রবিবার, ৩ আগস্ট, ২০১৪

ঈদেও শ্রমিকদের কপালে অনশন!


চোখ খোলার শক্তি নেই মনোয়ারার। কেমন আছেন, সেই প্রশ্নের জবাব দেয়ার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলেছেন। প্রায় সংজ্ঞাহীন শীর্ণদেহ মনোয়ারার। শুধু বিড় বিড় করে বলে যাচ্ছিলেন, ‘এত খাটলাম, তবে বেতন পাই না কেন?’ অতটুকু বোঝা যাচ্ছিল। কয়েকদিনের অনশনে একেবারে বিছানার সাথে লেগে গেছে মনোয়ারার শরীর। অপুষ্টি আর অবহেলায় এমনিতেই শীর্ণদেহী, তার ওপর গত কয়েকদিনের অনশন, এখন মৃতপ্রায় মনোয়ারা। শুধু মনোয়ারাই নন,  তোবা গার্মেন্টের শতাধিক শ্রমিকের একই অবস্থা।
গত কয়েকদিন ধরেই পত্রপত্রিকায় তোবা গার্মেন্টের শ্রমিকদের দুঃখ-দুর্দশার চিত্র মুদ্রিত হয়ে আসছে। কিন্তু তাতে কর্তৃপক্ষের টনক নড়েনি। পবিত্র ঈদে বেতন পায়নি তারা। ফলে বাধ্য হয়ে অনশনের পথ বেছে নেয় শ্রমিকরা। ৩ আগস্ট তারিখে প্রথম আলোয় ‘সামর্থ্য থাকলেও বেতন দেয়নি তোবা গ্রুপ’ শিরোনামে মুদ্রিম প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, তোবা গ্রুপ গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে ৩৯ কোটি টাকার পোশাক রপ্তানি করেছে। নতুন কার্যাদেশ পেয়েছে দুই কোটি টাকার। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো ও মালিকপক্ষ এই তথ্য দিলেও গ্রুপের পাঁচ কারখানার এক হাজার ৬০০ শ্রমিক বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না। মে, জুন ও জুলাই মাসের বেতন, ওভারটাইম ও ঈদ বোনাস বাবদ শ্রমিকদের পাওনা চার কোটি ১৩ লাখ ৭৭ হাজার ১২৭ টাকা। তবে মেরুল বাড্ডায় তোবা গার্মেন্টের আরেক কারখানার শ্রমিকরা নিয়মিত মজুরি পাচ্ছেন।
পোশাক শ্রমিকরা বলছেন, সামর্থ্য থাকলেও বেতন-ভাতা না দিয়ে মালিকপক্ষ তাদের জিম্মি করে তোবার মালিক দেলোয়ার হোসেনকে কারাগার থেকে মুক্ত করতে চেয়েছে। মালিকপক্ষের প্ররোচণায় আন্দোলনে নেমে পুলিশের গুলী খেয়েছেন তারা। এক শ্রমিক নেতার কথায় আবার রাস্তায় নেমে বিজিএমইএ কার্যালয় ঘেরাও করেছেন পাঁচবার। পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ-এর ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। দেড় মাস আগে তোবার পাঁচ কারখানায় বেতন-ভাতা নিয়ে ঝামেলা হওয়ার আশংকা করে বিষয়টি শুধু সরকারকে জানিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছেন তারা। নিজেরা কোনো পদক্ষেপই নেননি। উল্টো দেলোয়ারকে মুক্ত করতে বিজিএমইএর কোনো কোনো নেতা তাদের উসকে দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ করেন শ্রমিকরা।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, কঠোর পরিশ্রম করেও তোবা গ্রুপের শ্রমিকরা কয়েক মাস ধরে বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না। ফলে ঈদের আগের দিন আমরণ অনশনে গেছেন তোবার পোশাক শ্রমিকরা। গত শনিবার ষষ্ঠদিনের মত অনশন করেছেন তারা। শনিবার পর্যন্ত অসুস্থ হয়েছেন ৯২ জন শ্রমিক, হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৯ জন। এমন অবস্থায় যদি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তা হলে তার দায়িত্ব বর্তাবে কার ওপর? নিশ্চয় শ্রমিকদের ওপর নয়। পরিস্থিতির দায় মালিক, বিজিএমইএ, শ্রমিক নেতা, সরকার কেউই এড়াতে পারবে না। যার যতটুকু দায়িত্ব, তা পালিত হলে তোবা পরিস্থিতি আজ এ পর্যায়ে এসে পৌঁছত না। এখনও সময় আছে সঠিক পদক্ষেপটি নেয়ার। বিজিএমইএ সংকট সমাধানে শনিবার শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হকের সঙ্গে এক দফা বৈঠক করেছে। তারা নিজেরাও বৃহস্পতিবারের মধ্যে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধের ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগ নিচ্ছে বলে জানা গেছে। কিন্তু বেশ দেরি হয়ে যাচ্ছে। অনশনরত শ্রমিকদের অবস্থা বিবেচনা করে আরো দ্রুত সমাধানে পৌঁছা প্রয়োজন। ভাবতে লজ্জা লাগে, ঈদের সময় উৎসবের বদলে বাংলাদেশের শ্রমিকদের অনশন করতে হয়। আর তারা শ্লোগান দেয় ‘শ্রমিকরা কেঁদে মরে, প্রধানমন্ত্রী ঈদ করে।’ হয়তো অবজ্ঞা আর অবহেলার প্রতিক্রিয়ায় তাদের মধ্যে এভাবে ক্ষোভের সঞ্চার হচ্ছে। তবে ছোটদের অবহেলা করতে নেই। অবহেলায় অবহেলায় ছোটরা ক্ষোভে-দুঃখে ঐক্যবদ্ধ হয়ে গেলে তখন তারা অনেক বড় হয়ে ওঠে। তখন বড়রা ছোট হয়ে যায়, খুব ছোট। বিষয়টি সংশ্লিষ্টরা উপলব্ধি করলেই মঙ্গল।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads