বুধবার, ১৩ আগস্ট, ২০১৪

মহসিন আলী, চালিয়ে যান


আওয়ামী লীগের সমাজকল্যাণমন্ত্রী মহসিন আলী। আওয়ামী লীগের মতো সরকারের সমাজকল্যাণের জন্য এমন মানুষ যুৎসই বটে। তাকে দলের মন্ত্রী বললাম মূলত তার রগচটা স্বভাবের জন্য নয়, এ পর্যন্ত মঞ্চে বসে সিগারেট ফুঁকা, মঞ্চে ঘুমানোর অভিনব ব্যাখ্যা, মাদরাসা শিক্ষা নিয়ে অপরিণামদর্শী মন্তব্য, যৌনপল্লী নিয়ে তার ভাবনাচিন্তা, বিষয়গুলো এক জায়গায় এনে বিচার বিবেচনা করলে তাকে প্রজাতন্ত্র ও সরকারের কোনো পর্যায়ে দায়িত্বশীল পদপদবিতে চিন্তা করা সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগ জাতিকে এ ধরনের আরো মন্ত্রী উপহার দেয়ার রেওয়াজ আছে। সংসদে গান, নাটকের ডায়ালগ, বয়াতির কর্কশ কণ্ঠের বয়াত, সিনেমা শিল্পীর সুখীমুখ প্রদর্শন সবই এই দলের কৃপায় সম্ভব। আইন প্রণয়নের জন্য এরা মোক্ষমই বটে।
চণ্ডালের ভাষায়, বর্গি-হার্মাদদের মতো সাংবাদিকদের গোষ্ঠী উদ্ধার করে গালমন্দ করে মহসিন আলী হিরো হয়ে যাননি। তিনি আপাতত জিরোও হবেন না। কারণ তাকে চালিয়ে যাবারজন্য মদদদাতা আছেন। ঠেস দিয়ে দাঁড়াতে সহযোগিতা দেয়ার মতো সাংবাদিকও আছেন। তা ছাড়া সাংবাদিকসমাজে এমন কিছু কুলাঙ্গার আছে, যাদের কারণে পেশাদার সাংবাদিকসমাজের গায়ে কালিমা লেপনের সুযোগ মহসিন আলীরা নিতেই পারেন।
খবিশ, বদমায়েশ, চরিত্রহীন, লম্পট সাংবাদিক নেই তা তো জোর দিয়ে বলা কঠিন। মহসিন আলী বিকারগ্রস্তের মতো বক্তব্য দিয়ে শেষে ক্ষমা চেয়ে মাফ পেতে পারেন না, কৃপা পেতে পারেন। কারণ তিনি সাংবাদিকসমাজের নীতিনিষ্ঠ অবস্থান ও পেশাদারিত্বকে আক্রমণ করে বসেছেন। নাম জাগানোর জন্য ব্যতিক্রম হতেই হয়। এক ভণ্ড সমাজসেবক মামীশাশুড়িকে নিকা করে নাম ফাটিয়েছিলেন। তা ছাড়া বিশ্ববেহায়া ও দুই কান কাটা মানুষের স্বভাব অভিন্ন। এক কান কাটা মানুষ রাস্তার এক পাশ ধরে পথ চলেন। দুই কান কাটা মানুষ রাস্তার মাঝপথ ধরে হাঁটেন। একবার বেহায়া হয়ে গেলে তার আর কোনো সতিত্ব খোঁজার দরকার থাকে না। এরশাদের বক্তব্য শোনার পর কি মনে হয় না তার কাছে রাজনৈতিক নীতিনিষ্ঠা, হায়া-শরম, লোকলজ্জা কোনো বিষয় নয়। সকালে এক কথা, দুপুরে তার উল্টোটা বলা, রাতে সকাল দুপুরের বক্তব্য খণ্ডন করে তৃতীয় কোনো মন্তব্য তার মজ্জাগত। এটা রাজনৈতিক মুদ্রাদোষ হলে মেনে নেয়া যেত, তাতো নয়। তাই এরশাদ চরিত্র-বিদিশা-মেরি ও রওশন কেন খোদ দেবতাও বুঝতে অক্ষম। মহসিন আলী এখন এরশাদের ছায়া মাড়িয়েছেন। অন্তত অসংযত ও স্ববিরোধী কথাবার্তায়। তবে এরশাদ রুচি হারান না, মহসিন আলীর রুচিতেও অরুচি। তার ঠোঁট পাতলা, জিহ্বা লকলকে, পরিমিতিবোধশূন্য। সামাজিক জ্ঞান নেই বললেই চলে। তাই নাম ফাটাবার এত কসরৎ। মহসিন আলীর চরিত্রের পোস্টমর্টেম করা আমাদের কাজ নয়। তিনি সাংবাদিকসমাজকে নিয়ে যে বাড়াবাড়িমূলক ও ধৃষ্টতাপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে পরদিন ব্যাখ্যা দিয়ে বক্তব্য ঢাকতে চেয়েছেন সেটা আরেক ধরনের অসাধুতা। পেশাদার সাংবাদিকেরা এখনো উচ্ছন্নে যাননি। তাদের চরিত্রে এখনো এতটা ধস নামেনি যে তাদের খবিশ বলতে হবে। তবে পুঁজির বিকাশের সাথে সাথে সাংবাদিকসমাজের একটি অংশ যে নষ্ট চরিত্রের সাথে খাপখাইয়ে চলতে শুরু করেছেন তাতো মিথ্যে নয়। এরা হয়তো সাংবাদিক নয়, ক্ষমতা ও পুঁজির দাস। তাদের শ্রেণী চরিত্র আলাদা, যার সাথে সাংবাদিকতা বা পেশাদারিত্বের কোনো মিল নেই। এদের কেউ রাজনৈতিক ক্যাডার। এদেরই দু-চারজন সামাজিক দুর্বৃত্ত বা তথ্যসন্ত্রাসী।
দিন আগে এক জাঁদরেল সাংবাদিক, যিনি একটি ধারার নেতৃত্ব দিচ্ছেন। একটি চ্যানেলের কর্মকর্তাও। টকশোতে বলেছিলেন আলজাজিরা নাকি বাংলাদেশের একটি দল কিনে ফেলেছে। আকাশ থেকে পড়লাম। তার বিদ্বিষ্ট মন এতটা মতান্ধ যে তিনি আলজাজিরার মতো একটি বিশ্বখ্যাত চ্যানেলের প্রাতিষ্ঠানিকতা সম্পর্কে শুধু বেখবর নন, অজ্ঞও। পেশাদারিত্বের মূল জায়গায় তিনি দেউলিয়া তো বটেই।
আরেক সাংবাদিক নেতা, সব সময় ক্ষমতার প্রশ্রয় পান, সেই আশ্রয়ে তাকে মানায়ও ভালো। সম্প্রচার নীতির নামে যা করা হয়েছে তাকে যখন সাংবাদিকসমাজ শুধু প্রত্যাখ্যান করেনি, এটাকে নীতিমালা মানতেই নারাজ, তখন তিনি গলা ফাটিয়ে তারস্বরে এই কালো নীতির নামে বিধিবিধানটির পক্ষে সাফাই গেয়ে যাচ্ছেন। ক্ষমতা ও সময় পাল্টালে তিনি তার আজকের বক্তব্যের ব্যাখ্যা কি মহসিন আলীর মতো দেবেন! অথচ সম্প্রচার নীতিমালা অপজিশন ও ট্রেজারির ধারণার মতো বিষয় নয়। এর সাথে মিডিয়ার অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার প্রশ্ন জড়িত। সরকার কোনো প্রসঙ্গ নয়। সরকার আজ আছে কাল নেই। সোজা কথা যারা সরকার চালাবে তারাই এর অপব্যবহার করবে।
ব্যক্তিগতভাবে দীর্ঘ দিন ধরে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সদস্য। সেই অবিভক্ত ইউনিয়ন থেকেই। একই সাথে ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের কাউন্সিলর হিসেবেও বহুবার ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেছি। অধিকন্তু জাতীয় প্রেস কাবের সাথে নাড়ির সম্পর্কটাও বিদ্যমান। তাই সাংবাদিকসমাজের উল্লেখযোগ্য সদস্যের চেহারা পরিচিত; কিন্তু রাস্তায় প্রেস ও সাংবাদিক স্টিকার লেখা যেসব গাড়ি ও মোটরসাইকেল দেখি তাতে যাদের বসা দেখতে পাই তাদের চেহারাসুরত মেলাতে পারি না। এই বণিকশ্রেণীর সাংবাদিকেরা আকাশ থেকে পড়ল, না মাটি ফুঁড়ে গজিয়ে উঠল, পুলিশ খতিয়ে দেখতে পারে। সাংবাদিকতার নামে প্রতারণারও শেষ নেই। কদিন আগে দফতরে একটি পাঠকের চিঠি পেলাম। তাতে বিশেষ দ্রষ্টব্য দিয়ে লেখা রয়েছে, ‘আমি গরিব মানুষ পয়সা দিতে পারব না। দয়া করে চিঠিটি ছাপবেন। এ পাঠক নিশ্চয়ই এমন কোনো দুঃখজনক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন। বছর দুয়েক আগে একজন রাজনৈতিক কর্মী প্রেসরিলেজের সাথে পাঁচশত টাকার একটা নোট গুঁজে দিয়ে অনুনয়-বিনয় করে বললেন, ‘অন্যত্র বেশি দিতে হয়েছে বলে এখানে কম পড়েছে। এ সংস্কৃতির সাথে আমরা পরিচিত না হলেও সেই রাজনৈতিক কর্মীর অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই ভিন্ন। পাঠকের চিঠি ও প্রেস বিজ্ঞপ্তি ছাপতে নিশ্চয়ই কেউ না কেউ টাকা দাবি করেছে। এই নষ্টামির নাম সাংবাদিকতা হবে কেন? আমরা যারা ষাটের কোঠা অনেক আগেই পার করে এসেছি, তারা ভালো করে জানি আওয়ামী লীগের সাথে মিডিয়ার স্বাধীনতা যায় না। গণকণ্ঠ নিয়ে কী হয়েছিল আমরা ভুলিনি। আল মাহমুদের গ্রেফতার, আফতাব আহমদের অপহরণ, মওলানা ভাসানীর হক কথার ভাগ্য বিড়ম্বনা, বাকশালী ভূত নতুন প্রজন্ম না জানলেও আমরা জানি। তথ্যমন্ত্রী অনেক তথ্য ভুলে থাকতে পারেন, আমরা পারি না। কারণ তিনি ক্ষমতায়, আমরা পেশায়। আওয়ামী লীগের সাথে সাংবাদিকতার সাংঘর্ষিক অবস্থান পুরনো। ফেনীর টিপু সুলতান কেন আহত হলেন, কেউ ভুলে যাননি। কবরীর সাথে নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় সাংবাদিকদের দূরত্ব এমনিতে হয়নি। শামীম ওসমান সাংবাদিকদের নিয়ে কী ভাবেন, তার সেই ভাবনা সবার জানা। মাহমুদুর রহমানকে নিয়ে আওয়ামী লীগের আস্ফালনের প্রতিধ্বনি আজো থামেনি। চ্যানেল ওয়ান, দিগন্ত টিভি, ইসলামিক টিভি এখনো বন্ধ। আমার দেশের দম আটকে রাখার সময় যেন আর ফুরায় না।
তবে সাংবাদিকতার নামে যে অনাচার চলছে না তা তো জোর দিয়ে বলতে পারি না। চ্যানেলগুলোর সংবাদ পরিবেশনের ধরন, টুইস্টিং, পক্ষপাত ও দলান্ধতা কার না চোখে পড়ে। টকশোর আলোচকদের মতান্ধতা কি কম পীড়াদায়ক? তথ্য নিয়ে বিভ্রান্তির এই বেসাতি কাঁহাতক সহ্য করা যায়। একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, বয়সে তরুণ, টকশোর উপস্থাপক, একই সাথে আলোচকও। গতানুগতিক সাংবাদিকতার কিছু জ্ঞান ছাড়া অন্য রাজ্যে তার অবস্থান তৃতীয় শ্রেণীর শ্রমিক কর্মীর মতো। তবে আঁতেল ভাব টনটনে। সেই লোকটি হেফাজতকে গালি দিয়ে নিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল থাকার ভান করতে গিয়ে মধ্যযুগকে ভুলভাবে তো বটেই, অজ্ঞের মতো উপস্থাপন করলেন। তিনি যে সাংবাদিকতা পড়ান সেখানে মহসিন আলীর ভাষায় চরিত্রহীন মতান্ধ ছাড়া আর কী সৃষ্টি হচ্ছে। এরা কি দুপিঠ কোনো দিন দেখবে না!
মহসিন আলী খারাপ সাংবাদিকদের বউয়ের সাথে আরামে ঘুমাতে দেবেন না। খারাপ সাংবাদিকের বউ থাকবে কেন। তাদের তো থাকবে অন্য কিছু। দোহাই আমরা যারা ছাপোষা সাংবাদিক তাদের বউ তাড়াবার ব্যবস্থা করবেন না। বহুত নাম কামাই করেছেন, এবার সরে দাঁড়ালে আপনি ভালো থাকবেন। শান্তিতে ঘুমাতেও পারবেন। নয়তো খারাপ সাংবাদিকেরা আপনাকে ঘুমোতে দেবে কেন। তবে পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে মহসিন আলীকে আশ্বস্ত করতে চাই, কুকুর মানুষকে কামড়ালে খবর হয় না, মানুষ কুকুরকে কামড়ালে খবর হয়। পেশাদার সাংবাদিকেরা আর যাই হোক কোনো দিন কুকুর হতে যাবে না। তাই অসৎ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে আপনার জিহাদ চালিয়ে যান; তবে পদপদবিতে বসে নয়। আপনার দায় প্রধানমন্ত্রী নেননি। আপনাকে ভর্ৎসনাও করেননি। এর ফলে আপনার ভবিষ্যৎ ফকফকা এটা যেমন বোঝায় না, তেমনি অন্ধকার তা-ও মনে করা যাবে না। তবে সময় পাল্টালে অনেক কিছুই আপনার মতো লোকদের পিঠে চাপানো হবে। সেই দিন নিজেকে শুধু অসহায় অবস্থায় দেখবেন না। দেখবেন পৃথিবীটা সঙ্কুচিত হয়ে গেছে। আপনি নিজেই চাইবেন  যেন আজই কেয়ামত হয়ে যাক। 

মাসুদ মজুমদার


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads