বুধবার, ৬ আগস্ট, ২০১৪

এই দেউলেপনার জবাব কী


মুক্তিযুদ্ধকে পণ্য মানে বিকোবার শতভাগ কৃতিত্ব আওয়ামী লীগের। মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বাণিজ্যের পসরা সাজাবার মহৎকাজটিও আওয়ামী লীগ অত্যন্ত সাফল্যের সাথে সম্পন্ন করেছে। নতুন প্রজন্মকে নিয়ে সরকার প্রযোজিত শাহবাগ নাটকটি যখন গ্রিনরুম থেকে ব্ল্যাকরুমে, তখনই প্রাথমিক তথ্য পাওয়া গেল যুদ্ধবন্ধুদের সনদ ও ক্রেস্ট দেয়ার নামে একটি পুকুরচুরির ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। তার অল্প কদিন পর একটি জাতীয় দৈনিক জানিয়ে দিলো ক্রেস্টের স্বর্ণ জালিয়াতির খবরটি। এপ্রিল ৬ ক্রেস্টের স্বর্ণের ১২ আনাই মিছেশিরোনামের খবরটি দেশে-বিদেশে ঝড় তুলল; কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পরিচালিত সরকার এমন ভাব দেখাল, যেন এমনটি হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। প্রধানমন্ত্রী তার শপথনির্ভর নীতিনিষ্ঠ অবস্থান ভুলে রসের ভঙ্গিতে হাসিমাখা মন্তব্যটি করলেন, স্বর্ণকার নাকি মায়ের অলঙ্কারের স্বর্ণেও ভাগ বসায়। জাল-জালিয়াতি আর জোচ্চুরি নিয়ে রসিকতা আর কাকে বলে! আওয়ামী লীগ না হয়ে অন্য কোনো দল সরকারে থাকলে আওয়ামী লীগের ভূমিকা কী হতো ভেবে দেখা উচিত।
এ নিয়ে হইচই শুরু হলে একটি তদন্ত কমিটি করা হলো। সেটা বেশি দূর এগোলো না। এখন অধিকতর তদন্ত শুরুর একটা পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে, যাতে পুরো বিষয়টি দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়। জনগণ ভুলে যায়। রাজনীতির ইস্যু হতে যেন কোনো সুযোগ না থাকে, সেজন্য পুরো বিষয়টিকে ডিপ ফ্রিজে ফেলে রাখার বন্দোবস্ত হচ্ছে। অথচ জাতির ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে গেছে।
মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে বাণিজ্যটি আরো অনৈতিক এবং দেশ জাতির সাথে তো প্রতারণা বটেই, খোদ মুক্তিযুদ্ধ ও যোদ্ধাদের নিয়ে এক ধরনের তামাশাও বটে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে বাণিজ্য শুরু হয়, তার বেশির ভাগ হয় মুক্তিযোদ্ধা সনদ ও তালিকা নিয়ে। এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা দীর্ঘ হতে থাকে। যেন মাটি ভেদ করে মুক্তিযোদ্ধা প্রজনন শুরু হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি তারাও এই তালিকায় স্থান পায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় দুগ্ধপোষ্য শিশু বড় মাপের মুক্তিযোদ্ধার সনদ হাসিল করেন। চাকরি-বাকরি, ব্যবসাপাতি, লাইসেন্স-পারমিট পেয়ে যান এসব ভুয়া সনদধারী মুক্তিযোদ্ধারা। শুধু আওয়ামী লীগের খাতায় নাম লিখলেই হয়। এই তালিকায় থাকেন প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা, আইনের লোক, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক থেকে শুরু করে সব পেশার মানুষ। এ সময় আওয়ামী বুদ্ধিজীবী ও সুশীলরা কারো সতীত্ব খুঁজতে যান না। মুক্তিযুদ্ধ চেতনায়ও কোনো হেঁচকা টান পড়ে না।
চাকরিরত অবস্থায় চোরাপথে সনদ জোগাড়ের পর তিন হাজার কর্মচারীর মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিলের খবর পাওয়া যাচ্ছে। সব পেশার তালিকা ধরে টান দিলে দেশজুড়ে কত নালায়েক লোককে যে এ সরকার মুক্তিযোদ্ধা সাজিয়েছে, আর দেশের সম্পদ কী পরিমাণ লুণ্ঠনের সুযোগ করে দিয়েছে তার হিসাব করা কঠিন হয়ে পড়বে। ইতোমধ্যে তারা এই ভুয়া সনদ দেখিয়ে হালুয়া রুটি যা হাতাবার তা হাতিয়ে নিয়েছেন। কেউ কেউ অবসরে চলে গেছেন। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল, সেক্টর কমান্ডার ফোরামসহ মুক্তিযুদ্ধ ও যোদ্ধা নিয়ে যেসব ধান্ধাবাজ বণিক শ্রেণীর লোক জনগণকে এত দিন বোকা বানিয়েছে, ধোঁকা দিয়েছে, তাদের কি কোনো বিচার হবে না? যারা মুক্তিযুদ্ধ ও যোদ্ধাদের নিয়ে এমন অনৈতিক ও জাল-জালিয়াতির মতো কাজ করে, তারা শপথের ওপর টিকে থাকে কী করে! এই সরকার শুধু ক্রেস্টের সোনা তছরুপ এবং মুক্তিযোদ্ধা সনদ জালিয়াতির দায় মাথায় নিয়ে পদত্যাগ করা উচিত ছিল, অথচ এত বড় অপরাধের জন্য কারো গায়ে আঁচড়টাও কাটল না।
আওয়ামী লীগ একটি রাজনৈতিক দল। তারা একটি জোটের নেতৃত্ব দিচ্ছে। একটি সরকার পরিচালিত হচ্ছে দলটির নেতৃত্বে। যেকোনো দল ও সরকারের সাফল্য ব্যর্থতা থাকে। তবে আওয়ামী লীগ এবার নৈতিক অবস্থানের দিক থেকে একেবারে দেউলিয়া। সেটা ব্যাংক লুণ্ঠন থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বানানো থেকে মিথ্যা মামলাবাজি পর্যন্ত। ফলে তাদের পাঁচটি সাফল্য থাকলে পঞ্চাশটি ব্যর্থতা রয়েছে। তারপরও তারা রাজনৈতিক ক্ষমা পেতে পারে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে সীমাহীন অনৈতিকতার দায় থেকে কোনোভাবেই মুক্তি পেতে পারে না। নতুন প্রজন্ম কোনোভাবেই আওয়ামী লীগকে ক্ষমা করবে না।
দুর্ভাগ্য যে, আওয়ামী লীগ দেশ ও জাতির সাথে যে প্রতারণা করেছে তার তুলনা শুধু মুসলিম বিশ্বের সাথে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের ভূমিকার তুলনা করা যেতে পারে। যে কেউ কান পাতলে এবং অতীত স্মরণে আনলে শুনতে পাবেনÑ যুদ্ধবাজ সাবেক আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বুশ এবং ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর দাম্ভিকতা, ঔদ্ধত্য এবং একরোখা বক্তব্যের সাথে আমাদের শাসক দলের নীতিনির্ধারকদের কী আশ্চর্য মিল। তা ছাড়া গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন এবং নীতিনিষ্ঠ অবস্থানের বিবেচনায় তারা যে পরিমাণ দ্বৈত চরিত্রের, আমাদের শাসকেরা সমপরিমাণ ডাবলস্ট্যান্ডার্ড নীতির অনুসারী।
যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে মারণাস্ত্রের দোহাই দিয়ে আক্রমণ করে শুধু ইরাককে নয় বাগদাদ সভ্যতাকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত হলো ইরাকে তথা সাদ্দাম হোসেনের কাছে কোনো মারণাস্ত্র ছিল না। বিষয়টি ছিল আরোপিত মিথ্যা। অথচ সেই ইরাক আর ফিরে আসবে না। লাখো মানুষকে আর জীবিত করা যাবে না। পাচার হওয়া সম্পদ আর কোনো দিন ইরাকিরা পাবে না। সাদ্দামেরও পুনর্জন্ম হবার নয়।
একই কায়দায় আফগানিস্তানে একটি পাথুরে মূর্তি উদ্ধারের জন্য বাহানা তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ চাপাল। একটি দেশকে পোড়ামাটিতে রূপান্তর করল। শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত হলো খবরটি ছিল অতিরঞ্জিত। দামেস্ক ও মিসরীয় সভ্যতাকেও যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইলের চক্রান্তে, পশ্চিমা গোষ্ঠীর মদদে, আরব শাসকদের সমর্থনে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হলো। লাদেন খুঁজতে গিয়ে পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বকে যুক্তরাষ্ট্র ছেঁড়া নেকড়ার মতো বাতাসে উড়িয়ে দিলো। তালেবান-জঙ্গি দমনের নামে পাকিস্তান এখন ড্রোন হামলা ও মার্কিন অত্যাচারের নিপীড়ন ক্ষেত্র।
তিনজন ইসরাইলি অপহরণের মিথ্যা অভিযোগ তুলে গাজা আক্রান্ত হলো। নিহত হলো প্রায় দুই হাজার ফিলিস্তিনি। দুদিন আগে একজন ইসরাইলি সেনা খুনের প্রতিশোধ নিতে গাজায় রক্তগঙ্গা বইয়ে দিলো বর্বর ইহুদি বাহিনী, শহীদ করে দিলো পঞ্চাশজন ফিলিস্তিনিকে। অথচ দুটো তথ্যই ছিল অতিরঞ্জিত। ইরানের ঘাড় মটকানোর শেষ চেষ্টায়ও যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইল একাট্টা। ইরানের অপরাধ তারা পরমাণু শক্তিধর হতে চায়। অথচ যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল পরমাণু অস্ত্রের পাহাড় গড়ে তুলেছে। ইরানের জন্য যা পাপ, তাদের জন্য সেটা লীলাখেলা। এই স্বঘোষিত দারোগাগিরির বিরুদ্ধে পৃথিবী নিশ্চুপ।
ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে পরাশক্তি। ঘটে যাচ্ছে মুসলিম দেশগুলোতে। কোথাওবা মুসলমানদের ওপর। বসনিয়া, চেচনিয়া, পাতান, রোহাঙ্গ, কাশ্মির, জিনজিয়াং কিছু উপমা মাত্র। ফিলিস্তিনের গাজায় যুদ্ধটা অসম। এখানে প্রক্সি-যুদ্ধ করছে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা মিত্ররা। তাদের নতুন অস্ত্রের পরীক্ষাগার হচ্ছে ইরাক, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিনসহ মুসলিম বিশ্ব। গিনিপিগ হতে হচ্ছে কোটি কোটি মুসলিম উম্মাহর সদস্যকে। বাংলাদেশে এ সরকার গিনিপিগ বানিয়েছে বাঙালি মুসলমানদের। ইস্যু স্বাধীনতার তর্কিত প্রতিপক্ষ। এদের নাম জঙ্গি, মৌলবাদী, সন্ত্রাসী, হেফাজতি ...। যুদ্ধ কৌশল অভিন্ন। শুধু ময়দান আলাদা।
 
যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইলের কাছে যেমন হামাস, ব্রাদারহুড, তালেবান, ইরাকি, ইরানি, সিরীয়, মিসরীয়, আফগানিস্তান কিংবা লাদেন গোষ্ঠী সবাই জঙ্গি, মৌলবাদী। পশ্চিমাদের নিরন্তর সন্ত্রাস দমনের ছদ্মবেশে চলছে মুসলিম নিধন ও তাদের জনপদ ধ্বংস উৎসব। আওয়ামী লীগ সরকারের অন্তহীন যুদ্ধ চলছে স্বাধীনতার প্রতিপক্ষ চিহ্নিত করে তাদের দমনের ছদ্মবেশে সব রাজনৈতিক ও আদর্শিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নিধনযজ্ঞ।
 
আমাদের মন্তব্য রূঢ় কিন্তু অবাস্তব নয়। তারপরও আওয়ামী লীগ সরকার ইচ্ছে করলে আত্মপক্ষ সমর্থন করে বক্তব্য দিতে পারে। আলোচ্য বিষয়ে তাদের একটি বক্তব্য শুনতে আমরা আগ্রহী। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে এটা যেমন ঠিক, তেমনি মুক্তিযুদ্ধকে ক্ষমতার সিঁড়ি বানিয়ে রাজনৈতিক বাণিজ্যও করেছে এটাও মানতে হবে। এ সত্যটাও মানতে হবে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি গণযুদ্ধ। সাত কোটি মানুষ আওয়ামী লীগের ছিল না, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে শরিক থেকেছে। তাই দেশকে তালুক, জনগণকে প্রজা বানিয়ে রাখার অধিকার এককভাবে কারো নেই। 

মাসুদ মজুমদার


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads