শুক্রবার, ৮ আগস্ট, ২০১৪

ভারতের টিভি এবং হিন্দির আগ্রাসন


টেলিভিশন খুব একটা দেখা হয় না। দেখার মতো সময় নেই বলাটা ঠিক নয়, আসলে বসলেই বিরক্ত হতে হয় বলে দেখি না। বিরক্ত হওয়ার কারণ সম্পর্কে নিশ্চয়ই বিস্তারিত বলার অপেক্ষা রাখে না। একে তো ভারতের টিভি চ্যানেলগুলোর একচেটিয়া রাজত্ব ও বিজাতীয় হিন্দি সংস্কৃতির বাধাহীন আগ্রাসন চলছে, অন্যদিকে বাংলাদেশের যে কোনো চ্যানেল খুললেই আপনাকে শুধু বিজ্ঞাপন চিত্র দেখতে হবে। বিজ্ঞাপন বিদেশী চ্যানেলগুলোতেও দেখানো হয়। কিন্তু সব চ্যানেলই কিছু নিয়ম মেনে চলে। যখন-তখন এবং মিনিটের পর মিনিট ধরে তারা বিজ্ঞাপন দেখায় না। এদিক থেকে বাংলাদেশের চ্যানেলগুলোকে সাবাশী দিতেই হবে! খবর বা নাটক কিংবা নৃত্য বা সংগীতের যে অনুষ্ঠানই হোক, দর্শকদের নিস্তার নেই। কোনোভাবে মিনিট পাঁচেক যেতে না যেতেই শুরু হয়ে যাবে বিজ্ঞাপন দেখানোর পালা। সে পালা থামার আর নাম করবে না। ধৈর্য ও সময় থাকলে পাঠকরাও লক্ষ্য করে দেখতে পারেন। এমনও দেখবেন, একই সময়ে বাংলাদেশের প্রতিটি চ্যানেলে শুধু বিজ্ঞাপনই দেখানো হচ্ছে। যেন বিজ্ঞাপন দেখিয়ে টাকা কামানোর একমাত্র উদ্দেশ্য নিয়েই টিভি চ্যানেলগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে! দর্শকদের সঙ্গে এতটা নোংরামি কিন্তু ভারতের চ্যানেলগুলোও করে না।
কথা উঠেছে বাংলাদেশে ভারতের টিভি দেখানো নিষিদ্ধ করার প্রসঙ্গে। সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে সংবাদপত্রের পাতায় এই দাবি তোলা হচ্ছে বহুদিন ধরেই। দুদিন আগে একজন আইনজীবী ভারতের টিভির প্রদর্শন নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে হাইকোর্টে রিটও করেছেন। মাননীয় বিচারপতিরা কি রায় দেন সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে সত্য, তবে অভিজ্ঞতা অতি তিক্ত বলেই সচেতন অনেকে আবার সন্দেহের কথাও জানিয়েছেন। তাদের ধারণা, রিট পিটিশনটি ভারতীয়দের উদ্যোগে ও পরিকল্পনায় এবং গোপন আয়োজনের ভিত্তিতে করা হয়ে থাকলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কারণ, হাইকোর্ট যদি রিটটি খারিজ করে দেন তাহলে ভারতের টিভি চ্যানেলগুলোর জন্য বাংলাদেশের আকাশ আইনসম্মতভাবেই উন্মুক্ত হয়ে যাবে। এখন দেখার বিষয়, নিষিদ্ধ করার দাবির পক্ষে ওই রিট দায়েরকারী আইনজীবী কতটা শক্তিশালী যুক্তি হাজির করেন। তিনি যদি হেরে যাওয়ার জন্য রিট করে থাকেন তাহলে বুঝতে হবে, অন্তরালে আসলেও ভারতীয়দের যোগসাজশ রয়েছে!
এ পর্যন্ত এসে পাঠকদের মনে সম্ভবত নিবন্ধের উদ্দেশ্য নিয়ে জিজ্ঞাসার সৃষ্টি হয়েছে। দেশ ও জাতির স্বাধীন মর্যাদা এবং বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কৃতির প্রশ্ন জড়িত রয়েছে বলেই আমরা ভারতের টিভি চ্যানেলগুলোর বাধাহীন তৎপরতা সমর্থন করতে পারি না বরং এর বিরোধিতা করি। কারণ, সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যখন বাংলাদেশের কোথাও আপনি আর আগের মতো স্বদেশকে খুঁজে পাবেন না। দেখবেন, আমাদের শিশু-কিশোররাও আজকাল ‘বিলকুল নেহি’ ধরনের হিন্দি বলতে শুরু করেছে। হিন্দি সিরিয়ালগুলোর ঠ্যালা সামলাতে গিয়ে এদেশের নাটক এখন বুড়িগঙ্গার নোংরা পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে। চলচ্চিত্রও লাটে উঠেছে হিন্দি সিনেমার কাছে আছাড় খেয়ে। মার্কেটে, হোটেলে, বাসে, ট্রেনে এবং কার ও ট্যাক্সিক্যাবে তো বটেই, রিকশাওয়ালাদের কণ্ঠেও আজকাল হিন্দি ছাড়া বাংলা গান শোনা যায় না। বাংলাদেশের তো বটেই, এমনকি পশ্চিম বঙ্গের ‘হারানো দিনের’ গানও শোনার ‘সৌভাগ্য’ হবে না আপনার। শুনতে হবে ভারতীয় হিন্দি সিনেমার ‘জনপ্রিয়’ গান। শুধু গানের কথাই বা বলা কেন, যে কোনো বাসা-বাড়িতে গিয়ে দেখুন, টিভিতে ভারতের বিভিন্ন চ্যানেল দেখা হচ্ছে। হিন্দি সিরিয়ালের ডায়ালগ ছেলেপেলেদের মুখে মুখে ঘুরে ফিরছে। আরো অনেকভাবেই হিন্দি সংস্কৃতি বাংলাদেশীদের আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। এসবের সঙ্গেই ভারতীয় টিভির বাধাহীন আগ্রাসনের মাধ্যমে এখন চলছে ষোলকলা পূর্ণ করার আয়োজন, যাতে বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতি ইতিহাসের বিষয়ে পরিণত হয়। যাতে মানুষ একথা পর্যন্ত ভুলে যায় যে, বাংলা ভাষার জন্য এদেশেই এক সময় আন্দোলন হয়েছিল। সে আন্দোলনে সালাম-বরকত ও রফিক-জববারদের মতো কয়েকজন শহীদও হয়েছিলেন!
পরিস্থিতির অন্য একটি দিক সম্পর্কেও বলা দরকার। শিল্প চর্চার আড়ালে এদেশের দেশপ্রেমহীন একটি বেনিয়াগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের নামে এমন তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে যার কারণেও বাংলাদেশের সংস্কৃতি দ্রুত পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছে। এই গোষ্ঠীর লোকজন কেবল ভারত থেকেই শিল্পীদের ভাড়ায় নিয়ে আসছে। আনছেও আবার যাকে-তাকে। মাঝে-মধ্যে ‘নাম করা’ দু’চারজন যে আসছেন না তা নয়। তবে ওই গোষ্ঠীর বেশি আগ্রহ দেখা যাচ্ছে কম খ্যাতনামাদের ব্যাপারে। এর কারণ, এসব শিল্পীকে নামকা ওয়াস্তে টাকা দিলেই চলে। ওনারাও বাংলাদেশে আসতে পেরে এবং থলে বোঝাই করে রুপি নিয়ে যেতে পেরে কিতার্থ হয়ে যাচ্ছেন। সিনেমা ও সংগীতসহ ভারতের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যারা পাত্তা পর্যন্ত পান না, যাদের এমনকি কানাকড়ি মূল্যও নেই মুম্বাই কিংবা কলকাতায়, তাদেরকেই সুচিন্তিতভাবে আনা হচ্ছে ঢাকায়। পরিচয় করিয়ে দেয়া হচ্ছে নামের আগে-পরে বিশেষণ যুক্ত করে। সিনেমার ‘একস্ট্রা’ এবং নর্তকীরাও বাদ পড়ছে না। এদিকে বাংলাদেশেও নতুন গজিয়ে ওঠা কিছু ধনিক প্রবর রয়েছেন। তাদের আবার ভারতীয় শিল্পীদের ‘লাইভ’ অনুষ্ঠান না দেখলে ভাত ‘হজম’ হতে চায় না! এরাই দল বেঁধে ছুটে যাচ্ছেন হোটেলে, টাকা গুনছেন লাখের অংকে। এ ধরনের শিল্পীদের জন্য ফ্ল্যাট বাড়িও ভাড়া করা হচ্ছে। কারণ, বাংলাদেশে আসছেন তারা কয়েক মাসের চুক্তিতে!
এভাবে ভারতীয় শিল্পীদের নিয়ে আসার এবং তাদের দিয়ে অনুষ্ঠান করানোর মাঝখানে ঘটছে অবৈধ বিভিন্ন কর্মকান্ড। সংবাদপত্রের রিপোর্টে জানা যাচ্ছে, ভাড়ার বা সম্মানির প্রকৃত পরিমাণ নিয়ে লুকোচুরি করছে আয়োজকরা। একটি উদাহরণ হিসেবে বলিউড তথা মুম্বাইয়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়ক শাহরুখ খানের ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। আয়োজকরা জানিয়েছিলেন, শাহরুখ খানকে নাকি ৫৫ লাখ টাকায় রফা করা হয়েছিল। অন্যদিকে অনুসন্ধানে জানা গেছে, টাকার পরিমাণ ছিল ১৮ কোটি টাকা! এ ধরনের প্রতারণার ফলে একদিকে সরকার বঞ্চিত হচ্ছে বিপুল পরিমাণ কর পাওয়া থেকে, অন্যদিকে কোটি কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে হুন্ডির মাধ্যমে। ভারতের অন্য শিল্পীরাও তাদের পারিশ্রমিকের টাকা হুন্ডির অবৈধ পথেই দেশে নিয়ে যাচ্ছেন। দেশীয় আয়োজকরাও দিব্যি মিথ্যা তথ্য জানিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে।
ভারতীয় শিল্পীদের বিষয়টিকে হাল্কাভাবে দেখার সুযোগ নেই। এর মধ্যে অর্থনীতি তো রয়েছেই, বেশি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে রয়েছে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের দিকটি। আমরা অবশ্যই সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের বিরুদ্ধে নই। কিন্তু সেটা হতে হবে সমতার ভিত্তিতেÑ সমানে সমানে। অন্যদিকে ভারত যা করছে তাকে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। এ আগ্রাসনও আবার সর্বাত্মকভাবেই চালাচ্ছে দেশটি। স্যাটেলাইট টিভির কথাই ধরা যাক। অতি নিম্নমানের ভারতীয় টিভি চ্যানেলের আজেবাজে অনুষ্ঠানও বহু বছর ধরেই আমাদের দিয়ে গেলানো হচ্ছে। আমরাও রঙঢঙ দেখে মুগ্ধ হয়ে গিলে চলেছি। আমাদের শিশু-কিশোররা হিন্দিতে ‘বাতচিত’ করতে শিখছে। টিভিতে বিজ্ঞাপন দেখে আমরা বেশি বেশি করে ভারতীয় পণ্য কিনছি। ফলে মার খাচ্ছে বাংলাদেশের পণ্য সামগ্রী। অন্যদিকে দিল্লি, লক্ষেèৗ বা মুম্বাই দূরে থাকুক, বাংলাদেশের কোনো টিভি চ্যানেলকে এমনকি সবচেয়ে কাছের নগরী কলকাতায় পর্যন্ত দেখতে দেয়া হচ্ছে না। এই একটি ব্যাপারে ভারতীয়দের দেশপ্রেমের কোনো তুলনা হয় না! সমগ্র এ প্রেক্ষাপটেই আমরা ভারতীয় শিল্পীদের ঢালাওভাবে নিয়ে আসার বিরোধিতা করি। সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের ব্যাপারে সদিচ্ছা থাকলে বাংলাদেশের শিল্পীদের জন্যও ভারতের দরজা উন্মুক্ত করতে হবে। একই নীতি টিভি চ্যানেলের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রয়োগ করতে হবে। আমরা চাই, সংস্কৃতির এই আদান-প্রদান ভারত ও বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে পুরো সার্ক অঞ্চলেই সমতার ভিত্তিতে করা হোক। এজন্য প্রাথমিক উদ্যোগ অবশ্যই সরকারকে নিতে হবে। আমাদের ধারণা, হুন্ডিসহ অবৈধ কর্মকান্ড প্রতিহত করা গেলে ভারতের পক্ষেও বেশিদিন ঘাড় বাঁকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। সরকারের উচিত সে লক্ষ্যেই অবিলম্বে উদ্যোগী হওয়া।  
এবার ভারতের টিভি এবং বাংলাদেশের সংস্কৃতি প্রসঙ্গ। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধসহ ইতিহাসের আলোকে তো বটেই, সাধারণ মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার পরিপ্রেক্ষিতেও পর্যালোচনায় পরিষ্কার দেখা যাবে, বেইলী রোডের নাটক পাড়া থেকে রামপুরার টিভি ভবন ও এফডিসি পর্যন্ত সংস্কৃতির অঙ্গনে তৎপর তথাকথিত ‘প্রগতিশীলদের’ বদৌলতেই বাংলাদেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে ভারতের আগ্রাসন সর্বাত্মক হতে পেরেছে। ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশেও তারা খুঁজে খুঁজে অমুসলিমদেরকেই প্রধান চরিত্র বানিয়ে নাটক-সিনেমা তৈরি করেছেন। চরম মুসলিম বিদ্বেষী খুনি-সন্ত্রাসীদের পর্যন্ত নায়ক বানিয়ে ওনারা নাটক মঞ্চায়নের সেঞ্চুরি করেছেন, কিন্তু শেরে বাংলা ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী এবং শেখ মুজিবুর রহমানের মতো বিশাল ব্যক্তিত্বের কাউকে নিয়ে কোনো কাহিনী তৈরি করার ‘অনুগ্রহ’ করেননি। কারণ একটাইÑ হিন্দির চামচামো করে ওনারা ভারতের সুনজরে থাকতে চান। এজন্যই ভারত ও হিন্দির বিরোধিতাকারীরা ওনাদের মতে প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্প্রদায়িকÑ এমনকি পাকিস্তানের দালালও! দেশের অর্থনীতি ও সংস্কৃতির সর্বনাশ ঘটিয়ে হলেও নিজেরা যে হিন্দির পাশাপাশি ভারতের দালালি করে বেড়াচ্ছেন এতে কিন্তু দোষের কিছু নেই! এখানে সংস্কৃতির পাশাপাশি রাজনৈতিক দিকটিকে প্রাধান্যে এনে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বলা দরকার, সিনেমা ও নাটক জগতের এই ওনারা এমন এক রাষ্ট্র ভারতের দালালি করে বেড়াচ্ছেন, যে দেশটি কখনোই বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নেয়নি। এর প্রমাণও পাওয়া গেছে বিভিন্ন উপলক্ষে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের জনগণ কিন্তু সব সময়ই স্বতন্ত্র একটি সংস্কৃতিকে ধারণ ও লালন করে এসেছে। ‘পশ্চিম পাকিস্তান’কেন্দ্রিক শাসক-শোষক ও জেনারেলদের কারণে পাকিস্তান কেন টিকে থাকতে পারেনি এবং আমরা কিভাবে সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছি সে ইতিহাস সবারই জানা। এর মধ্য দিয়েও প্রমাণিত হয়েছে, ৯০ ভাগ মুসলমানের এই দেশটি কোনো অন্যায় ও আধিপত্যবাদের সামনে মাথা নত করতে জানে না। বস্তুত বাংলাদেশের জনগণ প্রচন্ডভাবে স্বাধীনচেতা বলেই ‘পশ্চিম পাকিস্তানীরা’ মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও তাদের সঙ্গে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ হিসেবে এক রাষ্ট্র পাকিস্তানে থাকেনি। অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে, ভারতপন্থীদের প্রচারণা এবং আওয়ামী লীগ সরকারের সুচিন্তিত কৌশলের পরিণতিতে ভারতের ব্যাপারে নতুন প্রজন্মের মধ্যে প্রবল আগ্রহের সৃষ্টি হচ্ছে। মূলত ভারতীয়দের ষড়যন্ত্রে এদেশেরই কিছু ছদ্মবেশধারী রাজনীতিক ও তথাকথিত সুশীল সমাজের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক জগতের দিকপালরাও সাফল্যের সঙ্গে আগ্রহ সৃষ্টির কাজটিকে এগিয়ে নিচ্ছেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বোম্বের সিনেমা এবং স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলগুলো। আমাদের ছেলে-মেয়েরা টিভি ও সিনেমার চাকচিক্যে চমৎকৃত হচ্ছে। ভারতকে স্বর্গের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া কোনো দেশ মনে করে বিভ্রান্ত হচ্ছে। তাদের একটি অংশ এমনকি বাংলাদেশকে স্বাধীন বা ভারতের বাইরে আলাদা একটি রাষ্ট্র হিসেবে টিকিয়ে রাখারও কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পাচ্ছে না!
অথচ পার্থক্য ও প্রকৃত অবস্থা বোঝার জন্য দূরে কোথাও যাওয়ার দরকার নেই, যে কেউ বাংলাদেশের লাগোয়া নগরী এবং ভারতের রাজ্য পশ্চিম বঙ্গের রাজধানী কলকাতায় গিয়ে দেখে আসতে পারেন। সেটাও সম্ভব না হলে দূরদর্শন টিভির কলকাতা কেন্দ্রের কিংবা ‘জি বাংলা’ ও ‘তারা বাংলা’ ধরনের বাংলা টিভি চ্যানেলের নাটক এবং কলকাতার সিনেমাগুলো দেখতে পারেন। দেখবেন, এগুলোর কোনোটিতেই বোম্বের সিনেমা-সিরিয়ালের মতো চাকচিক্যের ছিটেফোঁটাও নেই। হত দরিদ্র অবস্থায় রয়েছে পশ্চিম বঙ্গের মানুষÑ নামে যারা বাঙালী, কিন্তু ‘বীর বাঙালী’ নয়, যেমনটি আমরা ছিলাম ১৯৭১ সালে। এসব সিনেমা-সিরিয়ালের নায়ক-নায়িকারাও বাংলাদেশের কাউকে আকৃষ্ট করতে পারবে না। এটাই ভারতের আসল চেহারা, বোম্বেরটা নয়। সুতরাং চমৎকৃত বা আকৃষ্ট হয়ে ‘তা-ধিন তা-ধিন’ করে নেচে ওঠারও কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। মাতামাতিটুকু কেবল ধান্দাবাজেরাই করে, ভারত যাদের টাকা ও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে চাকর-বাকরের মতো পুষছে।
আপত্তি ও উদ্বেগের কারণ শুধু বোম্বে ও কলকাতার সিনেমা-সিরিয়ালের মধ্যকার পার্থক্য নয়। ধর্মীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামজিক কারণগুলোও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। অনেক ঘটনা ও উদাহরণেরই উল্লে¬¬¬খ করা যায়, যেগুলো থেকে প্রমাণিত হবে, মুসলমানদের প্রতি ভারতীয় হিন্দুদের মনোভাব সেই ব্রিটিশ আমলের মতোই রয়ে গেছে। যেমন কলকাতার মুসলিম প্রধান পার্ক সার্কাস এলাকাতেও মুসলমানরা জুমার নামাজ আদায় করতে যান টুপি পকেটে নিয়ে। অনেকটা লুকিয়ে লুকিয়েÑ যেন মহা কোনো অপরাধ করতে যাচ্ছেন! কলকাতাসহ পশ্চিম বঙ্গে মাইকে আযান দেয়া আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শুধু কলকাতার কথাই বা বলা কেন, ভারতের অন্য সব অঞ্চলেও হিন্দুদেরই একচেটিয়া প্রাধান্য চলছে। সোনিয়া গান্ধীর মতো বিদেশিনী খ্রিস্টান রমণীকেও নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করার আগে ব্রাহ্মণ পুরোহিত ডেকে এবং হাঁড়িতে আগুন জ্বালিয়ে পূজার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে হয়। মন্দিরে গিয়ে গলায় আঁচল পেঁচিয়ে দেবীকে পেন্নাম করতে হয়। এসবই ভারতের রাজনীতিতে অবশ্য পালনীয়Ñ সোনিয়া গান্ধী থেকে মনমোহন সিং ও নরেন্দ্রনাথ মোদী পর্যন্ত রাজনীতিকদের প্রত্যেককে হিন্দু ধর্মের বিধি-বিধান মেনে চলতে হয়। নাহলে ভোট পাবেন না তারা!
কথাগুলো জানানোর উদ্দেশ্য একথা পরিষ্কার করা যে, এদেশের ভারতপন্থী রাজনীতিক ও ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ সুশীলজনেরা যতোই বলুন না কেন, ভারত এখনো সর্বতোভাবে হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রই রয়ে গেছে। দেশটিতে বরং মুসলমানসহ সংখ্যালঘুদের বিপদ বাড়ছে দিন-দিন। ভারতে হিন্দু জঙ্গী-সন্ত্রাসীদেরও ব্যাপক হারে বিস্তার ঘটছে। ‘ভারত কেবলই হিন্দুদের রাষ্ট্র’Ñ এই উগ্র হিন্দুত্ববাদী স্লো¬াগানমুখে দেশজুড়ে ভয়ংকর তৎপরতা চালাচ্ছে তারা। তাদের লক্ষ্য ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র বানানো। কিন্তু ভারতের হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসী সংগঠন এবং তাদের নিষ্ঠুর কর্মকান্ডের ব্যাপারে বাংলাদেশের ভারতপন্থী মহল এবং সুশীলজনেরা কোনো উচ্চবাচ্য করেন না। তারা বরং বোঝাতে চান যেন হিন্দু এবং ভারতীয়রা একেবারে ‘দুধে ধোয়া তুলসি পাতা’! যেন যতো দোষ সব ‘নন্দ ঘোষের’Ñ বাংলাদেশের! সেটা তারা ভাবতেই পারেন, কিন্তু বর্তমান পর্যায়ে নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থেই অনুধাবন করা দরকার, মূলত ভারতের ষড়যন্ত্রে এবং এদেশের ভারতপন্থীদের উদ্যোগে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার ভয়ংকর চেষ্টা চলছে। সরকারী পর্যায়ে চলছে ভারতের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কার্যক্রম। সবকিছুর পেছনে রয়েছে আওয়ামী ক্ষমতাসীনদের পৃষ্ঠপোষকতা। এজন্যই ভারতের টিভি চ্যালেগুলো দাপটের সঙ্গে রাজত্ব করে চলেছে। কোনোকিছুই বিচ্ছিন্নভাবে ঘটেনি, ঘটছেও না। সবকিছুর পেছনে রয়েছে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা।
আহমদ আশিকুল হামিদ 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads