সোমবার, ১১ আগস্ট, ২০১৪

সম্প্রচার নীতিমালা কি সাংবাদিকদের টাইট দেয়ার জন্য?


সম্প্রচার নীতিমালা নিয়ে এখন বেশ আলোচনা-সমালোচনা চলছে। সরকার পক্ষের কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, সাংবাদিকরা ও মালিকরা সম্প্রচার নীতিমালা চেয়েছেন বলেই আমরা সম্প্রচার নীতিমালা দিয়েছি। তাই এ নিয়ে এতো সমালোচনার কী আছে? সাধারণভাবে ভাবতে গেলে নীতিমালাকে তো একটি ভালো জিনিস বলে মনে হয়। নীতি ছাড়া তো কোনো কিছু চলতে পারে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, নীতি কি নীতির জায়গায় অবস্থান করবে, না ডানে-বামে হেলেদুলে পড়বে? দুঃখের বিষয় হলো, বাংলাদেশে অনেক সুন্দর-সুন্দর কথা বলে নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়, কিন্তু প্রণয়নের পর স্বার্থকেন্দ্রিক হেলেদুলে পড়ার কারণে নীতিমালাকে আর সুন্দর বলে মনে হয় না। লক্ষণীয় বিষয় হলো, জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) দুই অংশের অবস্থানও একরকম নয়। সরকারপন্থী অংশ এ নীতিমালাকে সাংবাদিক সমাজের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফসল বলে মনে করছেন। তবে তারা এই নীতিমালার কিছু ধারার সংশোধনও প্রয়োজন বলে মনে করেন। অপরদিকে বিএফইউজের সরকারবিরোধী অংশ এ নীতিমালাকে অশুভ বলে মত প্রকাশ করেছেন। গত শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভেতরে সরকারপন্থী বিএফইউজের নেতারা যখন নীতিমালার পক্ষে কথা বলছিলেন, সেই সময়ই জাতীয় প্রেস ক্লাবের বাইরে সমাবেশ করছিল বিএফইউজের বিরোধী অংশ। উল্লেখ্য যে, সরকারপন্থী বিএফইউজের নেতারা জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালার প্রশংসা করলেও কমিশন গঠনের সময়সীমা নির্ধারণ না করা এবং কমিশন সম্পর্কিত আইন না হওয়া পর্যন্ত তথ্য মন্ত্রণালয়ের হাতে সিদ্ধান্তের ক্ষমতা রাখা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। সম্প্রচার কমিশন গঠনের আগে এই নীতিমালার কোনও ধারা প্রয়োগ না করার জন্যও সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তারা। সেইসঙ্গে কমিশনের মাধ্যমে যতো শিগগিরই সম্ভব নীতিমালাটি চূড়ান্ত করারও আহ্বান জানানো হয়। এ দিকে বিএফইউজের সরকারবিরোধী অংশ জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনের সমাবেশ থেকে জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা বাতিলের দাবি জানায়। তারা সরকারপন্থী সাংবাদিকদের বক্তব্যকে স্ববিরোধী আখ্যা দিয়ে সম্প্রচার নীতিমালা বাতিলের দাবিতে তাদেরকেও রাজপথে নেমে আসার আহ্বান জানান। তারা আরো বলেন, আওয়ামী লীগের প্রতিশ্রুতি ছিল বিটিভিকে স্বায়ত্তশাসন দেয়া হবে। সেটা না করে তারা এমন একটি নীতিমালা করেছেন, যেটা বাস্তবায়ন হলে সব বেসরকারি টেলিভিশন বিটিভিতে পরিণত হবে। আরো বলা হয়, কমিশনের মাধ্যমে এই সরকারের আমলে নীতিমালা হতে পারে না। কারণ এই সরকারের আমলে কমিশন হলে সেটাও আওয়ামী লীগেরই কমিশন হবে।
সম্প্রচার নীতিমালা প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের দুই অংশের বাইরেও নাগরিক সমাজ থেকে বক্তব্য রাখা হচ্ছে। জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা বাস্তবায়ন না করার দাবি জানিয়েছে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)। সুজন বলেছে, এই নীতিমালা বাস্তবায়ন হলে সম্প্রচার মাধ্যমগুলোর উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ বাড়বে। সঙ্কুচিত হবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। এছাড়া নীতিমালাটির বেশ কিছু ধারা অস্পষ্ট ও স্পর্শকাতর। গত শনিবার সুজনের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে আরো বলা হয়, নানা আলোচনা-সমালোচনার পর সরকার গত ৫ আগস্ট ‘জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা ২০১৪ অনুমোদন করেছে। যদিও গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা এ নীতিমালা বাস্তবায়ন করা হলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এই নীতিমালার সংবাদ ও অনুষ্ঠান প্রচারে বেশ কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। নীতিমালায় জাতীয় সম্প্রচার কমিশন গঠনের কথা বলা হলেও সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট সময় উল্লেখ করা হয়নি। বরং বলা হয়েছে, কমিশন গঠন না হওয়া পর্যন্ত তথ্য মন্ত্রণালয় সম্প্রচার সম্পর্কিত সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
সময়কে মুক্ত রেখে এভাবে সম্প্রচার সম্পর্কিত সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা তথ্য মন্ত্রণালয়কে দেয়ায় গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের মধ্যে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের মন্ত্রী বাহাদুররা জাতীয় স্বার্থের বদলে কতটা ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থবাজ হতে পারেন তার উদাহরণ দুর্লভ নয়। সম্প্রচার নীতিমালা যে সাংবাদিকদের টাইট দেয়ার জন্য করা হয়েছে, সেই তথ্য তো ফাঁস করে দিয়েছেন স্বয়ং সমাজকল্যাণমন্ত্রী। গত শনিবার সন্ধ্যায় সিলেট জেলা পরিষদ মিলনায়তনে আয়োজিত এক আলোচনা অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের ‘খবিস’ ও ‘চরিত্রহীন’ বলে ভর্ৎসনা করলেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী সৈয়দ মোহসিন আলী। তিনি ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, দুই টাকার সাংবাদিকরা যা খুশি তাই লেখেন। আওয়ামী লীগ সম্প্রচার নীতি করে সাংবাদিকদের টাইট দিচ্ছে। সময় থাকতে ভালো হয়ে যাও। আমি ক্যাবিনেটে থাকলে এমন টাইট দিতাম সাংবাদিকরা আর বউ নিয়ে ঘুমাতে পারতো না। সমাজকল্যাণমন্ত্রী আরো বলেন, ‘আমার নেত্রী শেখ হাসিনা আমাকে ডেকে বলেছেন, হাসানুল হক ইনু ১৪ দলের নেতা, আর তুমি আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতা। সাংবাদিকরা যা ইচ্ছে লিখুক, তাতে কিছু যায় আসে না। তুমি চালিয়ে যাও।’ মন্ত্রীর এমন বক্তব্যে বিস্ময় জাগে, আসলেই কি দেশের প্রধানমন্ত্রী তাকে এমন কথা বলেছেন? যদি এমন কথা বলে থাকেন, তাহলে জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা নিয়ে আশাবাদী হওয়ার কিছুই থাকে না। আর মন্ত্রী বাহাদুর ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা নীতিমালার কেমন ব্যবহার করেন, সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা এদেশের জনগণের আছে। আমরা মনে করি, সমাজকল্যাণমন্ত্রীর বক্তব্যের ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট ব্যাখ্যা আসা প্রয়োজন, আর সম্প্রচার নীতিমালার ব্যাপারে গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব সেই বিষয়গুলোকেও সরকারের যথাযথ গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads