রবিবার, ১০ আগস্ট, ২০১৪

উজ্জ্বল উদ্যানটিকে পবিত্র করা হোক


কোনো কোনো নাম অনেক ঘটনাই স্মরণ করিয়ে দেয়। যেমন ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যান’। এ নামটি উচ্চারণ করলেই মনে পড়ে যায় ঐতিহাসিক ৭ মার্চের কথা, ‘৭১-এর রক্তঝরা দিনগুলোর কথা। স্বাধীনতা আন্দোলনের সাক্ষী সেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আজ পরিণত হয়েছে অপরাধীদের আখড়ায়। জাতির উজ্জ্বল ইতিহাসের সাক্ষী এমন একটি উদ্যানের বর্তমান কালিমালিপ্ত অবয়ব দেখে প্রশ্ন জাগে, আর কতটা অধঃপতন হলে আমাদের অধঃপতনের মাত্রা পূর্ণ হবে? ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এখন অবাধে চলছে মাদক ব্যবসা, জুয়া, প্রতারণা, দেহব্যবসাসহ নানা অপরাধ। এসব অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন ঐতিহ্যবাহী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও। দৈনিক আমাদের সময়ে ৯ আগস্ট মুদ্রিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, তিনটি সিন্ডিকেট এই এলাকার অপরাধ কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করছে। এদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাকের ডগায় এসব ঘটনা ঘটলেও তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই বলে অভিযোগ রয়েছে। আর উদ্যান কর্তৃপক্ষ যেন এসব দেখেও দেখে না। উল্লেখ্য যে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যে তিনটি সিন্ডিকেট অপরাধ কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করছে, তাদের নেতৃত্বে রয়েছে এক শ্রেণীর অসাধু রাজনীতিক। ফলে মাঝে মাঝে অপরাধ কার্যক্রমের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া হলেও তা উন্মুল করা সম্ভব হচ্ছে না। মাসখানেক আগে গণপূর্ত অধিদফতর পুলিশের সহায়তায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করেছিল। চিত্রশিল্পীদের ছবির হাটও গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। এরপরেও অপরাধ তৎপরতা থামেনি। উচ্ছেদের কয়েকদিন পরেই আবারো অবৈধ দোকানপাটে ছেয়ে গেছে উদ্যান। অপরাধের মাত্রা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। অভিযোগ রয়েছে দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকদের প্রত্যক্ষ মদদ দিয়ে যাচ্ছে শাহবাগ থানার এক এসআই। এসব সিন্ডিকেটের আয় মাসে লাখ লাখ টাকা। সিন্ডিকেটের কেউ নিয়ন্ত্রণ করছে মাদক ব্যবসা, কেউবা নারী ব্যবসা। উদ্যানে বেড়াতে আসা মানুষকে ব্ল্যাকমেল করেও হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে হাজার হাজার টাকা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে মাদক ব্যবসা। এখানে এ ব্যবসা অনেকটা নির্বিঘেœ পরিচালনা করা যায় বলে রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে মাদক ব্যবসায়ীরা জড়ো হয়। অভিযোগ রয়েছে, থানা-পুলিশকে ম্যানেজ করে এ ব্যবসা পরিচালনা করেন সরকার দলীয় কয়েকজন নেতা। এছাড়া শাহবাগ থানার যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা পরিচয়ে কয়েকজন এ ব্যবসার সাথে জড়িত রয়েছে বলে আমাদের সময়ের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। আরো দুঃখের বিষয় হলো, উদ্যান এলাকায় বেড়াতে আসা দর্শনার্থীরা বিভিন্ন সময়ে মাদকসেবীদের হাতে নির্যাতনের শিকার হন। কয়েকমাস আগে উদ্যানে বেড়াতে এসে গণধর্ষণের শিকার হন পুরনো ঢাকার এক ছাত্রী। সেই ঘটনারও রহস্য উদ্ঘাটিত হয়নি এখনও। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, প্রায় দিনই উদ্যান এলাকায় ছিনতাই হয়, পতিতাদের আনাগোনাও বেড়েই চলেছে। জাতীয় ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে থাকা এমন একটি উদ্যানের বর্তমান কালিমালিপ্ত চিত্র কোনো দেশপ্রেমিক নাগরিকই মেনে নিতে পারে না।
আমরা জানি, রাজধানী ঢাকায় মানুষের চাপ অনেক বেশি। যানজট, বাসস্থান সংকট, খোলা প্রান্তর ও মাঠ-ময়দানের অভাবে মানুষের জীবনে ভোগান্তির মাত্রা বেড়েই চলছে। ধুলি ও ধোঁয়ায় নাগরিকরা তিত-বিরক্ত। কবির ভাষায় ‘কার্বনে ভরে গেছে ঢাকার আকাশ’। এমন পরিস্থিতিতে বিশাল সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নাগরিকদের জন্য হতে পারতো আনন্দ বিনোদন ও অক্সিজেন গ্রহণের কেন্দ্র। তেমন প্রাকৃতিক পরিবেশ তো এখানে ছিলই। কিন্তু দিনে দিনে তা এভাবে বিনষ্ট করলো কে? কোনো ভিনদেশী হায়েনারা এসে তো এখানে মাদক ও নারী ব্যবসা শুরু করেনি। কোনো ভিনদেশী হায়েনারা এসে তো এখানে ছিনতাই করে না কিংবা বেড়াতে আসা নাগরিকদের সর্বস্ব কেড়ে নেয় না। উদ্যানে বেড়াতে এসে পুরানো ঢাকার যে ছাত্রীটি গণধর্ষণের শিকার হয়েছে তার জন্য তো এ দেশের পথভ্রষ্ট রাজনীতিকদের সাঙ্গ-পাঙ্গরাই দায়ী। এমন ঘৃণ্য ঘটনাবলীর জন্য তো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মঞ্চ থেকে স্বাধীনতার ডাক দেয়া হয়নি। আসলে ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতিক দুর্বৃত্তায়নের কারণেই সোনার বাংলার স্বপ্ন আজ ধূসর হয়ে উঠছে। আমরা মনে করি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উজ্জ্বল ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের সরকার ও প্রশাসনের যথেষ্ট জ্ঞান আছে। তারপরও উজ্জ্বল এই উদ্যানকে অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত করলো কারা? জাতি এর জবাব চায়। জাতীয় ইতিহাসের প্রতি যদি আমাদের সামান্য শ্রদ্ধাবোধ থাকে এবং নাগরিক অধিকারের প্রতি যদি আমাদের কোনো সম্মানবোধ থাকে, তাহলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে দ্রুত যাবতীয় অপকর্ম থেকে পবিত্র করা হোক এবং গড়ে তোলা হোক বিনোদন ও অক্সিজেন কেন্দ্র হিসেবে। আর এ দায়িত্ব স্বাভাবিকভাবেই বর্তায় সরকার ও প্রশাসনের ওপর।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads