শনিবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৪

বিচারপতির অপসারণ : খায়রুল হক সাহেব সেদিন কি বলেছিলেন আর আজ কি বলছেন



বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি জনাব এ বি এম খায়রুল হক প্রধান বিচারপতির মর্যাদায় আইন কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়েছেন এবং এখনও সেই পদে বহাল আছেন। আইন কমিশনের চেয়াম্যান হিসাবে তিনি সরকারের কাছে সুপারিশ করেছেন যে, জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে অর্থাৎ জাতীয় সংসদ বা পার্লামেন্টের কাছে সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতিদের অভিশংসন ও অপসারণের ক্ষমতা ফেরত দেওয়া হউক। এই উদ্দেশ্যে দেশের প্রথম সংবিধান অর্থাৎ ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল করা হউক। এই সুপারিশ সরকার গ্রহণ করেছেন এবং মন্ত্রিসভার বৈঠকে সেটি অনুমোদন করেছেন। জাতীয় সংসদের আগামী অধিবেশনে এই সুপারিশ বিল আকারে উত্থাপিত হবে এবং সেই অধিবেশনেই এটি পাস হয়ে আইনে রূপান্তরিত হবে এবং সংবিধানের সংশোধনী হিসাবে আইনে পরিণত হবে বলে সরকারি মহল আশা করছেন। ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের (২) ও (৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে,
“(২) প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যরে কারণে সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অন্যূন দুই তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত সদস্যের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ব্যতীত কোন বিচারককে অপসারিত করা যাইবে না।

 এই অনুচ্ছেদের (২) দফার অধীনের প্রস্তাব সম্পর্কিত পদ্ধতি এবং কোন বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করিতে পারিবেন।

সরকারি মহল থেকে বলা হয় যে, মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের নিকট থেকে কেড়ে নেন এবং সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের নিকট অর্পণ করেন। এটি সত্য নয়। ১৯৭৫ সালে সংবিধানের যে চতুর্থ সংশোধনী পাস হয় এবং বাকশাল গঠিত হয় সেই সংশোধনীতে এই ক্ষমতা সংসদের নিকট থেকে কেড়ে নিয়ে প্রেসিডেন্টের হাতে অর্পণ করা হয়। এ সম্পর্কে ৯৬ অনুচ্ছেদের সংশোধনীতে বলা হয়,

“ (ক) (২) দফার পরিবর্তে নি¤œরূপ (২) দফা প্রতিস্থাপিত হইবে :

(২) অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের কারণে রাষ্ট্রপতির আদেশ দ্বারা কোন বিচারককে তাহার পদ হইতে অপসারিত করা যাইবেঃ

তবে শর্ত থাকে  যে, কোন বিচারককে তাঁহার সম্পর্কে প্রস্তাবিত ব্যবস্থা গ্রহণের বিরুদ্ধে কারণ দর্শাইবার যুক্তিসঙ্গত সুযোগদান না করা পর্যন্ত  তাঁহাকে অপসারিত করা যাইবে না ”

১৯৭৮ সালের ২য় ঘোষণা পত্রে এই ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে ন্যাস্ত করা হয়।ঐ ঘোষণা পত্রে বলা হয় যে এই কাউন্সিলের প্রধান হবেন প্রধান বিচারপতি এবং দুইজন সদস্য হবেন সেই দুইজন বিচারপতি যারা জ্যেষ্ঠতার দিক দিয়ে সিনিয়র মোস্ট। এই কাউন্সিলের সুপারিশ মোতাবেক প্রেসিডেন্ট ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য অংশ করা হয়।

২০০৫ সালে বিচারপতি খায়রুল হক এবং বিচারপতি ফজলে কবীর পঞ্চম সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করেন। একই সাথে তিনি খন্দকার মোশতাক, প্রেসিডেন্ট সায়েম এবং জিয়াউর রহমানের সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করেন। পঞ্চম সংশোধনী মামলা বাতিলের রায়ে এ বি এম খায়রুল হক সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বহাল রাখার পক্ষে বলেছেন। সেদিন তিনি কেন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বাতিল করেননি ? আজ তিনি কেন তার সে মতামতের সম্পূর্ণ উল্টা মতামত দিচ্ছেন? পরবর্তীতে সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগ পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায়টি বহাল রাখেন। কিন্তু সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের অনুচ্ছেদটি বাতিল করেননি। সেটিকে তারা বহাল রাখেন।

 জনাব খায়রুল হক অপর একটি রায়ে ঘোষণা করেন যে, মরহুম জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক নন। তিনি আরেকটি রায়ে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করেন, ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল হয়ে যায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল হওয়ার ফলে গত ৫ জানুয়ারীর তীব্র বিতর্কিত নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ সুগম করে দেন জনাব খায়রুল হক। এই রায়েও তিনি সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বাতিল করেননি।

দুই

সংবিধানের সংশোধনীর জন্য আওয়ামী লীগ খুব ঘটা করে একটি সংসদীয় কমিটি গঠন করে। পঞ্চম সংশোধনী বাংলাদেশের সংবিধানের সবচেয়ে বড় সংশোধনী। এটিকে একটি ছোটখাট সংবিধান বলা যেতে পারে। এত বিশাল একটি সংশোধনী সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও  সেখানেও  সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বহাল রাখা হয়।

এভাবেই চলছিল। ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনের পর এমন কি ঘটল যে খায়রুল হক সাহেবকে ৯৬ অনুচ্ছেদ ফেরত আনার জন্য সুপারিশ করতে হল ? আর সরকারই বা সাথে সাথে সেই সুপারিশ লুফে নিল কেন?

জনাব খায়রুল হক প্রধান বিচারপতির মর্যাদায় আইন কমিশনের চেয়ারম্যান। তিনি অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি। একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি কি আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হতে পারেন? এ সম্পর্কে বর্তমান সংবিধানের ৯৯ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট লেখা আছে,

 [৯৯। (১) কোন ব্যক্তি (এই সংবিধানের ৯৮ অনুচ্ছেদের বিধানাবলী- অনুসারে অতিরিক্ত বিচারকরূপে দায়িত্ব পালন ব্যতীত) বিচারকরূপে দায়িত্ব পালন করিয়া থাকিলে উক্ত পদ হইতে অবসর গ্রহণের বা অপসারিত হইবার পর তিনি কোন আদালত বা কর্তৃপক্ষের নিকট ওকালতি বা কার্য করিবেন না এবং বিচার বিভাগীয় বা আধা-বিচার বিভাগীয় পদ ব্যতীত প্রজাতন্ত্রের কর্মে কোন লাভজনক পদে নিয়োগ লাভের যোগ্য হইবেন না।

উপরোক্ত অনুচ্ছেদ মোতাবেক  তার বর্তমান পদ কি ‘বিচার বিভাগীয় বা আধা-বিচার বিভাগীয়’ সেটি নির্ধারিত হওয়া প্রয়োজন। আরো প্রয়োজন, তার এই পদটি প্রজাতন্ত্রের কোন লাভজনক পদ কি না ।

 জনাব খায়রুল হক যদি ১৯৭২ সালের ৯৬ অনুচ্ছেদে ফেরত যাওয়ার সুপারিশ করেন তাহলে তিনি ’৭২-এর সংবিধানের ৯৯ এবং ১১৬ অনুচ্ছেদ ফিরিয়ে আনার পক্ষে সুপারিশ করছেন না কেন ?

১১৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “বিচার-কর্ম বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনে রত ম্যাজিস্ট্রেটের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল-নির্ধারণ, পদোন্নতি দান ও ছুটি মঞ্জুরীসহ) ও শৃঙ্খলা বিধান সুপ্রীম কোর্টের উপর ন্যস্ত থাকিবে।”

’৭২ সালের সংবিধানের ৯৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে,

“৯৯। কোন ব্যক্তি (এই সংবিধানের ৯৮ অনুচ্ছেদের বিধানবলী অনুসারে অতিরিক্ত বিচারকরূপে দায়িত্বপালন ব্যতীত) বিচারকরূপে দায়িত্বপালন করিয়া থাকিলে উক্ত পদ হইতে অবসর গ্রহণের বা অপসারিত হইবার পর তিনি কোন আদালত বা কর্তৃপক্ষের নিকট ওকালতি বা কার্য করিবেন না এবং প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ লাভের যোগ্য হইবেন না।”

সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদের (২) উপঅনুচ্ছেদে বলা হয়েছে,

“একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকাসমূহ হইতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনানুযায়ী নির্বাচিত তিন শত সদস্য লইয়া এবং এই অনুচ্ছেদের (৩) দফার কার্যকরিতা কালে উক্ত দফায় বর্ণিত সদস্যদিগকে লইয়া সংসদ গঠিত হইবে; সদস্যগণ সংসদ-সদস্য বলিয়া অভিহিত হইবেন।”

 যে সংসদে ৩০০ জন সদস্যের মধ্যে ১৫৩ জনের নির্বাচনে জনগণকে  ভোট দিতে হয় না এবং অবশিষ্ট ১৪৭ জনের নির্বাচনে ২০ শতাংশও ভোট পড়েনা সেই সংসদের নিকট বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা কতখানি জনগণের ক্ষমতা বলে পরিগণিত হতে পারে সেটি খায়রুল হক সাহেবসহ বিবেকবান মানুষ বিচার করবেন। 

তিন

সরকার যদি জনগণের ক্ষমতায়ন তথা পার্লামেন্টকে শক্তিশালী করার নীতিতে এত বিশ্বাসী হয় তাহলে তারা সংবিধান সংশোধন  করার উদ্দেশ্যে গঠিত বিশেষ সংসদীয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশসমূহ গ্রহণ করেনি কেন? ২০১১ সালের মার্চ মাসে কমিটি সুপারিশ করেছিল যে, সাংবিধানিক পদসমূহে যে নিয়োগ  দেওয়া হবে সেই নিয়োগ সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত হতে হবে। এই জন্য অভিজ্ঞ ও সিনিয়র সংসদ সদস্যগণকে নিয়ে একটি বিশেষ কমিটি গঠিত হবে। তারা নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের শুনানি গ্রহণ করবেন। শুনানিতে ঐ কমিটি সন্তুষ্ট হলে তারা সেই নিয়োগ অনুমোদন করবেন এবং অনুমোদনের পর নিয়োগপ্রাপ্তরা শপথ গ্রহণ করতে পারবেন। কিন্তু এই সুপারিশ গ্রহণ করা হয়নি। উল্লেখ করা যেতে পারে যে বিশেষ সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন বেগম সাজেদা চৌধুরী, যিনি তখন ঐ সংসদের সরকারি দলের উপনেতা ছিলেন। এই কমিটির কো চেয়ারম্যান ছিলেন বাবু সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত। এরা সকলেই আওয়ামী লীগের লোক। তারপরেও তারা সেই সুপারিশ গ্রহণ করেনি। কারণ সরকারের নির্বাহী বিভাগ, সোজা কথায় প্রধানমন্ত্রী, চেয়েছিলেন যে প্রধান বিচারপতি, বিচারপতিবৃন্দ,  প্রধান নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন কমিশনার,  দুর্নীতি দমন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, এ্যাটর্নী জেনারেল,  কম্পট্রোলার জেনারেল, অডিটর জেনারেল প্রভৃতি পদে নিয়োগ দানের ক্ষমতা তার হাতে তথা নির্বাহী বিভাগের হাতে থাকুক।

বিশেষ সংসদীয় কমিটি ৩০ মে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব উত্থাপন করে। প্রস্তাবে বলা হয় যে, সংসদীয় কমিটিতে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য যাদের  ডাকা হবে তারা সবাই হাজির হতে বাধ্য থাকবেন এবং যে সমস্ত দলিল তলব করা হবে সংশ্লিষ্ট বিভাগ সে সব দলিল দাখিল করতে বাধ্য থাকবেন। কিন্তু কয়েকজন মন্ত্রী এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। তারা বলেন যে, এটি যদি আইন হয় তাহলে তাদের জন্য কাজ করা কঠিন হয়ে যাবে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, প্রধান মন্ত্রী ঐ মন্ত্রীদের পক্ষ অবলম্বন করেন। ফলে প্রস্তাবটি মাঠে মারা যায়।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এই যে, বিশেষ সংসদীয় কমিটি সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের সুপারিশ করেন। বলা হয় যে এই ৭০ অনুচ্ছেদ সংসদ সদস্যদের পায়ে পরাধীনতার শিকল পরিয়েছে। এই অনুচ্ছেদের ভয়ে সদস্যরা স্বাধীনভাবে সংসদে কথা বলতে পারেন না। কারণ স্বাধীনভাবে কথা বললে যদি সেটি বড় বড় নেতার চিন্তাধারার বিরুদ্ধে যায় তাহলে তাদেরকে সংসদ পদ হারাতে হবে। ২০১১ সালের ২৪ এপ্রিল কয়েকজন প্রখ্যাত আইনবিদ কমিটির বৈঠকে যোগদান করেন। তারা এবং অন্যরা বলেন যে ৩টি বিষয়ে সদস্যরা দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবেন না। এ গুলো হল, সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা, সরকারের বাজেট এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা। অবশিষ্ট বিষয়ে তারা স্বাধীনভাবে  ভোট দিতে পারবেন। এই প্রস্তাবটিও এই সরকার গ্রহণ করেনি।

 জনগণের ক্ষমতায়ন তথা পার্লামেন্টকে অধিক ক্ষমতা দেওয়াই যদি প্রস্তাবিত ষোড়শ সংশোধনীর উদ্দেশ্য হয় তাহলে ওপরে যে সব প্রস্তাবের কথা উল্লেখ করা হল  সেগুলো বর্তমান সরকার গ্রহণ করেনি কেন? অথচ প্রস্তাবগুলী দিয়েছিল এই সরকারেরই একটি উল্লেখযোগ্য অংশের সদস্যবৃন্দ। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, জনগণের ক্ষমতায়ন বা পার্লামেন্টের ক্ষমতায়ন নয়, সংসদীয় স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠাই এই সরকারের আসল মতলব।
আসিফ আরসালান

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads