রবিবার, ১০ আগস্ট, ২০১৪

জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা : আরেকটি কুখ্যাত কালাকানুন



গণতন্ত্র এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বুলি আওড়াতে আওড়াতে আওয়ামী লীগ মুখ দিয়ে ফ্যানা তুলেছে। ১৯৯৬ সালে তারা রেডিও এবং টেলিভিশনের স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবিতে বাংলাদেশের মাঠ ঘাট গরম করে ফেলেছিল। ৯৬ সালে যে নির্বাচন  অনুষ্ঠিত হয় সেই নির্বাচনে দলীয় মেনিফেস্টোতে আওয়ামী লীগ রেডিও এবং টেলিভিশনকে স্বায়ত্ত্ব শাসন দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিল। আওয়ামী লীগ তো কোন সময় অঙ্গীকার রক্ষার পার্টি হতে পারেনি। বরং ওয়াদার বরখেলাপ করাই আওয়ামী লীগের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই ৯৬ সালে পুরা ৫ বছরের জন্য ক্ষমতায় থাকলেও এই ৫ বছরে একটি বারের জন্য তারা রেডিও ও টেলিভিশনের স্বায়ত্ত্ব শাসনের বিষয়টি মুখে আনেনি। এবার ভূয়া নির্বাচনে মেয়াদে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে কাজ করছে ঠিক তার উল্টা। সেদিন যে মিডিয়া পলিসি বা সম্প্রচার নীতি ঘোষিত হল, যেটি মন্ত্রীসভা অনুমোদন করেছে এবং সরকারী গেজেটও হয়েছে। এবার স্বায়ত্ত্ব শাসনের পরিবর্তে সরাসরি রেডিও এবং টেলিভিশন এবং পরোক্ষ ভাবে সংবাদ পত্রেরও পায়ে ডান্ডা বেড়ী পরানো হয়েছে। আওয়ামী লীগের এই ধরনের চোখ উল্টানোতে অভিজ্ঞ মহল মোটেই অবাক হন না। কারণ চোখ উল্টানো তাদের মজ্জাগত স্বভাব। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে পাকিস্তানের ২৪ বছরে তৎকালীন সরকার ‘ইত্তেফাকের’ ওপর অনেক জুলুম চালিয়েছে। ‘ইত্তেফাক’ আওয়ামী লীগ সমর্থক পত্রিকা ছিল। আওয়ামী লীগ সংবাদ পত্র দলনের কড়া প্রতিবাদ করেছে এবং সংবাদ পত্রের স্বাধীনতার দাবীতে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করেছে। তাদের এই চিৎকারে জনগণ এই কারণে বিভ্রান্ত হয়েছেন যে আওয়ামী লীগ আসলেই প্রচার মাধ্যমের স্বাধীনতার দৃঢ় সমর্থক এবং প্রবক্তা।
কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আওয়ামী সরকার মারল এক বিরাট ডিগবাজি। আওয়ামী লীগের প্রথম সরকার সাড়ে তিন বছর ক্ষমতায় ছিল। এই সাড়ে তিন বছরে তারা প্রমাণ করেছে যে, যখন তারা বিরোধী দলে থাকে তখন তারা প্রচার মাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে। কিন্তু যখনই তারা ক্ষমতায় যায় তখনই তাদের প্রধান কাজ হয় গণতন্ত্রকে হত্যা করা। আওয়ামী লীগের ৬৫ বছরের ইতিহাস সেই সাক্ষ্যই দেয়। আওয়ামী লীগের ইতিহাস বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস। আওয়ামী লীগের ইতিহাস ওয়াদা ভঙ্গের ইতিহাস। গণতন্ত্রের ললিত বাণী উচ্চারণ করে আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসেছিল। আওয়ামী লীগের ওয়াদা ছিল জনগণের ভোট এবং ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। (যদিও জনগণের ভোট ও ভাতের অধিকার পূর্ণমাত্রায় বিরাজমান ছিল)। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ওয়াদা দিয়েছিল যে, তারা বিচার বিভাগকে স্বাধীন ভাবে কাজ করতে দেবে। আওয়ামী লীগ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, রেডিও এবং টেলিভিশনের স্বায়ত্ত্ব শাসন দেবে। আওয়ামী লীগ আরও ওয়াদা করেছিল, তারা বাক স্বাধীনতা, মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, রাজনৈতিক দল করা এবং সভা-সমিতি ও মিছিল করার স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করবে। অতীতেও তারা এই ধরনের ওয়াদা করেছিল। কিন্তু যখনই তারা ক্ষমতায় গেছে তখনই তারা সবগুলো ওয়াদা গিলে খেয়েছে এবং সব ধরনের স্বাধীনতাকে তারা হত্যা করেছে। এবারও আওয়ামী লীগ তাই করেছে। ভোটের অধিকার হরণ করেছে এবং মতামত প্রকাশের অধিকার গলা টিপে ধরেছে। গত সোমবার মন্ত্রীসভার বৈঠকে সম্প্রচার নীতিমালা অনুমোদিত হয়েছে। এই নীতিমালায় যে সব বিধান রয়েছে সেসব বিধান প্রয়োগ করলে সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করা হবে, রেডিও টেলিভিশনের টুঁটি চেপে ধরা হবে, বাক স্বাধীনতা ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হবে এবং সংবাদপত্রের কলামিস্ট এবং টেলিভিশনের টকশোর আলোচকদের স্বাধীন মতামত প্রকাশের কোমরে ডান্ডা বেড়ী পরানো হবে। গত ৪ আগস্ট প্রচার মাধ্যমের ইতিহাসে একটি কৃষ্ণ দিবস হিসেবে চিহ্নিত থাকবে। গত কয়েক দিন ধরে বিভিন্ন মহলের প্রতিক্রিয়ায় এই সত্যটিই বেরিয়ে এসেছে।
গত বৃহস্পতিবার নাগরিক ঐক্য একটি গোল টেবিল বৈঠক করেছে। বৈঠকের বিষয়বস্তু ছিল “নিয়ন্ত্রণ মূলক সম্প্রচার নীতিমালা জনগণ মানবে না”। বৈঠকে বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, স্বৈরাচারী শাসকরা প্রথমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর নির্ভরশীল হয়। এরপর তারা গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ নিতে তাদের ওপর চড়াও হয়। বর্তমান সরকার সেই স্বৈরাচারী কায়দায়ই অবলম্বন করছে। এই নীতিমালা এখন আটকাতে  না  পারলে সরকার আইন করে আগামী জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি, খুব বেশি হলে মার্চের মধ্যে গণমাধ্যম বন্ধ করা শুরু করবে। ড. আসিফ নজরুল বলেন, ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর থেকে টক শো নিয়ন্ত্রণ করছে সরকার। আর এই নীতিমালার মাধ্যমে গণমাধ্যমকে সার্বিকভাবে নিয়ন্ত্রণে নিতে চাচ্ছে তারা। আমি ও নুরুল কবিরকে চ্যানেল আইয়ের টকশোতে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ওদের তো সাহস নেই আমাকে, নুরুল কবিরকে ডাকার। এমন অনেক আলোচককে এখন সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে টকশো’তে ডাকা হয় না। এ ভাবে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে সবচেয়ে বেশি মিথ্যা বলছে বর্তমান সরকার। মিথ্যা বলার কারণ,  এই সরকার অনির্বাচিত সরকার। তিনি প্রশ্ন করেন, ‘বন্ধু রাষ্ট্রের’ সংজ্ঞা কি? তাহলে আমরা কি তিস্তার কথা বলতে পারবো না? ফেলানী হত্যা, বাংলাদেশে ভারতীয়দের অবৈধ চাকরির কথা বলতো পারবো না?
সাংবাদিক আশরাফ কায়সার বলেন, ফ্যাসিবাদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ভিন্নমতকে সহ্য না করা। ভিন্নমত দমনেই সরকার এ নীতিমালা করেছে।  প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা থেকে এখন বলা হচ্ছে অমুক-তমুককে টক-শো’তে আনবেন না। সরকার টকশো’কে ভয় পায়। সরকারের বোঝা দরকার ১৯৭৫ সালে গণমাধ্যম বন্ধ করার প্রায়শ্চিত্ত আওয়ামী লীগ একবার করেছে। এবারও করতে হবে। নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মান্না বলেন, দেশকে ধ্বংসের জন্য যতগুলো প্রক্রিয়া নেয়া দরকার সরকার তার সবই করছে। সরকার সম্প্রচার নীতিমালা তৈরি করছে এই কারণে যে, মানুষ যাতে আর আমাদের দেশের টেলিভিশন না দেখে ভারতীয় সিরিয়াল দেখে। এতে ধ্বংস হবে দেশীয় সংস্কৃতি। তিনি বলেন, দুর্নীতিবাজ ও মিথ্যাবাদীদের ‘রক্ষাকবচ’ হিসেবে এই নীতিমালা প্রণয়ন করতে চাচ্ছে সরকার। এই নীতিমালা বাতিলপূর্বক সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে অবিলম্বে সম্প্রচার কমিশন গঠন এবং কমিশন কর্তৃক নীতিমালা প্রণয়নের আহ্বানও জানান সাবেক এই আওয়ামী লীগ নেতা।
দুই
 আওয়ামী লীগ ৪টি মেয়াদে ৪ বার ক্ষমতায় এসেছে। শেষের মেয়াদে অর্থাৎ বর্তমান মেয়াদে তারা গায়ের জোরে ক্ষমতায় এসেছে। একটি  দেশে সামরিক শাসন আসে বন্দুকের জোরে। কিন্তু এই সরকার গত ৫ই জানুয়ারী নির্বাচনের নামে তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসেছে পুলিশ র‌্যাব এবং বিজিবির বন্দুকের জোরে। প্রতিটি মেয়াদেই তারা এক একাধিক বার কালা কানুন জারি করেছে। ১৯৭৩ সালে প্রথম মেয়াদে তারা জারি করে ‘সংবাদপত্র ও প্রকাশনা আইন’  (প্রেস এ্যান্ড পাবলিকেশন্স অ্যাক্ট)। একই মেয়াদে অর্থাৎ পরের বছর ১৯৭৪ সালে তারা জারি করে আরেকটি কালা কানুন। সেটির নাম ‘বিশেষ ক্ষমতা আইন’। পাকিস্তান আমলে যখন ডিপিআর অর্থাৎ ডিফেন্স অব পাকিস্তান রুলস বা পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইন জারি করা হয় তখন আওয়ামী লীগ তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। কিন্তু সেই আওয়ামী লীগই ১৯৭৪ সালে জারি করে বিশেষ ক্ষমতা আইন। এটি পাকিস্তানের ডিপিআরএর চেয়ে কোন অংশে উন্নত এবং উদার ছিলনা। বরং সিভিলিয়ানের মোড়কে আরেকটি ডিপিআর জারি করা হয়। সেই জন্যই কিছুক্ষণ আগে বলেছি যে, আওয়ামী লীগের ইতিহাস হল বিশ্বাস ঘাতকতার ইতিহাস। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের জানুয়ারী মাসে জারি করা হয় আরোও বেশি কুখ্যাত আইন এবং আরো বেশি কালা কানুন। ঐ বছর অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারী দেশব্যাপী প্রবর্তন করা হয় এক দলীয় বাকশালী শাসন। এই একদলীয় শাসনে মিডিয়াকে পদানত করার জন্য দেশে মাত্র চারটি সংবাদপত্র রাখা হয়। অবশিষ্ট সমস্ত সংবাদপত্র বিলুপ্ত করা হয়। যে ৪টি সংবাদপত্রকে জিন্দা রাখা হয় সেই ৪টি সংবাদ পত্রকেও প্রত্যক্ষ  সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনা হয়।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ২য় মেয়াদে ক্ষমতায় আসে। এবার ক্ষমতায় এসে তারা ভিন্ন ভাবে সংবাদপত্র দলন করা শুরু করে। ‘দৈনিক বাংলা’, ‘বাংলাদেশ টাইমস’ এবং সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’ বন্ধ করা হয়। ২০০৮ সালে তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে ২০১৩ সালে ‘দৈনিক আমার’ দেশ বন্ধ করা হয়। অন্যদিকে ‘দিগন্ত টিভি’ এবং ‘ইসলামিক টিভি’ও বন্ধ করা হয়। এর আগে তারা ‘চ্যানেল ওয়ান’ নামক টিভিটি বন্ধ করে দেয়। ‘আমার দেশে’র সম্পাদক মাহমুুদুর রহমানকে বছরের পর বছর কারাগারের অন্ধকারে পচানো হচ্ছে। পাকিস্তান আমলে ‘দৈনিক ইত্তেফাকের’ প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে একাধিক বার গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু কোন বার তাকে এত দীর্ঘ সময় ধরে কারাগারে রাখা হয়নি। এছাড়া কারাগারের ভেতরেও তার সাথে ভিআইপির মত ব্যবহার করা হয়। চতুর্থ মেয়াদে অর্থাৎ গত ৫ই জানুয়ারী র‌্যাব এবং পুলিশের জোরে ক্ষমতায় এসে এবার গ্রহণ করা হল জাতীয় সম্প্রচার নীতি। এই সম্প্রচার নীতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে গেলে এই ধরনের একটি মাত্র কলামে শেষ করা যাবে না।
বাংলাদেশের মত একটি স্বাধীন এবং গণতান্ত্রিক দেশে এই ধরনের নীতিমালার কোন প্রয়োজন নাই। বিগত ৪৩ বছর ধরে এ দেশে সংবাদপত্র এবং টেলিভিশন তাদের সম্পাদকীয় এবং সম্প্রচার নীতিতে সব সময় দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে দায়িত্ব হীনতার একটি উদাহরণও চোখে পড়ে না। তারপরেও বলতে চাই যে, এই ধরনের নীতি যদি আদতেই প্রণয়ন করতেই হয় তাহলে সেটি করবে একটি সম্প্রচার কমিশন, সরকার নয়। অথচ সরকার আগে ভাগেই সম্প্রচার নীতি প্রণয়ন করেছে, সেটি মন্ত্রীসভায় অনুমোদন করেছে এবং গত বৃহস্পতিবার গেজেট নোটিফিকেশন করে সেটি সার্কুলেট করেছে। এরপর নাকি সম্প্রচার কমিশন গঠিত হবে। একথা বললে অযৌক্তিক হবে না যে সম্প্রচার নীতিমালা প্রস্তাবিত কমিশনের সামনে একটি গাইড লাইন হিসেবে কাজ করবে। সুতরাং সেই সম্প্রচার কমিশন হবে একটি ‘জো হুজুর’ বা আজ্ঞাবাহী কমিশন। সরকার এখানে ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দিয়েছে। মন্ত্রীসভা অনুমোদিত নীতিমালায় এমন সব বিধান রয়েছে যে সরকার ইচ্ছা করলে যে কোন সময় যে কোন টেলিভিশন বা রেডিও যে কোন অযুহাতে নীতিমালার অপব্যাখ্যা করে বন্ধ করে দিতে পারে। সম্ভবত সেটি আশঙ্কা করেই আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেছেন, যদি এখনই এই সম্প্রচার নীতিমালার বিরুদ্ধে এখনই প্রতিবাদ গড়ে তোলা না যায় তাহলে আগামী জানুয়ারী ফ্রেব্রুয়ারী মাসের মধ্যেই এক বা একাধিক মিডিয়া সরকারি রোষানলে পড়ে বন্ধ হয়ে যাবে। এ জন্যই বলা হচ্ছে যে, এই আইন হল একটি কুখ্যাত কালা আইন এবং যেদিন থেকে এই আইনটি কার্যকর হবে সে দিনটি হবে বাংলাদেশের জন্য একটি কৃষ্ণ দিবস।
আসিফ আরসালান

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads