শনিবার, ২ আগস্ট, ২০১৪

বৃদ্ধাশ্রমে অশ্রুসিক্ত ঈদ


কাক্সিক্ষত ঈদের দিনটা তো চলে গেলো। জানি না কার ঈদ কেমন কেটেছে। তবে বৃদ্ধাশ্রমে যারা আছেন, তাদের ঈদ তেমন ভালো কাটেনি। কারো কারো ঈদ কেটেছে চোখের জলে। ঈদের দিন সকালে বৃদ্ধাশ্রমে ঈদের নামায আদায় করতে গিয়ে অশ্রু ধরে রাখতে পারেননি অশীতিপর বৃদ্ধ ইদ্রিস আলী (ছদ্মনাম)। তার বুক জুড়ে রাজ্যের দুঃখ। মনে পড়ে সুখের সেই দিনগুলোর কথা। যখন তার সন্তান খুব ছোট, ওই সময় সন্তানকে কোলে-কাঁধে করে ঈদগাহে নিয়ে যেতেন। নামায পড়তেন সঙ্গে নিয়ে। আজ সেই আদরের ছেলে জীবিত থেকেও কাছে নেই। এরচেয়ে কষ্ট পৃথিবীতে আর নেই। ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার মশাখালি গ্রামের ৮০ বছরের বৃদ্ধ ইদ্রিস আলী এক সন্তানের জনক। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। কোনমতে দুঃখ কষ্টের মধ্যে সংসার চালিয়েছেন। একমাত্র সন্তানকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেন। ছেলে ইমরান হোসেন ময়মনসিংহের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। ইদ্রিস আলী বলেন, আজ প্রায় ৭ বছর ধরে বৃদ্ধাশ্রমে আছি। ছেলে মাঝে মধ্যে ফোনে খবর নিলেও দেখতে আসে না। আমি আমার সে আদরের ছেলেকে নিয়ে  ঈদের আনন্দ আর উপভোগ করতে পারি না। ভেবেছিলাম বৃদ্ধ হলে ছেলে আমার পাশে থেকে একটু সেবা-যতœ করবে। কিন্তু তা আর ভাগ্যে জুটলো না।
এমন অনেক বৃদ্ধ বাবা ও মা এখন আশ্রয় নিয়েছেন বৃদ্ধাশ্রমে। ছেলে-ছেলে বউদের সঙ্গে অনেকেই থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু স্বার্থপর আচার-আচরণ, আবার কারো বা অসম্মানজনক আচরণে সন্তানদের সঙ্গে থাকা হয়ে ওঠেনি। বৃদ্ধাশ্রমে জীবন তো কেটে যাচ্ছে। কিন্তু এ জীবনের ভার অনেক বেশি। মাঝে মাঝে যখন সন্তানদের শৈশবের কথা মনে পড়ে, আদর-সোহাগে ভরা আনন্দময় দিনগুলোর কথা মনে পড়ে, তখন বৃদ্ধাশ্রমের প্রবীণ মানুষগুলোর অন্তর হাহাকার করে ওঠে। আদরের সন্তানদের থেকে দূরে এসে থাকতে হবে, এমন নিষ্ঠুর বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে, তা তারা কখনোই ভাবেননি। তবে এখনও তারা সন্তানদের ও আপনজনদের পথ চেয়ে থাকেন। ভাবেন, হয়তো তারা দেখতে আসবে, একটু সময় কাটাবে। অন্তত ঈদের দিনে প্রিয় খাবারগুলো নিয়ে আসবে। কিন্তু তাদের এমন আকাক্সক্ষা বাস্তবে আর পূরণ হয় না। মানুষ দিন দিন কেমন হৃদয়হীন হয়ে যাচ্ছে। আদরের সন্তানরা তো এখন সেই হৃদয়হীন সমাজেরই সদস্য। বস্তুবাদী এই সমাজের সদস্যরা এখন ভোগ-বিলাসে মত্ত। নৈতিকতা, মানবিকতা, শ্রদ্ধা, সম্মান, ত্যাগ-তিতীক্ষার মতো গুণাবলী থেকে এখন তারা বঞ্চিত। ফলে বিষণœতায় ভারাক্রান্ত এখন বৃদ্ধাশ্রমের বাবা-মায়েরা।
আজ ধর্মের একটি কথা মনে পড়েছে। যার মর্মার্থ হলো, তাঁদের নাক ধুলায় মলিন হোক, যারা বৃদ্ধাবস্থায় বাবা-মাকে অথবা তাদের কোনো একজনকে পেলো অথচ বেহেশ্্তে যেতে পারলো না, মহানবী (সাঃ) এর এমন বক্তব্য থেকে উপলব্ধি করা যায় যে, বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে সেবাযতেœর মাধ্যমে সহজেই স্বর্গ লাভ সম্ভব। আর শুধু স্বর্গলাভের আশায় কেন, যে বাবা-মা এতো কষ্ট করে দিনের পর দিন লালন-পালনের মাধমে সন্তানদের বড় করে তোলেন, মানবিক বিবেচনায় তাদের জন্য সন্তানদের কি কোনো কর্তব্য নেই? এমন প্রশ্ন উত্থাপন করতে গিয়ে মনে হচ্ছে, আমাদের সমাজ এখন ধর্ম ও নৈতিকতাবোধে পুষ্ট নয়। বিষয়টি আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালকদের ভেবে দেখা প্রয়োজন। আর যে অভিভাবকরা সন্তানদের আদর-সোহাগে লালন-পালন করে বড় বড় ডিগ্রিধারী করছেন, তাদেরও ভেবে দেখা প্রয়োজন, হৃষ্টপুষ্ট সন্তানদের তারা কতটা প্রকৃত মানুষ করতে পেরেছেন? ধর্মবোধ ও নৈতিকতাবোধে পুষ্ট না হলে বড় বড় ডিগ্রিধারী সন্তানরা যে কুসন্তান ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর মন্দ মানুষ হয়ে উঠতে পারে, তেমন উদাহরণ তো আজ ভুরি ভুরি। এরপরও কি রাষ্ট্র নেতা, সমাজ নেতা ও অভিভাবকদের মধ্যে কোনো বোধোদয় ঘটবে না?
কাক্সিক্ষত বোধোদয় না ঘটলে আমাদের ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ জীবনে দুঃখের মাত্রা যে বাড়তে থাকবে তা প্রায় নিশ্চিত।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads