বুধবার, ১৩ আগস্ট, ২০১৪

রাবিশ, স্টুপিড থেকে খবিশ, বদমাশ


বহু কারণে বাংলাদেশের অত্যন্ত বিশিষ্ট স্থান সিলেট। ইতিহাস, ঐহিত্য, সঙ্গীত, আধ্যাত্মিকতা সবকিছু নিয়েই সিলেট আমাদের গৌবরের অবস্থানে। এখানে হাসন রাজার মতো আধ্যাত্মিক সঙ্গীতজ্ঞ জন্ম নিয়েছেন। এখানে আছে হযরত শাহজালাল (র.) মাজার। আছে শাহপরাণসহ ৩৬০ জন আউলিয়ার মাজার। চা বাগানসহ অনেক ঐতিহ্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সিলেট। বিশ্বাসীরা তো বটেই, দোদেল বান্দারাও সিলেট গেলে এই মাজার দুটি জিয়ারত করতে ভোলেন না। শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার, জাফলং, তামাবিল, মাধবকু-, কী হৃদয়কাড়া নয়নাভিরাম দৃশ্য, কী আল্লাহর প্রার্থনায় নত হওয়া এইসব মিলে সিলেট বাংলাদেশের গর্ব। সে গর্বে আমিও একজন অংশীদার। কতবার সিলেট ভ্রমণ করেছি, কতবার এর আনাচে-কানাচে গিয়েছি, চা বাগানে ঘুমিয়েছি, মাজারে নামায পড়ে দেশ-জাতির জন্য দোয়া করেছি, তার কোনো হিসাব নেই। এখনকার প্রজন্ম জানে কিনা জানি না, সিলেটের মুসলিম হল লাইব্রেরি এক অমূল্য সম্পদ ভাণ্ডারে ঠাসা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের জন্য এই লাইব্রেরিতে মাসাধিককাল কাজ করেছি। তখন কম্পিউটারের যুগ ছিল না। পুশ বাটনে সবকিছু পাওয়া যেত না। কিন্তু মুসলিম হল লাইব্রেরিতে কী যে অসাধারণ তথ্যখনির সন্ধান পেয়েছিলাম, তা ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। এখন সেসব তথ্য গুগলে সার্চ দিলেই পেয়ে যাই। তখন সেরকম দিন ছিল না। গ্রন্থ বা পত্রিকাদির পাতার পর পাতা উল্টে দু’লাইন তথ্য সংগ্রহ করতে হয়েছিল। 
আমাদের এ গৌরবের সেই সিলেটে এখন দুই কিম্ভূত ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটেছে। তাদের প্রথমজন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তার লেখাপড়া বিদ্যাবুদ্ধি কী আছে সে সম্পর্কে আমাদের খুব বেশি কিছু জানা নেই। এরশাদের অর্থমন্ত্রী ছিলেন। চরম ব্যর্থতার কারণে এরশাদের মতো লোকও তাকে মন্ত্রিসভা থেকে বের করে দিয়েছিলেন। এরশাদের ফেলে দেয়া মাল শেখ হাসিনা কুড়িয়ে কোলে তুলে নিয়েছেন। এতে দোষের কিছু নেই। কারণ এরশাদ যখন গণতন্ত্রের কবর রচনা করেন, গণতন্ত্র হত্যা করে ক্ষমতা দখল করেছিলেন, তখন শেখ হাসিনা অতি আনন্দে বলেছিলেন যে, আই অ্যাম নট আনহ্যাপী। এই ক্ষমতা দখল প্রক্রিয়ায় তিনি অসুখী নন। গণতন্ত্রের কবর হোক, সামরিকতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হোক, বিএনপি বা জাতীয়তাবাদী শক্তি ক্ষমতা থেকে দূরে থাকুক সেরকম একটি নিম্নমানের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সম্ভবত শেখ হাসিনার এই উপলব্ধি।
তার আরও কারণ থাকতে পারে। তা হলো এই যে, শেখ মুজিব যখন সপরিবারে নিহত হলেন, তখন এদেশের মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। নিহত হওয়ার আগে শেখ মুজিবুর রহমান তার নিয়োজিত সেনাবাহিনী প্রধান শফিউল্লাহকে সাহায্যের জন্য ডেকেছিলেন। শফিউল্লাহ শেখ মুজিবকে বলেছিলেন, তিনি যেন পেছনের দেয়াল-টেয়াল টপকে কোনোমতে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসেন। শেখ হাসিনা এই শফিউল্লাহকেই এমপি বানিয়েছিলেন। রক্ষীবাহিনীর রাজনৈতিক প্রধান ছিলেন তোফায়েল আহমেদ। শেখ মুজিবের জীবন রক্ষায় তারাও এগিয়ে আসতে পারতেন। কিন্তু সেখানে ব্যারাকে রক্ষীবাহিনীর সদস্যরা হয় ‘পাথরের মূর্তি’র মতো দাঁড়িয়েছিলেন অথবা নিরুপদ্রব ঘুম দিয়েছিলেন। তারা কেউ এগিয়ে আসতে পারেননি।
শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর বাংলাদেশের ঘরে ঘরে কোনো কান্নার রোল ওঠেনি। খোন্দকার মোশ্্তাক আহমাদের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগই ক্ষমতা গ্রহণ করেছিল। শেখ মুজিব মন্ত্রিসভার মন্ত্রীদের প্রায় সকলে দলবেঁধে মোশ্্তাক আহমাদের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন। কাউকে কাউকে জেলে পোরা হয়েছিল। এবং আশ্চর্য এই যে, ঐ বিয়োগান্তক ঘটনার পর বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এসেছিল। দ্রব্যমূল্য এক লাফে অর্ধেকে নেমে এসেছিল। ব্যবসায়ীদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, দাম কেন এত কমল? ফকিরাপুল এলাকার ব্যবসায়ীরা একযোগে বলেছিলেন, যারা দাম বাড়িয়েছিল, তারা চলে গেছে। যেহেতু প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ চাঁদা দিতে হতো, সেহেতু দাম না বাড়িয়ে আমাদের কোনো উপায় ছিল না। এখন চাঁদাবাজরা পলাতক। আমরা ন্যায্য দামে বিক্রি করতে পারছি।
বিপরীত চিত্র দেখা গেল, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর। সারা দেশ স্তম্ভিত। শোকে হতবিহ্বল। দিনরাত মানুষের অশ্রুপাত। মানিক মিঞা এভিনিউতে যখন তারা জানাযা অনুষ্ঠিত হয়, তখন ওদিকে জয়দেবপুর, এদিকে আজিমপুর, অপরদিকে সাভার পর্যন্ত লাখো লাখো মানুষ সেই জানাযায় শরিক হয়েছিলেন। কোনো রাষ্ট্রনেতার প্রতি, রাষ্ট্রনায়কের প্রতি এ ধরনের সম্মান বাংলাদেশের মানুষ আর কোনোদিন দেখাননি। শেখ হাসিনার হৃদয়ে সম্ভবত সে আগুন দপদপ করে জ্বলতে থাকে। ‘কোথাকার কে এক মেজর’ তার জন্য এত মানুষের ভালোবাসা কেন? এটা অসহ্য ঠেকেছে শেখ হাসিনার। আর তার ফলেই বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, তিনি রাজনীতিতে এসেছেন পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে। তারপর তিনি যখন লাগাতার হরতাল-ধর্মঘট আহ্বান করতে থাকেন, তখন আরেকবার বিবিসি তাকে প্রশ্ন করেছিল, আপনার এই লাগাতার হরতাল-অবরোধে কি সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বা কষ্ট হয় না? জবাবে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, যে দেশের মানুষ মুজিব হত্যার বিচার করেনি, তাদের দুর্ভোগ ও কষ্ট হওয়াই উচিত।
২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত আঁতাতের নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে এই সাধারণ মানুষের ওপর তিনি যেন এক ধরনের প্রতিশোধপ্রবণ মনোভাব নিয়েই এগিয়ে চলেছেন। তিনি অবিরাম এমন সব ভাষায় এমন সব কথা বলছেন, যা জনগণের নেতা বা প্রতিনিধি হিসেবে অত্যন্ত বেমানান এবং এদেশের নাগরিকদের জন্য খুবই অবমাননাকর। কখনও কখনও ভাবতে লজ্জা হয় যে, এমন একজন ব্যক্তি বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের নেতা। যিনি বলেন, ‘আমার বেগুন আমি রানবো, যত খুশি লবণ দেবো।’
তার মন্ত্রিসভারই মন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বাড়ি সিলেট। যা কিছু তার অপছন্দ, যা কিছু সমালোচনামূলক, সেসব কথা শুনলে এই মুহিতের পিত্তি জ্বলে যায়, এসব অপছন্দের বক্তব্য যারা দেন, তিনি সবসময় তাদের ‘রাবিশ’ ও ‘স্টুপিড’ বলে গালিগালাজ করেন। কিন্তু মুহিত সাহেবের ধারণা নেই যে, তিনি যখন এমএ পাস করেছেন, তখন বাংলাদেশে স্বাক্ষরের হার ছিল ১৫ বা ১৭ শতাংশ। মানুষ ছিল ৬ কোটির মতো। এখন মানুষ ১৬ কোটি। এমএ পাস লোকের সংখ্যা লাখ লাখ। শিক্ষিতের হার কম বেশি ৬০ শতাংশ। ফলে মুহিতের ‘রাবিশ’ আর ‘স্টুপিড’ তত্ত্ব এখন আর খুব একটা কাজে আসবে না। কবি হেলাল হাফিজের ভাষায় বলা যায়, ‘আমরা গেরামের পোলা, চুতমারানি কইতে জানি।’ জনগণ সম্ভবত মুহিতকে এ কথাই কয়। তিনি অন্ধ এবং বধির। কিছুই শুনতে পান না। সম্ভবত শেখ হাসিনাও তাকে কথায় কথায় ‘রাবিশ’, ‘স্টুপিড’-এ উৎসাহ জুগিয়ে থাকেন।
এবার সিলেটে আরেক মাল-এর আবির্ভাব ঘটেছে। তার নাম সৈয়দ মহসিন আলী। তিনি সমাজকল্যাণমন্ত্রী। এরকম একটা ইতর লোক কোনো সরকারে মন্ত্রী হতে পারে এটা কল্পনারও অতীত। আগে কত কা- ঘটিয়েছেন জানি না, কিন্তু মন্ত্রী হওয়ার পর তিনি শিশুদের অনুষ্ঠানে মঞ্চে বসে আরামসে ধূমপান করেছেন। তাই নিয়ে লেখালেখি হলো। এই অভদ্র লোক তো ক্ষিপ্ত। চান্স খুঁজছিল। তারপর একদিন বলে ফেলল, সম্প্রচার নীতিমালা হচ্ছে। সাংবাদিকরা কে কি করে, দেখে নেবে। সেই নিয়ে তুমুল সমালোচনায় ছিলেন তিনি। সরকারের যে মান, এই মহসিন তার থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। সর্বশেষ গত ৯ আগস্ট তিনি সাংবাদিকদের একেবারে চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে দিয়েছেন।
সিলেটে আদিবাসী দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভায় মন্ত্রী ছিলেন প্রধান অতিথি। কিন্তু অনুষ্ঠানস্থলে ঢুকেই তিনি সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হন। সভাস্থলে ঢুকেই তিনি বলেন, সাংবাদিকরা যেন ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। কিন্তু খবর সংগ্রহের তাগিদে, পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য সাংবাদিকরা তবুও সেখানে থেকে যান। তিনি বলেন, ‘সাংবাদিকদের ঠিক করতে নীতিমালা হয়েছে। ঐদিন কেবিনেট মিটিং-এ আমি থাকলে সাংবাদিকদের ... ... (অকথ্য শব্দ) দিয়ে বাঁশ ঢুকাতাম। সাংবাদিকদের এমনভাবে ঠিক করা হবে যাতে নিজের স্ত্রীকে পাশে নিয়েও শান্তিতে ঘুমাতে না পারে। সাংবাদিকরা বদমায়েশ, চরিত্রহীন, খবিশ ও লম্পট।’
তিনি এমনও দাবি করেন যে, শেখ হাসিনা তাকে ডেকে বলেছেন ‘হাসানুল হক ইনু ১৪ দল নেতা, আর তুমি আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতা। সাংবাদিকরা যা ইচ্ছা লিখুক, তাতে কিছু যায়-আসে না। তুমি চালিয়ে যাও।’ তিনি সাংবাদিকদের অল্প শিক্ষিত উল্লেখ করে বলেন, ‘আমার মেয়ে সাংবাদিকতায় মাস্টার্স। আর যারা আমার বিরুদ্ধে পত্রিকায় লেখালেখি করে, তারা দু-এক কলম লেখাপড়া করেছে। আমি বলি একটা, তারা লিখে আরেকটা। দুই টাকা খেয়ে তারা আমার ... ... (অকথ্য শব্দ) দিয়ে বাঁশ ঢুকাতে চায়। আমার শ্বশুড়বাড়ি সিলেটে। সাংবাদিকদের পেছনে সিলেটের মানুষ লেলিয়ে দিতে আমার সময় লাগবে না। সাংবাদিকরা আমার ... ... (অকথ্য শব্দ) ছিঁড়তে পারবে না।’ উপস্থিত সাংবাদিকরা তার এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে তৎক্ষণাৎ একটি প্রতিবাদ মিছিল বের করেন।
মহসিন আলী তো জানিয়েই দিয়েছেন, শেখ হাসিনা তাকে চালিয়ে যেতে বলেছেন। ধারণা করি, মন্ত্রী মিথ্যা কথা বলেননি। শেখ হাসিনা যদি বলেন, না এরকম চালিয়ে যাওয়ার কথা তিনি বলেননি, তাহলে প্রসঙ্গ ভিন্ন। কিন্তু এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে যে, তারাই শেখ হাসিনার বড় আপন, যারা শালীনতার সীমা লঙ্ঘন করতে পারেন এবং জনগণের কাছে ইতর। এদের নিয়েই কি শেখ হাসিনা বলবেন ‘জয় বাংলা’?
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads