মঙ্গলবার, ১৯ আগস্ট, ২০১৪

বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদকে দেয়া প্রসঙ্গ


১৯৭২ সালের সংবিধানে বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা ছিল সংসদের হাতে। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি চতুর্থ সংশোধনীর (বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ-বাকশাল গঠনের সময়) মাধ্যমে এই ক্ষমতা দেয়া হয় প্রেসিডেন্টের কাছে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সময় ওই নিয়ম বাতিল করে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা দেয়া হয় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বিষয়টি সংবিধানে যুক্ত হয়। তবে উচ্চ আদালতের রায়ে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হলেও এ বিষয়টি বহাল থাকে। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল সম্পর্কে বলা হয়েছে-
৯৬। (১) এই অনুচ্ছেদের অন্যান্য বিধানাবলী সাপেক্ষে, কোন বিচারক পয়ষট্টি বৎসর বয়স পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল থাকিবেন।
(২) এই অনুচ্ছেদের নিম্নরূপ বিধানাবলী অনুযায়ী ব্যতীত কোন বিচারককে তাহার পদ হইতে অপসারিত করা যাইবে না।
(৩) একটি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল থাকিবে যাহা এই অনুচ্ছেদে “কাউন্সিল” বলিয়া উল্লেখিত হইবে এবং বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারকের মধ্যে পরবর্তী যে দুইজন কর্মে প্রবীণ তাহাদের লইয়া গঠিত হইবে; তবে শর্ত থাকে যে, কাউন্সিল যদি কোন সময়ে কাউন্সিলের সদস্য এইরূপ কোন বিচারকের সামর্থ্য বা আচরণ সম্পর্কে তদন্ত করেন, অথবা কাউন্সিলের কোন সদস্য যদি অনুপস্থিত থাকেন অথবা অসুস্থতা কিংবা অন্য কোন কারণে কার্য করিতে অসমর্থ হন তাহা হইলে কাউন্সিলের যাহারা সদস্য আছেন তাহাদের পরবর্তী যে বিচারক কর্মে প্রবীণ তিনিই অনুরূপ সদস্য হিসেবে কার্য করিবেন।
(৪) কাউন্সিলের দায়িত্ব হইবেÑ
(ক) বিচারকগণের জন্য পালনীয় আচরণ বিধি নির্ধারণ করা, এবং
(খ) কোন বিচারকের অথবা কোন বিচারক যেরূপ পদ্ধতিতে অপসারিত হইতে পারেন সেইরূপ পদ্ধতি ব্যতীত তাহার পদ হইতে অপসারণযোগ্য নহে এইরূপ অন্য কোন কর্মকর্তার সামর্থ্য বা আচরণ সম্পর্কে তদন্ত করা।
(৫) যে ক্ষেত্রে কাউন্সিল অথবা অন্য কোন সূত্র হইতে প্রাপ্ত তথ্যে রাষ্ট্রপতির এইরূপ বুঝিবার কারণ থাকে যে কোনো বিচারক-
(ক) শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যরে কারণে তাহার পদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করিতে অযোগ্য হইয়া পড়িতে পারেন, অথবা
(খ) গুরুতর অসদাচরণের জন্য দোষী হইতে পারেন, সেই ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি কাউন্সিলকে বিষয়টি সম্পর্কে তদন্ত করিতে ও উহার তদন্ত ফল জ্ঞাপন করিবার জন্য নির্দেশ দিতে পারেন।
(৬) কাউন্সিল অথবা অন্য কোন সূত্র হইতে প্রাপ্ত তথ্যে রাষ্ট্রপতির এইরূপ বুঝিবার কারণ থাকে যে কোনো বিচারক-
(ক) শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যরে কারণে তাহার পদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করিতে অযোগ্য হইয়া পড়িতে পারেন, অথবা
(খ) গুরুতর অসদাচরণের জন্য দোষী হইতে পারেন, সেই ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি কাউন্সিলকে বিষয়টি সম্পর্কে তদন্ত করিতে ও উহার তদন্ত ফল জ্ঞাপন করিবার জন্য নির্দেশ দিতে পারেন।
(৬)  কাউন্সিল তদন্ত করিবার পর রাষ্ট্রপতির নিকট যদি এইরূপ রিপোর্ট করেন যে, উহার মতে উক্ত বিচারক তাহার পদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনে অযোগ্য হইয়া পড়িয়াছেন অথবা গুরুতর অসদাচরণের জন্য দোষী হইয়াছেন তাহা হইলে রাষ্ট্রপতি আদেশের দ্বারা উক্ত বিচারককে তাহার পদ হইতে অপসারিত করিবেন।
(৭) এই অনুচ্ছেদের অধীনে তদন্তের উদ্দেশ্যে কাউন্সিল স্বীয় কার্য-পদ্ধতি নিয়ন্ত্রণ করিবেন এবং পরওয়ানা জারী ও নির্বাহের ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের ন্যায় উহার একই ক্ষমতা থাকিবে।
(৮) কোন বিচারক রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ্য করিয়া স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে স্বীয় পদত্যাগ করিতে পারিবেন।
উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে দেয়ার বিষয়টি জোরেশোরে আলোচনায় আসে আওয়ামী লীগের গত সরকারের মেয়াদে। ২০১২ সালে তৎকালীন স্পিকার ও বর্তমান রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের একটি রুলিংকে কেন্দ্র করে কয়েকজন সংসদ সদস্য হাইকোর্টের একজন বিচারপতিকে অপসারণের দাবি তোলেন। সে সময়ই বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে আনার দাবি জোরালো হয়।
সড়ক ভবন সরিয়ে নেয়াসহ উচ্চ আদালতের বেশকিছু রায় নিয়ে সে সময় সংসদে তীব্র সমালোচনা হয়। স্পিকার আবদুল হামিদ নিজেও এ সমালোচনায় অংশ নিয়ে বলেন, আদালতের রায়ে জনগণ ক্ষুব্ধ হলে তারা বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারেন। সরকারও যদি স্বৈরাচারী আচরণ করে, তাহলে জনগণ সে সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে। আবার সংসদে যদি জনবিরোধী কোনো বিল পাস হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধেও জনগণ রুখে দাঁড়াবে এ ধরনের নজিরও রয়েছে। উচ্চ আদালতের প্রতি ইঙ্গিত করে স্পিকারের আরও বলেন, সবাই যদি মনে করি ক্ষমতা পেয়েছি বলে যা ইচ্ছা তা-ই করব, এটা ঠিক নয়। আমাদের সবাইকে একে অপরের সহযোগী হয়ে কাজ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, জনগণ আমাদের দায়িত্ব দিয়েছে। সে দায়িত্ব সুন্দরভাবে পালন করতে হবে।
পয়েন্ট অব অর্ডারে উচ্চ আদালতের রায় ও আদেশের প্রসঙ্গ টেনে সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা নষ্ট করার ক্ষেত্রে উচ্চ আদালত ভূমিকা রাখছে কিনা- এমন প্রশ্ন রাখেন সরকারদলীয় সংসদ সদস্য শাহরিয়ার আলম। হাইকোর্ট এলাকায় সড়ক ভবনের ৫২ বছরের পুরনো অবস্থান থেকে তাদের সরিয়ে দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি এ কথা বলেন। ৫ জুনের মধ্যে হাইকোর্ট এলাকা থেকে সড়ক ভবন উচ্ছেদের সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়। এটি কোনো অবস্থাতেই সম্ভব নয় বলেও জানান তিনি। এক্ষেত্রে কোর্টকে সহনশীল আচরণ করার আহ্বান জানান তিনি।
এ কথার প্রেক্ষিতে স্পিকার বলেন, তিনিও বিষয়টি জেনেছেন। সরকার, আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ আমরা কেউই পৃথক নই; একে অপরের সহযোগী। দেশের একটি সুপ্রিম পাওয়ার যদি এরকম আচরণ করে, তড়িঘড়ি করে সরকারের একটি বিভাগকে এভাবে সরিয়ে দেয়, এতে পুরো সরকারই প্যারালাইজড হয়ে যাবে। স্পিকার বলেন, আদালত নিরপেক্ষ এবং স্বাধীন। কিন্তু দেশের অন্য মানুষের বিচারের ক্ষেত্রে বছরের পর বছর লেগে যাবে আর নিজেদের বিষয় বলে বিচার বিভাগ ঝটপট সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবে এটি ভালো দেখায় না। কেবল নিজেদের বিষয়টি দেখলে সরকার কীভাবে চলবে? সরকারকেও সহযোগিতা করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার ও বিচারবিভাগের সঙ্গে আলোচনা করা প্রয়োজন বলেও জানান তিনি। (সূত্রঃ দৈনিক আমার দেশ ২০ জুন ২০১২)
৫ জুন ২০১২ সড়ক ভবন নিয়ে উচ্চ আদালতের একটি রায়কে কেন্দ্র করে জাতীয় সংসদের বৈঠকে আলোচনা প্রসঙ্গে স্পিকারের বক্তব্য রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল বলে অভিমত ব্যক্ত করেন বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী। তিনি বলেন, স্পিকার জাতীয় সংসদে আলোচনায় অংশ নিয়ে ‘জনগণ ক্ষুব্ধ হলে আদালতের প্রতি রুখে দাঁড়াতে পারে’ বলে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল। এ বক্তব্য দিয়ে স্পিকার জনগণকে লেলিয়ে দিয়েছেন আদালতের প্রতি রুখে দাঁড়াতে। তার বক্তব্য আদালত অবমাননাকর। তিনি সংসদকেও অপমান করেছেন। স্পিকার সংসদের দায়মুক্তির অপব্যবহার করেছেন। তিনি সংসদে কোনো আলোচনায় অংশ নিতে পারেন না। স্পিকার তার পদের মর্যাদা রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছেন। ওই পদে থাকার অধিকার তার নেই। তার মুখ থেকে উচ্চ আদালত সম্পর্কে এ ধরনের মন্তব্য আসতে পারে না। স্পিকারকে অল্প বিদ্যায় ভয়ঙ্করি বলেও মন্তব্য করেন বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী।
স্পিকার সম্পর্কে আরও বলা হয়, উনার (স্পিকার) মনে হয় বিচার বিভাগ সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। স্পিকার তার অজ্ঞতা দেখিয়েছেন। একজন স্পিকার এতো অজ্ঞ হতে পারেন, তা আমরা ভাবতে পারি না।
হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরীর বেঞ্চে এ বক্তব্য দেয়ার দিনই বিকালে জাতীয় সংসদ অধিবেশনে এ নিয়ে পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দেন সিনিয়র সংসদ সদস্যরা। সংসদ সদস্যদের বক্তব্যে বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের অপসারণ দাবি করা হয়। নতুবা সংসদ সংবিধান সংশোধন করে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা হাতে নেয়ারও হুমকি দেয়া হয়। সিনিয়র সংসদ সদস্যরা বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরীকে ‘মানসিক বিকারগ্রস্ত’, ‘স্ট্যাডিস্ট’ বলে আখ্যায়িত করেন। তারা সংবিধান লঙ্ঘন করে জাতীয় সংসদের স্পিকার সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্যের দায়ে তিন দিনের মধ্যে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরীকে বিচারপতির পদ থেকে অপসারণ করার জন্য আল্টিমেটাম দেন। তা না হলে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল করে জাতীয় সংসদ তাকে ইমপিচ করবে বলে হুঁশিয়ারি করে দেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা।
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের জন্য প্রধান বিচারপতিকে নির্দেশ দিতে রাষ্ট্রপতির প্রতিও আহ্বান জানিয়েছিলেন তারা। তিনি মানুষকে অপমান করে আনন্দ পান বলেও মন্তব্য করেন তারা। কোনো লিখিত পরীক্ষা ও যোগ্যতা ছাড়াই আওয়ামী লীগের দয়ায় বিচারপতি শামসুদ্দিন বিচারক হয়েছেন বলে উল্লেখ করে তারা বলেন, স্পিকারকে অপমান করে এই বিচারপতি সংসদ ও সরকারকে অপমান করেছেন। এজন্য বিচার বিভাগের ক্ষমা চাওয়া উচিত। আর এক মিনিটও তাকে বিচারকের পদে দেখতে চান না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দেন সরকারি জোটের প্রভাবশালী নেতারা। পরে সংসদ সভাপতির দায়িত্ব পালনরত ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী এ বিষয়ে স্পিকারের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেবেন বলে সংসদে জানান। পয়েন্ট অব অর্ডারে বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরীর বিষয়ে রাশেদ খান মেননের বক্তব্যের শুরুতেই অধিবেশন কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান সংসদ নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিরোধী দলবিহীন সংসদে আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিম, তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক চুন্নু, ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন, জাসদের মঈন উদ্দিন খান বাদলের এসব বক্তব্যের সময় উপস্থিত সব সদস্য টেবিল চাপড়ে এবং উচ্চস্বরে ধ্বনি তুলে তার বক্তব্যকে সমর্থন জানান।
এসব বক্তব্যের প্রেক্ষিতেই স্পিকার বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন বলে রুলিং দেন। ১৮ জুন ২০১২ জাতীয় সংসদে স্পীকারের রুলিংয়ে বলা হয়-
মাননীয় সদ্যবৃন্দ,
 গত ২৯ মে ২০১২ তারিখ মহান এ সংসদে কয়েকজন মাননীয় সংসদ সদস্যের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে আমি কিছু কথা বলেছিলাম। আমার বক্তব্যের বিষয় ছিল মূলত সংসদ, আদালত ও নির্বাহী বিভাগের সাথে জনগণের সম্পর্ক এবং তাদের কল্যাণ সাধন। মাননীয় সংসদ সদস্যদের বক্তব্যের প্রেক্ষিতেই তাৎক্ষণিকভাবে কিছু সাধারণ মন্তব্য করা হয়েছিল। পরবর্তীতে গত ৫ জুন ২০১২ তারিখে ইন্টারনেট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় এ মর্মে সংবাদ পরিবেশিত হয় যে, হাইকোর্ট বেঞ্চের একজন মাননীয় বিচারপতি আমার বক্তব্যকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল বলে মন্তব্য করেছেন এবং আমার ও জাতীয় সংসদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ ও অনাকাক্সিক্ষত মন্তব্য করেছেন। ওইদিনই সংসদ চলাকালীন সময়ে আপনাদের মধ্যে সিনিয়র কয়েকজন মাননীয় সংসদ সদস্য চড়রহঃ ড়ভ ঙৎফবৎ-এ এ বিষয়ে সংসদের সার্বভৌমত্ব রক্ষাকল্পে উক্ত মাননীয় বিচারপতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এমনকি সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনপূর্বক অপসারণের দাবি জানিয়ে বক্তব্য রেখেছিলেন। উপস্থিত সকল মাননীয় সদস্য উক্ত বক্তব্য সমর্থন করেন যা গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে। ওইদিন স্পিকারের দায়িত্ব পালনরত মাননীয় ডেপুটি স্পিকার এ বিষয়ে আমার সাথে আলোচনা করে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে আপনাদের জানিয়েছিলেন। স্পিকার তথা সংসদকে নিয়ে বিরূপ মন্তব্যের প্রেক্ষিতে সংবিধানের ৭৮(১) অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করা, সংসদের সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং সংসদকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখার জন্য সেদিন আপনারা এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন এবং বিভিন্ন দাবি উত্থাপন করেছিলেন। বস্তুত সেই মুহূর্তে সেটাই স্বাভাবিক ছিল। আপনাদের এ সেন্টিমেন্টকে আমি শ্রদ্ধা করি, আপনাদের প্রতি জানাই আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।
মাননীয় সদস্যবৃন্দ,
এটা প্রণিধানযোগ্য যে, রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক ও সমন্বয়, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, যথাযথ ঈযবপশ  ্ ইধষধহপব গড়ে তোলার জন্য পৃথিবীর অনেক দেশ শত শত বছর নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছে। কারণ আমরা সবাই অবগত যে, উবসড়পৎধপু রং হড়ঃ ধ ংুংঃবস ড়হষু, রঃ রং ধ পষঁঃঁৎব ঃড়ড়. আমরাও এই মহান সংসদে সেই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি অর্জনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আর তাই কিছুদিন আগে আমাদের দেশের একজন অধ্যাপক, বরেণ্য শিক্ষাবিদ আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের বিষয়ে সংসদে কিছু আলোচনা হয়েছিল। যখনই সংসদের কাছে তার বক্তব্য সম্পর্কিত সঠিক ব্যাখ্যা গোচরীভূত হয়, তখনই সংসদ এ ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ করেছে। অপ্রয়োজনীয় অংশ এক্সপাঞ্জ করেছে। আমাদের প্রত্যাশা ছিল, মাননীয় বিচারপতি সমস্ত বিষয়টি হৃদয়ঙ্গম করবেন এবং মাত্রা অতিক্রমকারী বক্তব্য পরিহারে যথাযথ পদক্ষেপ নেবেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। (চলবে)
মাননীয় সদস্যবৃন্দ,
আমার বক্তব্যকে কেন্দ্র করে মহামান্য হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতি যে বিষয়গুলোর অবতারণা করেছে এবং পরবর্তীতে এ নিয়ে যে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে, তা সত্যিই দুঃখজনক এবং অনভিপ্রেত। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম, এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দেব না বা মন্তব্য করব না। সবাই স্বীয় বিবেচনায় বিষয়টি অনুধাবন করবেন। কিন্তু পরে দেখলাম, এটির সাথে আমার এবং মহান সংসদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। আমার অবস্থান স্পষ্ট না করলে মহান সংসদ এবং আমার সম্পর্কে অনেকেরই ভুল ধারণা থেকে যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তি মনে পড়ছে। তিনি বলেছিলেন, “যেটা নিয়ে অন্যের সঙ্গে ব্যবহার চলছে, যার প্রয়োজন এবং মূল্য সত্যভাবে স্থির হওয়া উচিত, সেটা নিয়ে কোন যাচনদার যদি এমন কিছু বলেন যা আমার মতে সংগত নয়, তবে চুপ করে গেলে নিতান্ত অনিবয়ন হবে।” শেষে ঠিক করেছি, এ বিষয়ে আমি আমার বক্তব্য স্পষ্ট করব।
সেদিন অর্থাৎ ২৯ মে ২০১২ তারিখে মাননীয় সংসদ সদস্য জনাব শাহরিয়ার আলম সংসদে সড়ক বিভাগের অফিস অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার জন্য সময় বৃদ্ধির বিষয়টি মাননীয় আইনমন্ত্রীর নজরে আনার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। আমি বলেছিলাম, মাননীয় আইনমন্ত্রী নেই, থাকলে হয়তো তিনি ব্যাপারটি দেখতেন। এরপর আমি যে কথাগুলো বলেছি, তার সারমর্ম হচ্ছেÑমহামান্য আদালতের প্রতি আমাদের সবার শ্রদ্ধা আছে। আদালত সম্পূর্ণ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ।
সড়ক ভবনের বিষয়টি এক স্পর্শকাতর বিষয়। রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ-আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগ থেকে একে অপরের পরিপূরক। এগুলো একটি আরেকটিকে সহযোগিতার জন্য রয়েছে। হঠাৎ এ ভবনকে সরিয়ে নিলে এর কার্যক্রম চধৎধষরংবফ হয়ে যাবে, যা সরকারকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
এ বিষয়গুলো যেন মহামান্য আদালত বিচার বিবেচনা করেন, সে অনুরোধটুকু সেদিন করেছিলাম। প্রয়োজনে এ বিষয়ে সরকারের সাথে বিচার বিভাগের আলোচনার মাধ্যমে তা সুরাহা হলে সুন্দর হয় বলেও উল্লেখ করেছিলাম। শেষে রাষ্ট্রের সকল অঙ্গের মাঝে সহযোগিতার মনোভাব রাখার কথা বলে এ পর্যায়ে আমার বক্তব্য শেষ করি।
মাননীয় সদস্যবৃন্দ,
 ওইদিন পরবর্তীতে মাননীয় সংসদ সদস্য জনাব মইন উদ্দীন খান বাদল আদালত সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বক্তব্য রাখলে আমি হাস্যচ্ছলে বলেছি, আমার স্পিকারশিপের মেয়াদ শেষ হলে আমাকে আবার কালো কোট পরে কোর্টে যেতে হবে। সুতরাং হিসাব করে কথা বলতে হয়। আবার কোন সমস্যায় না পড়ে যাই। মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে রিলিফ নাও পেতে পারি। এরপর গণমানুষের কাছে সবার সবাবদিহিতার বিষয়টি তুলে ধরতে গিয়ে বলেছিলাম, সংসদে সংসদ সদস্যরা যে আইনগুলো পাস করেন সেগুলো যদি জনগণের বিরুদ্ধে যায়, তাহলে শেষ পর্যন্ত জনগণ আমাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পরে। কোর্টের বিচারে যদি দেশের মানুষ ক্ষুব্ধ হয়, তাহলে বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে মানুষ একদিন হয়তো রুখে দাঁড়াতে পারে। একইভাবে যদি কোনো সরকার স্বৈরাচারী আচরণ করে সে ক্ষেত্রে জনগণের রুখে দাঁড়ানোর ইতিহাস আছে। (চলবে)
জিবলু রহমান 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads