বুধবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৪

তাহলে কেন গড়ে তোলা হলো এই সভ্যতা!


মাঝে মাঝে মনে প্রশ্ন জাগে, এই সভ্য সমাজে আমরা বন্য সমাজ থেকে কতটা ভাল আছি? আদৌ কি ভাল আছি? ভাল থাকলে তো মনে এমন প্রশ্ন উদয় হওয়ার কথা নয়। বনের পরিবেশকে আমরা বলি প্রাকৃতিক পরিবেশ। সেখানকার আবহাওয়া প্রাণী-বান্ধব। বনের পশু-পাখিরা বিশুদ্ধ অক্সিজেন গ্রহণের সুযোগ পায়। তারা যে ফলমূল খায়, তাতে বিষাক্ত কেমিক্যাল থাকে না। পাখিরা যে মাছ খায়, তাতে ফরমালিন থাকে না। বনের পরিবেশে, প্রাকৃতিক জীবন যাপনে তারা ভালই আছে। আমরা যারা মানুষ, তারাও তো প্রকৃতিরই অংশ, বলা হয়ে থাকে শ্রেষ্ঠ অংশ। কিন্তু এখন আমাদের যে জীবন-যাপন, তাতে কি শ্রেষ্ঠ পরিবেশ আছে? এক সময় আমরাও নদীর তীরে বসবাস করতাম, আমাদের চারপাশে ছিল ঘন গাছ-গাছালি, বন-বাদর। প্রকৃতির সাথে আমাদের ছিল নিবিড় সম্পর্ক। ইতিহাসের পরিক্রমায় মানুষ ক্রমশই প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। মানুষ বিজ্ঞান-প্রযুক্তির চর্চা করলো, সভ্যতা গড়ে তুললো এবং নিজেদের বন্দী করলো বিভিন্ন নগরীতে। নগর-সভ্যতায় কিন্তু বিশুদ্ধ অক্সিজেন পাওয়া যাচ্ছে না। নাগরিকরা আক্ষেপ করে বলছেন, কার্বনে ভরে গেছে আমাদের আকাশ। নগরীর বিপণী-বিতানে চমৎকার করে সাজানো আছে রকমারী ফলমূল। কিন্তু বনের ফলমূলের মত এ ফলমূল বিশুদ্ধ নয়, এতে মানুষ যুক্ত করেছে নানা মাত্রায় বিভিন্ন বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ। ফলে স্রষ্টার নেয়ামত এসব ফলমূল এখন মানুষের জীবনের জন্য হানিকর হয়ে উঠেছে। বলা হয়ে থাকে, মাছে-ভাতে বাঙালি। কিন্তু সেই মৎস্য খাওয়ার সাহস এখন ক’জন বাঙালির আছে? মাছেও মিশানো হচ্ছে ক্ষতিকর ফরমালিন। ফলে প্রবাসী বাংলাদেশীরা নাড়ির টানে স্বদেশে এলেও আবার দ্রুত ফিরে যাচ্ছেন বিদেশে। তারা বলছেন, পকেটে ডলার আছে কিন্তু বাজারে বিশুদ্ধ খাদ্য নেই। ছেলেমেয়েদের কী খাওয়াবো? তাই তো কবিও আক্ষেপ করে বলেন, টেবিলে টেবিলে সাজানো খাবার অথচ খাদ্য একটুও নেই, পানিতে পূর্ণ পাত্র সবার অথচ পানের পানীয় নেই। তাই প্রশ্ন জাগে, এ কোন্ সভ্যতা গড়ে তুললাম আমরা?
সভ্যতাগর্বী মানুষ যে শুধু বাতাস, খাদ্য বা পানীয় দূষিত করেছে তা নয়- শঠতা, চাতুর্য ও নীতিহীনতার রোডম্যাপে চলতে গিয়ে মানুষ যেন এখন দানব হয়ে উঠেছে। মানুষের সমাজে এখন মানুষের প্রতি মানুষের আস্থা নেই। কথা ও কাজে গরমিলের কারণে মানুষ মানুষকে সাপের মত ভয় করে, না জানি কে কখন ছোবল মেরে বসে। আতঙ্কের এমন পরিবেশে মানুষ শান্তিতে বসবাস করবে কীভাবে? উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা এবং মানসিক চাপে মানুষ এখন নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। বিজ্ঞানের নব-নব আবিষ্কার এবং প্রযুক্তির নব-নব উদ্ভাবনও মানুষকে কাক্সিক্ষত উন্নত মানবিক জীবন উপহার দিতে সমর্থ হচ্ছে না। ফলে এখন অনেকেই বলছেন, আলো ঝলমলে এক নব্য-জাহেলিয়াতে যেন এখন আমাদের বসবাস।
কম আক্ষেপে কবি বলেননি- লহ এ নগরী, দাও সে অরণ্য। বর্তমান সভ্যতা যেমন মানববান্ধব নয়, তেমনি মানুষও এখন মানববান্ধব নয়। ছোট ছোট উদাহরণ দিয়েও বিষয়টি প্রমাণ করা যায়। ময়মনসিংহ জেলার মঙ্গলসেন গ্রামের বাসিন্দা নূরুল আমিন। সৌদি আরবের একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কাজ নিয়ে ২০০৬ সালে তিনি সেদেশে যান। ভালই ছিলেন সেখানে। বাড়িতে টাকা পাঠাতেন নিয়মিত। নিজ দক্ষতা দিয়ে পদোন্নতিও পান। কিন্তু মানুষের অমানবিক আচরণের কারণে নূরুল আমিন এখন ভারতে এক ধরনের বন্দী জীবনযাপন করছেন। অনাহারে, অর্ধাহারে তার দিন কাটছে। দেশে পরিবারের লোকজনও আছেন অর্থকষ্টে। ইতোমধ্যে তার দু’ছেলের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। উল্লেখ্য যে, নূরুল আমিন ২০০৬ সালের ১লা মে থেকে সৌদি আরবের আরসিরোডন কোম্পানির পাওয়ার প্লান্টে ওয়েল্ডিং-এর কাজ করতেন। পরে দক্ষতার কারণে তাকে ফোরম্যানের দায়িত্ব দেয়া হয়। ২০১৩ সালে কোম্পানি তাদের ১৩ জন কর্মীকে ওয়েল্ডিং ইন্সপেক্টর ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করে। এর মধ্যে ৬ জন ভারতীয়, ৬ জন ফিলিপিনো এবং নূরুল আমিন একমাত্র বাংলাদেশী ছিল। বাংলাদেশে এ সংক্রান্ত ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা না থাকায় নূরুল আমিন ভারতীয়দের সঙ্গে তামিলনাড়–তে ট্রেনিং নিতে যান। একমাস মেয়াদী ওই কোর্সের জন্য তাকে একমাসের ভিসা দেয় ভারত। তবে ওই সময় তারা নূরুল আমিনকে জানান, পরে আরো তিনমাসের জন্য ভিসার মেয়াদ বৃদ্ধি করতে পারবেন। গত বছরের ২২শে ডিসেম্বর থেকে একমাস মেয়াদী ভিসা নিয়ে তামিলনাড়– সিঙ্গারাম এলাকার ওয়েল্ডিং কোয়ালিটি কনসেপ্ট ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন তিনি। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে পরীক্ষা না হওয়ায় তিনি ভিসার মেয়াদ বৃদ্ধি করতে সংশ্লিষ্ট কার্যালয়ে যান। তখন থেকেই তিনি পড়ে যান অভাবনীয় বিড়ম্বনায়। নূরুল আমিন ভারতের বিভিন্ন দফতরে যোগাযোগ করে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ভিসার মেয়াদ বৃদ্ধি করতে না পারায় সৌদি  আরবেও ফিরে যেতে পারেননি। এখন দেশে ফেরার অপেক্ষায় রয়েছেন। এদিকে ভারতের কোর্ট দেড় মাসের ভেতর নূরুল আমিনকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দিলেও সে মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। অপরদিকে তিনি অভিযোগ করেন, বাংলাদেশের দূতাবাসে যোগাযোগ করেও তিনি কোনো সহযোগিতা পাননি। নূরুল আমিন জানান, ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তিনি গত ১৬ জানুয়ারি প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে সংশ্লিষ্ট দফতরে যোগাযোগ করেন। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তাকে দু’দিন পর ১৮ জানুয়ারি যোগাযোগ করতে বলেন। এদিকে ভিসার নির্ধারিত মেয়াদ সীমা ২২ জানুয়ারি শেষ হয়ে যায়। পরে সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্মকর্তারা বাংলাদেশী লোকজন ভালো নয়- একথা বলে তাকে জানিয়ে দেন যে, ভিসার মেয়াদ বৃদ্ধি করা হবে না। কর্মকর্তারা তাকে টিকিট কেটে সৌদি আরবে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দেন। এ সময়ে নূরুল আমিন তার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে জানালে তারা একটি টেলিফোন নাম্বার দিয়ে বলেন, ইমিগ্রেশনে কোনো সমস্যা হবে না। ইমিগ্রেশন কোনো সমস্যা করলে ওই টেলিফোন নাম্বারে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেয়া হয়। তাদের পরামর্শ মোতাবেক তিনি ২৬ জানুয়ারি টিকিট কেনেন। কিন্তু সৌদি আরব যাওয়ার উদ্দেশে বিমানবন্দরে গেলে ইমিগ্রেশন নূরুল আমিনকে আটকে দেয় এবং ওই টেলিফোন নাম্বারে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। তারা বলেন, দেশ ত্যাগ করতে একজিট পেপার লাগবে। এরপর তিনি আবারও ফিরে আসেন সংশ্লিষ্ট ভিসা অফিসে। সেখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত এসপি তাকে ভিসার মেয়াদ এক মাস বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি করে লোকাল পুলিশ স্টেশনে জমা দিতে বলেন। নূরুল আমিন পরদিন ২৭ জানুয়ারি স্থানীয় পীরোরামপুর পুলিশ স্টেশনে কাগজপত্র জমা দেন। সেখানেও গড়িমসির কারণে প্রায় ১৩ দিন পার হয়ে যায়। পরে সেগুলো সংশ্লিষ্ট ভিসা অফিসে জমা দেন। কিন্তু ভিসা পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় গত ১৪ মার্চ তিনি সংশ্লিষ্ট দফতরে বাংলাদেশে ফেরার জন্য আবেদন করেন। ১৬ মার্চ তিনি টিকিটও জমা দেন। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা তার আবেদন গ্রহণ করেননি। তার কোনো উদ্যোগই কাজে না লাগায় গত ৬ জুন একজন আইনজীবীর পরামর্শে তিনি ভারতীয় হাইকোর্টে রীট করেন। গত ৩০ জুন হাইকোর্ট তাকে দেড় মাসের মধ্যে বাংলাদেশে পাঠানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি নির্দেশ দেন। গত ১০ আগস্ট সেই সময়ও পার হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে নূরুল আমিন সংশ্লিষ্ট বিভাগে খোঁজ-খবর নিলে তারা জানান, এ সংক্রান্ত কোনো কাগজপত্র এখনও তাদের কাছে আসেনি। সেগুলো দিল্লীতে আছে বলে তারা জানিয়েছেন। এদিকে কোনো টাকা-পয়সা হাতে নেই নূরুল আমিনের। এখন তিনি প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউটের একটি কক্ষে থাকছেন। বৈধ কাগজপত্র না থাকায় বাইরেও যেতে পারছেন না। এই ইন্সটিটিউটের মালিক মাঝে মাঝে এসে খাবার দিয়ে যান। বাকি দিনগুলো তার অভুক্ত অবস্থায় কাটে। বাংলাদেশ দূতাবাস থেকেও তিনি কোনো সহযোগিতা পাননি। নূরুল আমিন টেলিফোনে মানবজমিনকে জানান, তিনি সৌদি আরবের চাকরি হারিয়েছেন ভারতীয় কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতার কারণে। আর এখন দেশে ফিরতে পারছেন না বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের কোনো সহযোগিতা না পাওয়ায়।
নূরুল আমিনের এই করুণ কাহিনী মুদ্রিত হয়েছে মানবজমিন পত্রিকার ২৬ আগস্ট সংখ্যায়। বৈধ ভিসায় ভারত গিয়ে নূরুল আমিন যেভাবে আটকা পড়লেন, চাকরি হারালেন, নির্মম পরিহাস ও ভোগান্তির শিকার হলেন, তাতো এই সভ্য সমাজেরই চিত্র। এমন নিষ্ঠুর ভোগান্তির চিত্র প্রকৃত মানব সমাজে তো দূরে থাকুক, জংলি সমাজের জন্যও শোভা পায় না। এমন নিষ্ঠুর ও নির্মম হাজারো ঘটনা ঘটে চলেছে বর্তমান সভ্যতায়। এ কারণেই হয়তো কবি বলেছেন, লহ এ নগরী, দাও সে অরণ্য। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যদি অরণ্যেই যেতে হয় তাহলে আমরা এতটা সময় ব্যয় করে, এত মানুষের রক্ত ও ঘামে কেন গড়ে তুললাম এই নগর-সভ্যতা?

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads