বৃহস্পতিবার, ৭ আগস্ট, ২০১৪

দুর্ঘটনা নাকি হত্যাকান্ড


ঈদ মানেই তো আনন্দ। সে আনন্দ উপভোগ করতে নারীর টানে ছুটে যায় মানুষ গ্রামে। কিন্তু ঈদের আনন্দ যখন দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে বিলীন হয়ে যায় তখন আর কষ্টের সীমা থাকে না। এবারের ঈদ আনন্দটা উপভোগ করতে হয়েছে টেনশন আর অস্থিরতার মধ্য দিয়ে। ঈদের নামাযের মুনাজাতে মহান প্রভুর দরবারের অনেক দোয়াই করেছিলাম তার মধ্যে অন্যতম ছিলো দুর্ঘটনার কথা। আমরা যখন ঈদের নামায পড়েছি ঠিক সে সময়ে অনেকে হাসপাতালের বেডে, আবার অনেকে বিনা অপরাধে জেলখানায় দিনাতিপাত করছেন। অনেকে জীবনের তাজা রক্ত বিলিয়ে দিয়ে ইহুদিদের মুকাবেলা করছেন। প্রতিটি মানুষের মৃত্যু অবধারিত। মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পাওয়ার সুযোগ কারও নেই। তারপরও কিছু মৃত্যু সহজে মেনে নেয়া যায় না। প্রতিনিয়ত দেশের সড়কে মানুষের রক্ত ঝরছে। সড়কের রক্তের সাথে পাল্লা দিয়ে নদীতেও ঝরছে রক্ত। অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন দুর্ঘটনা একটু হলেও বেড়েছে। আমরা কেউ আজ আর নিরাপদে দিনাতিপাত করতে পারছি না। হত্যা, গুম, অপহরণের এই দেশে স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি আজ শুন্যের কোঠায়। কোথাও যেনো এতটুকু জায়গা নেই যেখানে দাঁড়িয়ে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা যায়। গত সোমবার প্রায় তিনশ যাত্রী নিয়ে শরীয়তপুরের কাওড়াকান্দি থেকে মুন্সীগঞ্জের মাওয়াঘাটে আসার পথে ডুবে যায় ফিটনেসবিহীন লঞ্চ পিনাক-৬। আমি যখন এই লেখাটি লিখছি তখন পদ্মায় ডুবে যাওয়া এমএল পিনাক-৬ লঞ্চের তিন শতাধিক যাত্রীর মধ্যে ২জন যাত্রীর লাশ পাওয়া গেছে। আশা করছি লেখাটি যখন প্রকাশিত হবে তখন হয়তবা বাকি যাত্রীদের স্বজনেরা লাশের সন্ধান পাবে। লাশ নিয়ে লুকোচুরি করার চেষ্টা কোনো মহল যেনো করতে না পারে ক্ষতিপূরণের আশায় সেই প্রত্যাশা করছে নিহত স্বজনেরা। নিহত যাত্রীদের লাশ যদি স্বজনেরা পায় তাহলে তাদের বুকফাটা কান্না একটু হলেও কমবে বৈ বাড়বে না।
বর্ষায় মওসুমে লঞ্চ দুর্ঘটনা নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর এ সময়ে পানিপথে শত শত মানুষের প্রাণ চলে যাচ্ছে না ফেরার দেশে। দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সরকারের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেয়ার কথা থাকলেও বাস্তবের চিত্রটা একটু ভিন্ন হওয়ায় বার বার নদীপথে এরকম দুর্ঘটনা লাগামহীনভাবে ঘটে চলছে। গত সোমবারে পদ্মায় ডুবে যাওয়া এমএল পিনাক-৬ লঞ্চটির দুর্ঘটনার সে দৃশ্য দেখে মনে হয়েছে তা স্রেফ একটি হত্যাকা-। মিডিয়ার বদৌলতে লঞ্চটি ডুবে যাওয়ার দৃশ্য দেখেছে গোটা বিশ্ববাসী। ফলাও করে প্রচার করেছে দেশীয় মিডিয়া তথা আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলো।
ডুবে যাওয়া লঞ্চটির যাত্রীরা যেভাবে আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলে আল্লাহর আশ্রয় কামনা করেছেন। তা ছিলো সত্যিই বেদনাদায়ক। ১৯১২ সালে টাইটানিক যেভাবে সাগরে ডুবেছিলো ঠিক একই কায়দায় পদ্মায় এমএল পিনাক-৬ লঞ্চটি ডুবলো। টাইটানিকের আবিষ্কারক ঔদ্বাত্ত্ব দেখিয়ে বলেছিলো টাইটানিক কখনও ধ্বংস হবে না। কিন্তু অবশেষে টাইটানিকও সাগরে ধ্বংস হয়ে ইতিহাস হয়ে রইল। দুর্ঘটনাকবলিত লঞ্চের প্রায় ১০০ জন যাত্রীকে জীবিত উদ্ধার করা গেলেও ১৩২ জন যাত্রীর কোনো হদিস মেলেনি। দুদিন পার হয়ে গেলেও ডুবে যাওয়া লঞ্চটির খোঁজ এখনও মেলেনি। আর নিখোঁজ ১৩৩ জনের তালিকা প্রকাশ করেছে স্থানীয় প্রশাসন। ধীর গতিতে উদ্ধার তৎপরতা দেখে ক্ষোভ বেড়েছে নিহত স্বজনদের। পদ্মার তীর স্বজনদের বুকফাটা কান্না আর আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠেছে। নিহত স্বজনদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে পরিণত হয়েছে বিক্ষোভ-অবরোধ। কেউ কেউ ট্রলার আর স্পিডবোট নিয়ে চষে বেড়াচ্ছেন পদ্মানদী। শুধুমাত্র প্রিয় মানুষগুলোর লাশ পাওয়ার আশায়। এখন শুধু লাশের অপেক্ষায় প্রহর গুণতে হচ্ছে। ডুবে যাওয়া লঞ্চটি শনাক্ত ও নিহতদের লাশের সন্ধানে মঙ্গলবার বিআইডব্লিউটিএ, বিআইডব্লিউটিসি, র‌্যাব, নৌপুলিশ, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সদস্যরা যৌথভাবে তৎপরতা চালিয়েও তেমন সুফল পায়নি। মাওয়াঘাটের আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে ওঠেছে নিহত স্বজনদের আহাজারিতে। স্বজনহারা মানুষগুলোর চেহারায় দিকে তাকানো যায় না। কাঁদতে কাঁদতে তাদের চোখ ফুলে গেছে। গলা ভেঙ্গে গেছে। মুখের ভাষা ফুরিয়ে গেছে। এরপরও তারা কাঁদছে। নিহত স্বজনহারাদের মুখে ছিলো অভিযোগ আর ক্ষোভের ছাপ। তারা সরকারকে উদ্দেশ্য করে বলতেছিলো ‘ভাই সরকারকে একটু বলেন না আমরা যাতে লাশটা পাই, আর কতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকুম। আরেকটা অনুরোধ সরকারকে বলেন, আমার দুই বছরের মাইয়া সারার লাশটার পেট কেটে যেন নদীতে ফেলে না দেয়।’ দুঃখভরা হৃদয় দিয়ে কথাগুলো বলছিলো নারায়ণগঞ্জের শহীদুল ইসলাম। উদ্ধারকাজে ধীরগতি দেখে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, কেন লঞ্চ খুইজ্যা পাইবে না, এত বড় বড় জাহাজ, এই নদীতে যদি লঞ্চ খুইজা না পাওয়া যায় তাহলে সাগরে ডুবলে কি হইত? নিহতের স্বজনেরা আরো অভিযোগ করে বলেন, সরকার ক্ষতিপূরণ না দেবার জন্য উদ্ধারকাজে ধীরগতি করতেছে। আমরা সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণ চাই না। আমরা আমাদের স্বজনদের লাশ চাই। অভিযোগ ওঠেছে অতিরিক্ত যাত্রী নেয়ার কারণেই লঞ্চটি দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে।
এক কথায় বলা যায় যে, দেশের লঞ্চ মালিকরা সারা বছরই অতিরিক্ত যাত্রী বহন করে থাকেন। অথচ তা দেখার যেনো কেউ নেই। দুর্ঘটনায় মানুষের জীবন চলে গেলে তারপর সরকার তৎপরতা দেখায়। তা যদি দুর্ঘটনা ঘটবার আগে দেখাতে পারতো তাহলে এতো মানুষের প্রাণ পানির সাথে মিশে যেতো না। সরকার এ দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারবে না। প্রতি বছর ঈদের সময় অতিরিক্ত যাত্রী বহনরোধে নানা কড়াকড়ি আরোপের কথা ঘোষণা করা হলেও অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়েই চলাচল করে লঞ্চগুলো। আর সরকারের আজ্ঞাবহ বাহিনীর চোখের সামনে দিয়েই প্রতিনিয়ত চলে ফিটনেসবিহীন লঞ্চ। তাই জনমনে আজ প্রশ্ন ওঠেছে, সরকারের নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে থাকেন। যার ফলে দুর্ঘটনা বেড়েই চলছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ১৯৯৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত ছোট বড় মিলে প্রায় ৬০০ নৌযান দুর্ঘটনায় পাঁচ হাজারেরও বেশি যাত্রীর লাশ পানিতে ভেসেছে। আর পাওয়া যায়নি ১০০০ জনের লাশ। ২০০৩ সালের ৮ জুলাই এমভি নাসরিন-১ লঞ্চ দুর্ঘটনায় ৮০০ জন যাত্রী নিহত হন। ২০০৪ সালে পাগলায় বুড়িগঙ্গা নদীতে এমভি মিতালী ডুবে গেলে ৪০০ জনের বেশি  যাত্রী নিহত হন। একই দিনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে এমএল মজলিসপুর ডুবে মারা যান আরো প্রায় ৯০ জন। ২০০৫ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি এমভি মহারাজ দুর্ঘটনায় মারা যান ১৫০ জন। ২০০৮ সালের ২৩মে চাঁদপুরে এমভি লাইটিং সান দুর্ঘটনায় মারা যান প্রায় ৩০০ জন। নিহতদের সংখ্যা নিয়ে সরকারি-বেসরকারি হিসাব মতে কিছু পার্থক্য থাকতে পারে। তবে দুর্ঘটনা যে ঘটেছে সে ব্যাপারে কারও দ্বিমত করার সুযোগ নেই। এসব দুর্ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও অবশেষে তা আর আলোর মুখ দেখে না। রাষ্ট্রীয়ভাবে দোষীদের বিরুদ্ধে কঠিন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করার ফলে দিন দিন নৌপথের নিরাপত্তার বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। যার প্রেক্ষিতে নৌপথে দিন দিন দুর্ঘটনা বেড়েই চলছে।
নৌপথের দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সরকারকে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে। নতুবা তার দায়দায়িত্ব  সরকারকেই নিতে হবে। এদেশের ১৬ কোটি মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব সরকারের। ফেরি ডুবির ঘটনায় দক্ষিণ কোরিয়ার মন্ত্রী যদি পদত্যাগ করতে পারেন তাহলে এদেশের মন্ত্রীদের ব্যর্থতার জন্য পদত্যাগ করতে সমস্যা কোথায়। এই প্রশ্নের উত্তর আজ জাতি জানতে চায়। সরকারের সদ্বিচ্ছার কমতি আছে বলেই কি ক্রুটিপূর্ণ নৌযান, অদক্ষ চালক, অতিরিক্ত যাত্রী বহন করে চলছে লঞ্চ মালিকেরা। এছাড়া দেশের নৌযানগুলোতে প্রয়োজনীয় জীবনরক্ষাকারী সরঞ্জাম ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা যেমন লাইফ জ্যাকেট, ফায়ার বাকেট, অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ইত্যাদির অনুপস্থিতির ঘাটতিতে প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। সরকারের কাছে বিনীত জিজ্ঞাসা রেখে শেষ করতে চাই, সরকার  কি শোক প্রকাশ আর ক্ষতিপূরণের মধ্যেই দায়িত্ব শেষ করবে নাকি এর পুনরাবৃক্তি রোধে ব্যবস্থা নেবে?
তোফাজ্জল বিন আমীন 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads