরিণত হয়। বহু বাদানুবাদের পর টোরিরা হুইগদের অনুকরণে রাজার স্বর্গীয় মতার কিছুটা কর্তন করতে রাজি হন এবং সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের মতবাদ গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রের প্রকৃতি ও সরকারের স্বরূপ নিয়ে পার্লামেন্টে ও বাইরে ইংল্যান্ডে চিন্তাশীল মানুষের যুক্তিতর্ক রাজনৈতিক মতবাদ হিসেবে রণশীল ও উদার মতবাদে মূর্ত হয়ে ওঠে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে যুক্তরাষ্ট্রেও ফেডারেল সরকার ও স্থানীয় সরকার বিতর্কে দুজন প্রেসিডেন্ট জড়িয়ে পড়েন। বিতর্কের পরিণতি লাভ করে ভোটাভুটিতে এবং এতে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা জয় লাভ করে। এরপর সেখানে ফেডারালিস্ট ও অ্যান্টি-ফেডারালিস্ট এ দুটি মতবাদের ধারাবাহিকতায় যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলগুলো উৎপত্তি লাভ করেছে।
ওপরের উদাহরণগুলো চিরায়ত গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলের বিবর্তনপ্রক্রিয়া। উদারবাদী বহুমাত্রিক চেতনা আধুনিক মননেরই আবিষ্কার, তবে দেশে দেশে প্রাচীনকাল থেকেই এটি ভিন্নমাত্রায় বিদ্যমান ছিল। সমাজে বিভিন্ন গোষ্ঠীর স্বার্থের সঙ্ঘাত, আবার নিজেদের কল্যাণচিন্তার বৈচিত্র্যের কারণেই বহুত্ববাদী চিন্তা সেই প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ চর্চা করে এসেছিল। মানবসমাজে বহু মত ও পথের অস্তিত্বের কারণে রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব ঘটেছে বিশ্বব্যাপী। অবশ্য যুগে যুগে নিষ্ঠুর শাসকেরা মানুষের বহুত্ববাদী চিন্তাকে নির্মূল করে দুঃশাসন চালু রেখেছিল। অনেক দেশে বিংশ শতাব্দীতে এবং এখনো দুঃশাসনের দৃষ্টান্ত রয়েছে, টিকে আছে একদলীয় একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। একদলীয় রাষ্ট্রে দলের কাছে শর্তহীন আনুগত্যই জনগণের জন্য নির্ধারিত।
আধুনিককালে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রগুলোর সমান্তরালে একক রাজনৈতিক দলের one party state গুলো সম্পর্কে আমাদের ধারণা আছে। তথ্যের মুক্ত প্রবাহ বহুদলীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এমন একটি প্রাণশক্তি, যার কারণে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী জাতীয় কোনো ইস্যুতে তর্ক-বিতর্কে অংশগ্রহণ করে ইস্যুটির সঠিক বিচার করতে পারে; কিন্তু একদলীয় রাষ্ট্রে one point of view বা একমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি জনগণের মধ্যে উপস্থাপিত করা হয়, যা সত্যও হতে পারে, আবার নাও পারে; কিন্তু সেটিকে নিয়ে জনগণকে তর্ক-বিতর্ক করার অনুমোদন দেয়া হয় না। মানবপ্রকৃতি শরীর ও মনকে যেকোনো ধরনের খোঁয়াড় বা বন্দিশালায় রাখার বিরোধী। একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে জাতীয় ইস্যু নিয়ে সরকারি দল ও বিরোধী দলে মতামতের প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে তর্কিত বিষয়টির সূক্ষ্ম বিচার নিশ্চিত করা যায় এবং একটি ইতিবাচক পরিণতিতে উপনীত হওয়া যায়। একদলীয় অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জাতীয় যেকোনো ইস্যুতে প-েবিপে বিতর্কের অনুপস্থিতিতে নিরপে বিচারের কোনো সুযোগ থাকে না। সেখানে ইস্যুটির রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণই বড় কথা। কারণ, সেখানে বিরোধী মতামতের কোনো সুযোগ থাকে না। ইস্যুটির যৌক্তিক পরিণতির জন্য পরস্পরবিরোধী বিতর্কের মধ্য দিয়ে স্বচ্ছ বিচারের প্রক্রিয়ায় যে নৈতিক মান ফুটে ওঠে, তা স্বীকার করা হয় না। একদলীয় রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তি জনপ্রিয় হলেও ধীরে ধীরে অলৌকিক মতার দেউলে অধিষ্ঠান করতে থাকেন স্বার্থপর পূজারিদের অর্চনায়। কারণ, তখন তার টিকে থাকার জন্য জনগণের মতামতের প্রয়োজন হয় না। এ অবস্থায় পূজারিদের সাড়ম্বর উপস্থিতি সর্বত্র দেখা যায়।
এ ধরনের রাষ্ট্র ক্রমাগতভাবে রাজনৈতিক শূন্যতার দিকে এগিয়ে যায়। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ইচ্ছার প্রতিফলনের অভাবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ভঙ্গুর হয়ে পড়ে, শূন্যতা গভীর থেকে গভীরতর হয়। ইউরোপে একটি প্রবাদ আছে Nature abhor vaccum. অর্থাৎ প্রকৃতি শূন্যতাকে ঘৃণা করে।তাই এ রকম রাজনৈতিক পরিস্থিতির উদ্ভব হলে কালবৈশাখীর হুঙ্কার শোনা যাবেই, শূন্যতাকে পূরণ করতে ধেয়ে আসা ঝড়ো হাওয়া সব কিছু ওলটপালট করে দেবেই। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে কিছুটা অরাজকতা থাকবেই, কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে রাষ্ট্রের প্রাণশক্তিকে দুর্বল করলে রাষ্ট্র নিজেই তীব্র প্রতিশোধ হানে।
রাষ্ট্রের প্রাণশক্তি দুর্বল হয় জনগণের কণ্ঠরোধে, বিবেক, চিন্তা ও উপাসনার অধিকার সঙ্কুচিত করে বিরোধী দলগুলোর গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করার মধ্য দিয়ে। ১৯৭২-৭৫ সাল ছিল রাষ্ট্রের প্রাণশক্তিকে নিস্তেজ করার এক ধারাবাহিক কর্মসূচি। দানবীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বাকশাল কায়েম করে চৈতন্যহীন অন্ধশক্তি হুড়মুড় করে ভেঙে ফেলে নির্মাণাধীন গণতন্ত্রের কাঠামো। শুরু হলো রাষ্ট্রকে দুর্বল করার পালা, ছড়িয়ে পড়ল রাজনৈতিক শূন্যতা। অনেক ঝড়ঝঞ্ঝার পর সেই শূন্যতা অনেকখানি পূরণ হয়েছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে। কারণ, দলটি বহুদলীয় গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, মানুষের নাগরিক স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিয়ে রাষ্ট্রের প্রাণশক্তিকে সবল করে তুলতে সম হয়েছিল।
রিজভী আহমেদ : বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads