শনিবার, ১৬ আগস্ট, ২০১৪

আতঙ্কিতের লাফালাফি

পুলিশ, বিজিবি, আনসার, র‌্যাব, প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন এসব ব্যবস্থা দলীয়করণ করে গত ৫ জানুয়ারি সরকার নির্বাচনের নামে এক প্রহসন করে জবরদস্তিমূলকভাবে ক্ষমতা দখল করে আছে। একমাত্র ভারত ছাড়া সারা পৃথিবী এরকম একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করার বিপক্ষে মত দিয়েছে। তাদের বক্তব্য ছিল, সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন করা হোক; কিন্তু ভারতের তৎকালীন কংগ্রেস সরকার যেকোনো মূল্যে শেখ হাসিনাকেই ক্ষমতায় আসীন দেখতে চেয়েছে। আর তাদের মদতেই শেখ হাসিনা এই নির্বাচন করার সাহস পেয়েছিলেন। যদিও তিনি অবিরাম বলে যাচ্ছিলেন, তিনি দুনিয়ার কাউকে পরোয়া করেন না। সেগুলো নিয়ে তার অহঙ্কারেরও শেষ নেই; কিন্তু আধুনিক পৃথিবীতে যে এরকম বেপরোয়া ভাব নিয়ে কোনো রাষ্ট্র বা সরকারের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব নয়, সেটি বুঝতে পারছে না এ সরকার।
ফলে বিশ্ব জনমত উপেক্ষা করেÑ যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাতিসঙ্ঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন কারো পরামর্শে কান না দিয়েÑ তিনি এক অদ্ভুত নির্বাচনের মাধ্যমে নিজেকে আবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আসীন করেছেন। সে ক্ষেত্রে তার এই শক্তির একমাত্র উৎস ছিল ভারতের কংগ্রেস সরকার। কংগ্রেস এ ক্ষেত্রে যে নির্লজ্জতার প্রমাণ দিয়েছে, তা এ দেশের মানুষের কাছে কল্পনারও অতীত ছিল। স্বাভাবিকভাবেই মানুষ আশা করে, প্রতিবেশী এই রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক হবে জনগণের। কোনো একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের সাথে নয়; কিন্তু ওই বিশেষ দলকে জনগণ চাক বা না চাক, কংগ্রেসের চাই-ই। স্বাভাবিকভাবেই এই মনোভাব, সাধারণ মানুষের ওপর ভারত সরকার সম্পর্কে বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করে।
ভারতের কংগ্রেস সরকারও একেবারে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এরা ভেবেছিল, ভারতবাসী চিরদিনের জন্য দিল্লির মসনদ তাদের ইজারা দিয়েছে। সেই কারণে ভারতীয় জনগণের মনোভাব এরা বুঝে উঠতে পারেনি। গত এপ্রিলের নির্বাচনে ভারতে কংগ্রেস এক প্রলয়ঙ্করী পরাজয় বরণ করেছে। সে পরাজয় এমন গ্লানিকর, যে গ্লানিতে কংগ্রেস গঠনের পর আর কোনো দিন পড়েনি। কংগ্রেস বিরোধী দলে দুই একবার গিয়েছে বটে, কিন্তু এরকম শোচনীয়ভাবে নয়। ভারতের লোকসভায় ৫৪৩টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস মাত্র ৪৩টি পেয়েছে। অনেক রাজ্যে আঞ্চলিক দলগুলোও এরচেয়ে বেশি আসন লাভ করেছে। ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী কোনো রাজনৈতিক দলকে বিরোধী দলের মর্যাদা পেতে হলে লোকসভার কমপক্ষে ১০ শতাংশ আসনে জিততে হয়। কংগ্রেস তাও জেতেনি। ফলে এখন শুধু দলের স্বীকৃতি আছে। তাদের বিরোধী দলের মর্যাদাও নেই।
কংগ্রেসের শাসকেরা তাদের শাসনকালে ধারাবাহিকভাবে সর্বগ্রাসী দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। জওয়াহেরলাল নেহরুর আমল থেকেই কংগ্রেস পার্টির আর একটা লক্ষ্য হলো, প্রতিবেশীদের সাথে ঠোকাঠুকি লাগিয়ে রাখা। কংগ্রেস সরকার ভারতের কাছে প্রতিবেশী কোনো রাষ্ট্রকেই শান্তিতে থাকতে দেয়নি। যে বন্ধুত্বপূর্ণ ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক থাকলে উভয় দেশে জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করা যেত, সেই সৌহার্দ্যরে ছিটেফোঁটাও কংগ্রেস নেতাদের মাথায় কখনো আসেনি। অপর দিকে দরিদ্র সাধারণ মানুষের ওপর কংগ্রেসের নির্যাতন পরোক্ষে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের মদতদান, বিত্তবানদের সুবিধা দেয়া, এমন সব কীর্তির ফলে ভারতীয় জনগণ অতিষ্ট হয়ে উঠেছিল। ভারতীয় জনতা পার্টির নেতা গুজরাটের সফলমুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে কংগ্রেসের প্রধান প্রচারণা ছিল মোদি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়েছে। তিনি উগ্রবাদী। মোদি ক্ষমতায় এলে ভারতের সর্বনাশ হয়ে যাবেÑ এমন জুজুর ভয় জনগণকে কংগ্রেসমুখী করতে পারেনি। তারা হয়তো ভেবেছে, মোদির বিজেপি জোটকে ভোট দেয়াই উত্তম। তাতে অনন্ত কংগ্রেসের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে। জনগণের মধ্যে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে যে এই মনোভাব সৃষ্টি  হয়েছে, সেটি কংগ্রেস ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি। পরিণতি যা হওয়ার তাই হয়েছে। ভারতীয় জনগণ কংগ্রেসকে একেবারে আঁস্তাকুড়ে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে।
ভারতে কংগ্রেস সরকারের পতনের পর শেখ হাসিনার সরকার চোখেমুখে অন্ধকার দেখতে শুরু করে। কংগ্রেস দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এবং ব্যক্তি হিসেবে শেখ হাসিনাকে যে লাই দিয়েছে, সুসম্পর্ক থাকলেও সে লাই যে মোদি সরকারের কাছ থেকে পাওয়া যাবে না, সেটা নিশ্চিত করেই বলা যেতে পারে। নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে আকাশপাতাল পরিবর্তন হবে এমন আশা করার কোনো কারণ নেই; কিন্তু তবু কিছু পরিবর্তন নিভৃতে ঘটেই যায়। সরকারে বিজেপির ভিত শক্তিশালী করার জন্য তাকে অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন ও বৈষম্য দূর করার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। তা ছাড়া ভারতে রয়েছে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। সেখানকার ২৯টি রাজ্যের মধ্যে ২২টিতে আছে মাওবাদীদের আধিপত্য। মাওবাদীরা দরিদ্র মানুষের সংগঠন। এরা সেইসব দরিদ্রের মধ্যে কাজ করে, যারা শোষিত, বঞ্চিত, নির্যাতিত হতে হতে একেবারে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ফেলেছে। ফলে এরা এখন ঘুরে দাঁড়াতে চায়। এদের লক্ষ্য রাষ্ট্রক্ষমতা দখল। মাওবাদী ও স্বাধীনতাকামীরা সাধারণত ভারতের স্বাধীনতা দিবস ১৫ আগস্টে ধর্মঘটের ডাক দেয়। এবারো তার ব্যতিক্রম ছিল না। ভারতের নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, তাদের অস্তিত্বের জন্য এটাই সবচেয়ে বড় সঙ্কট।
মোদি সরকারের সামনে বিকল্প দুটি। এক. এদের ওপর শক্তি প্রয়োগ করে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার চেষ্টা করা। সেরকম চেষ্টার ফলে স্বাধীনতাকামীরা ও মাওবাদীরা গত ৫০ বছরে নিশ্চিহ্ন তো হয়ইনি, বরং তাদের শক্তি ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। দুই. আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এর একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌঁছা। নরেন্দ্র মোদির সামনেও এই সঙ্কট ভারতের জন্য কম বড় নয়। আর যদি এই সঙ্কটের সমাধান না হয়, তাহলে মোদি সরকারের ভিত শক্তভাবে গ্রথিত হতে পারবে না। মোদির অগ্রাধিকার সেখানে নিশ্চয়ই হবে অভ্যন্তরীণ সঙ্কট নিরসন। দেখা যাক, সে ক্ষেত্রে তিনি কতটা সফল হন।
ভারতের বিকল্প হিসেবে এখন শেখ হাসিনার সরকার পৃথিবীর এ দিক ও দিক বন্ধু খুঁজছে। রাশিয়ার সাথে অস্ত্র চুক্তি এবং চীনের সাথে অর্থনৈতিক চুক্তি করে তিনি বোঝাতে চাইছেন, ভারত না থাক, তার পাশে চীন-রাশিয়া আছে। যদিও তার সরকার বারবার বলছে যে, কারো স্বীকৃতির এরা পরোয়া করে না; কিন্তু বিভিন্ন দেশ সফর করে এরা ভাব নেয়ার চেষ্টা করছে যে, ওইসব দেশ তাদের সরকারকে বৈধ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। সে ক্ষেত্রে জাতিসঙ্ঘে গিয়ে প্রেসিডেন্ট ও ব্রিটেন গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এক ধরনের বিপাকে পড়েছিলেন। এরা জাতিসঙ্ঘ ও ব্রিটেন সম্পর্কে এমন কথা বলেছিলেন, যা ছিল অসত্য এবং জাতিসঙ্ঘ ও ব্রিটেন সাথে সাথে তার প্রতিবাদ জানায়।
সরকারের ভ্রান্ত পররাষ্ট্রনীতির কারণে বাংলাদেশ এখন বিশ্ব থেকে কার্যত সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এই বিচ্ছিন্নতার জের ধরে বন্ধ হয়ে গেছে মধ্যপ্রাচ্যের জনশক্তি রফতানি, যা আনত বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা। সরকারের ভুল কূটনীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্র বন্ধ করে দিয়েছে জিএসপি সুবিধা। বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্পের বাজার ক্রমেই ভারতের দখলে চলে যাচ্ছে। ইউরোপেও দেখা দিয়েছে রফতানি সঙ্কট। তাজরীন ফ্যাশনস ও রানা প্লাজা ধংসের পর ইউরোপজুড়ে আন্দোলন হয়েছে বাংলাদেশী পোশাক আর নয়। মাস খানেক আগে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশকে জানিয়ে দিয়েছে, তারা আর বাংলাদেশ থেকে শাকসবজি আমদানি করবে না। সরকারের কোনো কোনো হাইব্রিড মন্ত্রী এমন আসফালনও করেছেন যে, ইউরোপীয়রা যদি আমাদের পোশাক না নেয় তাহলে তাদের ন্যাংটা থাকতে হবে। পোশাক নেয়া কমে এসেছে; কিন্তু এমন শোনা যায়নি যে, বাংলাদেশী পোশাকের অভাবে সেসব দেশের মানুষ উদোম শরীরে রাস্তায় ঘোরাফেরা করছে।
বিনিয়োগ কমে গেছে। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিনিয়োগ কমে এসেছে। বিদেশী ঋণ সহায়তা কমছে। অনেক চলমান প্রকল্প থেকে বিশ্বব্যাংক ও বিভিন্ন দেশ দুর্নীতির অভিযোগে বিনিয়োগ গুটিয়ে নিচ্ছে। এর সবই যে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের জেরে হচ্ছে, সেটি সরকারের না বোঝার কোনো কারণ নেই। ফলে এখন যার যা খুশি তাই বলছে। কেউ বিএনপিকে কষে গাল দিচ্ছে। কেউ মিডিয়ার বিরুদ্ধে অশ্লীল শব্দ প্রয়োগ করছে। কেউ সত্য প্রকাশে বাধা দেয়ার জন্য সম্প্রচার আইন নিয়ে গলদঘর্ম হচ্ছে। এর সবকিছুই এরা করছে চরম আতঙ্ক থেকে। ফলে হাওয়ায় গদা ঘুরিয়ে আসফালন করছে। এগুলো আতঙ্কেরই বহিঃপ্রকাশ। শেষ পর্যন্ত সরকারের এক উন্মাদ নেতা বলে বসেছেন যে, গণতন্ত্র দিয়ে দেশের উন্নয়ন হয় না। অথচ এদের অতি প্রিয়ভাজন অর্থনীতিতে নোবেলপ্রাপ্ত অমর্ত্য সেন এই তত্ত্ব বিচার বিশ্লেষণ করেই সিদ্ধান্ত দেন যে, গণতন্ত্র, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ছাড়া উন্নয়ন অসম্ভব। বিরোধী দল আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে কেবল। আন্দোলন শুরুই করেনি। তাতে এরা কতটুকু সফল হবে সেটিও এখন নিশ্চিত করে বলা যায় না। ওই ঘোষণায়ই সরকারের ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। গত শুক্রবারই এরা নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় অফিস অবরুদ্ধ করে রাখে। কাউকে ঢুকতে দেয়নি। এর সবই ঘটছে আতঙ্ক থেকে। দেখা যাক, আতঙ্কিত সরকার লাফাতে লাফাতে কোথায় গিয়ে পৌঁছে।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads