বৃহস্পতিবার, ৭ আগস্ট, ২০১৪

আন্দোলন ঠেকাতে মামলা ও দমন-নির্যাতন


বিরোধী দলের আন্দোলন চেষ্টা প্রতিহত করার উদ্দেশে সরকার মামলা দায়েরের পন্থাকে আশ্রয় করেছে। একযোগে চালানো হচ্ছে গ্রেফতারের অভিযানও। চলছে গুম ও বন্দুকযুদ্ধের নামে ক্রসফায়ারে হত্যার ভয়ংকর কর্মকা-ও। এসব অভিযানের শিকার হচ্ছেন দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীরা। গত বুধবার একটি পত্রিকার এক রিপোর্টে জানানো হয়েছে, বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ৩০ হাজারের বেশি মামলা দায়ের করা আছে। ওদিকে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার সংখ্যা প্রায় ২৬ হাজার। মামলাগুলোতে আসামী করা হয়েছে প্রায় পাঁচ লাখ নেতা-কর্মী ও সমর্থককে। দু’টি মাত্র তথ্য থেকেই ক্ষমতাসীনদের প্রকৃত উদ্দেশের প্রমাণ পাওয়া গেছে। প্রথম তথ্যটি হলো, বিএনপির চেয়ারপারসন, ২০ দলীয় জোটের নেত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও তার বড় ছেলে তারেক রহমানসহ জিয়া পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধেই নানা অভিযোগে ২৭টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। বিএনপির অন্য কয়েকজন শীর্ষ নেতাকেও মামলায় জড়িয়ে ধাওয়ার মুখে রেখেছে সরকার। এই নেতারা এরই মধ্যে দফায় দফায় জেল খেটেছেন। দু’একজনকে এমনকি জামিন পাওয়া সত্ত্বেও নতুন মামলা চাপিয়ে গ্রেফতার করা হয়েছে। ওদিকে জামায়াতে ইসলামীর ব্যাপারে ক্ষমতাসীনরা কোনো রকম রাখঢাক পর্যন্ত করছেন না। ২০০৯ সালে প্রথম দফায় ক্ষমতায় আসার পর পর যুদ্ধাপরাধী সাজিয়ে জামায়াতের আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদসহ শীর্ষ নেতাদের কারাগারে ঢুকিয়েছে সরকার। নিজেদের তৈরি করা ট্রাইব্যুনালকে দিয়ে এসব নেতাকে ফাঁসির আদেশ দেয়ার ব্যাপারেও জোর তৎপরতা চালাতে দেখা গেছে ক্ষমতাসীনদের। এরই মধ্যে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসিও দেয়া হয়েছে। জামায়াতের অন্য শীর্ষ নেতারা ফাঁসির মঞ্চে ওঠার অপেক্ষায় রয়েছেন। বয়সের কারণে জামায়াতের যেসব নেতাকে যুদ্ধাপরাধী বানানো সম্ভব হয়নি, তাদের বিরুদ্ধে মানুষ হত্যা ও অগ্নিসংযোগের মতো গুরুতর বিভিন্ন অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এই একটি বিষয়ে ক্ষমতাসীনরা কতটা মারমুখী ও মরিয়া তার প্রমাণ পাওয়া গেছে ঢাকা মহানগরী জামায়াতের আমীর মাওলানা রফিকুল ইসলাম খানের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার সংখ্যা থেকে। তার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় অন্তত দুইশ’ মামলা দায়ের করেছেন ক্ষমতাসীনরা। বর্তমান সময়ে মামলা দায়েরের পাশাপাশি চার্জশিট দেয়ার ব্যাপারেই বেশি তৎপর দেখা যাচ্ছে ক্ষমতাসীনদের। এর কারণ, মূলত রাজনৈতিক কারণে হয়রানির উদ্দেশে সাজানো হয়েছিল বলে বিশেষ করে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনবিরোধী আন্দোলনের সময় দায়ের করা বেশিরভাগ মামলারই তদন্ত কাজ শেষ করা যায়নি। এ সময় দেশের বিভিন্ন থানায় ৩১৫টি মামলায় বিএনপি-জামায়াতের প্রায় ৬৩ হাজার নেতা-কর্মীকে আসামী বানানো হয়েছিল। বেগম খালেদা জিয়ার ডাকে নতুন পর্যায়ে আন্দোলনের প্রস্তুতি নেয়া শুরু করতে না করতেই ক্ষমতাসীনরা পুলিশের ওপর হুকুম জারি করে বসেছেন। সে অনুযায়ী পুলিশও তদন্তের নামে নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে তৎপর হয়ে উঠেছে। এর ফলে নেতা-কর্মীরা নিজেদের বাসাবাড়িতে থাকতে পারছেন না। ক্ষমতাসীনদের দেয়া হুকুমের ফাঁক গলিয়ে পুলিশ রীতিমতো ঘুষ বাণিজ্যেও নেমে পড়েছে, যার শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এভাবে সব মিলিয়েই সরকার এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। উদ্দেশ একটাই বিরোধী দল যাতে আন্দোলন করতে না পারে।
আমরা গ্রেফতার ও মিথ্যা মামলা দায়েরের মাধ্যমে বিরোধী দলকে দমন করার এবং বিরোধী দলের আন্দোলন চেষ্টাকে প্রতিহত করার লক্ষ্য নিয়ে সরকারের এই অগণতান্ত্রিক কর্মকা-ের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানাই। গ্রেফতার ও মামলা নিয়ে আন্দোলনের প্রস্তুতি পর্বে কথা উঠলেও বাস্তবে প্রমাণিত সত্য হলো, ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী দলকে দমন করার জন্য উঠে-পড়ে লেগে আছে। পুলিশের বাধা ও নিষ্ঠুর অভিযানের কারণে বিরোধী দল দেশের কোথাও এমনকি শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশও করতে পারেনি। মিছিলের ওপরও পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সরকারের এই গণতন্ত্রবিরোধী ও ফ্যাসিস্ট কর্মকা-ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো হলেও সরকার  কর্ণপাত করেননি, সমঝোতা প্রতিষ্ঠার জন্য বিদেশীদের আহ্বানেও সাড়া দেননি ক্ষমতাসীনরা। পরিবর্তে দেশের সব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে একের পর এক ধ্বংস করেছেন তারা। এই প্রক্রিয়ায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতাও ধ্বংসের মুখে এসে গেছে। বিশেষ করে নি¤œ আদালতের ওপর ক্ষমতাসীনদের খবরদারি চলছে প্রকাশ্যেই, যার প্রমাণ পাওয়া গেছে হাজার হাজার মামলার তথ্য-পরিসংখ্যান থেকে। বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলেছেন এবং আমরাও মনে করি, সরকারের এই নিবর্তনমূলক কর্মকা- শুধু অগণতান্ত্রিক নয়, এর মধ্যে বিরোধী দলকে নির্মূল করে ফেলার উদ্দেশও রয়েছে। আমরা অনতিবিলম্বে গণতন্ত্রসম্মত পথে ফিরে আসার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই। সরকারকে অবশ্যই গ্রেফতার, গুম, ক্রসফায়ারে হত্যা এবং মিথ্যা ও সাজানো মামলা দায়েরর কর্মকা- বন্ধ করতে হবে। বুঝতে হবে, দমন-নির্যাতনের মাধ্যমে কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনই প্রতিহত করা যায় না। নির্মূল বা ধ্বংস করা যায় না কোনো রাজনৈতিক দলকেও। আমাদের মতে, বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে সরকারের বরং আলোচনা ও সমঝোতার পথে পা বাড়ানো এবং বিরোধী দলের দাবি মেনে নেয়া উচিত। তাহলে বিরোধী দল যেমন আন্দোলনে যাবে না সরকারকেও তেমনি ফ্যাসিস্ট পন্থায় পা বাড়িয়ে নিন্দিত ও প্রত্যাখ্যাত হতে হবে না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads