বুধবার, ৬ আগস্ট, ২০১৪

ঠুলি পরছে সরকার


২০০৮ সালের ডিসেম্বরে সেনাবাহিনী, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতীয় সরকারের সাথে আঁতাত করে ক্ষমতায় আসীন হয়েছিল এই সরকার। তারপর একের পর এক রাষ্ট্র ধ্বংসমূলক, সমাজ বিনাশমূলক অর্থনীতির গোরদানমূলক পদক্ষেপ সরকার গ্রহণ করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার ইমার্জিং টাইগার বাংলাদেশ এখন নিতান্তই এক অর্থনৈতিক ইঁদুরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনৈতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান সাস মন্তব্য করেছিল যে, দেশে গণতান্ত্রিক স্থিতাবস্থা ও নাগরিক স্বাধীনতা থাকলে ২০১৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বে একটি অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হবে। বাংলাদেশের সেই উজ্জ্বল সম্ভাবনাকে ভারতীয় মদত ও প্ররোচনায় একেবারে মুখ থুবড়ে দিয়েছে সরকার। এখন কোথায়ও কোনো সুখবর নেই।
২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসীন হয়েই এই সরকার অত্যন্ত অসহিষ্ণুভাবে বিরোধী দল নির্মূলের জন্য উঠে পড়ে লেগে যায়। কিন্তু গণতন্ত্রের তো সেটা নিয়ম ছিল না। বিরোধী দলকে গ্রহণ করে, সহ্য করে, তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা ত¦রানি^ত করতে হয়। এবং লক্ষণীয় বিষয়, যে দেশের মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা যত বেশি, সে দেশের অর্থনীতিক উন্নতিও ঘটেছে ততই দ্রুত। কিন্তু বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকার একেবারে উল্টোপথে হাঁটতে শুরু করেছেন। ভিন্নমত সম্পূর্ণ অসহ্য ও অগ্রহণযোগ্য।
প্রথমেই তিনি হামলে পড়েছিলেন প্রাইভেট টিভি চ্যানেলগুলোর উপর। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বৈশিষ্ট্য এই যে, আপনি দেখলেন, জানলেন, শুনলেন, ভুলে গেলেন। কিন্তু প্রিন্ট মিডিয়া বা খবরের কাগজ এমনই এক মিডিয়া যা চিরস্থায়ী হয়ে থাকে। একই ঘটনা বার বার দেখা যায়, পড়া যায়। সংশয় হলে বার বার সত্যতা যাচাই করে নেওয়া যায়। ফলে কোনো মিডিয়াই শেখ হাসিনার সরকারের কাছে আমোদের ব্যাপার থাকে না। তার কথাবার্তায় বোঝা গেছে, তিনি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর টকশো নিয়মিত দেখেন। তার হয়তো ধারণা, এই বাংলাদেশের ১৬ কোটি লোক তার পূজারী হয়ে অবিরাম বন্দনা করে যাবে। সমালোচনা করতে পারবেন না।
সেই কারণেই তিনি বহুবার উষ্মার সঙ্গে বলেছেন, টেলিভিশনের টকশোগুলো খুবই ‘টক’। সরকারের অপকর্ম, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, লুণ্ঠন সীমাহীন। টেলিভিশন টকশোগুলোতে সাম্প্রতিক বিষয় হিসেবে এসব তো আলোচনায় আসবেই। আলোচনায় এলে আলোচকরা সংশ্লিষ্ট ঘটনা সম্পর্কে যার যার নিজস্ব মত প্রকাশ করবেন। সেখানে সরকারের সমালোচনা থাকবে। থাকবেই তো। প্রধানমন্ত্রীর চারপাশে গুণ-কীর্তন করার স্তাবকের তো অভাব নেই। তারপরেও টেলিভিশনে কেন প্রধানমন্ত্রীর স্তাবক চাই। এ কথা সত্য যে, শেখ হাসিনার অবিরাম দাবড়ানিতে টেলিভিশনের টকশোগুলোতে আস্তে আস্তে বিদায় নিয়েছেন সত্যভাষী অস্তাবকের দল। তাদের ডাকতে মানা। কথা বলতে মানা। আর যতগুলো বেসরকারি টিভি চ্যানেল রয়েছে তার সবগুলোই সরকারের খয়ের খাঁদের পরিচালিত। সেখানে যারা সাংবাদিকতা করেন, তারা হয় সরাসরি সরকারের স্তাবক। অথবা চাকরি রক্ষার্থে সরকারের স্তাবক হতে বাধ্য হয়। ফলে ভিন্নমত ইতিমধ্যেই অনেকখানি তিরোহিত।
তারপরেও প্রতিযোগিতামূলক বাজারে এসব টিভি চ্যানেলগুলোকে বিজ্ঞাপন আকর্ষণের স্বার্থে কিছু না কিছু সত্য তুলে ধরতেই হয়। সেটিও সরকারের কাছে রীতিমত অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। টিভি টকশোগুলোতে যারা সরকারের সমালোচনা করেন তাদের কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নেই। উদ্দেশ্য একটাই, চাটুকার পরিবেষ্টিত সরকার যেন দেশের প্রকৃত চিত্র সম্পর্কে কিছুটা ওয়াকিফহাল থাকতে পারেন। এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিলে সরকারেরও কল্যাণ, জনগণেরও কল্যাণ। কিন্তু রাধিকা উল্টো বুঝেছে। তার মনে হয়েছে, চতুর্দিকে কেবলই তার কীর্তন ধ্বনি উঠুক। সবাই নামকীর্তনের মতো গাইতে থাকবে, ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম।’
কিন্তু বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতা রক্ত করবীর রাজার দেউল নয়। সেখানে সবাই তার কীর্তন গাইবে না। জোর করে কাউকে ফাঁসি দেওয়া যায়। হত্যা করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া যায়। তার সম্পদ লুণ্ঠন করে নেওয়া যায়। কিন্তু তার ভালবাসা পাওয়া যায় না। প্রধানমন্ত্রী লেখাপড়া জানলেওয়ালী লোক। ধারণা করি, তিনি সম্ভবত শওকত ওসমানের ‘ক্রীতদাসের হাসি’ নাটকটি পড়ে থাকবেন। সেখানেও শিক্ষণীয় হলো, অর্থ-বিত্ত দিয়ে ক্রীতদাস কেনা যায়। কিন্তু ক্রীতদাসের হাসি কেনা যায় না। প্রধানমন্ত্রীর চারপাশে অন্ধ পূজারীরা হাসে। সবাই ‘ঠিক, ঠিক’ বলে সাবাসী দেয়। কিন্তু প্রকৃত সত্য তার কাছে কখনোই পৌঁছায় না।
এমনি পূজারী পরিবেষ্টিত হয়ে পড়েছিলেন, শেখ মুজিবুর রহমান। তিনিও, কেন জানি না, যখন ন্যাপ-সিপিবি’র কবলে পড়লেন, তখন তাদের কব্জায় বন্দী হয়ে গেলেন। আর সারা জীবনের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আদর্শ থেকে বিচ্যুৎ হয়ে একদলীয় স্বৈরশাসন কায়েম করলেন। বন্ধ করে দিলেন সকল সংবাদপত্র। তখন বেসরকারি টিভি চ্যানেল ছিল না। ফলে টিভি চ্যানেল বন্ধ করার প্রশ্ন ওঠে না। ধারণা করি, বেসরকারি টিভি চ্যানেল থাকলে তাও তিনি বন্ধই করে দিতেন।
প্রকৃতপক্ষে, বিরোধী মতের সংবাদপত্র বা ইলেকট্রনিক মিডিয়া সরকারের তৃতীয় নয়নের কাজ করে। স্তাবকরা তার কাছ থেকে যা আড়াল করে, এসব মিডিয়া সেগুলো তার সামনে তুলে ধরে। ফলে সরকারের জন্য সুষ্ঠু চিন্তার অবকাশ তৈরী হয়। কিন্তু শেখ হাসিনা তা চান বলে মনে হয় না। আর আশ্চর্য আর উদ্বেগের ঘটনা হলো, তিনিও এখন সাবেক কমিউনিস্ট ও সমাজতন্ত্রীদের হাতে বন্দী। তাদের পরামর্শেই ঠিক করছেন কী করা যায়। এই বৃত্ত তাকে নিজেদের কব্জায় নেওয়ার জন্য ‘র‌্যাটস’খ্যাত তোফায়েল আহমেদ গং- কী যে বলছেন, কী যে করছেন, তার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। সেগুলো তাদের মানাচ্ছে কিনা সেটি ভেবে দেখারও অবকাশ তাদের নেই। তারাও এখন পূজারীর ভূমিকায়। কিন্তু মনে রাখা ভাল যে, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে বলেছিলেন, তিনি তোফায়েল গং-কে ফরগিভ করেছেন। ফরগেট করেননি। অর্থাৎ ক্ষমা করেছেন। কিন্তু তাদের কৃতকর্ম ভুলে যাননি। ফলে তোফায়েল গং-কে সিপিবি-অলাদের পোঁ ধরেই চলতে হবে।
১৯৭৫ সালের মতো এসব অপলোকদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েই সম্ভবত শেখ হাসিনা সম্প্রতি ইলেকট্রনিক মিডিয়ার জন্য একটি সম্প্রচার নীতিমালা মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদন করিয়ে নিয়েছেন। মুজিবের বিরুদ্ধে যুদ্ধকারী গণবাহিনী নেতা হাসানুল হক ইনু বলেছেন, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই গেজেট হয়ে যাবে। এরপর যাবে সংসদে। তারপর আইন।
এই সম্প্রচার নীতিমালায় বলা হয়েছে,
- সশস্ত্র বাহিনী এবং আইন-শৃঙ্খলায় নিয়োজিত কোনো বাহিনীর প্রতি কটাক্ষ বা অবমাননাকর দৃশ্য বা বক্তব্য প্রচার করা যাবে না।
- অপরাধীদের দ- দিতে পারেন এমন সরকারি কর্মকর্তাদের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করার মতো দৃশ্য বা বক্তব্য প্রচার করা যাবে না।
- জনস্বার্থ বিঘিœত হতে পারে এমন কোনো বিদ্রোহ, নৈরাজ্য ও হিংসাত্মক ঘটনা প্রচার করা যাবে না।
- সংবাদ ও অনুষ্ঠান সম্প্রচারে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি, এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আদর্শ ও নীতিমালা সমুন্নত রাখতে হবে।
- রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘিœত হতে পারে এমন সামরিক, বেসামরিক বা সরকারি তথ্য প্রচার করা যাবে না।
এই নীতিমালার আলোকে সম্প্রচার কমিশন এবং এ সম্পর্কিত আইন প্রণয়ন করা হবে। তবে কমিশন ও আইন না হওয়া পর্যন্ত সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় সম্প্রচার সম্পর্কিত সব সিদ্ধান্ত নেবে। আর কমিশন হলেও তার কাজ হবে তদন্ত করে সুপারিশ করা। শাস্তির ক্ষমতা সরকার তার নিজের হাতেই রাখছে। ফলে তদারকি ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে শেষ কথা সরকারেরই।
এই নীতিমালা অনুযায়ী,
- আলোচনামূলক অনুষ্ঠানে বিভ্রান্তিকর ও অসত্য তথ্য-উপাত্ত পরিহার করতে হবে।
- বেতার-টেলিভিশনসহ সম্প্রচার মাধ্যমকে রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের ভাষণসহ জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান যথাযথভাবে প্রচার করতে হবে।
- সরাসরি বা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে দেশবিরোধী ও জনস্বার্থবিরোধী বক্তব্য প্রচার থেকে বিরত থাকতে হবে।
- টকশোর উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা।
- সব সম্প্রচার প্রতিষ্ঠানকে সরকার বা সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে লাইসেন্স গ্রহণ করতে হবে।
আরও অনেক রশির বন্ধন এই নীতিমালায় আছে। সেদিকে না গিয়েও শুধুমাত্র দুই একটি বিষয় বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। যেমন “সশস্ত্র বাহিনী এবং আইন-শৃঙ্খলায় নিয়োজিত কোনো বাহিনীর প্রতি কোনো কটাক্ষ বা অবমাননাকর দৃশ্য বা বক্তব্য প্রকাশ করা যাবে না। এর অর্থ কী দাঁড়ায়? আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রকাশ্য রাজপথে কিংবা থানার লকআপে পিটিয়ে যদি একজন মানুষকে হত্যা করে, তাহলে কি সে দৃশ্য বা খবর প্রকাশ করা থেকে মিডিয়া বিরত থাকবে? যেমন, মিরপুর থানায় ব্যবসায়ী সুজনকে পিটিয়ে হত্যা করেছে থানার ওসি গোপালগঞ্জের সালাহউদ্দিন। ছবি না হোক, এই খবরও প্রকাশ করা যাবে না? যেমন র‌্যাবের কর্মকর্তারা অর্থের বিনিময়ে নারায়ণগঞ্জের সাতজন মানুষকে খুন করেছে, সেটা এখন প্রমাণিত সত্য। এবং মিডিয়াই সে সত্য প্রতিষ্ঠা করেছে। এই সত্য কি তুলে ধরা যাবে না? সম্প্রচার নীতিমালা অনুযায়ী পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি যত হত্যাকা-ই ঘটাক না কেন তাদের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটিও উচ্চারণ করতে পারবে না ইলেকট্রনিক মিডিয়া।
এর দু’টো ভয়াবহ দিক আছে। একটি দিক হলো, সরকার জনস্বার্থের প্রতি চোখ বন্ধ করেই থাকবে। আর একটি দিক হলো, জনগণকে এই নিপীড়ন নিঃশব্দে মেনে নিতে হবে। একে ফ্যাসিবাদ বললে সম্ভবত খুব কম বলা হয়। সুতরাং আমরা মিডিয়ায় যে যেখানে আছি, এর বিরুদ্ধে আমাদের এখনি প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। অন্যথায় ইলেকট্রনিক বলি, প্রিন্ট বলি, কেউই রেহাই পাবো না। আসুন, মত-পথ ভুলে সকলে মিলে একযোগে সাংবাদিকতার অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে শরীক হই। এখনও যদি আমরা বিভেদে থাকি, তাহলে আমাদের সকলের অস্তিত্বই বিপন্ন হবে।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads