বৃহস্পতিবার, ১৪ আগস্ট, ২০১৪

মিডিয়ার বিকাশে বিশ্বাসী নয় আওয়ামী লীগ


মিডিয়ার কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। কঠিন এক সময়ই পার করছে বাংলাদেশের মিডিয়া। আঘাত আসছে সম্ভাব্য প্রায় সব দিক থেকেই। সরকারের রোষানলে টিকতে না পেরে অধিকাংশ মিডিয়া সরকারের তোয়াজে ব্যস্ত থাকায় বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে।
মিডিয়ার গ্রহণযোগ্যতা সাধারণ মানুষের কাছে এখন আর তেমনটা নেই। গ্রামে আগে বাজার-চায়ের দোকানগুলোতে টিভির সংবাদ দেখার জন্য লোকে ভিড় জমাতো। আজ তারাই খবর দেখতে বিমুখ, হয়তো প্রতিদিনই একই রকম খবর তারা চায় না। প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছে। প্রতিদিন মানুষের সাথে গাড়ি পুড়ে যাচ্ছে, তার তাজা ফুটেজ তোলায় ব্যস্ত আজকের কলিং বা দাওয়াতে বিশ্বাসী কিছু ক্যামেরাম্যান, আর সেটাই হয়তো কোনো প্রতিবেদক সেখান থেকেই লাইভ রিপোর্ট করছে, হাজার হলেও টিআরপির একটা ব্যাপার আছেতো।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়েস স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৭৪ সালে প্রথম অনলাইন সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। সেটির নাম ছিল ‘নিউজ রিপোর্ট।’ এরপর পৃথিবীজুড়ে বিভিন্ন সংবাদপত্র তাদের অনলাইন সংস্করণ চালু করে। তবে সত্যিকারের অনলাইন সংবাদের ক্ষেত্র হিসেবে পরিণত হয় ‘সাউথপোর্ট রিপোর্টার।’ এটি ২০০০ সালে যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত হয়। সেই তুলনায় বাংলাদেশে অনলাইন সংবাদমাধ্যমের যাত্রা কিছুটা পরে। তবে বাংলাদেশ খুব বেশি পিছিয়ে নেই।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশেও সাম্প্রতিক সময়ে অনলাইন সাংবাদিকতা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, এ বিষয়ে কোনো নীতিমালা নেই। অনলাইন সাংবাদিকতার বিষয়ে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশে সব ধরনের মিডিয়ার পরিসংখ্যান থাকলেও অনলাইন মিডিয়ার কোনো পরিসংখ্যান নেই কারো কাছেই। ছাপা পত্রিকার রেজিস্ট্রেশনের বিধান থাকলেও অনলাইন পত্রিকার রেজিস্ট্রেশনের কোনো বিধান এখন পর্যন্ত করতে পারেনি সরকার।
বাংলাদেশে অনলাইন সাংবাদিকতা অর্ধযুগ পার না করলেও দেশে ছোট-বড় অন্তত তিন হাজার অনলাইন নিউজ-পোর্টাল রয়েছে বলে মনে করছেন সাংবাদিকরা। সে সঙ্গে সংবাদপত্রের লিঙ্কিং সাইটও রয়েছে অগুনতি। বিভিন্ন সাইট ঘেঁটে দেখা গেছে, ঢাকা থেকে অন্তত সাত-আটশ অনলাইন সংবাদপত্র প্রকাশিত হচ্ছে। এছাড়া প্রতিটি জেলা সদর থেকে এমনকি উপজেলা সদর থেকেও প্রকাশ করা হচ্ছে অনলাইন সংবাদপত্র। এগুলোর বেশিরভাগই নিয়মিত আপডেট করা হয় না। এমনকি অনেকগুলোতে যোগাযোগেরও নেই কোনো ঠিকানা। ছবি ও তথ্যের যথেচ্ছ ব্যবহার করা হচ্ছে সেসব সাইটে। অন্যদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকেও বাংলাদেশীদের মালিকানায় বাংলা-ইংরেজি ভাষায় অনলাইন সংবাদপত্র প্রকাশিত হচ্ছে। অবশ্য এসব সংবাদপত্রকে কতোটা সংবাদপত্র বলা যায় তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরা।
২০০৫ সালের প্রথম দিকে যাত্রা শুরু করে বিডিনিউজ। ২০০৬ সালের ২২ অক্টোবর পুরোপুরি কাজ শুরু করে বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরডটকম। এখন পর্যন্ত এটিই বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি পঠিত অনলাইন সংবাদপত্র। ওয়েবসাইট র‌্যাঙ্কিং প্রতিষ্ঠান অ্যালেক্সার হিসাব অনুযায়ী, বিডিনিউজের ওয়ার্ল্ড র‌্যাঙ্কিং ১ হাজার ২৬৩। বাংলাদেশ র‌্যাঙ্কিং ৮।
দেশে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট প্রযুক্তির ব্যাপ্তির ফলে ওয়েবসাইট তৈরির ব্যয় অনেক কমে গেছে। সাধারণ মানের একটি সাইট মাত্র তিন-চার হাজার টাকায়ও তৈরি করা যায়। অনেকক্ষেত্রে তারও কম লাগে। এর ফলে ঢাকাসহ সারাদেশে অনলাইন মিডিয়ার ব্যাপক প্রসার ঘটছে। কিন্তু দেখা গেছে, একেকজন কম্পিউটার অপারেটরও একটি সাইট তৈরি করে ‘সম্পাদক’ বনে গেছেন। মূলত কোনো ধরনের আয় না থাকলেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বিজ্ঞাপন বাবদ ‘চাঁদা’ই তাদের মূল আয়। সেইসঙ্গে গুগল অ্যাডসেন্সসহ এ ধরনের বিজ্ঞাপনের আশায় অনেকেই নিউজ পোর্টাল বানাচ্ছেন। আর নিজেকে পরিচয় দিচ্ছেন সাংবাদিক হিসেবে। এছাড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাংবাদিক হিসেবে নিচ্ছেন বিশেষ সুবিধা।
বিভিন্ন এলাকার নামে এমনকি ব্যক্তির নামেও অনলাইন সংবাদপত্র প্রকাশ করা হচ্ছে। রয়েছে অদ্ভুত নামও। ‘ছবি কথা বলে’, ‘শেষের খবর’, ‘বাঘা নিউজ’, ‘বাউফল নিউজ’, ‘সাভারনিউজ’, ‘আলোকিত জীবন’, ‘ভালো খবর’, ‘গাংনী নিউজ’, ‘ঈশ্বরদীডটকম’Ñ এ ধরনের অসংখ্য তথাকথিত নিউজ পোর্টাল রয়েছে অনলাইনে। এসব সাইট অনেকসময়ই বস্তুনিষ্ঠু তথ্য পরিবেশন না করায় পাঠকরা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগেন।
যারা অনলাইন মিডিয়াতে কাজ করেন তারা মোবাইলে মেসেজ বা সাথে থাকা ল্যাপটপে নিউজ টাইপ করতে ব্যস্ত, ভিজিটর বাড়াতে হবে না! না হলে অ্যাড আসবে কোথা থেকে। কেনো? এরা চাইলে সেখানে নাশকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারতো না?
আগে থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানানো যেতো না? তারা সেখানে অবস্থান নিলে সেই নাশকতাটাতো অন্তত এড়ানো যেতো। প্রিন্ট মিডিয়াকে ততোটা দায়ী করছি না কারণ সংবাদের জন্য তাদের এতো হাহাকার নেই। পরদিন সকালে কোন নিউজটা কোথায় অবস্থান করবে সেটা নির্ধারণ হয়ে থাকে অনেক আগেই। এর সাথে যুক্ত হয় রিসেন্ট কোনো কিছু। সাদাকে কালো আর কালোকে সাদা এতোটাই বানানো হচ্ছে যেটা মিডিয়া বানাচ্ছে সেইটা বোধকরি অতীতে কোনো জাদুকরও করে দেখাতে পারেনি। এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে হয়তো মিডিয়ার গ্রহণযোগ্যতা একেবারেই থাকবে না আর দর্শক, টিআরপি-ভিজিটর, পাঠক হয়তো পুরোতাই মুখ ফিরিয়ে নিবে গণতান্ত্রিক হাতিয়ার হিসেবে পরিচিত এই অংশ থেকে। ক্যামেরা আগে ছিলো মানুষের বন্ধু আর দিনে দিনে সেটাই মানুষের শক্র হয়ে যাচ্ছে।
কোনো নীতিমালা না থাকায় ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে অনলাইন সংবাদপত্র। এর ফলে সাংবাদিকতার নামে চলছে যথেচ্ছাচার। ‘সাংবাদিক’ হিসেবে করা হচ্ছে ‘ক্ষমতা’র অপব্যবহার। পত্রিকাগুলোর বেশিরভাগই চলছে ‘কপি-পেস্ট’ করে।
বিভিন্ন সময় নানা ধরনের গুজব ছড়ানোর ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে কিছু অনলাইন মিডিয়া। সে সঙ্গে সৃষ্টি করছে নানা ধরনের সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যারও। বিশেষ করে নিজেদের ‘এলেক্সা’ রেটিং বাড়ানোর জন্য ‘যা-তা’ সংবাদ প্রকাশ করা হচ্ছে। সেসব সংবাদের কোনো সূত্রও উল্লেখ থাকছে না। ভিজিটর বাড়ানোর জন্য সেলিব্রিটিদের রগরগে কাহিনী আর ছবিতে ভরপুর হচ্ছে সেসব কথিত মিডিয়ার পাতা।
এভাবে অনলাইন সংবাদপত্রের বিকাশ মিডিয়ার জন্য একটি ভালো লক্ষণ হলেও নীতিমালার অভাবে অনেকেই অপসাংবাদিকতা করার সুযোগ পাচ্ছে। তুলনামূলক অনেক সহজ হওয়ায় অন্য পেশায় থেকেও কেউ কেউ একটি অনলাইনভিত্তিক সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠা করে নিজেকে ‘সাংবাদিক’ বানানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। এদের অনেকেরই সাংবাদিকতার ন্যূনতম জ্ঞান নেই। সামাজিক প্রভাব বিস্তারের জন্যই তারা নিজের প্রতিষ্ঠিত মিডিয়াকে ব্যবহার করছেন। এ ধরনের সাংবাদিকতা ‘মহামারি’ আকারে ছড়িয়ে পড়েছে।
একটি স্বার্থান্বেষী মহল নিজেকে মিডিয়া ব্যক্তিত্ব হিসেবে সমাজে পরিচয় দেয়ার লোভ থেকেই অনলাইন মিডিয়ার দিকে ঝুঁকছে। এদের কেউ কেউ সাংবাদিকতার নামে দুর্নীতিও করছে। এর ফলে পুরো সাংবাদিক-সমাজের ওপর কলঙ্ক আসছে। এটি কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। বর্তমান অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে সরকারকে যতো দ্রুত সম্ভব একটি নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। এ বিষয়ে এখনই তথ্য মন্ত্রণালয়ের যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া উচিত। অবশ্য কেউ কেউ মনে করেন অনলাইন মিডিয়ার বিষয়ে কোনো নীতিমালার প্রয়োজন নেই। এ প্রসঙ্গে মিডিয়া ও উন্নয়নকর্র্মী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর এক নিবন্ধে বলেন, তথ্য মন্ত্রণালয় সহযোগিতার ভূমিকা পালন না করে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে যাচ্ছে। তাদের এই উদ্যোগ সমর্থনযোগ্য নয়। মন্ত্রণালয় অনলাইন সংবাদপত্রের জন্য নীতিমালা, লাইসেন্স ফি, নবায়ন ফি, রেগুলেটরি কমিটি করার পাঁয়তারা করছে। তথ্য মন্ত্রণালয় এক্ষেত্রে কিছু টাকা রোজগারের ফন্দি এঁটেছে বলেই আমাদের ধারণা। অনলাইন সংবাদপত্র ‘যুবক’ বা ‘ডেসটিনি’র মতো জাঁকালো ব্যবসা নয় যে, তথ্য মন্ত্রণালয় এর থেকে ফি নেবে।
অনলাইন সংবাদপত্রের একটি নীতিমালা তৈরির জন্য তথ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ১৪ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। ২০১২ সালের মাঝামাঝি ওই কমিটি গঠনের পর একটি খসড়া নীতিমালাও প্রণীত হয়। কিন্তু ‘অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট’দের নানান বাদ-প্রতিবাদের বিপরীতে কিছুটা শৈথিল্য আসে নীতিমালা প্রণয়নে। এরপর দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতায় তা আরো পিছিয়ে যায়। তবে নতুন সরকার গঠনের পর এ বিষয়ে আবারো কাজ শুরু করেছে তথ্য মন্ত্রণালয়।
কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় তথ্য অধিদফতর থেকে অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড নিতে অনেক অনলাইন পত্রিকার সাংবাদিকরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। আবার অনেকে পেশাদার সাংবাদিক না হয়েও অনলাইন পত্রিকাটির শুধু ট্রেড লাইসেন্স ও ইন-কর্পোরেশন সার্টিফিকেটের জোরে পেয়ে যাচ্ছেন অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড।
এমনও সংবাদপত্র রয়েছে যেটির কর্মীসংখ্যা মাত্র একজন! আবার তারও একাধিক ‘সংবাদপত্র’ রয়েছে। মূলত অন্যসব পত্রিকা থেকে নিউজ কপি করেই সেসব অনলাইন পত্রিকা চালানো হয়। অনেক অনলাইন সংবাদপত্রেরই প্রয়োজনীয় লোকবল নেই। যারা আছেন তারাও ঠিকমতো বেতনভাতা পান না। তাই অর্থনৈতিক প্রয়োজন মেটাতে অনেকক্ষেত্রেই তারা সাংবাদিক পরিচয়টির অপব্যবহার করে ব্ল্যাকমেইলের মতো ঘটনাও ঘটাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
দুঃসময় অবশ্য বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের জন্য নতুন কিছু নয়। যদিও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের পেছনে সাংবাদিক আর সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা অনস্বীকার্য। স্বাধীন বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যম অবশ্য দীর্ঘ সময় এ ভূমিকা রাখার সুযোগ পায়নি। সংবাদপত্র ও প্রচার মাধ্যম সম্পর্কে আওয়ামী লীগের আচরণ অত্যন্ত কঠোর। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে তাদের এ নীতির শুরু আর বাকশাল প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে হয় এর পরিণতি। ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান সাংবাদিকদের জন্য স্ক্রিনিং বোর্ড গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এরপর ১৯৭৫ সালে ১৬ জুন মাত্র চারটি দৈনিক পত্রিকা সরকারি ব্যবস্থাপনায় চালু রেখে সব পত্রপত্রিকা প্রকাশ নিষিদ্ধ হয় এক কলমের খোঁচায়। ষাটের দশকের আইয়ুবীয় এবং সত্তরের দশকে বাকশালীয় শাসনের সময় গণমাধ্যমের তথা সাংবাদিক সমাজ ভয়াবহ অবস্থায় পড়েছিল।
স্বাধীন মত প্রকাশ করায় এ দেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রবাদতুল্য সাংবাদিক মরহুম আব্দুস সালামকে ইংরেজি দৈনিক বাংলাদেশ অবজারভার থেকে বিতাড়িত করে তার স্থলে অধিষ্ঠিত করা হয় মুজিবের বশংবদ, এক সময়ের ট্রেড ইউনিয়ন নেতা কাজী মোস্তফাকে। পরে কাজী মোস্তফাকে লেবাননের রাষ্ট্রদূতের পদে নিযুক্ত করা হয়। সাহসী সাংবাদিক ও সাপ্তাহিক হলিডের সম্পাদক মরহুম এনায়েতুল্লাহ খানকেও যেতে হয়েছিলো কারান্তরালে সেই আওয়ামী শাসনামলে। ফেনীর সাংবাদিক টিপুকে নির্মমভাবে প্রহার করে স্থানীয় কুখ্যাত আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসী সংসদ সদস্য জয়নাল হাজারী যার ফলে বিদেশী পত্রপত্রিকার নিন্দিত হন। এ তো সেদিনের কথা।
বাংলাদেশে এ মুহূর্তে আইনের শাসন ভেঙে পড়েছে। ক্ষমতাসীন দলের এমপি এবং ছাত্রলীগের নেতা ও তাদের আত্মীয়-স্বজন গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ করলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। নানা ধরনের দুর্নীতি দেশ ছেয়েফেলেছে এবং সরকার বড় বড় দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে সেখান থেকে সরে যাচ্ছে। এসবের ফলে দেশের নাগরিকদের জীবন কঠিন নিরাপত্তাহীন ও দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। এসব সমস্যা সম্পর্কে প্রতিনিয়ত সঠিক তথ্য সংগ্রহ করে জনগণকে জানানোর একমাত্র মাধ্যম হলো সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া।
মহাজোট সরকারের প্রথম গণতান্ত্রিক শাসনের গত পাঁচ বছরে উল্টো পথে যাত্রা শুরু হয় সংবাদমাধ্যমের, আবার ৫ জানুয়ারির পর অগণতান্ত্রিক শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে সব কিছুর ভালোমন্দ দিক। এখন গণতান্ত্রিক দেশে সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া বন্ধ হওয়ার ঘটনা ঘটে।
গণমাধ্যমের ওপর কর্তৃপক্ষ বেশি মাত্রায় বিধি-নিষেধ আরোপ করছে। বিরোধী দলের অবস্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার কারণে ইতোমধ্যে দুটি টিভি চ্যানেল এবং দুটি দৈনিক পত্রিকা অস্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এ ছাড়াও ক্ষমতাসীন দল ২য় মেয়াদে সরকার গঠন করার পর ঘোষণা দিয়েছে, অবাধ ও সুষ্ঠু গণমাধ্যম চর্চা নিশ্চিত করার জন্য দ্রুতই বেসরকারি চ্যানেলগুলোর জন্য জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে এবং তা করাও হয়েছে।
মহাজোট সরকারের আমলে ২০১৩ সালে জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা করার উদ্যোগ নেয়া হয়। এ নিয়ে বেসরকারি টেলিভিশনগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করে একটি প্রাথমিক খসড়া করে তথ্য মন্ত্রণালয়। পরে তা সর্বসাধারণের মতামতের জন্য তথ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেয়া হয়। পরে মন্ত্রণালয়ের করা কমিটি খসড়াটি চূড়ান্ত করে।
অবশ্য এর আগেই অভিযোগ উঠে, টকশোতে অংশ নিয়ে সরকারবিরোধী কোনো কথা বললেই প্রচ্ছন্ন হুমকির শিকার হচ্ছেন দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ও বিভিন্ন সংস্থা টকশো নিয়ন্ত্রণে ক্ষমতা প্রয়োগ করে। যারা তৎকালীন সরকারে বিভিন্ন অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপের সমালোচনা করত তাদের কালো তালিকাভুক্ত করে টিভি চ্যানেলগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যেন সংশ্লিষ্ট আলোচকদের টকশোতে ডাকা না হয়। মহাজোটের সময়েও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ের মতো এখনও সরকারি বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে অস্বাক্ষরিত নির্দেশমালা ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে। কীভাবে টকশো চালাতে হবে, কী ধরনের কথাবার্তা সেখানে বলা হবে, কী পদ্ধতিতে টকশো রেকর্ড হবে-সবই বলে দেয়া হচ্ছে নির্দেশমালায়।
২৪ ডিসেম্বর ২০০৯ দৈনিক আমার দেশ-এ প্রকাশ, ভিন্নমতের সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের টেলিভিশন টকশোতে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হচ্ছে। সম্প্রতি সরকার এ সংক্রান্ত একটি নীতিমালা তৈরি করে নির্দেশনা দিয়েছে, ভিন্নমতের কাউকে আপাতত টকশোতে আনা যাবে না। ওই নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ‘টকশোগুলো অপরিকল্পিত ও নিয়ন্ত্রণহীনভাবে প্রচারিত হওয়ায় দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার ওপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করেছে। এজন্য চ্যানেলগুলোকে নির্দেশনাদানকারী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হবে এবং টেলিভিশন কর্তৃপক্ষকে গাইড লাইন মেনেই টকশো চালানোর অঙ্গীকার করতে হবে।’
খসড়া গাইড লাইনে কোনো ধরনের ‘উস্কানিমূলক’ বক্তব্য, অন্ধ ও পক্ষপাতদৃষ্ট মতামত এবং বাংলাদেশের আইনসিদ্ধ ও নির্বাচিত সরকারের প্রতি অসন্তোষ সৃষ্টি করতে পারে, এমন কোনো বক্তব্য প্রচার থেকে বিরত থাকতে হবে বলে উল্লেখ রয়েছে। এ ছাড়াও যেসব নির্দেশনা রয়েছে সেগুলো হচ্ছে : টকশোর আলোচনায় বক্তাকে নির্ধারিত লক্ষ্যে ধাবিত করার জন্য উদ্দেশ্যমূলক প্রশ্ন পরিহার করতে হবে, আলোচনার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রেখে অভ্যাগত অতিথিদের বেশি কথা বলার সুযোগ দিতে হবে। টকশোতে সব ধরনের উন্নয়নমূলক, গঠনমূলক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষামূলক বিষয় প্রাধান্য দিতে হবে, অতিথি নির্বাচনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, একই অতিথিকে বারবার আমন্ত্রণ জানানো নিরুৎসাহিত করতে হবে, টকশো অবশ্যই সংকলিত হতে হবে, একটি টেলিভিশন চ্যানেল একদিকে সর্বোচ্চ একটি টকশো আয়োজন করতে পারবে এবং টকশোগুলোয় কোনো ধরনের ইন্টারঅ্যাকটিভ আলোচনা অথবা লাইভ এসএমএস/টেলিফোন কল সংযোজন করা যাবে না।
অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি হিসেবে ২০১৩ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর সময়কালে সরকারের সমালোচনা কিংবা বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো কথা বলা থেকে বিরত থাকতে সতর্ক করে দেয়া হয় তাদের, এখন অবশ্য নীতিমালার নামে অঘোষিত সতর্কবাতা পৌঁছে গেছে সচেতনমহলের কাছে। অন্যথায় ব্যক্তিগতসহ পারিবারিকভাবে হেনস্তা, নির্যাতন ও গুমের মতোও হুমকি দেয়া হয়। টেলিভিশনের টকশোতে অংশ নিয়ে দেশের কোনো বিশিষ্ট নাগরিক যদি সরকারের সমালোচনা, সরকারবিরোধী কোনো কথা বলা বা সরকারের বিরুদ্ধে যুক্তিতর্ক তুলে ধরছেন তখন তাকে প্রচ্ছন্নভাবে হুমকি দেয়া হয়। এক্ষেত্রে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে হুমকি দেয়া হলেও হুমকিদাতার নম্বরটি মোবাইল ফোনে দৃশ্যমান হচ্ছে না। ফোনে কথা বললেও যে নম্বর দিয়ে কল দেয়া হচ্ছে তা অদৃশ্য থাকছে। এ ধরনের ঘটনা বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিকের ক্ষেত্রে ঘটায় এখন তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তরপর্বে ‘জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা-২০১৪’ প্রণয়নের কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে বলেও জানিয়েছেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। সংসদ সদস্য মো. আবদুল্লাহর এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী সংসদকে এ তথ্য জানান।
তথ্যমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ টেলিভিশনে একটি বিজ্ঞাপন নীতিমালা থাকলেও বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর জন্য নীতিমালা নেই। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ‘জাতীয় ওষুধ নীতি ২০০৫’-এ ওষুধ ও স্বাস্থ্য বিষয়াবলির ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনের দ্বারা সাধারণ মানুষ না করার জন্য সুনির্দিষ্ট বিধি-নিষেধ রযেছে। তথ্য মন্ত্রণালয় থেকেও অবৈধ পণ্য/ওষুধ বিপণন বিষয়ে বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্রে নির্দেশনা রয়েছে। বর্তমানে ‘জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা-২০১৪’ প্রণয়নের কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এই নীতিমালা প্রণীত হলে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্রে অধিকতর বিধি-নিষেধ আরোপ সম্ভব হবে।’
মোহাম্মদ সুবিদ আলী ভূঁইয়ার এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘বর্তমান সরকার গণমাধ্যমের স্বাধীনতা পরিপূর্ণভাবে বিশ্বাস করে। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া নিজস্ব আঙ্গিকে স্বাধীনভাবে সংবাদ প্রচার করে। তাদের সংবাদ প্রচারে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো হস্তক্ষেপ করা হয় না।’
৩ আগস্ট ২০১৪ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে বেসরকারি রেডিও-টিভিতে খবর প্রচার ও টকশোতে কথাবার্তা বলায় কঠোর সেন্সরশিপের বিধান করে জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালার খসড়া অনুমোদন করা হয়েছে। এতে একইসঙ্গে বেতার ও টিভির লাইসেন্স দেয়ার বিধানও রাখা হয়েছে।
জিবলু রহমান

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads