রবিবার, ১৭ আগস্ট, ২০১৪

গণতন্ত্রের সড়ক ছেড়ে ভুল পথে সরকার

আওয়ামী লীগ দলটির একটি বড় মাপের সমালোচনা হচ্ছে দলটি সরকারের বাইরে থাকলে দলনেতাদের মুখে গণতন্ত্রের বুলি আর ক্ষমতায় গেলেই এ দলটি গণতন্ত্রের পথ থেকে সরে যায়, চলে স্বৈরতন্ত্রের পথে। এ সমালোচনাটি যথার্থ কার্যকারণেই বলা ভুল হবে না। কারণ এ সমালোচনাটি যেমন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের বেলায় সত্য, তেমনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের বেলায়ও যথার্থ। কারণ এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে আমরা যেমন দেখেছি সারা জীবন জেল-জুলুম উপেক্ষা করে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করতে, তেমনি বাংলাদেশের শাসনক্ষমতায় এসে তাকে দেখেছি একদলীয় বাকশালী ব্যবস্থা কায়েম করে নিজেকে আজীবন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করতে। অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, তিনি বাকশাল নামের একদলীয় শাসনের সূচনা করেছিলেন, তার মধ্য দিয়েই তিনি ছিটকে পড়েছিলেন গণতন্ত্রের মহাসড়ক থেকে। বঙ্গবন্ধুর প্রবল সমর্থক ও সমালোচক সবাই তা স্বীকার করেন। অপর দিকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে আমরা দেখেছি গণতন্ত্র ও জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করার আন্দোলনের মাঝে মাঠ গরম করতে। আর তিনিই যখন আবার ক্ষমতায় আসীন, তখন তারই দল যেন মরিয়া হয়ে ওঠে জনগণের ভোটের অধিকার, নাগরিকসাধারণের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণে নানা অযৌক্তিক ও অনৈতিক কূটকৌশলের মাধ্যমে। এরই অংশ হিসেবে দেশের বেশির ভাগ মানুষের চাওয়া নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন না দিয়ে ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন ও প্রতিদ্বন্দ্বীবিহীন এমন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাকে আঁকড়ে ধরে রাখলেন, যা দেশের ভেতরে ও বাইরের বিভিন্ন মহলের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এই নির্বাচনে অর্ধেকেরও বেশি আসনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ছিলেন না। জেনারেল এরশাদকে সিএমএইচে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে পাঠিয়ে রওশন এরশাদকে দিয়ে নানা নাটকীয় ঘটনার জন্ম দিয়ে জাতীয় পার্টিকে যেভাবে নির্বাচনে নেয়া হলো এবং রওশন এরশাদকে দিয়ে যেভাবে পালাপোষা বিরোধী দল গঠন করে তাকে বিরোধীদলীয় নেতা বানানো হলো কাগজে-কলমে, আবার জাতীয় পার্টি থেকে সরকারের মন্ত্রী বানানো হলো, একপর্যায়ে জেনারেল এরশাদকে বানানো হলো প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এসবই শুধু হাসির খোরাক হয়েছে দেশ-বিদেশের মানুষের। এ প্রক্রিয়াকে গণতন্ত্রের কোনো সংজ্ঞায় ফেলা যায় না। সরকারেও আছি, বিরোধী দলেও আছি বলে যারা গাছেও খাবো তলায়ও কুড়াবোনীতি নিয়ে  আজ এই অদ্ভুত সরকারের সহযোগিতা করে চলেছেন, ভবিষ্যতে তারা জনগণের দরবারে কোন অভিধায় অভিহিত হবেন তা এই সময়ে আন্দাজ-অনুমান করা কঠিন। এই যে ক্রিয়াকাণ্ড বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার চালিয়ে যাচ্ছে, তা বিবেকবান কোনো মানুষই মেনে নিতে পারছেন না। বিবেকবান মানুষ খোলাখুলিই বলছেন, এ সরকার জনগণের সরকার নয়। কারণ যে নির্বাচনের ওপর ভর করে আজ ক্ষমতায়, সে নির্বাচনে জনগণকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। সব দলের অংশগ্রহণ এ নির্বাচনে ছিল না। এ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নেতানেত্রীরা বলেছিলেন, এ নির্বাচন নিয়ম রক্ষার নির্বাচন। সরকারকে বাধ্য হয়ে এ নির্বাচন করতে হচ্ছে। এ নির্বাচনে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তাই এরা বলেছিলেন, ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর সব দলের অংশগ্রহণে নতুন করে নির্বাচন দেয়া হবে; কিন্তু ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ নেতারা সুর পাল্টে এখন খোলাখুলিই বলছেন, পাঁচ বছরের আগে কোনো নির্বাচন নয়, বিএনপিকে পাঁচ বছর অপেক্ষায় থাকতে হবে। কারণ বিএনপি নির্বাচনী ট্রেন ফেল করেছে। তা ছাড়া পাঁচ বছর পর আবারো শেখ হাসিনার সরকারের অধীনেই বিএনপিকে নির্বাচনে আসতে হবে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না। এ নিয়ে বিএনপির সাথে কোনো সংলাপও হবে না। আওয়ামী লীগ নেতাদের কেউ কেউ এ-ও বলছেন, সংলাপের আগে বিএনপিকে ৫ জানুয়ারির নির্বাচিত সরকারকে বৈধতা দিতে হবে। আওয়ামী লীগের এই অবস্থান নিশ্চিতভাবেই গণতান্ত্রিক কোনো আচরণ নয়। একই ধারাবাহিকতায় ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর আমরা একটি জাতীয় দৈনিকে খবর প্রকাশ হতে দেখলাম কারাগারে ঠাঁই নাইশিরোনামে। এ খবরে বলা হয়, ‘ঠাঁই নেই দেশের কারাগারগুলোতে। রাজনৈতিক ধরপাকড় আর গণগ্রেফতারের কারণে বন্দীতে ঠাসা হয়ে উঠছে কারাগারগুলো। নিত্যনতুন বন্দীদের ভারে রীতিমতো উপচে পড়েছে দেশটির ৬৮টি কারাগার। ধারণক্ষমতা ২৯ হাজার হলেও বর্তমানে সেখানে রয়েছেন ৭০ হাজারেরও বেশি বন্দী। ...বন্দীদের বেশির ভাগই বিরোধী দলের নেতাকর্মী। Ñবাংলাদেশ প্রতিদিন, ১১ জানুয়ারি, ২০১৪।

একই দিনে এই পত্রিকাটির খবরে বলা হয়েছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক বিশাল জনসভায় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার উদ্দেশে বলেছেন ‘অনেক হয়েছে, এবার ক্ষান্ত হন। হরতাল-অবরোধ দিয়ে মানুষের জীবন ধ্বংস করা, খুনখারাবি করা বন্ধ করুন। এসব বন্ধ না করলে, কিভাবে বন্ধ করতে হয় তা আওয়ামী লীগের জানা আছে। মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দিতে, শান্তি নিশ্চিত করতে যত কঠোর হওয়া দরকার, তত কঠোর হবো।তার এ ধরনের হুমকি বিরোধী দলের দমন-পীড়নে তিনি ও তার দল কত যে মারমুখী, তা অনুমেয়। তার পুরো শাসনামলে তা কোন মাত্রায় চলেছে এবং এখনো চলছে, তা দেশের কোনো মানুষের অজানা নয়। সে জন্যই আওয়ামী লীগের জন্য এ সমালোচনা যথার্থ অর্থেই সত্য যে দলটি বিরোধী দলে থাকলে মুখে নেয় গণতন্ত্রের বুলি, আর ক্ষমতায় গেলে গণতন্ত্রের পথ ছেড়ে হয়ে ওঠে চরম স্বৈরতন্ত্রী। আর এ জন্য দলটির চূড়ান্ত লক্ষ্য সব বিরোধী দলকে অস্তিত্বহীন করে দেশে একদলীয় শাসন কায়েম করা।

দলটি যে গণতন্ত্র ছেড়ে সে দিকেই ধাবমান, তা সময়ের সাথে ক্রমেই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে। বিষয়টি এখন আর আওয়ামী নেতারা কোনো রকম রাখঢাক করে বলছেন না। বলছেন খোলাখুলি, জনসমক্ষে। বঙ্গবন্ধুর ৩৯তম মৃত্যুবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে গত ১৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেছেন, ‘গণতন্ত্র দিয়ে বিশ্বের কোনো রাষ্ট্র এগোতে পারেনি। গণতন্ত্র দিয়ে দেশের উন্নয়ন হয় না।

জানি না গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে মাহবুব-উল আলম হানিফের বক্তব্য তার একান্ত ব্যক্তিগত, না দলগত নীতিনির্ধারণী বক্তব্য। আর জানি না, গণতন্ত্র প্রশ্নে তার ও তার দলের মধ্যে কেন এ ধরনের বিতৃষ্ণা জন্ম নিয়েছে। আমাদের মনে হয়, তিনি ভালো করে জানেন Democracy শব্দটির উৎপত্তি demos kratosএই দুটি গ্রিক শব্দ থেকে। আর শব্দ দুটির অর্থ যথাক্রমে people (জনগণ) এবং power or rule  (ক্ষমতা বা শাসন)। আর Democracy is a form of Government in which the rulers are elected by the people| তিনি এও জানেন, আব্রাহাম লিঙ্কন বলে গেছে Democracy is government of the people, by the people and for the people-এর সরল অর্থ গণতান্ত্রিক সরকার হবে জনগণের সরকার, সে সরকার হবে জনগণের জন্য আর জনগণই গঠন করবে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে। অতএব, এটুকু স্পষ্ট ভোটারবিহীন, প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকার গঠিত, সে সরকার গণতান্ত্রিক সরকার হতে পারে না। সে জন্যই মাহবুব-উল আলম হানিফ ও অন্য আওয়ামী লীগ নেতারা আজ কথা বলছেন গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে। বলছেন গণতন্ত্র দিয়ে দেশ এগোতে পারে না, গণতন্ত্র দিয়ে দেশের উন্নয়ন হয় না।

গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ নেতাদের বিপ্রতীপ উচ্চারণের কারণ হতে পারে, এরা হয়তো গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলোও জেনে গেছেন, যা মেনে চলতে তাদের রীতিমতো কষ্ট হচ্ছে। গণতন্ত্রের বহু বৈশিষ্ট্যের মধ্য থেকে এখানে কয়েকটি কথা উল্লেখ করছি : 01. In a democracy the final decision making power must rest with those who are elected by the people, 02. A democracy must be based on a free and fair election, where those currentyly in power have a fair chance of losing, 03. In a democracy, each adult citizen must have one vote and each vote must have one value, 04. A democratic government rules within limits sets by constitutional law and citizens right, 05. The opposition parties are allowed to function freely before and after the elections and 06. The democratic governments are based on fundamental principles of political equality.

সুপ্রিয় পাঠক, এই বৈশিষ্ট্যগুলো একটি একটি করে বিবেচনায় আনলে স্পষ্ট হয়ে যাবে ৫ জানুয়ারির মাধ্যমে গঠিত সরকার কী মাত্রায় গণতান্ত্রিক গণ্ডির মধ্যে আছে, আর কতটুকু নেই। এসব বৈশিষ্ট্য থেকে গণতান্ত্রিক বলয়ের যে সীমা-পরিসীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে, সে ব্যাপারে সরকারের যে এরই মধ্যে ধৈর্যচ্যুতি ঘটে গেছে, তা-ও সরকারের নানা পদক্ষেপ ও মন্ত্রীদের কথা থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে।

গণতান্ত্রিক রীতিনীতি পায়ে দলে ভিন্ন পথে হাঁটতে গেলে এ ধরনের সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে ওঠে অবাধ গণমাধ্যম এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। তাই সরকার এখন মরিয়া কী করে গণমাধ্যমের পায়ে বেড়ি পরানো যায়, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে খাঁচায় বন্দী করা যায়। সে জন্যই সরকার নিয়ে এসেছে সম্প্রতি বহুল সমালোচিত সম্প্রচার নীতিমালা। দেশের বিশিষ্ট নাগরিক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিরা সম্প্রতি সরকারের ঘোষিত জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রণীত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। তাদের মতে, দেশে প্রকৃতপক্ষে বিরোধী দল না থাকায় সরকার গণমাধ্যমকে বিরোধী দল হিসেবে বেছে নিয়েছে। গণতন্ত্রকে হত্যার জন্য সর্বশেষ হাতিয়ার হিসেবে গণমাধ্যমের কণ্ঠ রোধ করতে চাইছে সরকার। আর এ জন্য সম্প্রচার নীতিমালার নামে গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে এ সরকার। গত ৭ আগস্ট নাগরিক ঐক্য আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিয়ে বক্তারা এসব কথা বলেন।

অপর দিকে দৈনিক মানবজমিনকে দেয়া অভিমতে দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বলেছেন এ নীতিমালা স্বাধীন গণমাধ্যম ধারণার পরিপন্থী। সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে বাকস্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার আটটি বিষয়কে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। এর বাইরে পার্লামেন্ট বা অন্য কারো ক্ষমতা নেই, যাতে এরা বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে। সংবিধানের সাথে এ নীতিমালা সাংঘর্ষিক। নীতিমালায় কমিশন গঠন করার কথা বলা হলেও মূল ক্ষমতা সরকারের হাতেই থাকবে। এরা এই নীতিমালাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী বলেও অভিমত দেন। এসব অভিমতদাতাদের মধ্যে রয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ, একই বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক শহীদুজ্জামান, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী, বিশিষ্ট সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান ও রাজনীতি বিশ্লেষক ড. মাহবুব উল্লাহ। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মহল এ নীতিমালার প্রবল সমালোচনা সত্ত্বেও সরকার এ নীতিমালা প্রণয়ন ও ঘোষণা শেষে এবার বাস্তবায়নে ব্যস্ত। যদিও জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালার আইনি কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কারণ, সংবিধান বলেছে আইন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে; নীতিমালা দিয়ে করা যাবে না। ওই আদালত একাধিক রায়ে বলেছেন, নীতিমালার কোনো আইনগত কার্যকারিতা নেই। তাই সমালোচিত এই নীতিমালার আইনি ভিত্তি প্রায় শূন্যের কোঠায়।

গণতন্ত্রের স্বাভাবিক গতিকে বাধাগ্রস্ত করতে এ সরকার সংবিধান সংশোধন করে জনমতের বিরুদ্ধে সংবিধান থেকে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনী ব্যবস্থা আবার চালু করেছে। নিয়েছে নানা আইনি উদ্যোগও। এরই অংশ হিসেবে সরকার আবারো সংবিধান সংশোধন করতে যাচ্ছে। এবার ইস্যু আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দেয়া। আইন মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যেই ১৬তম সংবিধান সংশোধন বিলের খসড়া প্রণয়ন করেছে। মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর আগামী অধিবেশনে বিলটি উত্থাপনের সম্ভাবনা রয়েছে। এ দিকে উচ্চ আদালতে এ বিল চ্যালেঞ্জ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশের সিনিয়র আইনজীবীরা মনে করেন, বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দিলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে ুণœ হবে। এর ফলে বিচার বিভাগ সংসদের মুখাপেক্ষী হবে এবং নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা বাড়বে। এভাবে সরকার গণতন্ত্রবিরোধী নানা পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের নানা উদ্যোগ সরকারের স্বৈরতান্ত্রিক আচরণকে আরো বাড়িয়ে তুলবে। সরকার চাইছেও তাই। তাই তো আওয়ামী নেতাদের মুখে আজ গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিষোদগার। শুধু আওয়ামী লীগ নেতারাই নন, আওয়ামী লীগ ঘরানার যেসব ব্যক্তি টকশোতে অংশ নেন, তাদের মুখ থেকেও মুখফসকে হোক কিংবা সচেতনভাবেই হোক গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বলতে শোনা যাচ্ছে। কয়েক দিন আগে আওয়ামী ঘরানার এমন একজনকে বলতে শুনলামÑ গণতন্ত্র না-ই বা থাকল। দেশে উন্নয়নই বড় কথা। এটাই যেন এখন হয়ে উঠেছে আওয়ামী সরকারের অন্তর্নিহিত নীতি। এর ফলে দেশে আজ গণতান্ত্রিক সরকারের বৈশিষ্ট্যগুলো অনুপস্থিত। এ অবস্থায় গণতন্ত্রের নামে যে শাসন চলছে তাতে জনগণ বঞ্চিত হচ্ছে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে। তাদের জানমালের নিরাপত্তা নেই, বিচার পাওয়ার জায়গাটুকুও অবশেষ নেই। বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংগঠন ও সংস্থার মতামত উপেক্ষা করে সরকার ক্ষমতাকে আঁকড়ে ধরে রাখার জন্য যেমনটি চাইছে, তেমনটিই করে যাচ্ছে। এভাবে দেশকে সরকার কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? মার্কিন কূটনীতিক উইলিয়াম বি. মাইলাম এ ব্যাপারে সম্প্রতি উদ্বেগজনক মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘রক্তপাতের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতার ৪৩ বছরেরও বেশি সময় পর বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল দৃশ্যত একদলীয় কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনব্যবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে। মিডিয়ার ওপর কড়াকড়িবিষয়ক আইন প্রণয়ন হলো সে লক্ষ্যে সর্বশেষ পদক্ষেপ। এনজিওগুলোকে চাপে রাখার আইন করা হয়েছে। বিরোধী কণ্ঠও নীরব করে দেয়া হয়েছে। যদি সব বিরোধী দল এক না হয়, ঐক্যবদ্ধ না হয়; তাহলে একসময় তাদের আর সিদ্ধান্ত নেয়ার কোনো সুযোগই থাকবে না। আমি কিছু একটা ইঙ্গিতের অপেক্ষায় আছি এখন।’ 

এ দিকে দেশের প্রবীণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. তালুকদার মনিরুজ্জামান বলেছেন, “সরকার ভুলপথে হাঁটছে। হঠাৎ করে নতুন সম্প্রচার নীতিমালা প্রণয়ন ও বিচারপতিদের জবাবদিহিতা বর্তমান প্রশ্নবিদ্ধসংসদের হাতে তুলে দেয়ার চিন্তাভাবনা সরকারের ভুল নীতিরই অংশ। এ ছাড়া ২০১৯ সালের আগে কোনো নির্বাচন নয়, সরকারের নীতিনির্ধারকদের এমন বক্তব্য সঠিক বলে আমি মনে করি না। যেহেতু ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে দেশী-বিদেশী মহলে প্রশ্ন উঠেছিল, এ ছাড়া দেশের মানুষ ভোটকেন্দ্রে যায়নিÑ তাই একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন দেয়া জরুরি। ক্ষমতাসীনদেরই এ উদ্যোগ নিতে হবে।বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৬ আগস্ট ২০১৪।

আওয়ামী লীগ সরকার ও সরকারি দলের নেতাদের উদ্দেশে বলা দরকার, গণতন্ত্রের মহাসড়কে আজ আপনারা ভুল পথে হাঁটছেন। আমাদের মনে রাখতে হবে, গণতান্ত্রিক সরকারই অধিকতর গ্রহণযোগ্য সরকার। কারণ, এ ধরনের সরকারেরই জনগণের কাছে সবচেয়ে বেশি মাত্রায় জবাবদিহি থাকে। গণতন্ত্রই পারে সিদ্ধান্ত নেয়ার মান উন্নত করতে। মতপার্থক্য ও দ্বন্দ্ব নিরসনের সহজ সুযোগ রয়েছে এই গণতন্ত্রেই, ভিন্ন কোনো পথে নয়। বহু ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতির দেশে জনগণের ঐক্য ধরে রাখার প্রক্রিয়া বিদ্যমান এই গণতন্ত্রে। গণতন্ত্রে স্থায়ী বিজয়ী বা বিজিত কেউ থাকে না, গণতান্ত্রিক সরকারই সর্বোত্তম। কারণ এখানে আমাদের সংশোধনের সুযোগ থাকে। গণতন্ত্রই জোরদার করতে পারে দেশের জনগণের মর্যাদা। গণতন্ত্রই সুযোগ করে দেয় দেশের সবচেয়ে গরিব ও সবচেয়ে অশিক্ষিত মানুষটির মর্যাদা সবচেয়ে বেশি ও শিক্ষিত লোকটির সমান হতে। গণতান্ত্রিক সমাজেই মানুষ সর্বাধিক সুযোগ পায় নিজের পছন্দের কাজ বেছে নেয়ার, অবাধে কাজ চালিয়ে যাওয়ার আর এর মাধ্যমেই আসে দেশ, জাতি ও ব্যক্তিবিশেষের সার্বিক উন্নয়ন। অতএব আমাদের কারো সুযোগ নেই এ কথা বলার গণতন্ত্র দিয়ে দেশের উন্নয়ন হয় না। আর এ কথা বলে গণতন্ত্রের পথ ছেড়ে স্বৈরতন্ত্রের অন্ধগলিতে পা রাখারও যৌক্তিকতা পাওয়া যায় না। একদলীয় শাসনব্যবস্থা ফিরে পাওয়াও এক ধরনের রাজনৈতিক পাপ। অতএব, গণতন্ত্রের পথেই হোক আমাদের অবিরাম চলা। এর বাইরে চললে হোঁচট খেতে হয়, আমাদের ইতিহাসও সে কথাই বলে। 

গোলাপ মুনীর

 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads