রবিবার, ১৭ আগস্ট, ২০১৪

আন্দোলনের ঘোষণা ও সরকার পক্ষের আস্ফালন


 গতকালের পর- প্রধানমন্ত্রী বলেন, রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। কিন্তু সে জনগণের অবস্থাটা কি? ঘরে শান্তি নেই, নিরাপত্তা নেই, স্বস্তি নেই। রাষ্ট্রের পুলিশ দিয়ে ঘর থেকে ধরে নিয়ে মানুষ হত্যা করা হয়। গুম করা হয়। তরতাজা মানুষগুলো বাড়ি থেকে পরিবারের মধ্য থেকে উধাও হয়ে যান। তার কোনো খবর থাকে না। রাস্তায় পড়ে থাকে তার রক্তাক্ত লাশ। বাংলার ঘরে ঘরে আজ কান্নার রোল। সন্তানহারা মা-বাবার আর্তনাদ, পিতাহারা পুত্রের করুন ক্রন্দন বাংলার আকাশ-বাতাসকে ভারী করে তুলেছে। এসব পরিবার থেকে আনন্দ-উচ্ছাস চিরদিনের তরে বিদায় নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কানে কি এসব নির্যাতিত মানুষের ক্রন্দন পৌছে না? এ মজলুম জনতা আত্মরক্ষার্থে প্রতিরোধ গড়ে তুললে কোনো জালিমশাহী পালানোর পথ পাবেন না সে কথাটা ভুলে যাওয়া উচিৎ নয়।
দাম্ভিকতা ভালো নয়। প্রধানমন্ত্রী কুরআনের সূরা আল-এমরানের ২৬ নং আয়াত উল্লেখ করে বলেছেন, “সম্মান দেয়ার মালিক আল্লাহ। জন্মালে মরতে হয়। মরার আগে মরে যাব না। দুর্বলের তর্জন গর্জন বেশী।” প্রধানমন্ত্রী কুরআনের এই ঘোষণাও নিশ্চয়ই পড়েছেন যে, মহান আল্লাহ্ জালিমদের পছন্দ করেন না। জালিমের জুলুমের জবাব আল্লাহ প্রতিদিন দেন না। যখন তিনি মজলুমকে উদ্ধারের সিদ্ধান্ত নেন তখন জালিম সরকার শেষ চেষ্টা করেও কুলকিনারা পায় না। ধ্বংসই হয় তার চূড়ান্ত পরিণতি। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে আল্লাহ বহু জনপদের কাহিনী বর্ণনা করেছেন। সীমালংঘনকারীকে আল্লাহ বরদাশ্ত করেন না। ফেরাউন, কারুন, নমরুদ, হামান তার জলন্ত উদাহরণ হয়ে থাকবে।
বাংলাদেশে নব নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কংগ্রেসে যে বক্তব্য রেখেছেন তাতে সরকার দলের বেশ কয়েকজন মন্ত্রী তীব্র ক্ষোভ ব্যক্ত করেছেন। কথাগুলো তাদের পছন্দ হয়নি। আওয়ামী লীগের স্বভাবই হলো যা তাদের পছন্দ হয়না তা তারা কিছুতেই মেনে নিতে চায় না। সরকারের প্রতিক্রিয়া যাই হোক না কেন, প্রকৃতপক্ষে এ সরকারের প্রতি বিশ্বসম্প্রদায়ের কোনো সমর্থন নেই। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন দেশে-বিদেশে কোথাও গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয়ন ইউনিয়নসহ গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলো এ নির্বাচনকে বৈধতা না দেয়ায় বাংলাদেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি ও সার্বিক বিনিয়োগ পরিস্থিতিতে প্রচ- নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সরকার যে বিশাল আকৃতির বাজেট পেশ করেছে তা বাস্তবায়ন করতে হলে প্রচুর বিনিয়োগ প্রয়োজন। আর এজন্য বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের এ সরকারের প্রতি সমর্থন প্রয়োজন। সরকার সে সমর্থন অর্জন করতে পারেনি।
২০ দলীয় জোটনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার আন্দোলনের ঘোষণা ও সরকারের পক্ষ থেকে তা প্রতিহত করা এবং আগামী ৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পাল্টা ঘোষণা দেয়ায় ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী, সুশীলসমাজসহ সকল মহলে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
কোনো কোনো মহল আন্দোলনের ঘোষণাকে ভিন্নদিকে প্রবাহিত করার ষড়যন্ত্র করছেন। আন্দোলনের প্রস্তুতি, শরীক দলগুলোর সাথে আলোচনাসহ নানা প্রসঙ্গ টেনে এক ধরণের সংশয় ও ভুলবুঝাবুঝি সৃষ্টির অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে।
॥ চার ॥
ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস হচ্ছে আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস। এ ভূখ-ের আন্দোলনের বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে জনগণ আন্দোলনের নিয়ামক হিসেবে ভূমিকা পালন করে। ১৭৫৭ সালে মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে বাংলার স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর পরই জনগণ স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সে আন্দোলন সফলতা পেতে ১৯০ বছর লেগেছিল। ব্রিটিশদের জেল, জুলুম, নির্যাতন, অসংখ্য মানুষকে ফাঁসির কাষ্টে ঝুলিয়ে হত্যা, কোনো কিছুই জনগণকে দমাতে পারেনি। জনগণের আত্মত্যাগের মাধ্যমে আন্দোলন সফলতা অর্জন করে।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধকালে আওয়ামী লীগ নেতারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল এদেশের ছাত্র, যুবক, কৃষক-শ্রমিক, মেহনতি মানুষ। আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দকে এ রক্তাক্ত যুদ্ধে পাওয়া যায়নি। জনতার স্বতস্ফূর্ত প্রতিরোধে অগণিত মানুষের রক্তের বিনিময়ে দেশটি স্বাধীনতা অর্জন করেছে। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের সকল কৃতিত্বের দাবি করে। কিন্তু ওই সময় তারা ভারতে আশ্রয় নিয়ে গা বাঁচানোর যে চাতুর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল তা দেশবাসী ভুলে যায়নি।
১৯৮২ সালে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এরশাদ সাহেব ক্ষমতা দখল করেন। প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তিনি ৯ বছর ক্ষমতায় টিকে ছিলেন। নূর হোসেনের রক্ত দেয়ার মাধ্যমে শ্রমিক, ছাত্র জনতা যে দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল তাতে এরশাদ সাহেব বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। কোনো ধরণের কূটকৌশল, সংবিধানের দোহাই কাজে লাগেনি। ৯০ এর গণআন্দোলনেরও নিয়ামক ছিল এদেশের ছাত্র, যুবক, সাধারণ মানুষ।
২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত কেয়ারটেকার সরকার তার ক্ষমতার মেয়াদ নানা কৌশলে রবারের মতো টেনে লম্বা করার চেষ্টা করেছিল। ৪ দলীয় জোট সরকারের মন্ত্রী ও নেতৃবৃন্দের উপর অবর্ণনীয় নির্যাতন চালিয়েছিল। জনগণ তাদেরকে গ্রহণ করেনি। নিরাপদ প্রস্থানের জন্য আওয়ামী লীগের সাথে আঁতাত করে ডিজিটাল কারচুপির মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসিয়ে তারা পিঠ বাঁচায়। সে প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন জনগণ মেনে নিয়েছিল গণতন্ত্রের স্বার্থে। আওয়ামী লীগ কোনো কোনো কেন্দ্রে শতকরা ১০৫ ভাগ ভোট পেয়ে হাস্যকর বিজয় অর্জন করেছিল। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নিজেদের ইচ্ছামত সংবিধান পরিবর্তন, কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে নিজেদের অধীনে নির্বাচন সম্পন্ন করে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার বন্দোবস্ত করে। দেশের ৯০ ভাগ মানুষ আজও কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার পক্ষে। জনগণের ইচ্ছা, অভিব্যক্তিকে পাশ কাটিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা নামক যে বাঘের পৃষ্ঠে সওয়ার হয়েছে তা তাদের জন্য এক মহা বিপদ ডেকে আনবে।
রাষ্ট্র পরিচালনায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে ৩৮ বছর পূর্বের মিমাংসিত যুদ্ধাপরাধী ইস্যুটি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে রাজপথের আপোসহীন জামায়াতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে বিচারের নামে প্রহসনের আয়োজন করে। জাতিসংঘ, বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা, ইন্টারন্যাশনাল বার এ্যাসোসিয়েশন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বসম্প্রদায় এ বিচার নিয়ে প্রশ্ন তুলেন। কিন্তু শেখ হাসিনার প্রতিশোধ পরায়ণতার সামনে বিশ্বসম্প্রদায়ের আহ্বান কোনো অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারেনি। সরকারি ষড়যন্ত্রের নির্মম শিকার শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা। আব্দুল কাদের মোল্লার জন্য কেঁদেছে দেশ, কেঁদেছে সারা বিশ্ব। আজও সে কান্না চলছে। এ কান্না চলতে থাকবে অনাদি-অনন্তকাল পর্যন্ত। শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা বেঁচে থাকবেন এদেশের কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে। আর শেখ হাসিনা খুনী হিসেবে ইতিহাসের পাতায় চিহ্নিত হয়ে থাকবেন। অনাগত ভবিষ্যত বিচারের নামে এ জালিয়াতির জন্য ধিক্কার জানাবে। আর আব্দুল কাদের মোল্লার জন্য কেঁদে বুক ভাসাবে। এটাই নির্মম সত্য। এই সত্য উপলব্ধি করার ক্ষমতা শেখ হাসিনা হারিয়ে ফেলেছেন।
জনগণ আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্র বুঝে ফেলেছে। মুক্তিযুদ্ধের দোহাই দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করা যায়নি। জামায়াতের উপর সীমাহীন দমন-পীড়ন চালিয়েও জামায়াতকে পর্যুদস্ত করা সম্ভব হয়নি। উপজেলা নির্বাচনে জনগণ জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীদের ২০০টি উপজেলায় বিজয়ী করে আওয়ামী ষড়যন্ত্রের সমুচিত জবাব দিয়েছে। আওয়ামী লীগ, কেন্দ্র দখল, ভোট জালিয়াতির মহোৎসব পালন না করলে উপজেলা নির্বাচনে তাদের আরো করুণ পরিণতি বরণ করতে হতো। জোর করে ক্ষমতায় থাকার এটাই বৈশিষ্ট্য যে, তারা জনগণের মনের ভাষা বুঝার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
বিরোধী দলের পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন যাবৎ সরকারের কাছে আবেদন, নিবেদন করা হচ্ছে আলোচনার টেবিলে বসে সমস্যার সমাধান করতে। কিন্তু সরকার তাতে কর্ণপাত না করে আলোচনার সম্ভাবনা নাকোচ করে দিয়েছেন। তারা ৫ বছর ক্ষমতায় থাকারই ঘোষণা দিয়ে বেড়াচ্ছেন। সমগ্র বিশ্বের জনমত হচ্ছে আলোচনার মাধ্যমে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য সুষ্ঠু নির্বাচন দেয়ার পক্ষে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচন চেয়েছে। বাংলাদেশে নবনিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া স্টিফেন্স ব্লুম বার্নিক্যাট বলেছেন, “বাংলাদেশে ৫ জানুয়ারির সংসদীয় নির্বাচন ত্রুটিপূর্ণ ছিল। এখন প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার গঠনের দিকে এগিয়ে যেতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর জরুরি ভিত্তিতে গঠনমূলক সংলাপে অংশগ্রহণ করা দরকার।” এসব বক্তব্যকে উড়িয়ে দিয়ে দাম্ভিক সরকারের মন্ত্রীগণ বলছেন, “নির্বাচনে কেউ না আসলে সে নির্বাচন ত্রুটিপূর্ণ হয় একথা আমরা মানি না।” সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল নিয়ম রক্ষার প্রয়োজনেই নির্বাচন করতে হচ্ছে। সরকারের এ ধরণের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে বিএনপি-জামায়াত জোট আন্দোলন বন্ধ করে দিয়েছিল এই ভেবে যে, হয়তো নির্বাচন শেষে সর্বজনগ্রাহ্য, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেবে আওয়ামী লীগ। কিন্তু এখন সরকার বলছে, তারা ৫ বছরই ক্ষমতায় থাকবে। ৫ বছর শেষে নির্বাচন হবে। সংলাপের কথা বললেই প্রধানমন্ত্রী ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, “কিসের সংলাপ, সরকারের মেয়াদ শেষ হতে আরো ৪ বছর ৭ মাস বাকি। এখনই এত অস্থিরতা কেন? সবকিছু চলবে সংবিধান অনুযায়ী।”
সরকার যদি মনে করেন, আন্দোলনের মাধ্যমে আন্দোলনকারীরা অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌছতে পারবে না এবং মাঠে মোকাবেলা করেই বিরোধী দলকে পরাজিত করবেন, তাহলে বলতে হবে সরকার বোকার স্বর্গে বাস করছে। আওয়ামী লীগ খেলার মাঠে মোকাবেলার কথা বলেছেন। কিন্তু স্বার্থপর, দুর্নীতিপরায়ণ ও ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলকারী মন্ত্রী-এমপিগণের পক্ষে খেলার মাঠে দেশের বিপুল জনশক্তির বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন সম্ভব নয়। এই খেলায় জনতার স্বতস্ফূর্ত সমর্থন প্রয়োজন। আওয়ামী লীগের পক্ষে জনগণের কোনো সমর্থন নেই। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর মনে রাখা উচিত বিশ্বকাপ খেলায় জাগরণ সৃষ্টিকারী ব্রাজিলের মতো ৭টি গোল খেয়ে তাকে এক কলঙ্কজনক পরাজয় বরণ করে রাজনীতির ময়দান থেকে নির্বাসনে যেতে হতে পারে। পরাজয়েরও একটি মর্যাদা থাকে। কিন্তু ব্রাজিলের ফুটবলে পরাজয় তাদের কোনো মর্যাদাই রাখেনি। শেখ হাসিনারও তাই হবে।  আস্ফালন ভালো নয়। ভোটার বিহীন নির্বাচনকে ভিত্তি করে গঠিত সরকার কখনো বৈধ হতে পারে না। অবৈধ শক্তি জোর করে জনগণের উপর প্রভুত্ব করতে পারে না। বৃটিশরা পারেনি, পাকিস্তানীরা পারেনি, কোন স্বৈরশাসকই পারেনি, আওয়ামী লীগও পারবে না।
মতিউর রহমান আকন্দ 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads