মঙ্গলবার, ৫ আগস্ট, ২০১৪

মার্কিন রাষ্ট্রদূত জিয়াকে দেখলেন প্রশান্ত মৃদুভাষী ও বন্ধুভাবাপন্ন


১৯৭৫ সালের নভেম্বরে জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৬ সালের জানুয়ারিতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বোস্টারের সাথে প্রথম বৈঠকে জিয়া মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে চমৎকৃত করেন। বৈঠকে আলোচনার যে গোপন প্রতিবেদন বোস্টার ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্র দফতরে পাঠান তাতে তিনি তার মন্তব্যে লেখেন, ‘আমি তাঁকে (জিয়াকে) দেখলাম প্রশান্ত, মৃদুভাষী এবং পরম বন্ধুভাবাপন্ন এবং তিনি যে নতুন দায়িত্বভার নিয়েছেন তার কোনো চাপ তার ওপর দেখিনি।
সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জিয়াকে যখন বন্দিত্ব থেকে মুক্ত করে মতায় বসানো হয়, তখন রাষ্ট্রদূত বোস্টার ছুটিতে তার দেশে ছিলেন। ছুটি থেকে ফিরে জানুয়ারি ১৯৭৬-এ বোস্টার জেনারেল জিয়ার সাথে প্রথম বৈঠকে মিলিত হন। জিয়ার সাথে কথোপকথনে বোস্টার স্পষ্টতই প্রীত হয়েছিলেন এবং এ বৈঠক সম্পর্কে ওয়াশিংটনে এক দীর্ঘ গোপন রিপোর্ট পাঠিয়েছিলেন। এখন অবমুক্ত স্টেট ডিপার্টমেন্টের গোপন দলিল থেকে রিপোর্টের কিছু অংশ হুবহু অনুবাদ উপস্থাপন হলো :
সরকার বিকেন্দ্রীকরণ
প্যারা ৬ : দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়াদি বলার সময় জিয়া গুরুত্বসহকারে বলেন, তিনি সরকারকে অধিকতর বিকেন্দ্রায়নের, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকাণ্ড জোরদার করার এবং চোরাচালানকে অধিকতরভাবে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছেন। আমার প্রশ্নের উত্তরে জিয়া আস্থা প্রকাশ করেন যে, দেশে শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকবে এবং আরো বলেন যে, সেনাবাহিনীতে নিয়মশৃঙ্খলা সম্পর্কিত কোনো সমস্যা নেই।
ভারতের মনোভাবে অসন্তোষ
প্যারা ৫ : জিয়া অবশ্যম্ভাবীভাবেই ভারতের প্রতি তির্যক উক্তি করলেন, তবে এ সম্পর্কে বেশি কথা বললেন না এবং ভারতের সাথে বর্তমান সম্পর্কের ব্যাপারে গভীর কোনো উদ্বেগভাব প্রকাশ করলেন না, বরং বললেন যে, ভারতের সাথে সম্পর্ক বাস্তবিক পূর্বের চেয়ে কিছুটা উন্নত হয়েছে। তিনি বললেন যে, এটা বিস্ময়ের ব্যাপার ভারতের সংবাদপত্রগুলোয় কী পরিমাণে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিরূপ সংবাদ প্রকাশ হচ্ছে এবং এটা আরো বিস্ময়ের ব্যাপার যে, ভারতে জরুরি অবস্থা বিরাজ থাকাকালেই এসব হচ্ছে। তিনি একটি হিন্দু মন্দিরে ডাকাতির কথা (ভারতীয় হাইকমিশনার এ সপ্তাহে ইতপূর্বে একই ঘটনা আমার কাছে উল্লেখ করেছিলেন) উল্লেখ করে বললেন ভারতীয়রা এ ঘটনা নিয়ে হৈ চৈ তুলেছে। এ ঘটনা নিয়ে তদন্ত করে দেখা গেছে সাতজন চোর এ মন্দির লুট করেছে যাদের মধ্যে চারজন ছিল মুসলিম এবং তিনজন ছিল হিন্দু। অতএব ঘটনাটি হচ্ছে চুরির ঘটনা যে রকম ঘটনা হরহামেশাই হয়। তিনি বলেন, বস্তুতপে সরকার পরিবর্তনের পর বাংলাদেশে একটিও সাম্প্রদায়িক সমস্যাজনিত ঘটনা ঘটেনি। আমি মন্তব্য করলাম এটা স্পষ্টতই নয়া দিল্লির জন্য একটি গুরুতর বিষয় এবং এ সম্পর্কে এখানে বিশেষ উদ্বেগ দেখে আমরা সন্তুষ্ট হয়েছি।
যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশ প্রশিণ
প্যারা ৩ : কথোপকথনে একাধিকবার জেনারেল জিয়া আমেরিকান সহযোগিতার প্রসঙ্গ তুললেন। তিনি আরো বললেন যে, সিনেটর ম্যাকগভার্ন এবং চার্জ চেসলের সফরকালে তিনি তাদের সাথে (বাংলাদেশের) পুলিশদের প্রশিণ দেয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেন এবং প্রশিণের জন্য নিউ ইয়র্ক সিটিতে একদল পুলিশ পাঠানোর প্রস্তাব করেন (যেখানে অপরাধ দমনের পদ্ধতি বাংলাদেশে অপরাধী দমনে পুলিশের প্রচেষ্টার সহায়ক হবে) এবং তার পুলিশের জন্য হালকা সরঞ্জাম যেমন রাইফেল এবং যোগাযোগ যন্ত্রপাতি সরবরাহের কথা বলেন। অমি বললাম যে, আমি এ অনুরোধ সম্পর্কে অবগত আছি এবং এ অনুরোধ ওয়াশিংটনকে জানানো হয়েছে। তবে আমি তাকে বললাম যে, প্রাথমিকভাবে আমরা আমাদের সহায়তা সম্পদ কৃষি উন্নয়ন এবং পরিবার পরিকল্পনা এবং আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ খাত যেখানে আমরা বিশেষভাবে সাহায্য করতে পারি, সেসব খাতে ব্যবহার করতে চাই।
প্যারা ৪ : (পুলিশ প্রশিণ এবং সরঞ্জাম দেয়ার জন্য জেনারেল জিয়ার অনুরোধ প্রসঙ্গ রোববার আমি ব্রিটিশ হাইকমিশনার স্মলম্যানের কাছে উল্লেখ করলে তিনি বলেন যে, একই নৈশভোজে জিয়া তার কাছেও এ অনুরোধ তুলেছিলেন, বৃটিশ সরকার ইতপূর্বে বাংলাদেশ সরকারের অধস্তন পর্যায় থেকে যে অনুরোধ পেয়েছিল তারই অনুসরণে।
স্মলম্যান বলেন, তিনি জিয়াকে বলেন বাংলাদেশ পুলিশকে প্রশিণ দেয়ার ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকারের কিছু করার সম্ভাবনা আছে; তবে আগের এক কর্মসূচির ভিত্তিতে যে যোগাযোগ যন্ত্রপাতিগুলি দেয়া হয়েছে তার অতিরিক্ত আরো কিছু যন্ত্রপাতি ব্রিটিশ সরকার দিতে পারে এমন ধারণা করার ব্যাপারে তিনি জিয়াকে নিরুৎসাহিত করেন। তিনি আরো বলেন, নৌবাহিনীকে সহায়তা দেয়ার জন্য কমডোর খান তাদের ওপর কিছু চাপ দিচ্ছিলেন, তবে তিনি কমডোর খানকে বলে দিয়েছেন এ ধরনের অধিকতর কোনো সহায়তা ক্রয়-বিক্রয় ভিত্তিতে হতে হবে।
রাষ্ট্রদূত বোস্টারের সমাপনী মন্তব্য
প্যারা ৭- কমেন্ট : জিয়া বাংলাদেশে শাসনমতার প্রকৃত অধিকারী ব্যক্তিরূপে আবির্ভূত হওয়াকালে আমি ছুটিতে দেশে থাকার কারণে এটাই হয় জিয়ার সাথে আমার প্রথম সাাৎ।
আমি তাকে দেখলাম প্রশান্ত, মৃদুভাষী এবং পরম বন্ধুত্বভাবাপন্ন এবং তিনি যে নতুন দায়িত্বভার নিয়েছেন এর কোনো চাপ তার ওপর দেখিনি। তিনি কথা বলেন এবং কাজ করেন এমনভাবে, মনে হয় তিনি তার এ গুরু দায়িত্ব পালন উপভোগ করছেন। তিনি আমেরিকান সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনাকে যে দৃষ্টিতে দেখছিলেন তাতে বোঝা যায় স্পষ্টতই এটা তার অল্প বয়স এবং ব্যাকগ্রাউন্ডের কারণে তার পারিপার্শ্বিক দৃষ্টিতে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমি যখন তাকে বললাম আমাদের এইডের সহকারী প্রশাসক গার্ডিনারকে আমি এ সপ্তাহেই তার সাথে সাাতের জন্য পাঠাব তিনি তৎণাৎ তাতে সম্মতি দিলেন, এতে আমরা তার অনুরোধ সম্পর্কে এ সপ্তাহেই আরো জানাতে পারব।’ 

মঈনুল আলম


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads